নেশা # Intoxication
🟣 বিশ্বরূপ দাস
➡️ নেশা হলো নিজের প্রতি নিজের অত্যাচার। সে এমন এক জিনিস যে তার সামনে সবকিছু ভালোকে সমূলে বিনাশ করে দেয়। ক্ষনিক আনন্দ ডেকে আনে চিরদিনের নিরানন্দ। একবার এই জগতে ঢুকে পড়লে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা খুবই দুষ্কর ব্যাপার।
নেশার ভালো-মন্দ দুই রয়েছে। আমি ভালো নেশার কথা বলছি না, বলছি সেই সব মন্দ নেশার কথা যার জন্য যুব সম্প্রদায় বিপথগামী হয়। অকালে ঝরা কুসুমের মতো ঝরে যায় তাদের জীবনের সব স্বপ্নগুলি। তখন অলির কথা শুনে বকুল হাসে না। নিজের অজান্তেই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় ধীরে ধীরে। ঠিক এভাবেই একদিন সে অন্ধকার জগতে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হয়। সেই সময় শুরু হয় নানান মানসিক প্রক্ষোভ। অভিভাবক এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে শুরু হয় দ্বন্দ্ব সংঘাত। নিজের উপর নিজের বিতৃষ্ণা আসে। ধীরে ধীরে বন্ধুবান্ধব বিচ্ছিন্ন হয়ে সে সম্পূর্ণরূপে হয়ে পড়ে একা। আর তাকে ঘিরে অভিভাবকদের যে স্বপ্ন ছিল তা অধরাই থেকে যায় চিরদিনের জন্য।
সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করার মুহূর্তে বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে এই ধরনের কু নেশায় পড়ে। বিড়ি, সিগারেট, চরস, গাঁজা, মদ, খৈনি, গুটকা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে নানা ড্রাগ আসক্ত হয়ে পড়ে যুব সমাজ। তার সাথে হাত মেলায় নানা ধরনের পর্ন ভিডিও, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্ট্রাগ্রাম, অনলাইন গেমস এর মতো নানা মোহময় জিনিসের সীমাহীন আকর্ষণ। প্রথমে নিদারুণ কৌতুহল থেকেই এ ধরনের নেশা হয় হাতেখড়ি যা বেশিরভাগ সময় বাবা-মা জানতেও পারেন না।
বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে নেশা করার সহজ পাঠ নিয়েই একদিন তারা এই বিষয়ে ওস্তাদ হয়ে ওঠে। সেদিনের সেই ছোট্ট কিশলয় সবার অজান্তে নেশার আখড়ায় ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে মহীরুহে পরিণত হয়। তখন তাদের দমানো মুশকিল। নানাভাবে ডালপালা ছেঁটে দিলেও আবার সে মাথা তুলে দাঁড়ায়। তখন "চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী"। নেশার জন্য প্রথমদিকে বন্ধুবান্ধবের সাহায্য পেলেও পরে পয়সা জোগাড়ের জন্য সে বাড়ির মধ্যে চুরি চাপটা করতে শুরু করে। ধরা পড়লেই শুরু হয় অশান্তি গন্ডগোল। বাড়িতে কোনভাবে পয়সা না মিললে সে তখন বাইরে কোন অপকর্ম করে পয়সা উপার্জনের মরিয়া প্রচেষ্টা করে। তার তখন মনে হয় আমি শেষটা দেখেই ছাড়বো। নেশায় নেশায় বুঁদ হয়ে জীবনটাকে উপভোগ করে নেব।
পড়াশোনার কথা তখন তার একদম মাথায় থাকে না। বাবা মাকে তার শত্রু বলে মনে হয়। নেশাখোর বিপথগামী বন্ধুদের সে তখন তার ইহকাল পরকাল বলে মনে করে। তাদের কথা তখন তার কাছে বেদবাক্য, অন্য কারো কথা শুনতে চায় না, মানতে চায় না। আবার কখনো কখনো একটা অবচেতন মন তাকে বলে "তুই ফিরে আয় ফিরে আয়।' কিন্তু ফিরব বললেই কি আর ফেরা যায়। আসলে এই নেশার পথ এমন পথ যেখানে যাওয়াটা সোজা কিন্তু ফিরে আসাটা বড্ড কঠিন। কারণ এর পাতায় পাতায় রয়েছে এমন এক রস যা মানুষকে স্নায়বিক ভাবে এবং মানসিকভাবে বশীভূত করে ফেলে। সে কারণে অনেক বয়স্ক লোককেও দেখেছি খারাপ জেনেও তারা এটা ছাড়তে পারছেন না। কখনো টেনশনের দোহা দিয়ে, কখনো মানসিক উদ্বেগের কথা বলে দিব্বি বিড়ি সিগারেটে সুখ টান দিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। আর হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া, যক্ষা থেকে শুরু করে নানাবিধ রোগের শিকার হচ্ছেন এবং পার্শ্ববর্তী লোককেও সেই একই রোগে আক্রান্ত করছেন। সাথে সাথে নিজের কষ্টার্জিত পয়সা ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। অথচ এই পয়সাটা থাকলে অনেকেরই বাড়িতে নুন ভাতটা হত, কিংবা ছোট্ট মেয়েটির জন্য নিদেনপক্ষে একটা পুতুল কিনে দেওয়া যেত।
আসলে জ্ঞানপাপী আমরা অনেকেই। জেনেও না জানার ভান করি। নেশা ছাড়ার বিপক্ষে নানান অজুহাত দিয়ে বলে থাকি - মরতে তো একদিন হবেই, তাই খেয়েই মরি। অমুকের এত বছর বয়স হল দিব্যি সুখে সিগারেট বিড়ি খেয়ে যাচ্ছেন তার যখন কিছু হয়নি তখন আমার হবে না। পৃথিবীতে ভোগ করতে এসেছি ভোগ করে যাই।
আবার অনেকেই নেশা ছাড়বো ছাড়বো করেও ছাড়তে পারেন না। নেশা ছাড়ার জন্য নির্দিষ্ট দিনক্ষণ দেখেন। দুঃখের কথা ক্যালেন্ডারের পর ক্যালেন্ডার পেরিয়ে গেলেও তাদের সেই সুদিন আর আসে না। তাই দেখা যায় জ্বলন্ত বুকে সিগারেট চুমুক নয়তো হুইস্কির বোতলে আদুরে মুখ।
১) নেশা ছাড়তে হলে প্রথমেই মনটাকে শক্ত করতে হবে। মনে মনে সংকল্প করতে হবে যত বিপদই আসুক আগামীকাল থেকে আমি আর নেশাদ্রব স্পর্শ করবো না।
২) নেশাগ্রস্ত বন্ধুবান্ধবের কাছে কিছুতেই যাবো না। গেলেও ব্যক্তিগত অসুখের দোহাই দিয়ে সেই জিনিস গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩) একটু একটু করে কমিয়ে কখনোই সম্পূর্ণ নেশা কমানো যায় না বা ছাড়া যায় না। বরং তাতে চাহিদাটা আরো বেড়ে যায়। তাই ছাড়তে হলে একেবারেই ছাড়ুন।
৪) অনেকে আবার সিগারেট বিড়ি না খেলে পটি ক্লিয়ার হয় না। এগুলো একদম বাজে কথা, সম্পূর্ণ মানসিক ব্যাপার। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম একদিন হবে না, দুদিন হবে না এক সপ্তাহ হবে না তাতে কি এমন ক্ষতি হবে। তারপর দেখবেন সবকিছু নরমাল হচ্ছে।
৫)আচ্ছা ভাবুন তো আপনার ঠান্ডা সর্দি লেগেছে এবং প্রচন্ড কাশি হচ্ছে। আপনি কি সেই সময় নেশাভাঙ করবেন? নিশ্চয়ই না। সেই পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে আপনার নেশা ত্যাগ করা উচিত।
৬) নেশা ত্যাগ করার পর সত্যি সত্যি নানাভাবে মানসিক প্রক্ষোভ তৈরি হয়। ঠিক এ সময়ে মনোবিদ এবং ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
৭) নেশা ত্যাগ করার উপায় হল নিয়মিত শরীরচর্চা এবং যোগ ব্যায়াম করা। যোগের দ্বারা শুধু শরীর সুস্থ হয় না নানাবিধ রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং নেশার প্রতি আসক্তি তীব্রভাবে কমে যায়।
৮) মনে রাখতে হবে মাদকদ্রব্য সেবনে কখনো কারো কোন উপকার হয় নি, হয়নি সমস্যার সমাধান। বরং তা হয়ে উঠেছে সমস্যা বাড়ানোর বীজ মন্ত্র।
৯) নেশা জ্বালা মেটায় না, জ্বালা বাড়ায়। তাই সুস্থ-সুন্দর পথে ফিরে আসার জন্য যারা নেশা ছেড়েছে বা নেশা করে না তাদের জীবনাদর্শ পড়া দরকার। তাদের সাথে মেশা দরকার।
১০) ছাত্র-ছাত্রীদের মনে রাখা উচিত তুমি নেশাকে একবার ছুঁলে সে তোমাকে বারবার ছোঁবে। না পারলে শেষকালে সে ছোবল মেরে ঢেলে দেবে তার বিষাক্ত কালকুট। তাই অলিক কিছু পাবার আশায় ভুল করেও এপথে তোমরা পা দিও না। ঠিক সেই কারণেই বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয় স্তরে নেশার সুফল ও কুফল নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা প্রয়োজন।
১১) তবে অনুগ্রহ করে "লুকিয়ে নেশা ছাড়ান" - এ ধরনের প্রতারণার ফাঁদে কখনোই পা দেবেন না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই নেবেন।
১২) পাবলিক প্লেসে নেশা ভাঙ করা নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও নেশা কিন্তু বন্ধ হয়নি। চোখ খোলা রাখলেই আপনি দেখতে পাবেন হাটে মাঠে ময়দানে অফিসে স্কুল কলেজ চত্বরে নেশা ভাং চলছে রমরমিয়ে। তাই সরকার এবং প্রশাসনকে আরও সচেতন ও কঠোর হতে হবে এ বিষয়ে। পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোকেও নিতে হবে সক্রিয় ভূমিকা। তবেই আমরা একটি নেশা মুক্ত জেলা, রাজ্য এবং দেশ গড়ে তুলতে পারব। নেশা মুক্তির জন্য চাই সকলের সদর্থক ভূমিকা। চাই আন্তরিক ইচ্ছা এবং যথাসময়ে সক্রিয় পদক্ষেপ। যা একটা জীবনকে সত্যিই বদলে দেবে।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক