চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

বাঙালির অদ্বিতীয় মহানায়ক : উত্তমকুমার

 


বাঙালির অদ্বিতীয় মহানায়ক : উত্তমকুমার


 🟣 অভিজিৎ মিত্র


 ➡️  ব্যায়াম করা ঋজু চেহারা, প্রায় ৬ ফুট, ব্যাকব্রাশ চুল, মুখের ভেতর যেন নিঃশব্দে রোমান্টিক আর নায়ক কথাদুটো লেখা আছে, হাসির জাদু, চোখের চাউনি অর্ধেক ডায়লগ বলে দিতে পারত, নায়কোচিত গলার স্বর, অভিনয়ে যাত্রাপালার ছাপ নেই এবং স্ক্রিনে ওনার উপস্থিতি বাকি অনেক কিছুই ঢেকে দিত – এই ছিলেন উত্তম কুমার (আসল নাম অরুন কুমার চ্যাটার্জী)। বাংলা সিনেমার মহানায়ক। সেই সময়ের মহানায়ক, যখন স্বাধীনতার পর বাংলা সিনেমা অর্থনৈতিক কষ্টে ধুঁকছে। বাংলা সিনেমার বাণিজ্যে স্বর্ণযুগ কে নিয়ে আসবে সেই দিকে সবাই চেয়ে বসে।

আজ বেঁচে থাকলে ওনার বয়স হত ৯৫ বছর। দুর্ভাগ্য, মাত্র ৫৩ বছর বয়সেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে উনি মারা যান। সেটা ছিল তিন নম্বর অ্যাটাক। তাছাড়া সেই সময়, ১৯৮০ সালে, তখনো বাইপাস সার্জারি কলকাতায় সেভাবে হত না। কিন্তু এটা ঠিক, উনি মরে গিয়ে চিরকালের জন্য বাঙালির মনে মহানায়ক উত্তম কুমার (৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ – ২৪ জুলাই ১৯৮০) হয়েই বেঁচে রইলেন। একমেবাদ্বিতীয়ং।

উত্তম কুমার কিন্তু রাতারাতি মহানায়ক হন নি। ১৯৪৮ থেকে শুরু করে কয়েকটা ফ্লপ ছবির পর একের পর এক হিট সিনেমার মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের জায়গা পাকা করেছেন নায়ক হিসেবে। জুটি বেঁধেছেন সুচিত্রার সঙ্গে। ১১৩ টা সিনেমার ভেতর দিয়ে বাংলা ছবিকে টেনে অনেক ওপরে তুলে আনার পর ১৯৬৬-তে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় করেছেন ‘নায়ক’। তদ্দিনে তিনি সত্যিই মেনস্ট্রিম বাংলা সিনেমার মহানায়ক, যার কাঁধে ভর দিয়ে প্রায় গোটা ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে কোন ধরনের লিড রোলে ওনাকেই পছন্দ করা হচ্ছে। ওনার বয়স তখন মাত্র ৪০। সত্যজিৎ-ও বলেছিলেন এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট উনি উত্তমকুমারকে মাথায় রেখেই লিখেছিলেন এবং উত্তম ‘না’ বলে দিলে উনি এই সিনেমা করতেন না। মৃত্যুর আগে অব্ধি উত্তম আরো প্রায় ১০০ টা ছবিতে কাজ করেছেন । এবং সিনেমা করতে করতেই মারা গেছেন। স্বপ্নের জীবন বলে মনে হয়, তাই না?

মহানায়কের সিনেমা হিসেবে ‘নায়ক’ দিয়েই শুরু করব। প্যারালাল বলুন, মেনস্ট্রিম বলুন, উত্তমের সেরা অভিনয়ের ফসল এই ছবি (একমাত্র ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’কে এর কাছাকাছি রাখতে পারি)। এটা এমন একটা ছবি যেখানে উত্তম ও সত্যজিৎ, দুজনেই দুজনের থেকে শিখেছিলেন। এবং সেটা উভয়েই পরবর্তীকালে স্বীকার করেছেন। বাংলা সিনেমার স্বনামধন্য নায়ক, যিনি সম্প্রতি এক মারামারির স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়েছেন, রাজধানী এক্সপ্রেস চড়ে দিল্লী যাচ্ছেন জাতীয় পুরষ্কার নিতে – ‘নায়ক’ তার সেই যাত্রাপথের ছবি। রেলযাত্রায় এক যুবতী সাংবাদিককে (শর্মিলা ঠাকুর) ইন্টারভিউ দেওয়া এবং ফ্ল্যাশব্যাক থেকে উঠে আসা সেই নায়কের ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের এক নম্বর পজিশন ধরে রাখা নিয়ে উৎকন্ঠা আর প্যানিক – এই নিয়ে সিনেমা। ক্যামেরার অ্যাঙ্গল, স্ট্যাটিক বা ডায়নামিক শট, আলোর খেলা, ফোকাসিং, লং শট, সংলাপ ও ডাবিং – এসব কিছুই বলব না কারন এগুলো সত্যজিতের ক্রেডিট। আমি শুধু উত্তমের অভিনয় নিয়ে বলব। প্রথম সিনে ডাইনিং টেবিলে তাকানো, ভুরু কোঁচকানো থেকে শুরু করে সানগ্লাস চোখে টেলিফোন ধরে আলগোছে ঠোঁট দিয়ে সিগারেট বের করে নেওয়া, জার্নির শুরুতে ট্রেনের দরজায় ভক্তদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়া – অসাধারন বলা ছাড়া উপায় নেই, কারন এই শটগুলো ঠিক এরকম গ্ল্যামারাসভাবে আর কেউ দিতে পারত বলে সন্দেহ হয় (একমাত্র খাবার টেবিলে ফর্ক ধরাটা ঠিক হয় নি, ওটা সত্যজিতের চোখ এড়িয়ে গেছে নিশ্চয়)। পুরো ফ্রেম জুড়ে উত্তমের হাঁটাচলা, খাবার টেবিলে সংলাপ, শর্মিলার সঙ্গে ক্লোজ-আপেও স্বাচ্ছন্দ্য অভিব্যক্তি, দরজার ফাঁক দিয়ে মাতাল তাকানো, অপরাধবোধ - দুর্দান্ত। এত সিরিয়াস এক সিনেমা, তার ভেতরেও এক বৃদ্ধের সঙ্গে উত্তমের হাল্কা হিউমার, সেটাও চোখে পড়ার মত।  

এই সিনেমা নিয়ে একটা কথা না বলে শেষ করা যাবে না। উত্তম জানতেন এই সিনেমা সত্যজিৎ তাকে, মহানায়ক হিসেবে তার উদ্বেগ আর আশঙ্কাকে, উদ্দেশ্য করেই বানিয়েছেন। ফলে এই সিনেমায় উত্তম যে যে শট্‌ দিয়েছিলেন তার একশ শতাংশ ছিল নিখুঁত। কারন উনিও এটা নিজের কেরিয়ারের মাইলস্টোন হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। উদাহরন দিই। রাজধানী এক্সপ্রেসে যাবার সময় বেসিনে মুখ ধুয়ে রুমালে মুছে আয়নায় নিঃশব্দে তাকানোর একটা সিন আছে। যে তাকানোর ভেতর দিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ পাবে। প্রথম শটেই সত্যজিতের চোখে সেটা ওকে হল। কিন্তু উত্তমের পছন্দ হল না। উনি অনুরোধ করলেন শট্‌টা আবার নেবার জন্য। দ্বিতীয় নয়, তৃতীয় শট উত্তমের পছন্দ হল। ক্যামেরায় এবার ফুটে উঠল তার মুখের শিরা-উপশিরাগুলো, চোখ বা ভুরু নড়ানোর দরকার হল না। ঐ সিনে উপস্থিত সবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল - ‘পারফেক্ট’। এমনকি লক্ষ্য করবেন, এই সিনেমায় উত্তমের মুখে মেক-আপ ছিল খুব কম। ফলে মাঝে মাঝে সদ্য চিকেন-পক্স থেকে সেরে ওঠা উত্তমের মুখের স্পটগুলোও বোঝা গেছে। 

নায়ক বাদ রেখে আমি ওনার দুটো অভিনয়ের উদাহরন দেব যেখানে শুধু অভিনয়ের জন্য ছবিগুলো সুপারহিট হয়েছে। এক, ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১)। উত্তমের তখন মাত্র ৩৫ বছর বয়স। পরাধীন ভারতের দুই ডাক্তারি ছাত্র-ছাত্রীর প্রেম – এক মধ্যবিত্ত হিন্দু ছেলে কৃষ্ণেন্দু ও এক অ্যাংলো মেয়ে রিনা ব্রাউন। স্বভাবতই, রক্ষণশীল পরিবারের চাপে তাদের বিয়ে হয় না। বহু বছর পর, যুদ্ধের পটভূমিকায়, যখন কৃষ্ণেন্দু এক রেভারেন্ড ডাক্তার, তখন রিনা এক মাতাল সৈনিক হিসেবে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসে। আবার তাদের দেখা হয়। অবশেষে ভালবাসার মিলন হয়। এইরকম পটভূমিতে অনেক সিনেমা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু শুধুমাত্র উত্তম-সুচিত্রার অভিনয়ের জন্য সেইসব ছবির ভেতর এই ছায়াছবি আজো সুপারহিট। এমনকি (কিছু মনে করবেন না), এই সিনেমার বিখ্যাত গান ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ খুব রোমান্টিক হতে পারে, কিন্তু ব্রড-ভিউতে আউটডোর শুটিং ছাড়া আমার এর চরিত্রায়ন মোটেই ভাল লাগে নি। সুচিত্রার প্লাস্টিক চাউনি-হাসি আর উত্তমের লিপস্টিক পরা বোকা বোকা হাসি আমার বেশ কমিকাল মনে হয়েছে। পরিচালনা নিয়েও কয়েক জায়গায় জিজ্ঞাসা আছে। যেমন শেষদিকে নায়ককে দেখে নায়িকার এক বয়স্কা রুগিকে হাসপাতালে ফেলে রেখে পাগলের মত বাইরে চলে যাওয়া। কিন্তু এই সিনেমার আসল রহস্য লুকিয়ে, ঐ যে বললাম, অভিনয়ে। মেডিকেল কলেজে সুচিত্রার জন্য উত্তমের নির্বাক পথ ছেড়ে দাঁড়ানো বা দুজনের ঝগড়া বা রেভারেন্ড হিসেবে উত্তমের শান্ত অভিনয় অথবা শেষ দৃশ্যে অন্তরঙ্গ মুহুর্তে হাস্কিং গলায় ‘তুমি কিছুই হারাও নি, তোমার সব আছে...’, এগুলো এখন মিথ। অবশ্য এটাও মানতেই হবে, ক্যামেরার কাজ আর মুখে আলোছায়ার খেলা এই ছবিতে বেশ ভাল।   

দুই, ওনার পরিনত বয়সে করা ‘অগ্নীশ্বর’ (১৯৭৫)। লো-টোন অভিনয় থেকে শুরু করে চড়া মাত্রার ইমোশন, সব কিছুর সমাহার এই সিনেমা। পরাধীন ভারতের এক শিরদাঁড়া খাড়া করে চলা ডাক্তারের গল্প, যে জীবনে কোনদিন নিজের নীতির সঙ্গে আপোষ করে নি। এরকম প্রচুর গল্প বা সিনেমা হয়েছে। নতুন কিছু নয়। এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি আমার ভাল লাগে নি। বেশিরভাগ দৃশ্য ইন্ডোর। ক্যামেরা প্রায় সময়েই স্ট্যাটিক। এমনকি কাট-সিন গুলোও ভাল লাগে নি। আলোর ব্যবহার তত দাগ কাটে না। কিন্তু যা দর্শকের মনে স্থায়ী হয়ে থাকে, তা হল সংলাপ ও অভিনয়। স্ক্রিনে উত্তমের উপস্থিতি। এখানে যেমন থিয়েট্রিকাল সংলাপ পাওয়া যায় - ‘আপনার গালে ঠাস ঠাস করে যদি তিনটি চড় মারার দরকার হয়, সেখানে এক চড়ে কাজ হবে কি?’ (ডাক্তার অগ্নীশ্বরের সঙ্গে ইঞ্জিনীয়ারের কথোপকথন), তেমনি হাল্কা হিউমার রয়েছে - ‘আমি একজন ব্যাচেলর, একা থাকি, তোমার মত যুবতীর এখানে এভাবে আসাটা খুব একটা সঙ্গত মনে করছি না’ (অগ্নীশ্বরের সঙ্গে রায়বাহাদুরের মেয়ের সংলাপ)। আবার শেষ দৃশ্যে এক বাচ্চা বোবা মেয়ের সঙ্গে ইমোশনাল কয়েকটামাত্র কথা - ‘ফুল এনেছিস, আমার জন্য ফুল? দে দে...’। এক সিনেমায় লিড রোলে এত ধরনের আবেগ আনা উত্তমের মত আর কোন নায়ক বুঝতেন বলে মনে হয় না। এটা ঠিক, যে কোন ভাল অভিনেতা তার সিনেমার চরিত্রকে ঘেঁটে ভেতরে ঢুকে যেতে পারেন। কিন্তু উত্তম কুমার একধাপ এগিয়ে নিজের মত করে সেই চরিত্রে কিছু রং ঢেলে দিতেন তার নিজস্ব মেধা দিয়ে। যে কোন শট্‌ কি করে পারফেক্ট করা যায়, সেই নিয়ে ওনার ভাবনার গভীরতা অন্যদের ভেতর ছিল না। সেখানেই উনি অন্যদের থেকে তফাতে।    

একজন সমালোচক হিসেবে আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় ভারতীয় সিনেমায় উত্তম কুমারের জায়গা কত নম্বরে হওয়া উচিত, সেক্ষেত্রে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে ওনার স্থান একটু ভেবে লিখতে হলেও সর্বকালের সেরা নায়কদের ভেতর ওনাকে সব সময়েই এক নম্বরে রাখব। দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, এম জি রামচন্দ্রন, এন টি রামারাও, শিবাজি গনেশন – এদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি। এটা জরুরি নয় যে এক নম্বর হতে গেলে তাকে ভাল হিন্দি ডায়লগ বলতেই হবে বা নাচ জানতেই হবে। যে কোন প্রাদেশিক নায়ক কত ধরনের চরিত্রে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেছেন এবং ইন্ডাস্ট্রিকে কিভাবে দশকের পর দশক নিজের কাঁধে ধরে রেখেছেন, তার ওপরেই এক নায়কের নায়কত্ব নির্ভর করে। আমার মনে হয় না এই বিষয়ে উত্তমের ওপরে আর কারো নাম উঠে আসতে পারে বলে। প্রায় তিন দশক ধরে বাংলা সিনেমাকে নিজের কাঁধে চাপিয়ে স্বর্ণযুগে পৌঁছে দেওয়া, এই সাফল্য আমি অন্য কোন নায়কের দেখতে পাইনা। ভাবুন, ৭২ সালে রাজেশ খান্না যখন তার কেরিয়ারের তুঙ্গে, তখন ‘অমর প্রেম’ করার পর বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে সেই ছবিতে তার অভিনয় ৭০-এ ‘নিশিপদ্ম’-র উত্তমের ধারেকাছেও যায় নি। গুলজারের মত আমিও একমত যে উত্তমকে কেউ যদি ধৈর্য ধরে হিন্দি ডায়লগ থ্রো করার টেকনিকটা বোঝাতেন, তাহলে আজ হয়ত উত্তম জাতীয় স্তরেও সর্বকালের এক নম্বর নায়ক হিসেবে থাকতেন।

একটা উদাহরন থেকে হয়ত আমি নিজের মতামত আরো ভাল বোঝাতে পারব। হলিউডের সর্বকালের সেরা ২৫ নায়কের ভেতর দ্বিতীয় স্থানে আছেন কেরি গ্রান্ট (হামফ্রে বোগার্টের পরেই)। একবার কেরি গ্রান্টের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখুন। তারপর উত্তম কুমারের। আপনি নিজেই বুঝে যাবেন অভিনয়ে আত্মবিশ্বাস বলতে কি বোঝায়, কেন আমি উত্তমকে নায়ক হিসেবে এত ওপরে রাখতে চাই। আমি তো আরেক ধাপ এগিয়ে বলতে চাই যে সিনেমাকে শুধুমাত্র নিজের অভিনয় আর ক্যারিশমা দিয়ে হিট করানোর জন্য উত্তম কুমারকে আমি হামফ্রে বোগার্টের সঙ্গে একাসনে রাখতে চাই (বোগার্টের ‘দ্য মল্টিজ ফ্যালকন’ আর উত্তমের ‘নিশিপদ্ম’ দেখুন), অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শককে হাল্কা হিউমার থেকে সিরিয়াস আবেগ অব্ধি নিয়ে যেতে গ্রেগরি পেকের সঙ্গে উত্তমকে সারিবদ্ধ করব (পেকের ‘রোমান হলিডে’ আর উত্তমের ‘সপ্তপদী’), এবং পাওয়ার হাউজ অভিনয় দিয়ে দর্শককে সিটে আঠার মত বসিয়ে রাখার জন্য মার্লন ব্রান্ডোর সাথে উত্তম এক জায়গায় থাকবেন (ব্র্যান্ডোর ‘গডফাদার’-এর উল্টোদিকে, ভাবুন, উত্তমের ‘অগ্নীশ্বর’)। হ্যাঁ, এটা মানতে দ্বিধা নেই যে উত্তম কুমার ছিলেন বাংলা মেনস্ট্রিম মহানায়ক। বাণিজ্যিক ছবির নক্ষত্র। যে কারনে দর্শক ওনাকে কোন নেগেটিভ রোলে দেখতে পছন্দ করত না, যেমন ‘বাঘবন্দী খেলা’ (১৯৭৫)। কিন্তু তাও উনি বিভিন্ন চরিত্র পছন্দ করতেন। এমনকি প্যারালাল সিনেমা নিয়েও ওনার যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা ছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক প্রতিবন্ধী সিরিয়াল কিলার হিসেবে ‘প্লট নাম্বার 5’ নামক এক প্যারালাল হিন্দি ছবি করে এসেছিলেন, যা সেই সময়ের দর্শক নিতে পারেনি। কিন্তু ছবিটা দেখলে বুঝবেন শুধুমাত্র উঁচু-টোনে হিন্দি ডায়লগ বলা ছাড়া প্রতিটা সিনে ওনার বডি মুভমেন্ট কতখানি পারফেক্ট।

হ্যাঁ, কয়েকটা জায়গায় ওনার অভিনয় আমার ভাল লাগে নি। যেমন ‘চিড়িয়াখানা’-র শুরুর দিক। সেই জাপানি চরিত্র হিসেবে অদ্ভুত হাঁটা আর অসমঞ্জস হাসিমুখ অভিনয়। কি করে এটা সত্যজিৎ রায় ‘ওকে’ করেছিলেন বুঝিনি। কেরিয়ারের শুরুতে কিছু বি-গ্রেডের রোমান্টিক সিনেমায় মুখে চড়া মেক-আপ আর ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে উত্তমের লিপে বোকা বোকা কিছু গান – একটু আগে সপ্তপদী নিয়েও যেটা বলেছি (অবশ্য দর্শকরা ওনাকে এইরকম রোমান্টিক রোলে দেখার জন্যই সিনেমা হলে যেত)। আর কয়েকটা ছবিতে মারামারি করার চেষ্টা, যেটা উনি একদম পারতেন না। এটাও ঠিক, ওনার গ্রেসফুল হিরো ইমেজে রাফ-অ্যান্ড-টাফ ব্যাপারটা ছিল না বলে অনেকের ওনাকে স্ট্রং মাসকুলিন হিরো বলতে আপত্তি ছিল। অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না, কারন হলিউড সিনেমা যারা ঘেঁটেছেন তারা শালীনতা আর লালিত্যর তফাৎ জানেন।       

এইসব টুকরোগুলো সরিয়ে রাখলে উত্তম একজনই। স্বাধীন ভারতের এক অভিনয়-নিখুঁত মহানায়ক, যাকে আইডল মেনেছিল একসময়ের পুরো বাঙালি জেনারেশন। দৃষ্টিশক্তি আরেকটু বাড়িয়ে অস্কার কমিটির অন্তত এই একজন প্রাদেশিক ভারতীয় নায়ককে, উচিৎ ছিল, ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অস্কার’ পুরষ্কার দেওয়া। 


(লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যক্ষ এবং একজন কবি ও চিত্র সমালোচক)