চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

জাগ্রত দেবী মা-ই-ত কালী'র অলৌকিক উপাখ্যান


জাগ্রত দেবী মা-ই-ত কালী'র অলৌকিক উপাখ্যান 

জগন্নাথ ভৌমিক, সংবাদ প্রভাতী : বাংলার বহু তীর্থক্ষেত্র এবং জাগ্রত দেবদেবীর নাম শুনেছেন। কিন্তু মা-ই-ত কালী'র অলৌকিক ঘটনাবলী শুনলে গায়ে কাঁটা দেবে ভক্তিতে শিহরণ জাগবে। হেমন্তের ঘোর অমানিশায় আজ মা-ই-ত কালী'র  অলৌকিক ঘটনার কথাই জানাবো।  বাঁকুড়া জেলার শহর সোনামুখীতে প্রায় শতাধিক কালীপুজো হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে সব চেয়ে জাগ্রত কালী হিসেবে প্রসিদ্ধ "মা ই-ত কালী"। সোনামুখীর এই কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার বর্গি আক্রমণের বহু স্মৃতি। কথিত আছে, এক সময় বর্গি হানার হাত থেকে সোনামুখীকে রক্ষা করেছিলেন এই ‘মা ই-ত কালী'। নির্দিষ্ট নিয়ম রীতি মেনে ‘মা-ই-ত কালী' মাতার পুজো হয়। পুজোর পর দেবী মূর্তির বিসর্জন হলেও হয় না ঘট বিসর্জন। ঐতিহ্য মেনে বিসর্জনের আগে মন্দির থেকে দেবীমূর্তি কাঁধে করে  নিয়ে গোটা সোনামুখী শহর প্রদক্ষিণ করার পরে স্থানীয় একটি পুকুরে বিসর্জন করা হয়।

বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর এই মা-ই-ত কালী মায়ের নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন। কিন্তু এমন বহু ঘটনা আছে যা শুনলে অনেক ঘোর নাস্তিক মানুষও মা-ই-ত কালীর ভক্ত হয়ে যাবেন। 

ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১০৪২ খ্রীষ্টাব্দে  মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত বর্গীদের একটি দল নিয়ে বিষ্ণুপুর থেকে সোনামুখী আসেন। এখানে লুঠপাট করতে ইচ্ছুক হয়ে বাদ্যযন্ত্রসহ হির হর বোম বোম' শব্দ করতে করতে রাণীরবাজারে মা কালীর মন্দিরের সামনে এসে বর্গীদল জড়ো হয়। এখানে তখন মন্দিরের চারিদিকে গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ ছিল। দিনের বেলাতেই অনেকে মন্দিরের সামনে আসতে সাহস করতেন না। তখন দিনের অপরাহ্ন। এ অঞ্চলের পুরুষ মহিলা সকলে বর্গীদের ভয়ে নিজের নিজের ঘরের দুয়ার বন্ধ করে ভয়ে সিটিয়ে রয়েছেন। বর্গীদল বাজনা বাজিয়ে নাচতে লাগল। মন্দিরে বর্তমান সেবাইতদের পূর্বপুরুষ এক বৃদ্ধ সন্ধ্যার সময় দেবীমন্দিরে আলো দেবার জন্য একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে মন্দিরে মায়ের ঘটের কাছে রেখে বলিস্থানে হাড়িকাঠে সাষ্টাঙ্গে প্রণামরত হন। এমন সময় বর্গীদের সর্দ্দার অর্থাৎ সেনাপতি একটি খাঁড়া তুলে প্রণামরত বৃদ্ধকে বলি দিতে উদ্যত হন, কিন্তু মায়ের ইচ্ছায় দৈবশক্তিতে ঐ উদ্যত খাঁড়া আর নামে না, যেন পিছন থেকে কেউ টেনে ধরে রেখেছে এবং ঐ ঘাতক অন্ধ হয়ে গেলেন। তখন সেনাপতি তাঁর সঙ্গীদের বললেন, “কেন তোমরা আমার খাঁড়া পিছনে টেনে রেখেছ?” বর্গীদল থেকে উত্তর দিল, “কেউ আপনার খাঁড়া পিছন থেকে টেনে রাখেনি নেই।” সেনাপতি বললেন, “মন্দিরে প্রদীপটি এখনও জ্বলছে কিনা, আর যে বুড়ো প্রণাম করছিল তিনি এখনও আছেন কিনা ?” তারা বলল, 'প্রদীপ ঠিকই জ্বলছে এবং বুড়ো এখানেই আছে।' 

সেনাপতি বললেন, 'প্রদীপের আলো আমি দেখতে পাচ্ছিনা, তবে কি আমি অন্ধ হয়ে গেলাম। কোন্ দৈবশক্তিতে আমার খাঁড়া আটকে আছে যে আমি খাঁড়া নামাতে পারছিনা ? আচ্ছা, ঐ বুড়ো।কে হত্যা না করে আটকাও এবং আমার পূর্ব্বাবস্থা প্রাপ্তির জন্য অনুরোধ করো।” 

ইতিমধ্যে ঐ বৃদ্ধ প্রণাম শেষ করে উঠে এসে সব ব্যাপার শুনে বুঝতে পারলেন এবং সেই সময় তারা ঐ বৃদ্ধকে অনুরোধ করায় তিনি মন্দিরে মায়ের ঘট থেকে জল এনে ওই ঘাতক সর্দারের চোখে এবং সর্বাঙ্গে শান্তিবারি দিলেন। মুহুর্তে সর্দার চোখের দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেলেন এবং তিনি খাঁড়া নামাতেও সক্ষম হলেন। সর্দার বৃদ্ধকে বললেন, “এখানে কোন দেবতা আছেন?' বৃদ্ধ উত্তর দিলেন মা কালী আছেন। সেনাপতি বললেন, 'মায়ী-ত কালী হ্যায়।' আচ্ছা, আমি তোমাকে যে খাঁড়াতে কাটতে যাচ্ছিলাম সেটি এবং আরও একটি খাঁড়া নাও। তোমরা এই খাঁড়াতেই বলিদান করবে। আমরা আর এখানে লুটপাট করবো না। আমরা কাটোয়া চললাম । এই বলেই বাজনা বাজাও "মায়ী-ত হ্যায়, মায়ী-ত কালী হ্যায়।” এরপর বর্গীদল বাজনা বাজাতে বাজাতে মায়ের নামকীর্তন করতে করতে সোনামুখী ছেড়ে চলে যায়। এবং সেই সময় থেকেই ‘মায়ী-ত-কালী’ বা ‘মা-ই-ত-কালী' নামের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে। 

বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর এই মা-ই-ত কালীর পুজো বংশ পরম্পরায় সেবাইতরাই চালিয়ে নিয়ে আসছেন। সামগ্রিকভাবে পুজো সর্বজনীন রূপ পেলেও এখনও সেবাইতরাই এই পুজোর মূল অধিকারী। এবছর সেই সেবাইতদের মধ্যে মামা কুলের সেবাইত সাংবাদিক স্বপন মুখার্জী এবং তাঁর পুত্র জুয়েল মুখার্জীদের পালা পড়েছে। এছাড়া সেবাইদদের মধ্যে রয়েছেন দুর্গাদাস ও তাঁর পুত্র অপূর্ব, নিশিত ও তাঁর পুত্র অরণি, গুরুপ্রসাদ, সঞ্জীব, সুখেন্দু ও তাঁর পুত্র অর্জুন (নাবালক), অমিয় ও তাঁর পুত্র অমিত। 

এবার সেই সেবাইতদের একটি ঘটনাক্রম শুনবো এবছরের সেবাইত তথা সাংবাদিক স্বপন মুখার্জীর কাছ থেকে। তিনি জানালেন, সেবাইত শ্রী ত্রিপুরাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ১৩২৮ সনের কার্ত্তিক মাসে শ্রী শ্রী শ্যামাপুজার রাতে মায়ের পুজার সময় তিনি মায়ের মন্দিরে উপস্থিত ছিলেন না। তার স্ত্রী ও পুত্র ছিলেন। রাত প্রায় ৩টের সময় বলিদানের আগে উপবাসী পুরুষ ও স্ত্রী লোকেরা মানত অনুযায়ী কেউ মাথায়, কেউ বুকে, কেউ বা পিঠে ধুনার খোলা রেখে ধুনো পোড়াচ্ছিলেন। তারমধ্যে শ্রী হরিপদ বীটের স্ত্রী (বয়স আনুমানিক ১৯-২০) সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে করতে মুখ, হাত মাটিতে ঘষতে ঘষতে চিৎকার করে উঠলেন। ত্রিপুরা বারুজ্যের এতোবড়ো অহঙ্কার, আমার পূজার সময় এখানে আসেনি। তখন মন্দির উঠোনে প্রায় দু-তিনশো মানুষ সমবেত হয়ে ছিলেন। তখন মন্দিরের পুরোহিত বলেন, "মা, ত্রিপুরা বারুজ্যে কলিয়ারিতে সাহেবের চাকুরি করেন। হয়তো সে ছুটি পাননি, তাই তিনি আসেননি।" সেই স্ত্রী লোকটি জোর গলায় ধমক দিয়ে বললেন। তুই কি জানিস সে ছুটি নিয়ে রাত ১০ টার সময় বাড়ি এসেছে। এখন তোয়াজ করে আরামে ঘুমাচ্ছেন। সে যখন গরিব ছিল তখন আমাকে খুবই ডাকত। আমার দয়াতেই তার এই চাকরি ও এত ধন সম্পদ। এখন অহঙ্কার হয়েছে, তাই ঘুম ছাড়িয়ে এখানে আসতে পারেনি। তাঁর পুত্র দ্বিজপদ এইসব শুনে দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে তার পিতা ত্রিপুরা বারুজ্যকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে মন্দিরে নিয়ে আসেন। তিনি এসেই গলায় কাপড় দিয়ে জোর হাতে বললেন, 'মা, আমার অপরাধ হয়েছে, ক্ষমা কর। সেই স্ত্রী লোকটি আগের কথাগুলি পুনরায় বলে শেষে জানায় আমার মন্দিরের ছাদ ভেঙেছে তুই কি জানিস না। শীঘ্রই আমার মন্দিরের ছাদ পাল্টিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। তিনি মায়ের নির্দেশে মন্দিরের ছাদ তৈরি করে দিয়েছিলেন। 

এইরকম‍ই অসংখ্য ছোট বড় অনেক ঘটনা বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর মা-ই-ত-কালী-কে বিখ্যাত করেছে। এখনো হাজার হাজার মানুষ রোগ শোক ঝগড়াঝাঁটি থেকে শান্তিতে বাঁচতে মায়ের কাছে প্রার্থনা জানান এবং কথিত আছে কেউই মায়ের করুণা থেকে বঞ্চিত হন না। তাই বলছি সুযোগ ও সময় থাকলে বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীতে মা-ই-ত-কালী- কে দর্শন করে আসুন। যেতে না পারলে সকলে মিলে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলুন "ওঁ মা-ই-ত-কালী তারা ব্রক্ষ্মময়ী নমঃ"।