চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

বাদল বাবু




বাদল বাবু

🟣 বিশ্বরূপ দাস


➡️ স্টাফ রুমে বাদল বাবু ঢুকতেই সুজাতা ম্যাডাম বললেন কি ব্যাপার দাদা আজ মুড অফ কেন ?  মুখ একেবারে যে অমাবস্যার রাত। সাতসকালে বৌদির সাথে কিছু হয়েছে বুঝি ? অরূপ স্যার ফোড়ঙ কেটে বললেন, না দিদি যা হবার রাতে হয়েছে। তারই আফটার এফেক্ট চলছে। কথাটা শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন বাদল বাবু। চিৎকার করে বলেন তার মানে ?  তুই কি বলতে চাইছিস ? কি আর বলব দাদা, আপনার তো বয়স হচ্ছে তাই কাজ-কাম সব ভালো ভাবে পারছেন না। বৌদির রাগ তো অস্বাভাবিক কিছু নয় ! তুই একটা আস্ত জানোয়ার, অসভ্য কোথাকার ? আহঃ রাগছেন কেন ? আমি তো হাট বাজারের কথা বলছিলাম ! আপনার কাজটা আমি করে দিয়ে আসলে কি ভালো হবে ?  যদি বলেন তাহলে ফ্রি সার্ভিস দিতে আমার কোন আপত্তি নেই ! গোটা স্টাফ রুমে চাপা হাসির গুঞ্জজলৃঋ্য্য্যন ওঠে। আর তাতেই ক্ষেপে লাল হয়ে ওঠেন সবার মধ্যমণি বাদল বাবু। ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াতে পারতো কিন্তু তার আগেই প্রেয়ারের ঘন্টা পড়ে যাওয়ায় সেই যাত্রায় অরূপ রক্ষা পেয়ে যায়। নইলে ওনার হাতের ৮২ ছক্কায়  ওর ক্লাস করা আজ বেরিয়ে যেত।
রাগে গজগজ করতে করতে বাদল বাবু অফিসরুমে চলে যান অ্যাটেনডেন্স খাতায়  সই করতে। মিনিট খানেকের মধ্যেই তার পিছু পিছু  ভালো মানুষ সেজে  পিছু ধাওয়া করেন অরূপ, নবাগত নীল এবং মিতা ম্যাডাম। এই তিনজনের জন্য মাঝেমধ্যে বাদল বাবুর মনে হয় চাকরিটা ছেড়ে দিই। রোজ রোজ এই পিছন লাগার যন্ত্রণা থেকে তো মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু ছাড়বো বলে কি আর ছাড়া যায়। এনাদের ভালোবাসা, একসাথে টিফিন ভাগ করে খাওয়া,  সুখ-দুঃখের সাথী হওয়া, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ভুলে যাবেন কি করে। সত্যি বলতে গেলে কি বাদল বাবু হলেন খাজাঞ্চিবাবুর মতন সেই মানুষটি যাকে না হলে স্কুলটাই যেন নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। ষ্টাফ রুমটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে। হ্যাঁ খাজাঞ্চি বাবুর মত কিছু বাতিক ও তার আছে বৈকি। একই জিনিস বারবার বলা, লেখা, দেখা, ধোয়া, পরিষ্কার করা তার স্বভাবে দাঁড়িয়েছে।  হাজার চেষ্টা করেও খুঁতখুঁতে স্বভাবটা তার বদলানো গেল না। 

এদিকে সই করতে গিয়ে বাদল বাবুর পেনের কালি বের হচ্ছে না। ইতস্তত করছেন  দেখে মিতা টিপ্পনী কেটে বলে, " পেনের আবার দোষ কি দাদা, ওরও তো বয়স হচ্ছে। কোন কালে একটা জিনিস ছিল বলে ওটাকে জাদু ঘরে রেখে দিয়ে আসবেন। আমরা H M কে রিকোয়েস্ট করছি এবার থেকে আপনি টিপ ছাপ দেবেন। ইঙ্ক প্যাডের ব্যবস্থা না হয় আমরাই করব"।  কথাটা শুনে রাশভারী হেডমাস্টারও ফিক করে হেসে ফেলেন। বাদলদা করুন মুখে বলেন, "স্যার, আপনিও এদের দলে ! তাহলে আমি কোথায় যাই বলতে পারেন ?" পাস থেকে নীল ফিসফিস করে বলে যেখানে যাবেন যান কিন্তু উৎচ্ছন্নে  যেন যেয়েন না। বড্ড বাজে জায়গা।" কিছু বলার আগেই ঘন্টা পড়ার শব্দ শোনা যায়। তড়িঘড়ি করে খাতা হাতে যে যার ক্লাসে চলে যান। গুরুগম্ভীর পরিবেশে গোটা স্কুল জুড়ে শুরু হয়ে যায় বাগদেবীর আরাধনা। 

প্রথম পিরিয়ডে বাদল বাবুর ক্লাস নেই। কিন্তু স্টাফ রুমে এসে বসতে তার বড্ড ভয়। পাছে কেউ কিছু বলে বা পিছু লাগে। তাই নানান বাহানায়  অফিস রুমে ঘন্টা খানেক থেকে যান। বাদল বাবুর বড্ড আক্ষেপ আজ পর্যন্ত কেউ তার পূর্ণ নাম ধরে ডাকলো না। সবাই অপভ্রংশ করে। আর সেটা স্টাফরুমের সবাই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে। কেউ কোনো প্রতিবাদ পর্যন্ত করে না। এমনকি উঁচু ক্লাসের ছেলেরা আড়ালে আবডালে এ নিয়ে হাসাহাসি করে। 

টিফিনের সময় তিনি যে মনের সুখে দুটো খাবেন তার কি উপায় আছে। বেশিরভাগ দিনই তার ব্যাগ অদৃশ্য জাদু বলে কোথাও না কোথাও ভ্যানিশ হয়ে যায়। নয়তো নানা দিক থেকে পাঁচ ছ'টা হাত চিলের মতো ছোঁ মেরে তার টিফিনে ভাগ বসায় আর তারিফ করে বলে, "আহঃ ! বৌদি কি রেঁধেছে মাইরি!"। নিত্যদিন এই উৎপাত তার ভাল না, লাগলেও শেষের কথাটা তার মনে বড় আনন্দ দেয়।
বেশ গদগদ স্বরে বলে "ঠিক আছে তোদের বউদিকে বলব এবার থেকে একটু বেশি করে দিতে"।
কিন্তু মুখ থেকে কথা খসালেই যে তাকে আবার বিপদে পড়তে হবে তা বুঝেও বোঝেন না আপনভোলা বাদল বাবু। তাই পাশের বেঞ্চ থেকে মুখে পেপার চাপা দিয়ে রহিম ভাই চাপা স্বরে বলে ওঠে "দাদা-বৌদি দিলেই কি আপনি নিতে পারবেন। যতই হোক বয়স হচ্ছে তো। এই বয়সে অতটা চাপ ভালো নয়। তাছাড়া এখন বর্ষাকাল, খুব সাবধানে যাতায়াত করবেন। পারলে পকেটে সাপের সেই ওষুধ টা রেখে দেবেন। সময়ে অসময়ে ভীষণ কার্যকরী।" আবার হো হো করে হাসির ফোয়ারা ছোটে। টিফিন পর্ব জমে ক্ষীর হয়ে যায়।
শনিবার এলে কলিগরা যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে যায়। আজ রকমারি স্বাদের খাবার তাদের হাতে। এক এক করে কব্জি ডুবিয়ে খেতে হবে। ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশস্তি বাক্য বলে রক্ষণশীল স্বভাবের বাদলদার গাঁটের কড়ি খরচ করে খেতে হবে চা ওমলেট। তারপর সুপরামর্শ দিয়ে বলতে হবে, " দাদা আজ শনিবারের রাত। বাবুকে তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দেবেন। নয়তো ঠাকুমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।" কেউ পাশ থেকে বলবে ঠিকই তো, প্রদীপ নেবার আগে একবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠুক! সেটাও কি কম সুখ"।
তবে যে যাই বলে বলুক বাদল দা কিন্তু সুষ্ঠু সংস্কৃতিমনস্ক। স্কুলের ফাংশনে বক্তৃতা দেন। একটু জোরাজুরি করলে কীর্তনের ঢঙে গানও শোনান। ছেলে মেয়েদের হাতের কাজ শেখান। তার রাগ আশ্বিনের চালমেঘের মতো। এক পশলা বৃষ্টি হয়েই দেখা যায় শরতের নীল আকাশ।
তবে  হাঁটুর বয়সী কলিগদের রঙ্গ রসিকতা সব সময় তার ভালো লাগে না। অথচ তাদের সাথে গল্প না করেও তিনি থাকতে পারেন না। তার এই অপার সহিষ্ণুতা এবং মিশুকে স্বভাবের জন্য সহকর্মীরা তার ভূয়শী প্রশংসা করে মাঝেমধ্যে তাকে " নদের নিমাই "ও বলে ডাকেন। কিন্তু সেটা পুরস্কার না তিরস্কার, বুঝে উঠতে পারেন না সরল প্রাণের বাদলবাবু। 

দীর্ঘ লকডাউনের পর স্কুল খুলতেই শোনা যায় বাদলবাবু স্কুল থেকে চলে যাবেন। মিউচুয়াল ট্রান্সফার পেয়েছেন।
এবার বাদল বাবুর নয়, সকলের মুখে নেমে আসে অমাবস্যার অন্ধকার। সহকর্মীদের ভালোবাসার রসে পুষ্ট ফুলের মালা গলায় নিয়ে বিদায় নেবার আগে কান্নাভেজা গলায় সবার সাথে গ্রুপ ফটো তোলেন তিনি । স্কুলের পক্ষ থেকে তাঁর হাতে তুলে দেয়া হয় মানপত্র এবং কিছু প্রীতি উপহার। মানপত্র লেখেন সবথেকে পিছু লাগা অরূপ স্যার। বাদল বাবু কে জড়িয়ে ধরে তিনিও হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন। যাবার আগে পাঁচ হাজার টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বলেন," স্কুল খুললে ছাত্রদের মিষ্টি খাওয়াস। আর বাকি  টাকায় তোরা ফিস্ট করিস, লাগলে আরো কিছু দেব। খবর দিস। পারলে আমিও আসবো সেদিন।খুব জমিয়ে খাওয়া চাই কিন্তু"।
তারপর থেকে স্টাফরুম বড্ড ফাঁকা। শ্রাবণ মেঘে এখন অঝোর ধারায় বাদল ঝরছে। 

(বিঃদ্রঃ : এই গল্পের সব চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক)
                                          লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক