চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

Raibenshe folk dance বিলুপ্ত প্রায় রায়বেশে নাচকে বাঁচিয়ে রাখতে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন শীতেন্দু চক্রবর্তী


 

Raibenshe folk dance

বিলুপ্ত প্রায় রায়বেশে নাচকে বাঁচিয়ে রাখতে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন শীতেন্দু চক্রবর্তী 


Jagannath Bhoumick
Sangbad Prabhati, 6 April 2023


জগন্নাথ ভৌমিক, পূর্ব বর্ধমান : "রায়বেশে নাচ নাচের ঝোঁকে মাথায় মারলে গাঁট্টা/ শ্বশুর কাঁদে মেয়ের শোকে বর হেসে কয় ঠাট্টা।" বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ছড়া যেমন আজ আর শোনা যায় না। তেমনি রায়বেশে নাচও ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। তবে শীতেন্দু চক্রবর্তীর নাম হয়তো শুনেছেন অনেকেই। রায়বেঁশে বা রায়বেশে নৃত্যের সঙ্গে যে নামটি জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। শীতেন্দু বাবুর জন্যই দেশে-বিদেশে উজ্জ্বল হয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলার নাম। পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের জারগ্রামের বাসিন্দা শীতেন্দু চক্রবর্তী। তিনি বিলুপ্ত প্রায় এই আঞ্চলিক নাচকে (folk dance) বাঁচিয়ে রাখতে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। ২৫০ জনের উপর শিক্ষার্থী নিয়ে ৪০ জনের উপর শিক্ষক তৈরী করেছেন তিনি নিজে হাতে। বর্তমানে তার দল দেশ বিদেশের নানা মঞ্চ মাতিয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলা কে শিরোনামে তুলে ধরছে।

এই রায়বেঁশে নাচের উদ্ভব নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক থাকলেও ইতিহাসের নিরিখে বলা যায়, দিল্লির মসনদে যখন আকবর বাদশাহ। সে সময় অধুনা মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা থানা এলাকায় ফতেসিং পরগনায় ফতে হাড়ি নামক এক স্বাধীনচেতা সামন্তরাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর সৈন্যসামন্ত, দুর্গ, গড় সবই ছিল, আর ছিল তাঁর হস্তীবাহিনী। তিনি দিল্লির শাসন মানতেন না। ওই সময়ে ফতেসিং পরগনা সংলগ্ন অধুনা খড়গ্রাম থানার শেরপুর নামক দুর্গে দুর্গরক্ষক ছিলেন ওসমান খান। তিনি ছিলেন সুলতানি শাসকদের প্রতিনিধি। এঁরাও দিল্লির শাসন মানতেন না। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি মান সিংহকে আকবর এই অঞ্চলে পাঠান এঁদের দমন করে মুঘল শাসন কায়েম করার জন্য। মান সিংহের সঙ্গে আসেন তাঁর সহকারী সেনাধ্যক্ষ সবিতা রায় দীক্ষিত। তাঁর সঙ্গে ছিল দুদ্ধর্ষ ভীল সৈন্যদল, অর্থাৎ ভল্ল বা বল্লমধারী যোদ্ধা। মান সিংহ ওসমান খাঁকে পরাভূত করে এই অঞ্চলে মুঘল শাসন কায়েম করেন। সবিতা রায় দীক্ষিত মান সিংহের নির্দেশে ময়ূরাক্ষী নদীর তীরবর্তী মুণ্ডমালা নামক স্থানে হাড়ি রাজাকে যুদ্ধে পরাস্ত ও হত্যা করেন। পুরস্কারস্বরূপ দিল্লির বাদশাহের অনুমতি নিয়ে তাঁকে ফতেসিং পরগনার শাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। গড় নির্মাণ করে তিনি এখানে থেকে যান। জেমো-বাঘডাঙার রাজপরিবার সবিতা রায়ের উত্তরাধিকারী। রাজস্থান থেকে আগত ভল্লধারী যোদ্ধাবৃন্দও বাধ্য হয়ে এখানে থেকে যান। তাঁরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হলেও চাষ-আবাদের কাজ জানতেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁরা লেঠেল, পাইক-বরকন্দাজের জীবিকা গ্রহণ করেন। অনেকে আবার লুঠতরাজও করতেন। এই যোদ্ধারা জমিদারদের লেঠেল হিসেবে বার্ষিক খাজনা আদায়ের সময় থাকতেন। ঘাঘরা পরে নৃত্যছন্দে বাদ্যের তালে তালে তাঁরা যেতেন। দস্যুদলের আক্রমণ হলে তাঁরা বীরদর্পে ঢাল-তরোয়াল-বল্লম-লাঠি নিয়ে প্রতিহত করতেন। আগেকার দিনে বিয়ে পালকি সহযোগে হেঁটে হেঁটে যেত সেই সময় দুস্য ডাকাত দল যে কোনো সময়ে হানা দিত সেই জন্য বিয়ের বরযাত্রীর সহিত কিছু আগে ও শেষে নৃত্য করতে করতে যেত এই রায়বেঁশের দল এরা এক এক জন ১০ থেকে ১৫ জন ডাকাতকে একা প্রতিরোধ করতে পারতো।

যাইহোক এঁরাই পাশাপাশি বসবাসকারী হাড়ি, বাগদি, ডোম, বায়েনদের নিয়ে রায়বেঁশে দল গঠন করেন। রায়বাঁশ থেকে রায়বেঁশে নামের উদ্ভব বলে অনেকে মনে করেন। রাই বেশ (নারী বেশ) থেকে রাইবেশের উদ্ভব কথাটিও বলা যেতে পারে। এই ভল্লা জনগোষ্ঠীর বসতিকেন্দ্র সংলগ্ন মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমানের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রাইবেশে দলগুলির সৃষ্টি হয়েছে এবং এগুলিই তাদের বিকাশকেন্দ্র। এঁরা প্রধানত গ্রাম্য বিয়েতে অংশ নিয়ে জীবিকা চালান। ইদানীং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এঁরা কিছু অনুদান পাচ্ছেন ও দেশের নানা স্থানে রায়বেশে প্রদর্শন করছেন। 

এপ্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হয়, মুর্শিদাবাদ জেলার খড়গ্রাম থানার রতনপুর গ্রামে নবোদয় রায়বেঁশে সমগ্র ভারতবর্ষে নিজেদের নাম প্রতিষ্ঠিত করে আছে। রায়বেঁশে লোকনৃত্য নানা উত্থানপতনের মধ্যে টিকে আছে আজও। সত্তরের দশকে মুর্শিদাবাদে এই নৃত্য প্রায় বিলুপ্তির পথে গেলেও এখন লোকায়ত শিল্পী সংসদ তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছে।

 রায়বেঁশে বা রায়বেশে নৃত্য সম্পর্কে শোনা যায় বীরভূম জেলাতেই নাকি প্রথম উদ্ভব হয়েছিল, কিন্তু কথাটা ঠিক নয়। এই নাচের উদ্ভব মুর্শিদাবাদের বড়ঞা ও খড়গ্রাম থানা এলাকায়। তবে এটা বলা যায়, চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে বীরভূমের নাম বলা যেতেই পারে। রায়বেঁশে বা রাইবেশে উদ্ভাবনের একটা আঞ্চলিক ইতিহাসও আছে। অনেক আগে থেকে শারীরিক কসরতমূলক কিছু নৃত্যভঙ্গি বঙ্গের নানা প্রান্তে প্রচলিত ছিল এবং তা ছিল রায়বেঁশের আগে থেকেই। এই নৃত্যশৈলীর মুল বৈশিষ্টই হল, নর্তকরা ডানপায়ে ঘুঙুর পড়তো। ঘন্টা, ঢোল, করতালের ছন্দে ডানপায়ের ঘুঙুর সহকারে নৃত্য করতো। আর তার সঙ্গে হাতে থাকতো কখনো ধনুক, কখনো বর্ষা, কখনোবা তলোয়ার। হাতের কৌশলে অস্ত্র ব্যবহারের ভঙ্গি প্রদর্শনই এর প্রধান আকর্ষণ। এই নাচে বাদ্যের তালে তালে একই অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে হয়। বাদ্য ও নৃত্যের এই সম্মিলিত গতি ও ছন্দে রায়বেঁশে নাচের স্বাতন্ত্র্য ও সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। 

তবে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে গুরুসদয় দত্ত যখন বীরভূমের জেলা শাসক হিসেবে এসে রায়বেশের সঙ্গে পরিচিত হন। সে সময় ব্রিটিশ সরকার ভল্লাদের অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এই অভিশাপ থেকে তিনি তাঁদের মুক্তি দেন ও জীবনের মূল স্রোতে নিয়ে আসেন। একই সঙ্গে রায়বেশে নৃত্যকেও পুনরুজ্জীবিত করেন। এই নৃত্যশৈলীর সহায়তায় স্বদেশ হিতৈষণা ও সমাজসেবাকে একীভূত করে তিনি একটি অসাধারণ নৃত্যশৈলী উদ্ভাবন করেন, যা আজও ব্রতচারী হিসেবে সগর্বে প্রচারিত।