চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

বাংলা সংবাদপত্রের দু’শ বছর : উপেক্ষিত নায়ক গঙ্গাকিশোর


 

বাংলা সংবাদপত্রের দু’শ বছর : উপেক্ষিত নায়ক গঙ্গাকিশোর 


🟣  পুলক মণ্ডল, কালনা 


➡️  কলকাতা তখন সবে শৈশবদশা অতিক্রম করতে চলেছে। তখন কলকাতা মানে কদর্য বাবু কালচার। তখন কলকাতা মানে জঙ্গলে ঘেরা মেঠোপথ। সবে একটা মাত্র চওড়া রাস্তা হয়েছে। রাজা রামমোহন রায় সবেমাত্র কলকাতায় এসেছেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার উদ্দেশ্যে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখনো জন্মগ্রহন করেননি। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের পদধ্বনি কলকাতার বুকে শোনা যাবে সেইসময় থেকে আরও ঢের ঢের বছর পরে। তখনও কারখানায় চিমনির ধোঁয়া নেই। বৈদ্যুতিক বাতি নেই। কিন্তু বাংলা বই এসেছিল...... 

কলকাতাকে গ্রন্থনগরী করে তোলার সেই ভগীরথ হলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। ১৮১৬ সালে কলকাতা থেকে ছাপা রায়গুনাকর ভারতচন্দ্র লিখিত ‘অন্নদামঙ্গল’ সচিত্র বইটি সাধারনের কাছে বিক্রির জন্য প্রথম প্রকাশ করেন হুগলীর শ্রীরামপুরের এক মিশনারি প্রেসের কম্পোজিটর গঙ্গাকিশোর। বাংলা ভাষায় এটি প্রথম ছাপার হরফে প্রকাশিত বই। নবজাগরনের সেই ঊষালগ্নে কলকাতা থেকে প্রায় শত কিমি দূরে বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর প্রত্যন্ত গ্রাম বহরা’র এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের এই ইতিহাস নির্মাণ বিস্ময়কর। ইতিহাস তিনি আরও নির্মাণ করেছেন একাধিক ক্ষেত্রে এবং সবকটিতে তিনিই প্রথম কারিগর। একদিকে তিনি যেমন বাংলা বই’এর প্রকাশক তেমনি তিনি প্রথম বাংলা পুস্তক ব্যবসায়ী। সোজা কথায় তিনিই প্রথম বাংলা বইয়ের দোকানদার। আবার তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি ছাপাখানা বসান এবং সর্বোপরি শুধুমাত্র বাংলা ভাষাতেই নয় যে কোন ভারতীয় ভাষাতেই প্রকাশিত সংবাদপত্রের জনক তিনি। অথচ তিনি, গঙ্গাকিশোর, তাঁর সমকালে মর্যাদা পাননি। প্রথম বাংলা গ্রন্থের প্রকাশক রূপে তিনি পরবর্তীকালে কিছুটা স্বীকৃতি পেলেও সংবাদপত্রের জনক রূপে আজও উপেক্ষিত। সে প্রসঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে একবার দেখে নেওয়া যাক প্রথম বাংলা বইয়ের প্রকাশক রূপে তাঁর সম্পর্কে যা জানা যায়- ১৮৩০ এর ৩০শে জুন কলকাতার সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’- এ প্রকাশিত হয়, ‘এতদেশীয় লোকের মধ্যে বিক্রয়ার্থে বাঙ্গলা পুস্তক মুদ্রিতকরনের প্রথমদ্যোগ কেবল ১৬ বৎসরাবধি হইতেছে ইহা দেখিয়া আমাদের আশ্চর্য বোধ হয় যে এত অল্প কালের মধ্যে এতদেশীয় লোকেদের ছাপার কর্মের এমন উন্নতি হইয়াছে;  প্রথম যে পুস্তক মুদ্রিত হয় তাহার নাম অন্নদামঙ্গল।শ্রীরামপুর ছাপাখানার একজন কর্মকারক শ্রীযুত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য তাহা বিক্রয়ার্থে প্রকাশ করেন’। আবার গঙ্গাকিশোর সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী উল্লেখ যাঁর লেখাতে পাওয়া যায় সেই প্রাবন্ধিক-ঐতিহাসিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলীর ভুমিকায় আর এক স্বনামধন্য লেখক সজনীকান্ত দাস উল্লেখ করেছেন, ‘ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য মুদ্রন করিয়াই বাংলাদেশে বাঙালির পুস্তক ব্যবসা আরম্ভ হয়; ১৮১৬ খ্রীস্টাব্দে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ইহার একটি চমৎকার সচিত্র সংস্করণ বাহির করিয়া পাবলিশিং বিজনেস্‌ আরম্ভ করেন.... গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী ধরিয়া বাংলাদেশের অন্য কোনও বাংলা পুস্তক এত অধিক প্রচারিত এবং পঠিত হয় নাই’। 

কলকাতার ‘ফেরিস এন্ড কম্পানি’ প্রেস থেকে গঙ্গাকিশোর অন্নদামঙ্গল ছেপে বের করেন, এর পরপরই তিনি ‘লক্ষ্মীচরিত্র’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ ইত্যাদি প্রকাশ করেন। ক্রমশঃ বাংলা ভাষার পুস্তক চাহিদা বাড়তে থাকায় ১৮১৮-এর শুরুতে তিনি নিজে ‘বঙ্গাল গেজেট প্রেস’ নামে ছাপাখানা পত্তন করেন। এবং এই ছাপাখানা থেকে অন্যান্য লেখকদের বই প্রকাশ করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দ্রব্যগুন’, ‘দায়ভাগ’, ‘চিকিৎসার্ণব’ ইত্যাদি বাংলা বই এবং ‘এ গ্রামার ইন ইংলিশ এন্ড বেঙ্গলী’ নামক একটি ইংরাজী ব্যকরনের বই। যার নাম ভুমিকায় তিনি লেখেন, ‘এতদেশীয় প্রায় অনেক বালকগন ইংরাজী ব্যকরন পাঠ করিতে আরব্ধ করিয়া অত্যল্পকাল পরে তাহাদিগের উহাতে অলস তাচ্ছিল্য এবং অশ্রদ্ধা জন্মে তাহার কারন এই অভিপ্রায় হয় যে বালকত্ব ধর্ম হেতু তাহাদিগের মনের চঞ্চলতা প্রযুক্ত ঐ ব্যকরনের যে পাঠ তাহাদিগের গুরু ও বন্ধুজনেরা দেন তাহা তারা মনে রাখিতে পারেন্না.... অতএব আমি বিবেচনা করিয়া দেখিলাম যে ইংরাজী ব্যকরনের অর্থ আমাদিগের আপনার ভাষাতে সংগ্রহ থাকিলে অতি সুসাধ্য হইতে পারে’-(তথ্যসুত্রঃ ‘সাহিত্য সাধক চরিতমালা’- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)। প্রেস স্থাপনের বছরেই গঙ্গাকিশোর বাঙালির অন্যতম সেরা ইতিহাস নির্মাণ করেন দেশীয় ভাষায় সর্বপ্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের মাধ্যমে...... 

১৮১৮-২০১৯ ; শুধুমাত্র বাংলা ভাষাতেই নয় যে কোন ভারতীয় ভাষাতেই সংবাদপত্র প্রকাশনা দু’শ বছর অতিক্রম করল। ১৮১৮ সালের ১৫ই মে শুক্রবার বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র “বঙ্গাল গেজেটি” প্রথম প্রকাশ করেন কালনা মহকুমার পাটুলির বহরা গ্রামের বাসিন্দা গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। এই বহরা গ্রামেই ছিল তার বাসস্থান এবং ছাপাখানা। আজও এই এলাকা “ছাপাখানা ডাঙ্গা” নামে পরিচিত। 

কর্মজীবনের শুরুতে গঙ্গাকিশোর কাজ করতেন হুগলীর শ্রীরামপুরে এক মিশনারি প্রেসে। সেই সময় কলকাতা ব্যতিরেকে যে কোন ছাপার কাজের জন্য শ্রীরামপুরের প্রেসের ওপরই নির্ভরশীল ছিল ব্রিটিশ সরকার। অবিভক্ত ভারতে প্রথম সংবাদপত্র ইংরাজী ভাষায়। ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামক ইংরাজী সংবাদপত্রটি জেমস্‌ অগাস্টাস হিকি প্রকাশ করেন ১৭৮০ সালে। গঙ্গাকিশোর প্রকাশ করেন দেশীয় ভাষার প্রথম সংবাদপত্র ‘বঙ্গাল গেজেটি’ তার ঠিক ৩৮ বছর পরে ১৮১৮ সালের ১৫ই মে। প্রায় একই সময়ে ১৮১৮ সালের ২৩শে মে শ্রীরামপুর ব্যপটিস্ট মিশন থেকে জন ক্লার্ক মার্শম্যান প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ’। এই পত্রিকাটিকে সরকারিভাবেই বলুন অথবা ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিকোণ থেকেই বলুন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলার প্রথম সংবাদপত্রের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কেননা আশ্চর্যজনকভাবে গঙ্গাকিশোর  সম্পাদিত বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্রের কোন কপি আজও অবধি পাওয়া যায়নি। 

তবে কেন বর্ধমান জেলা সহ রাজ্যের নানা প্রান্তের সাংবাদিক-প্রাবন্ধিকরা গঙ্গাকিশোরকেই বাংলা সংবাদপত্রের পথিকৃৎ রুপে মর্যাদা বা স্বীকৃতি দেন? এর নেপথ্যে আছে বর্ধমান থেকে একদা প্রকাশিত ‘দামোদর’ পত্রিকার সম্পাদক দাশরথি তা এবং তাঁর সহযোগী কালিপদ সিংহ সহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় ইতিহাসপ্রেমী মানুষের দীর্ঘ কয়েক বছরব্যাপী নিরলস গবেষণায় গঙ্গাকিশোর ও বঙ্গাল গেজেটি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্যের উন্মোচন,যা প্রমান করে মার্শম্যানের এক সপ্তাহ পূর্বেই গঙ্গাকিশোর সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি কলকাতা থেকে বহু দূরবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা হবার কারনেই হোক অথবা সৃষ্টিকর্তা একজন নেটিভ বাঙালি হবার কারনেই হোক তাঁর সৃষ্টিতে সরকারি সিলমোহর লাগানো হয়নি। এ সম্পর্কে একটি তথ্যপ্রমাণ দেখা যেতে পারে; গঙ্গাকিশোরের সহযোগী হরচন্দ্র রায় তৎকালীন সরকারি গেজেটে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন ১৮১৮-এর ১৪ই মে “ Hurrochunder  Roy begs leave to inform….he has established  a Bengale Press……intends to Published a Weekly Bengal Gazetttee……Hurrochunder Roy. 145 Chorebagan Street, Price R.2 per month (Govt.Gezette, 14 th May 1818 “ )।১লা জুলাই ১৮১৮ সালে হরচন্দ্র রায়ের নামে গভঃ গেজেটে আরও একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় যা থেকে জানা যায় পত্রিকাটি চলছে। এবং এই বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় পত্রিকাটিতে বেসামরিক নিয়োগের বিজ্ঞাপন, সরকারি বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি প্রকাশ করা হতো এবং মাসিক চাঁদা ছিল ২ টাকা। যদিও এই দুটি বিজ্ঞাপনে গঙ্গাকিশোরের নামোল্লেখ নেই কিন্তু যেহেতু তিনি এবং হরচন্দ্র যৌথভাবে ব্যবসার অংশীদার ছিলেন, সুতরাং এই বিজ্ঞাপন প্রমান করে ‘বঙ্গাল গেজেটি’–ই বাংলায় প্রথম সংবাদপত্র। 

বঙ্গাল গেজেটির জনকরূপে প্রথম গঙ্গাকিশোরের নামোল্লেখ হয় ১৮২০ সালের সেপ্টেম্বরে ইংরাজী পত্রিকা ‘ফ্রেন্ড অফ্‌ ইন্ডিয়া’-তে। ১৮৩১ সালের ১১ই জুন ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার একটি বিশেষ প্রতিবেদনে গঙ্গাকিশোরের ভূয়সী প্রশংসা করে তাকে বঙ্গাল গেজেটের প্রকাশক রূপে উল্লেখ করা হয়। গঙ্গাকিশোরের কর্মজীবনের সংক্ষিপ্ত উল্লেখও দেখা যায় ঐ প্রতিবেদনে। অবশ্য পরবর্তীকালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৫২ সালে ‘সংবাদপত্রের ইতিবৃত্ত’ নামক গ্রন্থে এবং ১৮৫৫ সালে পাদ্রী লঙ ‘ডেসক্রেপ্টিভ ক্যালকাটা অফ বেঙ্গলি ওয়ার্কার্স’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন গঙ্গাকিশোর সম্পাদিত বঙ্গাল গেজেটি–ই বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র। 

তৎকালীন সামাজিক কুসংস্কার, বিদেশী নিপীড়ন ও স্বদেশপ্রেমের বহু মূল্যবান রচনা বঙ্গাল গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল, তার মূল্যায়ন পরবর্তীকালে বহু গ্রন্থে উল্লেখিত আছে। যার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘সাহিত্য সাধক চরিতমালা’। দাশরথি তা সম্পাদিত ‘দৈনিক দামোদর’-এর ৩১ বৈশাখ ১৩৮২ সংখ্যায় ১৮১৯ সালের ২রা এপ্রিল তৎকালীন কলকাতা কাউন্সিল অফ চেম্বারের সেক্রেটারি এম.এ.বেলীর হাতে লেখা একটি আদেশনামা ছাপা হয়েছে। যাতে উল্লেখ আছে কলকাতা থেকে গঙ্গাকিশোর তাঁর নিজ গ্রাম বহরায় ছাপাখানা তুলে নিয়ে যেতে চান এবং সেখান থেকে তাঁর সংবাদপত্র প্রকাশিত হবে। খুব সম্ভবত এই সময় হরচন্দ্র রায়ের সঙ্গে গঙ্গাকিশোরের মতভেদ হয় এবং সংবাদপত্রটির যেহেতু তিনি প্রকাশক তাই সেটিকে আলাদাভাবে প্রকাশ করার কারনে তিনি তৎকালীন সরকারের অনুমতির জন্য আবেদন করেন, যার ফলশ্রুতিতে সরকারি সিদ্ধান্তটি গভঃ গেজেটে প্রকাশিত হয়। এর পরপরই তিনি নিজ গ্রাম কালনা মহকুমার বহরাতে চলে আসেন। স্থানীয়দের কাছে আজও এই এলাকা ছাপাখানা ডাঙ্গা নামে পরিচিত হলেও কার্যত গঙ্গাকিশোরের বাস্তুভিটা কিম্বা ছাপাখানার কোন অস্তিত্ব নেই। যদিও স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা ঐ এলাকায় একটি পরিত্যক্ত ভগ্ন ইটের স্তুপ সম্বলিত স্থান দেখিয়ে জানান যে, বংশ পরম্পরায় তারা শুনে আসছেন ঐখানেই নাকি ছিল গঙ্গাকিশোরের বসতবাড়ী এবং ছাপাখানা।

১৮১৮-এর ১৫ই মে ‘বঙ্গাল গেজেটির’ জন্ম, ১৮১৯-এর এপ্রিল মাসের প্রথম ভাগে গঙ্গাকিশোর চলে এলেন কলকাতা থেকে বহু দূরে নিজ গ্রামে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রায় পুরোটাই আলোচনার বাইরে চলে গেলেন। কেননা তাঁর সম্পর্কে ১৮১৮ মে-১৮১৯ এপ্রিল পরবর্তী সময়ে বিশেষ কিছু উল্লেখ গবেষণাপত্র গুলিতে পাওয়া যায়নি। গবেষকদের অনেকেরই ধারনা তাঁর পত্রিকা খুব সম্ভবত একবছর স্থায়ী হয়েছিল। 

কেন ‘বঙ্গাল গেজেটি’ নামকরন? এ প্রসঙ্গে সাময়িক পত্র গবেষক কেদারনাথ মজুমদারের মত, ‘এই বাংলা পত্রিকার নাম কেন বঙ্গাল গেজেটি রাখা হয়েছিল তাহার কোন কারন খুঁজিয়া পাওয়া যায়না। খুব সম্ভবত হিকির বেঙ্গল গেজেট নামের প্রভাব অতিক্রম করিতে পারে নাই’। এই মন্তব্য উল্লেখিত আছে যে গ্রন্থে সেই ‘বাংলা সাময়িক সাহিত্য’ কেদারনাত্থ মজুমদার প্রকাশ করেন ১৯১৮ সালে। বঙ্গাল গেজেটির প্রকাশ তারও এক’শ বছর আগে। আবার ব্রজেন্দ্রনাত্থ বন্দ্যোপাধ্যায় যে সব তথ্যসুত্রের উল্লেখ করেছেন সেখানে মনীন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি রচিত একটি প্রবন্ধের উল্লেখ করেছেন যেটি বাংলা ১৩০৪ সালের বৈশাখ সংখ্যায় ‘নব্যভারত’ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়- ‘১২২৫ সনের ১১ই জ্যৈষ্ঠ( ১৮১৮, ২৩শে মে) শনিবার, সমাচারপত্র বিভাগে বঙ্গভাষায় দ্বিতীয় পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়। এই সমাচার দর্পণ-এর জ্যেষ্ঠ একটি ছিল তাহার নাম বঙ্গাল গেজেটি’। 

গঙ্গাকিশোর বাংলা সংবাদপত্রের উপেক্ষিত নায়ক। গঙ্গাকিশোর বাংলা ভাষার প্রথম কোন গ্রন্থের প্রকাশক। বাংলা সংবাদপত্র এবং গ্রন্থ প্রকাশনা দুটোরই জনক তিনি। তবুও তিনি তাঁর সমকালে স্বীকৃতি পাননি। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মর্যাদা দেয়নি। স্বাধীন ভারতেও তাঁকে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে অনেক বিলম্বে। পাওয়া যায়নি বহু নথি এবং সর্বোপরি ‘বঙ্গাল গেজেটির’ কোন কপি। তবুও স্বাধীনতা পূর্ব বাংলার ইতিহাস লেখায় বহু প্রাবন্ধিকই উল্লেখ করেছেন তাঁর নাম। প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’–তে বাংলা গ্রন্থের এবং সংবাদপত্রের প্রথম প্রকাশক রূপে গঙ্গাকিশোরের নামোল্লেখ করেছেন লেখক-প্রাবন্ধিক বিনয় ঘোষ।                                                                    

গঙ্গাকিশোরের মৃত্যু ১৮৩১ সালে হয় বলে ধারণা করা হয়। যদিও এর কোন প্রত্যক্ষ প্রমান মেলেনি। 

আজ থেকে দু’শো বছর পূর্বে প্রকাশিত ‘বঙ্গাল গেজেটি’ কোন সাধারন ঘটনা নয়। বরং নবজাগরনের সূচনাপর্বে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে পরাধীন ভারতে এক বাঙালি যুবকের প্রতিস্পর্ধার প্রতীক। বাংলা সংবাদপত্রের পথিকৃৎ রূপে ‘বঙ্গাল গেজেটি’ এক ঐতিহাসিক মাইল ফলক। 

                    লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক