চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

বিদ্যালয় আছে তার স্বপ্ন নিয়ে, অথচ....


 

বিদ্যালয় আছে তার স্বপ্ন নিয়ে, অথচ....


🟣  বিশ্বরূপ দাস 


এক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা বিদ্যালয়ের মতো সুন্দর প্রতিষ্ঠানের নামে কলঙ্ক বা বদনাম ছড়িয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। তাদের মুখে কখনও সেই প্রতিষ্ঠানের গুনগান শুনি না। তারা কখনও মনে করেন না সেই বিদ্যালয়টি তাদের এলাকার সম্পদ। তাদেরই সন্তান সন্ততীরা সেখানে পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে এবং সেই প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে অনেকেরই স্বপ্নপূরণ হবে। অথচ কিছু মানুষ আছেন কোথাও সামান্যতম খুঁত পেলে বা খুঁতের গন্ধ পেলে তারা মাছির মতো ছোটে এবং কী করে প্রতিষ্ঠানটির সর্বনাশ করা যায় তার খেলায় মেতে ওঠে। সেই উদ্দেশ্যে দুর্নাম ছড়িয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন । কখনও বিদ্যালয়টিকে উপেক্ষার এবং উপহাসের পাত্র করে তোলেন। তাদের সেই দূরভিসন্ধির কারণেরই দিনের পর দিন ড্রপ আউট বাড়ে। ছাত্র সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকে। পড়াশুনা করা ঘরের ছেলে মেয়েরা ঘরের কাছে বিদ্যালয় ছেড়ে দূরের স্কুলে ছোটে। যা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। অথচ এই সমস্ত স্কুলে শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত নিজেদের শ্রেষ্ঠটুকু উজাড় করে দেন সন্তান তুল্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে। কিন্তু তার প্রতিদানে ন্যূনতম সম্মানটুকু তাদের ভাগ্যে জোটে না। নানা ভাবে তারা লাঞ্ছিত এবং অপমানিত হয়ে থাকেন।

অবশ্য এই চিত্র কমবেশি রাজ্যের সব স্কুলগুলিতেই দেখা যায়। এলাকার মানুষ এবং অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বাড়িয়ে দিতে হবে সব রকমের সহযোগিতার হাত যাতে শিক্ষকরা এবং শিক্ষার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা খোলা মনে কাজ করতে পারেন। নতুবা মানুষ গড়ার পরিবর্তে নিষ্প্রাণ মূর্তি গড়া হবে আর স্কুলগুলো হয়ে উঠবে প্রাগঐতিহাসিক যুগের কঙ্কালের মত। 

অনেকে হয়তো বর্তমান শিক্ষা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার সম্বন্ধে আঙ্গুল তুলবেন। অভিযোগের পর অভিযোগের তীর ছুটে আসবে। ত্রুটিগুলোই সর্বাধিক চোখে পড়বে। ভালো কাজ গুলো নজরে আসবে না। কেউ সেগুলোর সম্বন্ধে গুনগান গাইবেন না বা উৎসাহ দেবার জন্য তাদের কাজের তারিফ করবেন না। পূর্ব বর্ধমানের তেজগঞ্জ হাইস্কুল শহরতলীর মধ্যে থেকেও বর্তমানে শহরের নামী স্কুলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। স্কুলটি যখন নানা কারণে মৃতপ্রায় অবস্থায় ছিল তখন তাকে নতুন করে সাজাবার দায়িত্ব  মাথায় তুলে নিয়েছিলেন এলাকার বেশ কয়েকজন সমাজসেবী মানুষ এবং বর্তমান পরিচালন কমিটি সহ প্রধান শিক্ষক। তাদের নিবিড় সান্নিধ্যে এবং বিগত কয়েক বছরে বর্তমান সরকারের প্রায় পঞ্চান্ন লক্ষ টাকার অনুদানে স্কুলটির খোল নলচে সম্পূর্ণ বদলে যায়। পর্যাপ্ত ক্লাসরুম, ছাত্র-ছাত্রীদের পৃথক পৃথক শৌচাগার থেকে শুরু করে স্যানিটারি ভেন্ডিং মেশিন, বিশুদ্ধ পানীয় জল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বিরাট হলঘর ও সুসজ্জিত মঞ্চ, মিড ডে মিলের সহায়তার জন্য মৎস ও সবজি চাষ, জৈব সার প্রস্তুত, আধুনিক ল্যাবরেটরি, সাইকেল স্ট্যান্ড, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ এবং পুর্নব্যবহারীকরণের সুব্যবস্থা করা হয়।  সামাজিক কর্মকাণ্ডেও এই বিদ্যালয়টি পিছিয়ে নেই। জানা গেছে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্যোগে প্রতি শনিবার বিদ্যালয়ে বয়স্কদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। স্বেচ্ছায় একাধিকবার রক্তদানের আয়োজনও করা হয়েছে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে। কোভিদের সময় শিক্ষকরা এলাকার দুস্থ দরিদ্র গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের ঘরে দিনের পর দিন শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পড়াবার ব্যবস্থা করেছেন। হোমটাস্ক দেখেছেন। এছাড়াও সারা বছর ধরে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষা কর্মী এবং ছাত্র-ছাত্রীরা বৃক্ষরোপন করে স্কুলটিকে করে তুলেছে সবুজ ঘেরা এক টুকরো শান্তিনিকেতনের মত। পাশাপাশি নানান ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্র ছাত্রীদের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনস্ক করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। 

বলতে দ্বিধা নেই এখানকার পড়ুয়ারা বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলঘর থেকে আসে। সেই কথা মাথায় রেখে বিগত বছরে ২৮ ডিসেম্বর সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সন্দীপ কুমার চক্রবর্তী Poor Fund নামে একটি প্রকল্প চালু করেন। তিনি তাঁর মাতৃদেবীর হাত দিয়ে প্রকাশ্য সভায় কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে সেই তহবিলের শুভ উদ্বোধন করেন। সেই মহতি উদ্যোগে সাড়া দিয়ে সেই মঞ্চেই একাধিক ব্যক্তি নিজের নিজের সাধ্য অনুসারে সেখানে  মুক্ত হস্তে দান করেন। সমস্যাটা ঠিক এখান থেকেই শুরু হয়েছে। এই ক্ষুদ্র তহবিলের কলেবর যাতে বাড়ে, যাতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীদের এডমিশন ফি (সরকার নির্ধারিত) থেকে আগামীদিনে রেহাই দেওয়া যায়। সেই উদ্দেশ্যে এ বছর ভর্তির সময় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ (পরিচালন কমিটি) আলোচনা সাপেক্ষে একটি অপশনাল ডোনেশন স্লিপ ছাপান।  উদ্দেশ্য একটাই যাদের ক্ষমতা আছে তারা ইচ্ছা অনুযায়ী এই মহতি উদ্যোগে দান করতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটাই বুমেরাং হয়ে যায়। প্রচার হতে শুরু করে তেজগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় নাকি সরকারি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট দেখিয়ে ভর্তির জন্য ছাত্র পিছু কিছু বর্ধিত ফিস (fees) নিচ্ছে। কিন্তু কেন নিচ্ছে, কত নিচ্ছে তার ইতিবৃত্তের কোন খোঁজ খবর না নিয়ে অনেকেই অপপ্রচার চালাতে শুরু করেন। যা বাজারের প্রথম শ্রেণির একটি বিশেষ সংবাদপত্রে বেশ মুখরোচক ভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু তারা একবার ঘটনার সত্যতা যাচাই না করে শুধুমাত্র টিআরপি বাড়াবার জন্য  স্কুলের পক্ষে সম্মান হানিকর এ ধরণের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর ছাপিয়েছেন, যা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।

অথচ তাদের এতটুকু সহানুভূতি এবং সাহায্য পেলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই জেলার বুকে একটা দৃষ্টান্তস্থাপন করে দেখিয়ে দিতে পারতেন যে তেজগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় আছে "সবার পিছে, সবার নীচে, সব হারাদের মাঝে"। সেই সুদিনের প্রত্যাশায় বিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষা কর্মীসহ এলাকার শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ দিন গুণছেন।

                                                         -- ফাইল ছবি
               লেখক : শিক্ষক, তেজগঞ্জ হাইস্কুল, বর্ধমান