Maa Sarada
"মা সারদা"
🌑 ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায়
"প্রকৃতিং পরমামভয়ং বরদাম্ নবরূপধরাং জনতাপ হরাম্ ৷
শরণাগত সেবক তোষকরীম্ প্রণমামি পরাং জননীং জগতাম্ "৷
আমি তাঁর ধ্যান করি -
"ওঁ ধ্যায়েচ্চিত্তসরোজস্থাং সুখাসীনাং কৃপাময়ীম্। প্রসন্নবদনাং দেবীং দ্বিভূজাং স্থিরলোচনাম্ "৷
অর্থাৎ মানসপদ্মে বিরাজিতা, সুখাসনে উপবিষ্টা( বসা), দয়াময়ী , সহাস্যবদনা, দুই বাহু বিশিষ্টা, স্থির নয়না দেবীর ধ্যান করি ৷
"ওঁ ঐঁ হ্রীং" বীজমন্ত্রে একমনে সারদা দেবীর জপ করি ৷ সারদা গায়ত্রী," ওঁ ঐং হ্রীং সারদায়ৈ বিদ্মহে মহাদেব্যৈ ধীমহি তন্নো দেবী প্রচোদয়াৎ " পাঠ করি৷ তিনি সতেরও মা অসতেরও মা৷ হৃদয়ে যার তিনি আছেন তার আবার ভয় কি ? তিনি সর্বকালের সেরা নারী ৷ আমাদের সবার "মা"৷ তিনি ধর্মভাব জাগিয়ে আশ্রিতের সাধনপথ প্রস্তুত করেন ৷ ইহ জগতে সব আশা পূরণের সঙ্গে অন্তিমে মোক্ষ লাভের রাস্তা সুগম করেন ৷তাই তাঁকে প্রণাম জানাই ৷-" ওঁ জননীং সারদাং দেবীং রামকৃষ্ণং জগৎ গুরুম্ ৷
পাদপদ্মে তয়োঃ শ্রিত্বা প্রণমামি মুহুর্মুহুঃ৷" তিনি বলে গেছেন ," ছোট লক্ষ্য নিয়ে কখনো বড় হওয়া যায়না৷ আর ছোট মন নিয়ে কখনো মহান হওয়া যায় না৷" "ভালবাসায় সবকিছু হয় ৷ জোর করে কায়দায় ফেলে কাউকে দিয়ে কিছু করানো যায় না" ৷তাঁর আরেক বাণী ," মনকে বসিয়ে আলগা না দিয়ে কাজ করা ঢের ভালো , মন আলগা হলে যত গোল বাধায়"৷ নমঃ যথাগ্নের্দাহিকা শক্তি , রামকৃষ্ণে স্থিতা হি যা ৷ / সর্ববিদ্যাস্বরূপাং তাং সারদা প্রণমাম্যহম্ "৷
যাঁর শেষ উক্তি ছিল ," মানসিক শান্তি চাইলে অন্যের নয় নিজের দোষ দেখো৷ জগতে কেউ অচেনা নয় ৷ সবাইকে আপন করে নাও৷ পুরো জগৎ সংসারই তোমার "! আসলে তিনি যে ছিলেন সতেরও মা , অসতেরও মা !
১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শ্যামাসুন্দরী দেবীর প্রথমা কন্যা (২ কন্যা ও ৫ পুত্রের) সারদামণি (ক্ষেমঙ্করী বা ঠাকুরমণি) র জন্ম৷ তাঁর জন্মের আগে তাঁর মা স্বপ্নে দেখেন মা ভগবতী তাঁর ঘরে আসছেন৷ আবার পরে স্বপ্নাদেষ পান কামাবপুকুরের রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়ীতে ঐ মেয়ের "চালকলা" বাঁধা আছে ৷তিন বছর বয়সে এক গানের আসরে সারদা দেবী রামকৃষ্ণকে দেখেন। গায়ক সারদামণিকে জিজ্ঞাসা করেন তুমি কাকে বিয়ে করতে চাও ৷ ছোট্ট মেয়েটি রামকৃষ্ণদেবকে দেখায়। এরপর, মাত্র ৫ বছরের সারদার বিয়ে হয় ২৪ বছরের গ্রাম্য পুরোহিত "গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের ( রামকৃষ্ণ) সঙ্গে ৷ সেই বিবাহ যেন আধ্যাত্মিক দাম্পত্য জীবনযাপন ৷ সারা জীবন কেউ কাউকে রূঢ় বাক্য বলেন নি৷ ১৪ বছর বয়স হলে তাঁকে স্বামী গৃহে পাঠানো হয়েছিল ৷ ১৮ বছর বয়সে রামকৃষ্ণ দেবের কর্মস্থল দক্ষিণেশ্বরে আসেন৷ এই মন্দিরের নহবত খানাতেই তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন ! পরমহংসদেব ঈশ্বরের সাধনা করেছেন শক্তিরূপিণী মাতৃমূর্তিতে৷ সারদা তাঁর কাছে ছিলেন জীবন্ত ভগবতী৷ তিনিই পরমহংসদেবের প্রথম দীক্ষিত শিষ্য৷ ভোর ৪ টেয় জপ দিয়ে তাঁর দিন শুরু হতো৷ মধ্যরাত পর্যন্ত অবিশ্রান্ত ছিল গৃহকর্ম , সংসার , ভক্তদের দেখাশোনা ও আর্তের সেবা ৷ অশিক্ষিতা , গরিব, গ্রাম্য মহিলা হলেও ধর্ম , আধ্যাত্মিকতা, ইতিহাস , সমাজ , সংস্কৃতি , নারী শিক্ষা, কুসংস্কার দূরীকরণ , রঙ্গালয় থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সব ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অপরিসীম৷ স্বামী বিবেকানন্দ তাই বলেছিলেন ," মা ঠাকুরাণী ভারতে মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন "৷ স্বপ্নে মাতৃমূর্তি দেখে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ সারদা দেবীর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন৷ পরমহংসদেবের সুযোগ্যা সহধর্মিনী ও সাধনসঙ্গিনী এবং মিশনের সংঘ জননী সারদা দেবী৷ তাঁকে ছাড়া রামকৃষ্ণ , বিবেকানন্দ , রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন অকল্পনীয় ৷তিনি পরমহংসদেবের প্রথম দীক্ষিত শিষ্য ৷
সারদা দেবী বলেছিলেন, "ঠাকুরকে আর আমাকে এক দেখবে, আলাদা দেখো না "৷
তাঁর আদেশেই স্বামীজী আমেরিকা গিয়েছিলেন। তাঁর বড় আদরের ছিল মিশনের শিষ্য, শিষ্যা ও ভক্তরা৷ আদরের "খুকি" মার্গারেট বা নিবেদিতা তাঁর কথা শুনেই চলতেন ৷রক্ষণশীল গ্রামের মেয়ে এক বর্ণ ইংরেজি না জেনেও সারা বুল , ম্যাকলয়েড ও নিবেদিতার সঙ্গে চমৎকার আলাপচারিতা চালাতেন৷ এঁদের সঙ্গে আহার করতেন ৷ ভেঙে দিয়েছিলেন জাত পাত আমরা ওরার বন্ধন ৷তুলে ধরেছেন সনাতনী নারী সংস্কৃতির শিব ও সুন্দর রূপ ৷ আবার আধুনিক নারীর আশা আকাঙ্খাও সফল করেছেন৷ তিনি গুরু পত্নী বা পাতানো মা নয়৷ একবারে যেন নিজের মা ৷মায়ের তত্বজ্ঞান ও মহানুভবতা তাঁকে সর্বকালের এক জন সেরা জননীর মর্যাদা দিয়েছে৷ ভক্তদের কাছে তিনি ছিলেন মহাশক্তির অবতার৷ অষ্টাদশী সারদাকে রামকৃষ্ণদেব স্বয়ং " ষোড়শী " রূপে পুজো করেছিলেন৷ ফলহারিণী কালীপুজোয় তুলে দিয়েছিলেন নিজের জপমালা ! "গুরোর্মধ্যে স্থিতা মাতা মাতৃমধ্যে স্থিতো গুরু "৷
শ্রীশ্রীমায়ের জীবন হয়ে উঠেছিল তাঁর বাণী। অনেক গল্প বলে মানুষকে প্রকৃত শিক্ষা দিয়েছেন৷ তিনি ধূর্ত ময়রা ও বোকা ছেলের গল্প বলে দেখিয়েছিলেন ওল কেটে সেদ্ধ করে রসে চোবানো মিষ্টি কিনে দিদির বাড়ী যেতে গিয়ে লোভে ছেলেটি টপাটপ ঐ মিষ্টি খেয়ে মুখ লাল করে গলা ধরে অস্থির তবু বারবার ঐ নকল মিষ্টি খেয়েই চলেছে৷ এই গল্পে তিনি দেখিয়েছেন বিষয়াবদ্ধ জীব বিষৈর জ্বালায় জর্জরিত হলেও বিষয়ের আস্বাদন ছাড়তে পারে না ! সামান্য জমি নিয়ে দুই ভাইয়ের লাঠালাঠি দেখে তিনি খুব হেসে ফেলেন৷ যেমন ভগবান হাসেন আমাদের লোভ , হিংসা, ঈর্ষা ও স্বার্থপরতা দেখে৷ যে জিনিস চিরকালের নয় মৃত্যুর সময়েই ফেলে দিতে হয় তা নিয়েই আমাদের আসক্তি সীমাহীন ! সাহসিনী মা সারদা ভয়ঙ্কর ডাকাতের হাতে পড়েও কে তুমির উত্তরে নির্ভয়ে বলেছিলেন "আমি তোমার মেয়ে সারদা "! তাতে ডাকাতরা শুধু তাঁকে ছেড়েই দেয়নি৷ নিজেরাও আরো অনেকের মত তাঁর করুণায় জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসে।
১৯২০ সালের ২০ জুলাই রাত দেড়টায় বেলুড়ের উদ্বোধন ভবনে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে ৷ সেখানে গঙ্গা তীরে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়৷ যেখানে এখন গড়ে উঠেছে শ্রীশ্রীমায়ের " সমাধি মন্দির " ৷ তাঁর পবিত্র জন্ম দিনে তাঁকে জানাই শতকোটি প্রণাম ৷ মা , তুমি আমাকে চেতনা দাও।