চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

বাংলা কাব্যে নববর্ষ


 

বাংলা কাব্যে নববর্ষ


প্রচ্ছদ স্কেচ............................... 


🔸 সুমিতা নাথ



লিখেছেন................................... 


🔸 অংশুমান কর

🔸 অন্তরা দাঁ

🔸 অভিজিৎ মিত্র

🔸 শুভেন্দু সাঁই

🔸 সুরমান আলি মল্লিক

🔸 অতনু হাজরা

🔸 শান্তনু সেনশর্মা

🔸 কল্যান দে

🔸 হাফিজুর রহমান 

"""""""""""'''""""""""""'''''''''''''''



বরষ ফুরায়ে যাবে 


অংশুমান কর 


আর

একটা নতুন পাখি দেখা যাবে হয়তো

কিংবা উপহার পাওয়া যাবে 

সেই পাখিটির একটি পালক যাকে দেখিনি অনেকদিন।

ছোটো পাহাড়ের তলদেশ থেকে ভেসে আসবে

ঘাসের বেঠোফেন।

নিশ্চয়ই কোনও একদিন দোতলা বাড়ির একতলা থেকে 

সুর করে কেউ আবৃত্তি করবে, "কিনু গোয়ালার গলি। দোতলা বাড়ির লোহার-গরাদ-দেওয়া একতলা ঘর

পথের ধারেই";

কিন্তু তাকে দেখতে পাবে না আমাদের পাড়ার কেউ।

মনে হয় দিগন্তের দিকে আরও একটু  এগিয়ে যাবেন মিমি দিদিমণি,

তিনি, মনে হয়, আরও গম্ভীর আর ময়ূর পালকের মতো আরও নীল ও সুন্দর হয়ে যাবেন।

আমার বেদনা আমাকে বেদনার থেকেই সান্ত্বনা দেবে বলে

নিশ্চয়ই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে একদিন।

আর আমি গুনব কবিতার মাত্রা, বন্ধুর সংখ্যা,

প্রণাম করার মতো পা।

সেসব যেন কেবলই কমে না-আসে।



################### 


আমার একলা বৈশাখে 
শুধু মনকেমনের ডাকে... 


অন্তরা দাঁ 


সকাল ছ'টায় প্রাত্যহিকীতে কে যেন গম্ভীর গলায় ঘোষণা করতেন, আজ পয়লা বৈশাখ অমুক বঙ্গাব্দ...  অমুক শকাব্দ... আজ সূর্যোদয় ভোর পাঁচ'টা বেজে অমুক সময়ে... সূর্যাস্ত...!  তখন রেডিও'র যুগ, সাদাকালো টিভি এসেছে তবে সে বাঁধাধরা সময়ের জন্য। 

"এসো হে বৈশাখ, এসো এসো " শুনে আধোঘুমে পাশ ফিরতেই, মায়ের সদ্য চান করে ওঠা 'বসন্তমালতীর গন্ধটা নাকে লাগতো, চোখ

খুলে দেখতাম কপালজোড়া সিঁদূরের টিপ, সে আমার সূর্যদেখা সকাল।  

ইস্কুল ছুটি, পড়ার তাড়া নেই। শেষ বসন্ত লেগে থাকা সেই সদ্য গরমের স্নিগ্ধ সকাল আমার প্রথম কৈশোরের দিনগুলো এক অননুভূত ভালোলাগায় মুড়ে দিয়েছিল। হলুদের ওপর গোলাপি ফুলছাপ একখানা কাগজের বাক্সের ভেতর অর্ধেকটা জুড়ে একটা মচমচে নিমকি, কটকটে মিষ্টি বালি বালি দানাদার, বোঁদের লাডডু, চৌকোমত ছানার গজা, আর পান্তুয়া, তাও পান্তুয়া সব প্যাকেটে থাকত না। সঙ্গে বাংলা পাঁজি ক্যালেন্ডার, লক্ষীঠাকুরের ছবি দেওয়া, যার ওপর প্রত্যেকবার মা হামলে পড়তো, বাড়ি আনার সাথে সাথে। দোকানে-আড়তে, সুতুলি দড়িতে গাঁথা, আমপাতা, গাঁদাফুল আর শোলার কদমফুলের শিকলি ঝুলতো! সে বেশ উৎসব উৎসব মনে হতো। দু চারখানা ভ্যারাইটি স্টোর্স, সত্যনারায়ণ জুয়েলারি, বিজয়া বস্ত্রালয়ে গিয়ে ক্যালেন্ডার, মিষ্টির বাক্স নিয়ে, রঙিন স্ট্র দেওয়া কোল্ডড্রিন্কসের সামান্য বিলাসিতা জড়ানো হালখাতা'র হাতছানি! বাড়িতে  নতুন হাতপাখা, লাল ফিতের ফ্রিল দেওয়া আর মাটির কুঁজোর জল, মাঝে মাঝে মিছরির সরবত খাওয়া হয় ওই জলে! সব ফল ধুয়ে মুছে বাড়ির মা-কাকীমা'রা কেটে রাখতো কলাপাতায়, তরমুজ, ফুটি,কাঁকুড়, পেয়ারা, আপেল তো আছেই! ভোরবেলা পুকুরে জাল পড়তো, জেলে, মুনিষ,কাজের লোকজন সব বাড়িতেই পাত পাড়তো দুপুরে। দু চার রকম ভাজা, কুমড়ো ফুলের বড়া,এঁচড়ের কোপ্তা, সুকতো, গোপাল-ঘন্ট মাছের মাথা দিয়ে সোনা-মুগের ডাল,মাছের দু-তিন রকম পদ, কাঁচা আমের চাটনি আর ঘরে পাতা টকদই, মোটাদানার লাল চিনি ছড়ানো। বিকালে গন্ধরাজ-লেবু চটকে ঘোলের সরবত আর রাতে পাঁঠার মাংস। 

সেই যে কৃষ্ণচূড়া দিনগুলো, দাদামশায়ের আঙুল ধরে বেড়ে ওঠা শৈশব, সময়ের হরজাই স্রোতে বানজারা নদীর মত ভেসে গেছে, তা গেছেই, আর চাইলেও ছুঁতে পারিনা। 

আমার পয়লা বৈশাখ, মায়ের হাতের গোল সাদা শাঁখার মত পড়ে থাকে একলা, উদাসীন। 


################


মনবসন্ত 


অভিজিৎ মিত্র 


যার চুল বিদিশায় ওড়ে 
              তার খোঁপায় পলাশের জাদু 
যার মুখে দু’এক দানা ক্লান্ত গুমোট 
              তার চোখে ঝিলের বাতাস 
যে হাতে হাত রাখতে গিয়ে কেঁপেছে 
              শীতশেষ ষোলোর বসন্ত 
যাকে বলতে গিয়ে ফিরে এসেছে 
             আমার বয়স আরো গুটি গুটি পায় 
             তার বারান্দায় আজ বৃষ্টি এল... 
স্মৃতি খুলে যে হেঁটে চলে গেছে 
যার কোন ঘর নেই আরব সাগরে 
             শুধু সেই জানে 
             তার জন্য একবাটি বৈশাখ 
             তুলে রেখেছি   


##################


" নববর্ষ : তখন আর এখন" 


শুভেন্দু সাঁই 


তখন --

নববর্ষ মানে মায়ের পুজো,

চন্ডীতলা, নারায়ণ মন্দিরে।

সবাই যেন ভালো থাকি।

নতুন খাওয়া। নতুন জামা। 

ঠাকুমা বলতেন, বছরের প্রথম দিন।

যা করবি, যা বলবি, 

সেটাই সম্বৎসর চলবে। 

মিথ্যা কথা বলতে ভয়,

মিষ্টি খাওয়া, কথা বলার চল।

সকাল যেন নতুন নতুন ভাব,

মনটা যেন নতুনে মোড়া।

বিকেল বেলায়-

সুধির বেনের মিষ্টির দোকান,

এক টাকার পাখির ডিমের রসগোল্লা,

জিলিপির সাথে জিভে-গজা।

সে স্বাদ আজও লেগে জিভে। 

সন্ধ্যে হলে, বাবার সাথে-

মুদির দোকান, অভয়া বস্ত্রালয়,

ছোট্ট মোড়া মজার প্যাকেট। 

এটাই যে 'নতুন খাতা'।

পুরানো ধার-দেনা,  সব- 

মিটিয়ে দেবার দিন। 


আর এখন --

মা এখনো দেয় সেই পুজো,

ঠাকুমার কথা,  মনে গাঁথা।

নতুন খাতার বালাই নেই,

আধুনিকতার চরম ছোঁয়া। 

মধ্যরাতে মোবাইল বিজি,

হাজার ম্যাসেজের ভিড়।

হোয়াটস্যাপ-ম্যাসেঞ্জার মেমরি ফুল,

হরেক মিথ্যার ফুলঝুড়ি,

ডিজাইনের ইমোজিতে

আর টিকটকে। 

দুপুরে গরম ভাতের ঢেঁকুর তোলা-

গলা ভিজানো কোল্ড ড্রিনক্স।

ঝাঁঝ নেই নতুনের। 

ঠান্ডা ঘরে ভাত ঘুম।

রঙিন পোশাকে বাইরে ঘোরা,

রোদ চশমায় চোখ বন্ধ।

সন্ধ্যে নামলে এদিক-ওদিক,

রাতে ঐ রেস্টুরেন্ট।

ঠাণ্ডা গরমে নতুন দিন গেল কেটে-

আর পাঁচটা দিনের মতো। 


তখন আর এখন

যাই হোক, 

নতুন বছর শুরুর দিন। 

নতুন করে, নতুন ভাবে।

ভালো কাটুক, সুখে কাটুক

আগামী তিনশো পঁয়ষট্টি টা দিন-- 


#################


আমিও অপেক্ষায় আছি


সুরমান আলি মল্লিক 


আগুন জলের অপেক্ষায় 

একদিন নিভে যাবে ঠিক 

দাউদাউ দহনে পড়বে প্রলেপ 

শুশ্রূষা- উপশম অধিক.... 


চৈতালী শেষ রাগে

জাগুক স্বপ্ন নতুন করে

বোশেখের গানে গানে

ছড়াক ভাতৃত্ব ঘরে-দোরে..... 


ঝড় যাক থেমে

ধরা বুকে খেলে যাক

শান্তির শীতল হাওয়া

আর নয় প্রাণ ক্ষয়

আগুন নেভাতে হোক

বসে কথা কওয়া..... 


আমিও অপেক্ষায় আছি.... 

নববর্ষের হাত ধরে __

মুছে যাবে পিছনের সব ক্ষত 

বাঁচার গান বাজবে নতুন করে.... 


##################


এসো বৈশাখ 


অতনু হাজরা 


সেলের বাজারে প্রচুর ভিড়,

দোকানে দোকানে লাল খাতার সারি,

সারি দিয়ে সাজানো গণেশ লক্ষ্মীর মূর্তি,

মিষ্টি গড়ার কারিগর ব্যস্ত লাড্ডু তৈরিতে,

পাতা ঝরে যাওয়া গাছেতে আবার সবুজ কিশলয়,

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি,

নাচ গান কবিতা আবৃত্তি জমজমাট,

ফিকে হওয়া সম্পর্কে নতুনের ছোঁয়া,

নতুন উদ্যম নতুন করে আবার বাঁচতে চাওয়া,

    বৈশাখ সমাগত।


##################


নতুন প্রভাতে 


শান্তনু সেন শর্মা 


আজি এ নতুন প্রভাতে

উদিত সূর্যালোকে-

আলোকিত এ বিশ্ব

প্রাণময় হয়ে ওঠে,

নবীনেরে করি আহ্বান-

গাই জীবনের জয়গান।

শত আশা

আর ভালোবাসা,

দুহাত উজাড় করে

দিয়ে মানুষেরে- 

আজি টেনে নিই কাছে,

যারা ভুল করিয়াছে

সে ভুল ভাঙায়ে

তারেও নিই ডেকে বুক-মাঝে,

পথে বা বিপথে

যে বা যারা গেছে

সকলেরই আপন করি

আজি এ প্রভাতে।

নতুনেরই করি বরণ

করি আবেদন-

এসো সব ভেদ ভুলে

এ মানবকুলে

নিষ্পাপ হই সকলে।

মনে যা আছে ক্লেদ

পড়ুক সেথা ছেদ,

থাক বুকভরা ভালোবাসা

আর অনন্ত আশা।

এ নবীন ভোরে

সকলের দোরে

করি দাঁড়ায়ে নিবেদন-

এ বিশ্ব হোক

শান্তির নিকেতন। 


###################


মানুষ এবং মনুষত্ব 


কল্যাণ দে 

                   

কপালে তিলক কেটে, মাথায় ফেট্টি বেঁধে দরজার খিল দিয়ে মনকে বেধড়ক ঠেঙিয়ে যাচ্ছে গিরগিটি ডাকাত 

তবু নির্বীকার চিত্তে মত্ত হয়ে প্রকৃতির প্রেমে মশগুল ... 

বিছানায় রক্তের সাথে বুলেটের গড়াগড়ি 

কংক্রীটের ছাদ গনগনে আগুনে ফেটে চৌচির

বাঁ পাশ থেকে বিবেক পোড়ার গন্ধে গা বেয়ে বমি গড়াচ্ছে

ডান পাশে সতীচ্ছদ ছেঁড়ার যন্ত্রণার গোঙানীতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হতে চাইছে পাষান বুকের মধ্যস্থল

ঘরের সুদৃশ্য শো কেসে ঝুলছে দামী   নির্লজ্জের নোংরা গিলে করা বাসন্তী রঙা পাঞ্জাবী 

নববর্ষ উদযাপনে ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় এবার  কবিতা পাঠের পালা।


################# 


কামনা 


হাফিজুর রহমান 


নববর্ষের বর্ষণে আজ

ধুয়ে যাক ,মুছে যাক,

পৃথিবীর বুকে জমে থাকা

যত বিদ্বেষ, যত গ্লানি। 


পলাশের বনে নতুন সংসার হোক

যত মান-অভিমান দুঃখ যন্ত্রণার।

প্রতি আঙ্গিনা মুখরিত হোক

বিশুদ্ধ তুলসীর বাতাসে। 


হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের বন্ধন হোক

মানবিকতার মনুষ্যত্বের মূল্যবোধের।

স্বার্থের জাতি ধর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে

ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হোক সকলে। 

নববর্ষে সেই কামনা।।

###################