চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

শুধু ছাত্র-ছাত্রীরা নয়


 

শুধু ছাত্র-ছাত্রীরা নয়


🟣 বিশ্বরূপ দাস


➡️ শুধু কি ছাত্র-ছাত্রীরা,  দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে নানা রকম হতাশা এবং মানসিক অবদমন‌। সন্তান তুল্য ছাত্র-ছাত্রীদের নিবিড় সান্নিধ্য, হই হুল্লোর, ক্লাস ঘরের পঠন পাঠন, বিভিন্ন বিদ্যালয় কৃত্যালী থেকে তারা আজ বঞ্চিত। কর্মজীবনের তালভঙ্গ হয়েছে তাদের। বেসুরো ছন্দে বাজছে হৃদয় বীনা। আর ঠিক সেই কারনেই তারাও নানান অবসাদে ভুগছেন। বিভিন্ন স্কুলে অনলাইন ক্লাস চালু থাকলেও তা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার মতো। কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী, শিক্ষা পোর্টাল ও মিড ডে মিলের জন্য শিক্ষকদের নানা সময়ে বিদ্যালয়ে যেতে হলেও তা স্রোতহীন নদী এবং ফুলহীন বাগান পরিদর্শনের মতো। তার না আছে  সৌরভ, না আছে সেই সৌন্দর্য। 

বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুবাদে মনে হচ্ছে জীবনে অকালবার্ধক্য নেমে এসেছে। ঘরে স্ত্রী -পুত্র, মা-বাবা সবাই থেকেও যেন কেউ নেই। উঠতে-বসতে মনোমালিন্য। নিজের ছেলে মেয়ের সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না। ঘটি বাটিতে ঠোকাঠুকি লেগেই আছে। কিছুতেই কোনও কাজে মন বসে না। টিভি -খবরের কাগজ পড়া- বাজার যাওয়া এই খাড়া বড়ি থোর, থোর বড়ি খাড়া জীবন একদম ভালো লাগছে না। সপ্তাহান্তে ছুটির আনন্দ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। স্কুল যাবার সেই তাড়াহুড়ো নেই, সঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়া নেই, নাকে চোখে মুখে গুঁজে ট্রেন বাস ধরার  তাড়াও নেই। অসময়ে খাওয়া-দাওয়া করে কমবেশি সবাই আমরা গ্যাস অম্বল এর রোগী হয়ে গেলাম। নয়তো শুয়ে বসে ওজন বাড়ালাম। আর বাড়ির গিন্নি থেকে শুরু করে পাড়াপড়শির বিদ্বেষের শিকার হলাম। আসলে স্কুলের যে প্রাণপ্রদীপ তারাই যদি না থাকে তাহলে আলোটা জ্বলবে কেমন করে। তাই স্কুলে গেলেও প্রতিনিয়ত এক অন্ধকার গ্রাস করছে ছাত্র দরদী সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাকে। এরইমধ্যে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে গ্রামগঞ্জের অনেক ছেলে তাদের বইপত্র শিকেয় তুলে দিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ক্ষেতে খামারে কাজ করতে যাচ্ছে। কারণ পেট বড় বালাই। মিড ডে মিলে আর কদিনেরই বা পেট ভরে ! এছাড়াও কান পাতলেই আপনারা শুনতে পাবেন কন্যাশ্রী প্রকল্পের আওতায় থাকা অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। স্কুল খোলা থাকলে হয়তো এটা হতো না। শিক্ষক শিক্ষিকারা বোঝাতেন, সহপাঠীরা বোঝাত। অন্তত ব্যাপারটা জানাজানি হলে একটা ভালো পদক্ষেপ নেওয়া যেত। কিন্তু তার আর অবকাশ পাওয়া গেল কোথায় ? তাই শিক্ষকরা ভালো নেই। 

সত্যি বলতে কি এর মধ্যে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা বদলি হলেন। আবার অনেকে অবসর নিলেন। কেউ কেউ চির জীবনের জন্য এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু বিদায় নেওয়ার সময় প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে তাদের আর দেখা হলো না। তারা কেমন আছে, তাদের পড়াশোনার সত্যিই হচ্ছে কিনা কোন শিক্ষকই ভালোভাবে জানতে পারলেন না।

কুরুক্ষেত্র আর শান্তিনিকেতনের উপাদান দিয়ে তৈরি স্টাফ রুমের সেই জমজমাট পরিবেশ কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ভার্চুয়ালে ভার্চুয়ালে ভাইরাসকে ঠেকানো গেলেও বিদ্যালয়ের একচুয়াল জীবনের  আগমনী গান আর গাওয়া হলো না। বরং শিউলি ঝড়ানো চিরদিনের বাণী আনার আগেই করোনাসুর এসে তাকে গলা টিপে মেরে দিল।তার সাথে হাত মেলালো রাজনীতির সুন্দ উপসুন্দরা। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন এক অলৌকিক শক্তির বলে তাকে বাঁচানো যায় ততক্ষণ পর্যন্ত বেশিরভাগ শিক্ষক শিক্ষিকাকে অবসরকালীন জীবনের যন্ত্রণা ভোগ করতেই হবে। সহ্য করতে হবে সামাজিক নানা শ্লেষক্তি-  "বসে বসে মাইনে নিচ্ছে " !

তবে ঘরে বসে বসে এই মাইনে নেওয়ার দল, সময় পেলেই আবার শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষক, নার্স এবং মানুষের মত মানুষ তৈরি করবে যা আর কারো দ্বারা সম্ভব নয়। আসলে শিক্ষকরাই হলেন স্বপ্নের সওদাগর। তারা স্বপ্ন দেখেন এবং তা বাস্তবে রূপায়িত করার চেষ্টা করেন। অন্তরের যন্ত্রণা নিয়েও তাদের স্বপ্ন দেখে বলবে...

"সোনার আলোয় জাগবে পৃথিবী

বাজবে আলোর বাঁশি

আকাশপটে মহামায়ার

ভূবনমোহিনী হাসি...."

ছাত্র ছাত্রীদের মুখে সেই ভুবনমোহিনী হাসি দেখলেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শত শত যন্ত্রণার অবসান হবে। অনাগত সেই সুন্দর শারদ প্রভাতের প্রতীক্ষায় আমরা শিক্ষকরা দিন গুনছি।

                                         লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক