চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

বাঙালির শৈশব ও ছড়া


 

বাঙালির শৈশব ও ছড়া 


🟣 বিশ্বরূপ দাস 


 ➡️ ছড়া হলো লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা। লোক পরম্পরায় এগুলো দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে রচিত হয়ে আসছে। ছোটবেলায় মা মাসি কিংবা দাদু ঠাকুমার কাছে ছড়া শোনেনি এমন মানুষ পাওয়া খুবই বিরল। আমরাও ছোটবেলায় ছড়া শুনতে শুনতে কখনও ঘুমের দেশে চলে যেতাম, কখনও  অবাক বিস্ময়ে নানান ভাব কল্পনার জগতে বিচরণ করতাম। মনের খোল করতাল মৃদঙ্গ বাজিয়ে কখনো "আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম" সাজতাম। কখনও "ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে "যেতাম "ক্ষীর নদীর কূলে"। আবার "আড়ি আড়ি আড়ি /কাল যাব বাড়ি / পরশু যাব ঘর" বলে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়াও করলেও " এলাডিং বেলাডিং সইলো / একটি খবর আইলো" বলে মিতালী করতেও দেরি করিনি আমরা। সেদিনকার সেই ছড়ার দিনগুলো আজও আমাদের কাছে

মধুর স্মৃতি, গভীর নস্টালজিয়ায় ভরা। মনের ক্যামেরার ফ্ল্যাশব্যাকে পুরোনো দিনে ফিরে গেলেই দেখতে পাবেন আপনি মায়ের সামনে বসে বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে অবাক বিস্ময়ে ছড়া শুনছেন। এক অনাবিল আনন্দে ভরে যাচ্ছে আপনার তনু মন প্রাণ। তারপর আপনার  কচিকাঁচা ঠোঁট  থেকে জুঁই হাসনুহানার মতো  ফুটে ফুটে বেরোচ্ছে নানান ছড়ার সৌরভ। তারই গুঞ্জনধ্বনি শুনতে শুনতে মায়ের হাত ধরে আপনি লিখতে শিখছেন 

অ এ অজগর আসছে তেড়ে

আ এ আমটি খাবো পেড়ে।

হচ্ছে বর্ণপরিচয়, জীবনের প্রথম পাঠশালায় পদার্পন-- আহা!  সেইসব ছবি আজও ছড়ার মত আমার আপনার প্রত্যেকের জীবনে জলসাঘরে হাজার টাকার ঝাড়বাতির মতো জ্বলছে। 

ছড়ার উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে পড়াশোনা করতে গিয়ে জানতে পারছি উনবিংশ শতকের আগে ছড়া শব্দটির তেমন কোনো ব্যবহারিক প্রয়োগ ছিল না। মধ্যযুগে পাঁচালী মঙ্গলগীত জাতীয় সংগীতের মধ্যে টুকরো পদ্য পংক্তির আবৃত্তিকে বলা হতো "শিকলি "। সেই শিকলি শব্দের আধুনিক রূপ ' ছড়া' বলে অনেকেই মনে করেন ।

ছড়া শব্দের একটি অর্থ হলো প্রকীর্ণ বা বিক্ষিপ্ত অর্থাৎ ছড়ানো। অন্য অর্থ গ্রথিত বা সারিবদ্ধ গুচ্ছ (যেমন ধানের ছড়া, কলার ছড়া)। অর্থাৎ যে পদ্য পংক্তি উচ্চারণ দ্বারা মালার মতো গীত আখ্যানকে গ্রথিত করা হয় তাকেই ছড়া বলে। অনেক গবেষক মনে করেন সংস্কৃত 'ছটা 'শব্দ থেকে ছড়া শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। 'ছটা ' শব্দের অর্থসমূহ বা পরম্পরা। অর্থাৎ শ্লোকে পরম্পরা। "বঙ্গীয় শব্দকোষ" এর জনক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছড়া বা ছটা শব্দের অর্থ ধরেছেন 'গুচ্ছ'। আবার কেউ মনে করেন ছড়া সম্ভবত ছন্দ শব্দের অপভ্রংশ। তবে ছড়া শব্দটির যেহেতু প্রকীর্ণ শ্লোক বা টুকরো ছন্দময়  পদ্যাংশ অর্থেই প্রযোজ্য সেহেতু " ছড়ানো" শব্দটি "ছড়া" শব্দের মূল বলে মনে করা অসঙ্গত হবে না। 

যাইহোক এই তত্ত্ব আর তথ্যের কচকচানি থেকে এবার আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। জানতে হবে আমাদের এ বাংলা ছড়ার পথিকৃৎ কে। মূলত শিশুতোষ্য রচনা হিসেবে ছড়া আমাদের সমাজে প্রচলিত থাকলেও তা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে কেউ সংগ্রহ করেননি। বিশ্বকবি এই ছড়ার রূপ এবং রসগত সৌন্দর্য আকৃষ্ট হয়ে আমাদের জনমানসে ছড়িয়ে থাকা ছড়াগুলি সংগ্রহ করে নাম দেন "মেয়েলি ছড়া "। যা সাধনা পত্রিকায় ১৩০১ সনের আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যায় এই শিরোনামে (মেয়েলি ছড়া)  প্রবন্ধ হিসাবে তা প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি সেই সংগ্রহীত ছড়ার নাম দেন ছেলেভুলানো ছড়া যা তাঁর "লোক সাহিত্য" গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 

মুখে মুখে অন্ত্যমিল যুক্ত ছড়ার জগত মূলত শিশুদের আনন্দের এবং কল্পনা বিলাসের জগত হলেও তা লোকমানসের বিশ্বস্ত দর্পণ। এর আপাত অসংলগ্ন, চিত্র রসাত্মক, কল্পনাসমৃদ্ধ বুকের মাঝে লুকিয়ে আছে নানান লোক ইতিহাস, সমাজ- অর্থনীতি, লোক মনস্তত্ত্ব, লোকাচার এবং লোকসংস্কৃতি। তাই ছড়ার মাঝে আমরা যেমন আঠারো শতকের বাংলাদেশের বুকের বর্গী হাঙ্গামার চিত্র দেখতে পাই তেমনি দেখতে পাই শিক্ষাসংক্রান্ত, প্রকৃতি বিষয়ক, পৌরাণিক বিষয়ক, ব্যক্তি ও ঘটনা বিষয়ক, আনুষ্ঠানিক, উপদেশ মূলক, পশু পাখি বিষয়ক নানা ছড়া।" খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে", " আদুর বাদুড় চালতা বাদুড় কলা বাদুরের বে, " ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা, " আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই, একে চন্দ্র দুইয়ে পক্ষ তিনে নেত্র চারে বেদ", "রোদে ধান, ছায়ায় পান", গোপালনগরের মজুমদাররা তার কেঁদে ম'লো/ ডোমরা হইতে বাজু সরকার বাড়ি লুটে নিল। (পাবনায় প্রজাবিদ্রোহ প্রসঙ্গে)," সুরাই মেলের কুল / বেটার বাড়ি খানাকুল/বেটা সর্বনাশের মূল/ ওম তৎ সৎ বলে ব্যাথা বানিয়েছে স্কুল (রামমোহন প্রসঙ্গে)-- ছড়াগুলি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, " এই ছড়াগুলি আমাদের নিয়ত পরিবর্তিত অন্তর আকাশের ছায়ামাত্র"। আবার ছড়াকে তিনি মেঘের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন ছড়া এবং মেঘ উভয়েই পরিবর্তনশীল। মেঘ বৃষ্টি হয়ে নেমে এসে শিশু শস্য কে  প্রাণ দান করে এবং ছড়াগুলো কল্পনা বৃষ্টিতে শিশু হৃদয়কে উর্বর করে তোলে। ছবির পর ছবি, ঘটনার পর ঘটনা তার কল্পনার জগৎকে বিকশিত করে।

এই ছড়া প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ভাষাবিদ এম ব্লুমফিল্ড কি বলেছিলেন তা আমরা দেখব।

তিনি বলেছিলেন "The popular rhyme is striking example of the poetic primitive, going back in its construction and psychological essence almost to the primitive archaic times, and at the same time it is frequently an expession of new attitudes among the masses of the people "

অর্থাৎ ও ছড়াগুলি "Poetic primitive " কোন বিশেষ বার্তা বা মনোভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে তার রচিত নয়। এমনকি অর্থপূর্ণ সংলগ্ন তার কোন দায় ও তার নেই। শিশুর সদাচঞ্চল দৃষ্টিপাতের মতো এখানেও টুকরো টুকরো পরস্পর বিচ্ছিন্ন কতগুলো ছবির সমাহার দেখতে পাওয়া যায়।

বিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড অবশ্য আলাদা কথা বলেছেন। তার মতে মানুষের বিভিন্ন অবদমিত ইচ্ছা এবং স্বপ্ন প্রতীকের প্রকাশ ঘটে আদিম ছড়া গুলিতে যা পরবর্তীকালে হয়ে উঠতে পারে আরও অর্থপূর্ণ এবং সচেতন।

রবীন্দ্রনাথের পর ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার "খুকুমণির ছড়া" শীর্ষক একটি গ্রন্থ সংকলিত করেন যেখানে গ্রন্থের ভূমিকায় আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এটিকে প্রথমবারের মতো "সাহিত্যের বিষয় "বলে উল্লেখ করেন। আধুনিক ছড়া প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লোক গবেষক ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী বলেছেন, " ছড়া শুধু সমাজ সংস্কার নিয়ে বলে না, দেশ ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বলে। কালের সাথে অনবরত তার রূপ বদলায়.... "

সময়ও যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে ছড়ার রূপ ও তার ব্যবহারের বদল যে হবে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 


কিন্তু শিশুপাঠ্য ছড়া অবশ্যই শিশুর মনোরঞ্জনের জন্য চিরকাল একইভাবে থাকবে। থাকা উচিত। সেখানে অর্থ খুঁজলে ছড়ার মাধুর্য নষ্ট হয়ে যাবে । একটু খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাই "পথের পাঁচালী"র বালক অপু। প্রসন্ন গুরুমশাই এর পাঠশালায় " সীতার বনবাস "এর অংশবিশেষের শ্রুতিলেখনীর বিন্দুমাত্র বুঝতে না পারলেও তার শব্দ ঝংকারে সে মোহিত হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বের যে কোনও শিশুর কাছে এই ধ্বনিময়তা বা ছন্দ মাধুর্যের অহৈতুকী আবেদনই মুখ্য। অর্থই অনর্থের মূল তা না জেনেও পৃথিবীর কোন শিশু ছড়ার অর্থ নিয়ে খুব ভাবিত নয়, সেই অর্থে সমস্ত সার্থক ছড়ার মূল রস "অদ্ভুত এবং উদ্ভট"। সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, অন্নদাশঙ্কর রায়, নজরুল ইসলাম কিংবা এডওয়ার্ড লিয়ার এর অনেক আগেই আমাদের দেশের মা ঠাকুরমা'রা আমাদের শৈশবের আকাশকে খাঁটি 'ননসেন্স'এর  আলোয় ও রসে মাখামাখি করে দিয়েছেন। একথা  আজকালকার দিনে  রিয়েলিটি শো 'পন্থী হিপহপ গান ভালোবাসা অভিভাবকরা চুপিসারে স্বীকার করবেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট এসে শিশুদের স্বপ্নের রাজ্যে থাবা বসিয়েছে। ধীরে ধীরে কেড়ে নিচ্ছে তাদের অনাবিল আনন্দের জগৎ কে। কিন্তু তাই বলে অধুনা বিজ্ঞানের প্রভাবকে তো অস্বীকার করা যাবে না। তাদেরকে নিয়েই আমাদের ঘর করতে হবে। তাই আমাদের শিশুরা  যাতে যন্ত্রের অতি প্রভাবে যান্ত্রিক না হয়ে যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। তাদের হাতে তুলে দিতে হবে চিরাচরিত ছড়ার ডালি। তাহলে তাদের "নোটন নোটন পায়রাগুলি" আবার ঝোটন বাঁধবে "।  মনের কদম তলায় আবার" চাঁদ উঠবে,ফুল ফুটবে এবং হাতি ও ঘোড়া নৃত্যের সাথে শুরু হবে সোনামনির বে।

পরিশেষে বলি ছড়া বেঁচে থাকুক ছড়ার আনন্দে।

তথ্যঋণ : বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি (পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ) গ্রন্থ ও আন্তর্জাল।


                                                লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক