ভোটপ্রার্থী কোন এক রবীন্দ্রনাথের প্রচার পুস্তিকা
🟣 সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়
সারা দেশ জুড়ে ভোটে দামামা বেজে গেছে। আমাদের রাজ্যে তো ভোটের দামামা নয়, যুযুধান পক্ষের রণদুন্দুভি শোনা যাচ্ছে। চারিদিকে কথা, কুকথা ও প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি বয়ে যাচ্ছে। এমন একটি নির্বাচনী বছরে পঁচিশে বৈশাখের নির্মল সকালে ১৬৪ বছর পর সশরীরে পুজো নিতে স্বর্গচ্যুত দেবদূত এক রবীন্দ্রনাথ অবতরণ করে দেখলেন, তাঁর জন্মস্থানের এলাকায় নির্বাচনী মনোনয়ন পর্ব এখনো চলছে। তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয় পরিজনদের আগ্রহাতিশয্যে ভাবলেন একবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ফেললে কেমন হয়। বাঙালি নাকি তাঁকে ৩৬৫ দিনই স্মরণ-- মনন করে থাকে। তাঁকে ছাড়া বাঁচতেই পারে না ! পথে-ঘাটে, রাস্তায় মোড়ে, স্কুল-কলেজে, পাড়ার প্যাণ্ডেলে সর্বত্রই তাঁর গান। দেখি আমার কথা কেমন মনে আছে?
কিন্তু মনোনয়নপত্র পেশ করতে গেলে ভোটার কার্ড দরকার। চিন্তার কথা। কোন কাগজপত্রও নেই। কিছুক্ষণ পরেই নেতাগোছের কিছু লোক বলল, কোন চিন্তা নেই। কবি অবাক। লোকগুলি বলল, শুনেছি আপনার পূর্বপুরুষ জগন্নাথ কুশারী বাংলাদেশের খুলনায় ছিলেন। সেখানে আবার পতিত হয়ে বহু বছর আগে এদেশে আপনারা চলে আসেন। যাই হোক নাগরিকত্ব নিয়ে সি এ এ' র চক্করে পড়তে হবে না। আর জোড়াসাঁকোর বাড়িটা , আপনার জন্মগৃহ সব প্রমাণ এখনো আছে। তাই রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট পেতেও অসুবিধা হবে না। অনলাইনে কার্ডও চলে এল। নেতারা ভাবলেন কবি যদি আমাদের সমর্থনে নির্দল প্রার্থী হন, তাহলে একটা জম্পেশ প্রচার পুস্তিকা লেখানো যাবে। কেউ জানতে চাইলো-- গুরুদেব, আপনার দলের কোনো নাম ঠিক করেছেন? কবি এক মুহূর্ত ভেবে বললেন "ভারত তীর্থ" । আপন মনে গেয়ে উঠলেন --' হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে / এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে "
নির্বাচনেও মহামানবের সাগরতীরে যেতে হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখতে আরম্ভ করলেন দেশের মানুষের কাছে তার বক্তব্য। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে
" নির্বাচনী প্রচার পুস্তিকায়" কবি লিখবেন তার দেশের কথা, দেশকে গড়ে তোলায় তার কাঙ্ক্ষিত কাজ। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে সব ধর্মের বাঙ্গালীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন যে গান, আজ তাঁর মনে হল সেই গান বড় প্রয়োজন-- আমি ভয় করব না ভয় করব না/ দুবেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না।। / ধর্ম আমার মাথায় রেখে চলব সিধে রাস্তা দেখে..../ বিপদ যদি এসে পড়ে সরব না, ঘরের কোণে সরব না।" ভয় না করেই তিনি ডাক দিয়েছিলেন রাখি বন্ধনের -- বাঙালি ঐক্যবন্ধনের। সকালবেলায় সবাইকে নিয়ে জগন্নাথ ঘাটে গেলেন হেঁটে। রাস্তার দু ধারে অজস্র লোক। মেয়েরা খই ছড়াচ্ছে শাঁখ বাজাচ্ছে। গঙ্গায় স্নান করে সবাইকে রাখি পড়ানো হল। পাথুরেঘাটার বীর মল্লিকের আস্তাবলের সহিসের হাতে কবি বাঁধলেন রাখি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে চিৎপুরের মসজিদে গিয়ে মৌলবীদের হাতে রাখি পরানো হলো। আজকের কবি ভাবছেন ধর্মকে গৌণ রেখে সৌহার্দ্যের বন্ধনে কেন আজও আমরা এক হবো না?
কবির মনে হল প্রচার পুস্তিকায় লিখি, যা লিখেছিলাম 'বাংলা ভাষা পরিচয়' এর সপ্তম অধ্যায়ে " আমরা যাকে, দেশ বলি বাইরের থেকে দেখতে সে ভূগোলের অংশ । কিন্তু তা নয়। পৃথিবীর উপরিভাগে যেমন আছে তার বায়ুমণ্ডল, যেখানে বয় তার প্রাণের নিঃশ্বাস, যেখানে ওঠে তার গানের ধ্বনি, যার মধ্যে দিয়ে আসে তার আকাশের আলো, এমনি একটা মনোমন্ডল স্তরে স্তরে এই ভূভাগকে অদৃশ্য আবেষ্টনে ঘিরে ফেলেছে--- সমস্ত দেশকে সেই দেয় অন্তরের ঐক্য।" সেই ঐক্যের আহ্বায়ক তিনি।
রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি, সামাজিক সুবিধাবাদ কিংবা সাম্প্রদায়িক স্বার্থসিদ্ধি --- এই ব্যাধি সারা দেশ তথা বাংলাকে ক্ষতবিক্ষত ক'রে আত্মমর্যাদাহীনতায় ভূলুণ্ঠিত করে দিয়েছে। তিনি দেখছেন আজও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সামগ্রিকভাবে বঞ্চিত , অবহেলিত। তারা এখনো পশ্চাতে। কবির মনে পড়ল " হাতে কলমে"প্রবন্ধে তাঁরই করা তীক্ষ্ম মন্তব্য -- " আমাদের স্বদেশহিতৈষীদের....... স্বদেশের উপর প্রেম এত অত্যন্ত বেশি স্বদেশের "লোকের" উপর প্রেম আর বড় অবশিষ্ট থাকে না। এই কারণে, ইহারা স্বদেশের হিতসাধনে অত্যন্ত উন্মুখ, সুতরাং স্বদেশীর হিতসাধনের সময় পান না।" কবি দেখছেন আজও দেশের নায়কদের হাতের চেয়ে হাতিয়ার বেশি।
আর সেই জন্যই তিনি বারবার ভাবছেন,00 আজও দেশের মানুষের জন্য 'আত্মশক্তি' আর 'স্বাবলম্বন' এর কথা। "রাজা ও প্রজা" , " আত্মশক্তি" " স্বদেশী সমাজ" , "স্বদেশ" প্রভৃতি গ্রন্থে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন- "আমাদের দেশে সমাজ যদি পঙ্গু হয়, তবেই যথার্থভাবে দেশের সঙ্কটাবস্থা উপস্থিত হয়। এইজন্য আমরা এতকাল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ করি নাই কিন্তু আমাদের সামাজিক স্বাধীনতা সর্বতোভাবে বাঁচাইয়া আসিয়াছি।" (স্বদেশী সমাজ) । আজও আমাদের সামাজিক স্বাধীনতাই বিপুলভাবে খর্বিত হচ্ছে।
কবি উপলব্ধি করছেন, আমার প্রাসঙ্গিক কথা আজ কত অপ্রাসঙ্গিক, নিরর্থক। ধর্ম বলছে মানুষকে শ্রদ্ধা না করলে অপমানিত ও অপমানকারী কারো কল্যাণ হয় না। কিন্তু ধর্মতন্ত্র বলছে মানুষকে নির্বিচারে অশ্রদ্ধা করতে এবং আজও তা চলছে। কবি ভাবলেন আবার লিখি " কর্তার ইচ্ছায় কর্ম" প্রবন্ধে যা লিখেছিলাম,-- " মনে রাখা দরকার, ধর্ম ও ধর্মতন্ত্র এক জিনিস নয়। ও যেন আগুন আর ছাই। ধর্মতন্ত্রের কাছে ধর্ম যখন খাটো হয় তখন নদীর বালি নদীর জলের উপর মোড়লি করিতে থাকে। তখন শ্রোত চলে না, মরুভূমি ধু ধু করে। তার উপরে, সেই অচলতাটাকে লইয়াই মানুষ যখন বুক ফোলায় তখন গণ্ডস্যোপরি বিস্ফোটকং।" কবির কাছে ধর্ম কোনদিন সাম্প্রদায়িক মতবাদ ছিল না বরং তাহলো মানবধর্ম। পরিপূর্ণ মানব-দেবতার, আবির্ভাব তিনি চেয়েছিলেন। বারবার নরদেবতার পায়ে নত হয়েছেন। তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন ধনঞ্জয় বৈরাগী কিংবা বিশু পাগলদের। তাঁর প্রচার পুস্তিকায় তিনি মনে করালেন "গান্ধারীর আবেদন" কবিতায় গান্ধারীর কথা " ধর্মেই ধর্মের শেষ । " কবি ভাবছেন, বাঙালি কি আমার "অচলায়তন" নাটক আর পড়ে না। মানুষ আজ মন্ত্রকে মননের চেয়ে, পুঁথিকে গুরুর চেয়ে এবং আচারকে মানুষের চেয়ে বড় ভাবছে।
জাতপাত অস্পৃশ্যতায় দীর্ণ সমাজের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন, আমিই তো লিখেছিলাম 'পুনশ্চ' কাব্যগ্রন্থের 'শুচি' কবিতা। গুরু রামানন্দের নৈবেদ্য দেবতা গ্রহণ করেন নি -- " আমার বাস কি কেবল বৈকুন্ঠে, / সেদিন আমার মন্দিরে যারা প্রবেশ পায় নি / আমার স্পর্শ যে তাদের সর্বাঙ্গে,/ আমারই পাদোদক নিয়ে/ প্রাণপ্রবাহিণী বইছে তাদের শিরায় / তাদের অপমান আমাকে বেজেছে; / আজ তোমার হাতের নৈবেদ্য অশুচি।"
কিন্তু রামানন্দ শুচি হয়েছেন, তাঁর ঠাকুরকে এতদিন যেখানে হারিয়েছিলেন সেখানে খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু আমরা কি রামানন্দ হতে পেরেছি? তাই উচ্চ নীচ, জাতপাত, ধর্মমোহ ধর্মতন্ত্র মুক্ত স্বদেশ সেবা আজও চাইছেন কবি। যেখানে জনগণ সুস্থ, সবল, শিক্ষিত, আনন্দিত, আত্মসম্মানে দীক্ষিত হবে। যে ভারতবর্ষের মানুষ গোরার মত বলবে " আজ আমি ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু- মুসলমান- খ্রিস্টান কোন সমাজের কোন বিরোধ নেই।" ভারতবর্ষের দেবতাকে কবি আজও খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
কবির সারা জীবনে কর্মও এই দর্শনকে কেন্দ্র করেই চলেছে। দেশের মধ্যে মানুষের আত্মাকে ব্যাপ্ত হতে, প্রকাশিত হতে চেয়েছেন । দেখতে চেয়েছেন মানুষের দেশ মানুষের চিত্তের সৃষ্টি। নরদেবতার পূজা তিনি বারবার করে গেছেন। আজ মনে করছেন সে পূজার অধিকার তাঁর নেই। তাই এইসব " পোলিটিক্যাল প্রয়াস" তাঁর পক্ষে "স্বাভাবিক বলে" সেদিনও অনুভব করেন নি, আজ তো নয়ই।
তাই এ সবই কল্পনা। কবির কাছেও আজকের দেশ, দেশবাসী , সমাজ চূড়ান্ত অবক্ষয়ে ভরা এক নিষ্ফল পরিণাম। প্রমোদে মন ঢেলে মানুষ চলেছে এক প্রমোদতরীতে, সে তরীতে কবির গান নাই দর্শন নাই , স্থানও নাই। ২৫ শে বৈশাখের দিনটির শেষে জোড়াসাঁকোর সুতিকাগৃহটিতে সারাদিনের পুজোর শেষে রৌদ্রজ্বালায় ফুলমালার স্তূপ শুকিয়ে মলিন। ধীর পদক্ষেপে জোড়াসাঁকো থেকে চিৎপুর হয়ে নিমতলা ঘাটে গঙ্গায় সমস্ত "প্রচার পুস্তিকা" বিসর্জন দিয়ে ১৩ই আশ্বিন ১৩০৪, ৩৬ বছর বয়সে পতিসর থেকে কলকাতা যাবার পথে রেলগাড়িতে লেখা গানটি গাইতে লাগলেন--
" এ কি সত্য সকলই সত্য, হে আমার চিরভক্ত
মোর নয়নের বিজুলি -- উজল আলো
যেন ঈশান কোণের ঝটিকার মতো কালো--
এ কি সত্য "।