পুলিশী তদন্ত : কে ভালো আর কে মন্দ
🟣 দিলীপ রঞ্জন ভাদুড়ী
➡️ বগটুই কান্ড ও ঝালদা কাণ্ডের পর কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা আর রাজ্য তদন্তকারী সংস্থা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কে নিরপেক্ষ ও কে কত ভালো ? রাজ্য সরকার কোনওদিন সি বি আই তদন্ত'র পক্ষপাতী নয়। তাঁরা সিট বা সি আই ডি তদন্তের পক্ষপাতী। কেউ কেউ বলেন এঁরা সি বি আই থেকে অনেক দক্ষ। কিন্তু, বিরোধী দলগুলো সব সময় সি বি আই তদন্তের দাবী করেন। রাজ্য সরকার না চাইলে কেন্দ্রীয় সংস্থা কোনও তদন্ত করতে পারেন না।তাই আজকাল সি বি আই তদন্তের জন্য রাজ্য পুলিশের কাজকর্মে তিতি বিরক্ত ব্যাক্তিগন মহামান্য হাই কোর্টের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এরমধ্যে বেশ কিছু কেস মহামান্য হাইকোর্ট সি বি আই এর হাতে তুলে দিয়েছেন। কাজেই কে ভাল বা কে মন্দ, এই নিয়ে তর্ক। শাসক কে সেটাই বড় কথা। কেন্দ্রে বি জে পি আর রাজ্যে টি এম সি। ধরেই নেওয়া হয় রাজনৈতিক চাওয়া বা পাওয়া সব কিছুতেই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। তাই আইন আইনের পথে চলবে বলা যত সহজ, আসলে ওটা কথার কথা। চাকরী টাই রুজি রুটির জন্য। ভেবে চিন্তে চলতেই হয় উভয়েই পুলিশ সংস্থা। একে অপরকে সাহায্য করার কথা। যে কোনও কেসে রাজ্য পুলিশ আগে তদন্ত শুরু করে আর কার্য কারনে সি বি আই তদন্ত নিতে কিছু দেরী হয়েই যায়। ফলে বহু সূত্র নষ্ট হয়েই যায়। আর রাজ্য পুলিশ জড়িত থাকলে তো আর কথাই নেই। তবে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ কতটা দক্ষ, অভিজ্ঞ ও প্রাথমিক তদন্তে পারদর্শী সেটাই বড় কথা। তারপর প্রশ্ন সততা ও কতটা অকূতভয়।
পুলিশে এখন মাথা ভারী প্রশাসন। বহু ডিজি, বহু এ ডি জি, বহু আই জি, বহু স্পেশাল আই জি, বহু ডি আই জি, বহু এস পি বা কমান্ডেন্ট, বহু এডিশনাল এস পি, বহু ডি এস পি, বহু ইন্সপেক্টর, বহু সাব ইন্সপেক্টর, বহু এ এস আই। বহু বিভাগ। পুরুষ কনস্টেবলের সংখ্যা যথেষ্ট কম। মহিলা পুলিশের সংখ্যা মোটামুটি ভাল। ট্রেনিং সময় কমে গেছে। পাঠ্যসূচির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। প্রমোশন আগের চাইতে দ্রুত। হাউজিং সমস্যা অনেক কম। বেতন কাঠামো অনেক ভালো। চলাচলের পথ আগের চাইতে অনেক সহজ। ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেশি কাজ কর্ম হয়। আধার কার্ডের দৌলতে সনাক্ত করন অনেক সহজ। আসামী বা পলাতক ব্যক্তিদের ট্র্যাক করা এখন অনেক সহজ। পুরুষ পুলিশের সংখ্যা কমলেও সিভিক পুলিশ, গ্রীন পুলিশের সংখ্যা অনেক বেশী। প্রতিটি থানার আয়তন খুব বেশী নয়। সি সি ক্যামেরা প্রায় অধিকাংশ স্থানেই বর্তমান। এখন আর অষ্টম শ্রেণী পাশ নয় বহু উচ্চ ডিগ্রী ধারীরা পুলিশে কাজ করছে। বর্তমান সরকার পুলিশের মধ্যে অনেক আধুনিকতা এনেছেন। খুব একটা অসুবিধাজনক জায়গায় নেই বঙ্গ পুলিশ।আইনে নানা পরিবর্তন এসেছে। পুলিশের গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে কিছু বিধি নিষেধ এসেছে। পুলিশ যাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার তাঁকে নোটিশ পাঠিয়ে ডেকে আনছেন। আগে মহিলাদের ও বয়স্ক বৃদ্ধদের বাড়িতে গিয়ে বা তাঁদের কর্মস্থলে গিয়ে জিজ্ঞাসা বাদ করতে হত। এখন ওসব আর নেই। অনেক শর্টকাট পদ্ধতি এসে গেছে। ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে বলতে পারব না। পুলিশের জীবন যাত্রার মান এখন নিঃসন্দেহে অনেক উন্নত ও কেতা দুরস্ত। পুলিশ ও সমাজ অনেক কাছাকাছি। জন সম্পর্ক অনেক উন্নত। এহেন বর্তমান পুলিশ চাইলে অনেক কিছু করতে পারেন। কিন্তু, আজকাল মানুষ একটু অসুবিধা হলেই পুলিশের উপর আস্থা হারাচ্ছেন। পুলিশে বিপদে পড়লে কেউ কারও পাশে দাঁড়ায় না। নিজেদের মধ্যে হিংসা হিংসি চিরকাল ছিল, এখনো আছে। ফলে প্রশ্ন উঠতেই পারে তাহলে পুলিশ নিজেরা কতটুকু ভাল আছে।
বেশ কিছু টা পিছিয়ে শুরু করা যাক। গঙ্গাধর ভট্টাচার্য ছিলেন তিলজলা থানার আই সি। অত্যন্ত সৎ, দক্ষ ও কর্তব্য পরায়ণ ছিলেন তিনি। ৩০ শে এপ্রিল, ১৯৮২ সালে বিজনসেতু হত্যা কাণ্ডে ১৭ জন আনন্দ মার্গী সন্যাসীকে শিক্ষামূলক আলোচনা সভায় তিলজলায় যাবার পথে একদল দুষ্কৃতী ট্যাক্সী থেকে টেনে নামিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। বর্বরতার চরম নিদর্শন ছিল সেই ঘটনা। ৩১শে অক্টোবর,১৯৮৩ সালে গঙ্গাধর ভট্টাচার্য কর্তব্যরত অবস্থায় গুলিতে নিহত হন। তাঁকে পিছন থেকে 303 বুলেট দিয়ে গুলি করা হয়েছিল। এই নিয়ে মহামান্য বিচারপতি অমিতাভ লালা'র কমিশনে তাঁর স্ত্রী মমতা ভট্টাচার্য সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তাঁর পিঠে মোট ৪ টি বুলেটের আঘাত পাওয়া গিয়েছিল। আনন্দমার্গী হত্যা কেস তদন্ত করেছিল সি আই ডি। তবে আই সি গঙ্গাধর বাবুর হত্যা কান্ড কোন সংস্থা তদন্ত করেছে জানি না। গঙ্গাধর বাবুর পরিবার বিচার পান নি, বলেই শুনেছি। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ছিল না।
পুলিশে কর্তব্য করতে গিয়ে প্রাণ দেওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। ইং ২০০৫ কুচবিহারে গ্রেটারের আন্দোলন চলছিল। মারমুখী জনতাকে রুখতে গিয়ে কালিম্পঙের এডিশনাল এস পি মুস্তাক আহমেদ গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। সেই কেসে বহু আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার হলেও, বিচারে সবাই খালাস হয়ে যায় বলে শুনেছি। ইং ২০১৪ সালে দুবরাজদিঘী থানার সাব ইন্সপেক্টর অমিত চক্রবর্তী কর্তব্যরত অবস্থায় বোমার আঘাতে গুরুতর জখম হয়। মাস খানেক চিকিৎসা করেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। যাই হোক বীরভূম জেলায় চাইলেই পুলিশের পক্ষে গ্রেপ্তার করাটা মোটেই সহজ নয়। জেলা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে মোট ১৮ জনকে দোষী বলে চার্জশিট দেয়। সব পুলিশের সাক্ষ্য গ্রহনের সময় সবাই সব কিছু ভুলে যান। অথচ তাঁর পুলিশ দলের সামনেই তাঁকে বোমা মারা হয়েছিল কেসটি বেকুসুর খালাস হয়ে যায়। ইং ২০১৩ সালের অক্টোবরে এক সঙ্ঘর্ষে সাব ইন্সপেক্টর অমিতাভ মালিক গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সাথে লড়াইয়ে প্রাণ হারান। তাঁকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাহ করা হয়েছিল। ৬টি এ কে ৪৭ রাইফেল, পিস্তল, ৫০০ রাউন্ড গুলি ও বিস্ফোরক ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। সি আই ডি এই কেসে বিমল গুরুং ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। কিন্তু, মামলা টি সরকার রাজনৈতিক কারণে তুলে নেন। এসব হল অধস্তন পুলিশের কেস। এবার বলছি সব চাইতে লোম হর্ষক বিনোদ মেহতা আই পি এস ডি সি পোর্ট সাহেবের দেহ রক্ষী মুক্তার আলীর হত্যা কান্ড ইং ১৯৮৪ সালের ১৮ মার্চ। গার্ডেন রিচ এলাকায় তাঁদের কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। মূল আসামী ইদ্রিস আলীকে পুলিশ ধরলেও তাঁকে পিটিয়ে হাজতেই মারা হয়েছিল। এটা বাঞ্ছনীয় নয়। আইন হাতে তুলে নেওয়া। বহু জন সন্দেহ ভাজন কে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তারমধ্যে কিছু নাবালক ছিল। বিচার পর্বে ৪ জনের ফাঁসির হুকুম হয়। সবাই আপিল করে মহামান্য হাইকোর্টে। তখন দু'জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। তারপর এক জন মারা যান। বাকি একজন সর্বোচ্চ আদালতের বিচারে খালাস পান। এখনও নাবালক কজনের বিচার বাকি। শুনছি নথি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই তো কপাল। মেহতা সাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর অভাগিনী স্ত্রী ও শিশু পুত্র কলকাতায় থেকে গিয়েছিলেন। তাঁদের খোঁজ ক'জন রাখেন জানি না।
জরুরী অবস্থা জারি হবার পর নকশাল আন্দোলন চলাকালীন বহু পুলিশের মৃত্যু হয়েছে। কোনও হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কিছু পাওয়া যায়নি। হত্যার বদলা ছিল হত্যা। বহু নিরীহ লোকের মৃত্যু হয়েছে। নানা আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ও পুলিশের দৃষ্টি ভঙ্গী, সময়ের সাথে পাল্টেছে। না, তাই বলে সব কেসে বিচার পাওয়া যায়নি তা নয়। পুলিশ সার্জেন্ট বাপী সেন পাঁচ মদ্যপ পুলিশ কনস্টেবলকে জনৈকা মহিলার সাথে অসভ্য ব্যবহার করতে বাধা দিলে, প্রকাশ্য রাস্তায় পিটিয়ে তাঁকে মেরে ফেলে। এই কেসে সবার যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে।ভদ্রেশ্বর থানার বড়বাবু ভোলানাথ ভাদুড়ী হত্যা কাণ্ডে সি আই ডি তদন্ত করেছিল। দু'জনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। আসল কথা হল, তদন্তের ফাঁক ফোকর না থাকা, সাক্ষীর বয়ানের বিশ্বাস যোগ্যতা, সরকারী কৌশলীর যোগ্য মামলা পরিচালনার উপর সব কিছু নির্ভর করে। সততা হল আসল কথা। কে ভালো বা কে মন্দের ব্যাপার নয়। একক প্রচেষ্টায় কেউ তদন্তে সাফল্য লাভ করতে পারে না। রাজ্য পুলিশের বিশেষত জেলা পুলিশের তদন্তের ধার অনেক কমে এসেছে। এ এস আই বাবুদের হাতে তদন্তের ভার তুলে দেওয়া হয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষা দান না করেই এই কাজ হয়েছে। ফলে যা হবার হচ্ছে। তদারকি নেই বললেই চলে। অপকীর্তিতে পুলিশের জুড়ি মেলা ভার। বহু ভালো কাজ একটি দুটি খারাপ কাজের জন্য জনমানসে বিশ্বাস জোগাতে পারছে না।
বহু সৎ পুলিশের জীবন ভুল বিচারে স্তব্ধ হয়ে গেছে। চাকরী জীবনে কোনও কেস হলে টেকনিক্যাল কারনে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়। অনেক ক্ষেত্রেই উপযুক্ত কারন ছাড়াই চিরকালের জন্য ছাঁটাই হয়ে যায়। পরে দেখা যায় সে বেকুসুর খালাস পেয়েছে। সব সরকারী কর্মচারী দের জন্য বিভাগীয় তদন্তের বিধি আছে। পুলিশ বিভাগের নিম্নস্তরের জন্য সেই বিধি প্রযোজ্য নয়। বিভাগীয় পুলিশ প্রধান যা চাইবেন, তাই করার অধিকারী। পুলিশের ভিতরে সব সময় পুঞ্জীভূত ভয়। ছুটি চাইলে ছুটি পায় না। নিজের পরিবারের ঠিক মত দেখাশুনা করতে পারে না। এই তো পুলিশের জীবন। পুলিশের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা খুব কম নয়। কি কারনে কে আত্মহত্যা করছেন, তার কারণ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে এই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, নানা অভাব অভিযোগ, কাজের চাপ পুলিশের জীবন বড় সুখময় নয়। এর থেকে বেড়িয়ে আসার পথ নেই।
পুলিশ কারও নয়। যে সরকার যখন আসে তখন তাঁর। এটাই নিয়ম। এই ধারা বদলে নিজেকে স্বাধীন ও বিরল ভাবলেই বিপদ। যে সরকার যেমন পুলিশ কে চালাবেন, তেমন চলতে হবে। বলতে পারবেন, কোন দপ্তর ঘুষ খায়না অথচ, সবাই দোষ দেয় পুলিশের। পুলিশের সত্যি করে কোন স্বচ্ছ ভাবমূর্তি আছে কি? থাকলেই আশ্চর্য হবো। অভিযোগ হলে যতদূর সম্ভব নিচুস্তরে কাউকে বলির পাঁঠা বানিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হয়। রাজনৈতিক অভিযোগ, অভিসন্ধি, বাধ্য বাধকতা, নানা চাপ, অশান্তির জবাব পুলিশকেই দিতে হয়। কে ভালো, কে মন্দ তার রাজনৈতিক ব্যখ্যা নানা রকম। কিন্তু, পুলিশ সময়ের দাস। সবার চাইতে আলাদা।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি পুলিশ সুপার ও আইনজীবী।