চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

রথের চাকা চলছে... The wheel of Rath is running


 

রথের চাকা চলছে...


🟣 অন্তরা দাঁ

 

তোদের হলুদ মাখা গা 

তোরা রথ দেখতে যা

আমরা পয়সা কোথায় পাব 

আমরা উল্টো রথে যাব। 




  হিন্দু কোন ধর্মের নাম নয়, হিন্দুত্ব একটি যাপনের নাম, জীবন পেরিয়ে মোক্ষের পথে অবিচল হেঁটে যাওয়ার নাম। 

আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর প্রেমময় কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে হয় রথযাত্রা উৎসব। ভবিষ্যপুরাণে সূর্যদেবের, দেবীপুরাণে মহাদেবীর, পদ্মপুরাণ স্কন্দপুরান ও ভবিষ্যত্তোর পুরাণে বিষ্ণুর রথযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। 

এইপর্যন্ত পড়ে যারা ভেবেছ আমি আজ রথযাত্রা আর হিন্দুধর্মের পারস্পরিক সম্পর্ক, আমাদের সমাজে তার প্রভাব, পুরাণ, পুঁথি সব মিলিয়ে-মিশিয়ে একখানা গম্ভীর প্রবন্ধ গোছের রেসিপি করে তোমাদের পাতে দেবো, নাহ! সেটি হচ্ছে না। আমি খুব কুঁড়ে, উইকিপিডিয়া থেকে ঘেঁটেঘুঁটে, বইপত্তর নামিয়ে পড়াশোনা করেছি বটে তবে সেটা নিছক খোশগপ্পো করবো বলে, আরে গল্পে গরু গাছে ওঠে, তায় আমি আড্ডাবাজ বাঙালি, একটু-আধটু শব্দবাজি করি আর কী, লোভ সামলাতে পারলাম না গো, একটা বেশ আষাঢ়ে গপ্পো, রথ-টথ দিয়ে সাজিয়ে...দ্যাখো তো কেমন লাগে!

 কী বলছিলাম যেন, হ্যাঁ, রথ দেখা আর কলাবেচার চক্করে আমার আক্কেলগুড়ুম হবার যোগাড়, ও বাবা মেলা ঝামেলা এসব গপ্পোর, একে বিষ্ণু না কৃষ্ণের অবতার এই নিয়ে একখানা মারাত্মক ক্যাঁচাল আছে, ওই দ্যাখো, ছ্যা ছ্যা ছ্যা যাকে নিয়ে গপ্পো তার কথাই তো বলিনি, ওই আমাদের জগন্নাথদেব, রথে করে বেরোন বছরে একবার, তাঁর গপ্পো বলব। কী রকম গোলগাল চোখ মাইরি, আর হাত-পা কিচ্ছু নেই, আমি তো ছোটবেলায় একবার দেখে ভিরমি খেয়ে গেছিলাম, এখনও বুড়ো বয়েসে অন্ধকারে ভাবলে বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। সে যাকগে, ভেবেছিলাম জগন্নাথ দেব'কে নিয়ে জম্পেশ একখানা রঙচঙে লেখা নামিয়ে দেবো, ও বাবা সে বিরাট কান্ড —সরলাদাসের 'ওড়িয়া মহাভারত', বলরাম দাসের 'ওড়িয়া রামায়ণ' জগন্নাথ দাসের 'দারুব্রহ্মগীতা', অচ্যুতানন্দ দাসের 'হরিবংশ', দিবাকর দাসের 'জগন্নাথ চরিতামৃত,' মহাদেব দাসের 'নীলাদ্রি মহোদয়' ইত্যাদি গ্রন্থে তাঁর সম্মন্ধে বিস্তৃত   বিবরণ  পাওয়া যায়।  ওরেব্বাস  এই  এত ?!  অতশত পড়া কী আমার কম্মো ঈ? ঝপ করে দিলাম গুগলিয়ে...পাতার পর পাতা এটাসেটা বেরিয়ে মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল, সব পড়ে যেটুকু মনে রাখতে পারলাম তাতে রথ অবধি গড়িয়ে গেলো বিষয়টা গড়গড় করে। 

আরে বাপু এই রথযাত্রা আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণে তৈরি এক লোকাচার। শাস্ত্রগ্রন্থ ও কিংবদন্তি মিলেমিশে এক আশ্চর্য রূপকথা। কথিত আছে যে কৃষ্ণের মৃত্যুর পর দ্বারকার নির্জন সমুদ্রতীরে মৃতদেহ পোড়াবার সময় এলো ভীষণ তুফান। সে দূর্যোগের কারণে সৎকার-কার্য অসমাপ্ত রেখে পালিয়ে যায় মানুষজন। সেই অর্ধদগ্ধ দেহাংশ ভাসতে ভাসতে পশ্চিম উপকূল থেকে পূর্ব উপকুলে কলিঙ্গ রাজ্যে এসে পৌঁছয়। ওই অঞ্চলে বসবাসকারী শবরগণ তাদের নেতা বিশ্বাবসুর নেতৃত্বে ওই দেহাংশ'কে নীলমাধব নামে পুজো করতেন। 

ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি 'ব্রহ্মান্ডপুরাণ' অনুসারে সত্যযুগে রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল। জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব রহস্য এক কিংবদন্তী। 

সে সময় ওড়িশা মালবদেশ নামে পরিচিত ছিল, সেই মালবদেশের পরম বিষ্ণুভক্ত অবন্তী-রাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদিষ্ট হলেন বিষ্ণুদেব স্বয়ং তার পুজাপ্রার্থী, কী আশ্চর্য তার দুএকদিনের মধ্যে এক তেজস্বী সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটলো রাজবাড়িতে। তিনি সমস্ত তীর্থের কথা জানানোর পর নীল পর্বতে ভগবান বিষ্ণুর গুপ্তভাবে পূজিত হওয়ার সংবাদ দেওয়ায় রাজা মুক্তিপ্রদায়ক বিষ্ণুদেবের রূপমাধুরী অবলোকনের অভিপ্রায়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। মোক্ষলাভের আশায় তিনি তাঁর পুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতিকে পাঠালেন শবরদের দেশে, পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে, সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য তাকে পথ দেখালেন যে কিশোর রাখাল তিনিই আমাদের নন্দলাল।

বিদ্যাপতি প্রেমে পড়লেন শবরী ললিতার, সে গপ্পো আরেকদিন বলবো ক্ষণ। বিদ্যাপতি মারফত খবর পেয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন শবর দেশে গেলে নীলমাধব স্বয়ং অন্তর্হিত হন, আবার মন্দলোকে বলে, বিশ্বাবসু লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেসময় তো আর ইন্টারনেট ছিলো না বাপু, মিডিয়াও হইহই করে লাফিয়ে পড়তো না খবরে, সেজন্য সবই জনশ্রুতি, দ্বিমত, অসংখ্য গোঁজামিলে ভরা তথ্যসূত্র, যে যেখানটায় আটকেছেন মিসিংলিঙ্কে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে... এখন যেরকম মিডিয়া দেখায় গো, কীসব পরামানন্দ, শুধু ভয় নেই আনন্দ, অমুক টিভি, তমুকে আছি, কার বাপের ক'টা দিন এসব দেখায় না?! সেইই সবের মতো এখানেও মেলা... যাকগে আমি আমার মত করে লিখি, এ্যাঁ ?

তারপর কী হলো, রাজা তো কুশাসনে শয্যা নিয়েছেন, প্রাণত্যাগের জন্য তিনি প্রস্তুত, এমনসময়ে সেখানে উপস্থিত হলেন দেবর্ষি নারদ। তিনি জানালেন স্বয়ং পিতা ব্রহ্মা জানিয়েছেন 'এই স্থানে তোমার মাধ্যমে ভগবান জগন্নাথদেব দারুব্রহ্ম রূপে পূজা পাবেন । '

এখন রাজা আবার স্বপ্নাদেশ পেলেন পুরীর সমুদ্রতীরে চক্রতীর্থ অঞ্চলে দারুব্রহ্ম বা নিমকাষ্ঠ ভেসে আসবে এবং তা থেকে বিগ্রহ তৈরি করে পূজিত হবেন বিষ্ণু। অর্থাৎ কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর অভেদ তত্ত্বটি এক্ষণে পরিষ্কার। বাঙ্কিমুহানে দারুব্রহ্ম ভেসে এলে তা উদ্ধার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ায় আবার বিষ্ণুদেবের শরণাপন্ন হলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। শবররাজ বিশ্বাবসুর সহায়তায় সেই দারুব্রহ্ম সমুদ্র থেকে তোলা সম্ভবপর হয়, বিদ্যাপতি, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও শবররাজের সম্মিলিত প্রয়াস এখানে আবার সেই অভেদ-তত্ত্ব, সত্ত্ব-রজ-তমোগুণের অভিন্নতা প্রমাণ করে।


কাঠ তো পাওয়া গেল, বিগ্রহ তৈরি করবে কে? ছেনি-হাতুড়ি সে কাঠে লাগামাত্র ছিটকে পড়ে, মহাবিপদ ! এমতাবস্থায় অনন্ত মহারাণা নামে এক বর্ষীয়ান ভাস্কর রাজাকে শর্ত দিলেন একুশ দিনের নিরঙ্কুশ নির্জনতার বিনিময়ে গোপনে একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে সেই ভাস্কর মগ্ন রইলেম নির্মাণকাজে। একুশ দিন দূরস্থান পনেরো দিনের মাথায় রাণী গুন্ডিচা, ইন্দ্রদ্যুম্নের ধর্মপত্নী অধৈর্য হয়ে পড়লেন। তার কারণও ছিলো, অন্যান্য দিনের মত সেদিন আর রুদ্ধদ্বার কক্ষে কান পেতে কোন শব্দ শুনতে না পাওয়ায় কৌতুহলী স্ত্রী-মন সন্দেহবশতঃ দরজা খুলে যা দেখলেন তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি। অর্ধসমাপ্ত ভীষণ-দর্শন মূর্তি, জগন্নাথদেব যিনি তাঁর গাত্রবর্ণ ঘোরকৃষ্ণ, গোল-গোল চোখ, হস্তপদরহিত সে এক অদ্ভূত স্থাপত্য, গুন্ডিচা জ্ঞান হারালেন আর সেই সুযোগে অন্তর্হিত হলেন সেই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী, আসলে তিনি ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা স্বয়ং। এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তিই পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ। তাঁর লৌকিক হস্ত নেই অথচ তিনি সর্বদ্রব্য গ্রহণ করেন, পদ নাই অথচ সর্বত্রগামী, রূপ নাই অথচ অরূপ, আকার নাই নিরাকার এই তিনিই বিশ্বাত্মা, জগন্নাথদেব তাঁরই প্রতীক। তাঁর রূপ সৃষ্টিতে মানুষ অক্ষম তাই তিনি প্রতীকী।

স্কন্দপুরাণে সরাসরিভাবে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার কথা পাওয়া যায়, সেখানে উল্লেখিত 'পুরুষোত্তম ক্ষেত্র ' বা 'শ্রীক্ষেত্র' পুরীকেই বোঝায়। রথ আভিধানিক অর্থ অনুসারে যুদ্ধযান হলেও সনাতনী বিশ্বাস অনুসারে রথ ঐহিক নশ্বর শরীর, আর তাতে উপবিষ্ট দেবতা হলেন আত্মা, ঈশ্বর, দেহরূপ রথের রথী, ”তুমি যন্ত্র আমি যন্ত্রী যেমন বাজাও তেমনই বাজি। “কঠোপনিষদে বলা হয়েছে “না আত্মানং রথিনংবিদ্ধি শরীরং রথমেবতু “। ঈশ্বর অন্তরে থাকেন, তাঁর কোনো রূপ নেই, তিনি সর্বত্র বিরাজমান ‘অবাঙমানসগোচর' অর্থাৎ মানুষ বাক্য ও মনের অতীত।

জগন্নাথদেব সনাতন হিন্দুর শাক্ত, শৈব, গাণপত্য, সৌর ও বৈষ্ণব এই পঞ্চমতের একত্বের প্রতীক। বলদেব শিব, সুভদ্রা শক্তি, জগন্নাথ বিষ্ণু ও সুদর্শন সূর্যের প্রতীক একস্থলে অভিষিক্ত হন এবং রথযাত্রার অনতিপূর্বকালে গানপত্য মতে পূজা পান । লেখার শুরুতেই বলেছিলাম হিন্দুত্ব একটি যাপনের নাম।

এই বার গপ্পো শেষের দিকে, দুত্তোর বলে যারা মুখ ফিরিয়েছে তাদের রথযাত্রার একটা ঝলমলে এপিসোড দিয়ে শেষ করবো, আরে শুনে যান...

প্রথম যাত্রা শুরু করেন বড়ভাই বলভদ্রের রথ, নীলরঙা তালধ্বজ, মাঝে সুভদ্রা মানে দুইভাইয়ের বোনটির লাল পদ্মচিহ্নযুক্ত পদ্মধ্বজ আর শেষে ওই যাকে দেখে ভিরমি খেয়েছিলাম, তিনি, জগন্নাথের হলুদরঙ কপিধ্বজ। কী সুন্দর যে তাদের কারুকাজ আর সোনার সিংহাসন, সাটিনের জামাকাপড়, হীরে-মোতির গহনা ! মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখে। রাজপরিবারের উত্তরাধিকার যারা তার সোনার ঝাড়ু করে ঝাঁট দ্যান রথের সামনে আর সুগন্ধি ছড়ান। সে এক এলাহি আয়োজন। এখন তো নানা জায়গায় রথের অনুষ্ঠান হয়। ১৯৬৮ সাল থেকে 'ইসকন হরেকৃষ্ণ' আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহরে রথযাত্রা শুরু হয়। এই সংঘের নেতা ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ লন্ডন, মন্ট্রিয়ল, প্যারিস, বামিংহাম, নিউইয়র্ক সিটি, টরেন্টো, সিঙ্গাপুর, সিডনি, ডেনিস ইত্যাদি বিভিন্ন শহরে রথের আয়োজন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে মেদিনীপুরের মহিষাদলে, হুগলির শ্রীরামপুরে মাহেশের রথ, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের রথ, কলকাতা এবং বাংলাদেশের ধামরাই জগন্নাথ রথ এখনও সেই সনাতনী ঐক্যমত প্রবাহ বহন করে চলেছে।

এবারের রথ পড়েছে জুলাইয়ের বারো তারিখ, সাতাশে আষাঢ়। মাসির বাড়ি গুন্ডিচা মন্দির যাবেন জগন্নাথদেব। ফিরবেন, সেই সাতদিন পর। ততদিনে শ্রাবণ মাস পড়ে যাবে, বৃষ্টিবাদলের দিন, রথে যদিও সোনার ছাতা দেওয়া থাকে, তবুও সাবধানে বাছারা জ্বরজারি না হয়, আর হ্যাঁ এবার ওই রথ-টথ যাতেই চেপে বসো বাবা মায়েরা মুখে মাস্ক'টি পরতে ভুলোনা,শুনেছ তো কী সব নতুন স্ট্রেন এসেছে, কী যেন ডেল্টা প্লাস নাকি...!

ঠাকুর ঠাকুর করে ফিরে এসো বাছা। আমরা ততক্ষণে কলা বেচি।

                                          লেখক : শিক্ষিকা ও প্রাবন্ধিক।