চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

১২০ তম তিরোধান দিবসের আলোয় বিবেকানন্দ


 

১২০ তম তিরোধান দিবসের আলোয় বিবেকানন্দ


🟣 বিশ্বরূপ দাস


"বীর সন্ন্যাসী বিবেকের বাণী ছুটেছে বিশ্বময়

বাঙালির ছেলে ব্যাঘ্রে বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়"

                                  --"সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত "।


➡️ বৃষভের সাথে বাঘের সমন্বয় ঘটাবার মত কিছু অসম্ভব অলৌকিক ঘটনা মাঝেমধ্যে এই পৃথিবীতে ঘটে থাকে। তবে সেইসব ঘটনার কান্ডারীরা কোন সাধারণ মানুষ নন। তারা হলেন জগতের মুক্তি দূত, জীবের পরম আশ্রয়,আশার আলো, মানুষের জীবনপথের দিশারী সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। যাদের পুণ্য করস্পর্শে দেশ ও জাতির মরা গাঙে আসে নবজাগরণের জোয়ার। সংকীর্ণ ধর্মের বেড়াজাল যায় ভেঙে। তমসাচ্ছন্ন আদর্শভ্রষ্ট জাতি জেগে ওঠে নব প্রাণ কল্লোলে। ঠিক সেই রকমই একজন হলেন আধুনিক ভারতের ভগীরথ তথা নবযুগের চালক বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ।

আজ বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের ১২০ তম তিরোধান দিবস। সেই তিরোধান দিবসে তাঁকে আমরা স্মরণ করব তাঁর ধর্ম, কর্ম এবং সাহিত্য জীবনের মাধ্যমে। তাঁর জ্ঞানযোগ,কর্মযোগ থেকে শুরু করে পরিব্রাজক, ভাববার কথা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত, নানান টুকরো প্রবন্ধ এবং আদর্শ চিঠিপত্রে প্রচারিত বাণী, আদর্শ এবং দার্শনিক যুক্তিনিষ্ঠ ভাবনা চিন্তাকে সামনে রেখে সেই পুণ্যাত্মা মহাপুরুষের অবদান ও বর্তমান দিনের তাঁর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করব।

বলতে দ্বিধা নেই মাত্র ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিন - এই সামান্য জীবৎকালে দেশ ও দেশের বাইরে বিবেকানন্দ ধর্ম, বর্ণ, জাত পাত এবং মানবতার মূল ধারনাটাই বদলে দিয়েছিলেন। বদলে দিয়েছেন নীচ হীন, দরিদ্র নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতি দেশের অন্যান্য মানুষের উন্নাসিক মানসিকতাকে। তিনি প্রথম আপন মুক্তির আকাঙ্ক্ষা চেয়ে দরিদ্র নারায়ণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে বলেছিলেন

"who cares for your Bhakti and Mukti?... I will go to the hell cheerfully a thousand times, if I can rouse my countrymen, impressed Tamas, and make them stand on their own feet "ঠিক এই কারণেই তাঁকে বলা হয়ে থাকে Cyclonic Monk যিনি আপন প্রাণের দুর্দম দুর্দমনীয় তেজ এবং শানিত বুদ্ধি দিয়ে কালবৈশাখী ঝড়ের মত দেশ ও জাতির বুকে জগদ্দল পাথরের মতো জমে থাকা সমস্ত ধর্মীয় কুসংস্কার,অস্পৃশ্যতা, শোষণ শাসন অত্যাচারকে ভেঙে চুরমার করে সাম্য শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রেম-ভালোবাসার মন্ত্রে দেশবাসীকে দীক্ষিত করেছিলেন। একসূত্রে সহস্রটি মন কে বেঁধে শুনিয়েছিলেন নৈতিকতা ও আত্মনির্ভরশীলতার বাণী।


ধর্মভাবনা :-

স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মের মানুষ ছিলেন। ধর্মের পথ ধরেই তিনি সাধারণ মানুষকে কল্যাণের পথে তথা মঙ্গলের পথে আনার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তার ধর্ম বিশেষ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়। নয় আচার বিচার আর গতানুগতিকতার বিধিনিষেধে ভরা। তার ধর্মবিশ্বাসের মূলে ছিল জীবে প্রেম। ছিল ত্যাগ ও বৈরাগ্য সাধনা।তাই শিব জ্ঞানে জীব সেবার বাণী উচ্চারিত হয়েছিল তার কণ্ঠে-

" বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/ জীবে প্রেম করে যেইজন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর"

বুঝতে অসুবিধা হয় না তার এই ধর্ম শুধু মানবতা নয় জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং দার্শনিকতার আলোয় আলোকিত ছিল।

ভারত বর্ষ সহ বিশ্বের বিভিন্ন মনীষীদের রচনা, ইতিহাস, ধর্মগ্রন্থ, দর্শন, সাহিত্য পড়ে তিনি বুঝতে পারেন যুক্তিনির্ভর সংস্কারের পরিবর্তে ধর্মের পথেই মানুষকে পরিশুদ্ধ করা সম্ভব। তাই পূর্বসূরী রাজা রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অক্ষয় কুমার দত্ত প্রমুখ সংস্কারকদের যুক্তিনির্ভর সংস্কারের পথে না হেঁটে তিনি ধর্মের পথেই সমাজ সংস্কারে প্রতি হন সেই ধর্ম অবশ্য মানবতার ধর্ম। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রবর্তিত " যত মত তত পথ "এর ধর্ম। ধর্মীয় সহনশীলতা এবং উদারতার ধর্ম। যার মধ্যে ব্যাপক সামাজিক ও ব্যবহারিক তাৎপর্য রয়েছে। তিনি জানতেন শুদ্ধতম ধর্মানুভূতি সম্পন্ন মানুষ সমাজের মূল চালিকাশক্তি। এরা সমাজের আন্তঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে আবার দশ জনের মঙ্গল সাধন করে সমাজকে নিয়ে যায় অগ্রগতির পথে। শাশ্বত মানব ধর্মের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শিকাগো বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলন সভায় তিনি বলেছিলেন,..." খ্রিস্টানকে হিন্দু-বৌদ্ধ হতে হবে না, হিন্দু ও বৌদ্ধদের খ্রিস্টান হওয়ার প্রয়োজন নেই…

.. আধ্যাত্মিকতা পবিত্রতা এবং তার দাক্ষিন্য কেবল বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের একচেটিয়া বস্তু নয়।প্রত্যেক ধর্মের পতাকায় লিখিত হবে যুদ্ধ নয় সাহায্য, ধ্বংস নয় আত্মস্থ করে নেওয়া, ভেদ দ্বন্দ্ব নয়,সামঞ্জস্য ও নয় শান্তি"।

শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে তার সেই ৫ মিনিটের ভাষন আজ আমাদের জাতীয় জীবনে একটা গৌরবময় ইতিহাস। বলা যেতে পারে তাঁর হাত ধরেই

" নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান" এর ভারতবর্ষ জগত সভায় লাভ করেছে শাশ্বত মানব ধর্মের স্বর্ণ মুকুট।


শিক্ষা ভাবনা :-

এতো গেলো ধর্মের দিক এবার আসা যাক তার শিক্ষা ভাবনা সম্বন্ধে।

বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন " গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা ভালো"। বিশ্বাস করতেন ভারতীয় আধ্যাত্বিক আদর্শের সঙ্গে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান চেতনা এবং বৈষয়িক কর্মকুশলতা যুক্ত হলেই ভারতবাসী ব্যক্তি এবং জাতি হিসেবে পূর্ণতা লাভ করবে। তবে পাশ্চাত্যের সঙ্গে তুলনা মূলক মূল্যায়নে তিনি হিন্দু আদর্শ ও রীতিনীতির শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে দেশবাসীকে সচেতন করে দিয়েছিলেন যে তারা যেন সোনার বিনিময় রাঙ গ্রহণ না করে। তার শিক্ষার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি তাঁর দার্শনিক তত্বগুলোকে প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ করেছেন এবং সন্ন্যাসী সংঘকে "ভারতবাসীর জনসাধারণের উন্নতির জন্য একটা যন্ত্র"রূপে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। তাই রোমা রোলা ঠিকই বলেছিলেন,"He himself was the embodied unity of a man "

জীবনের নানান হতাশা এবং প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে কিভাবে শিক্ষার্থীদের সাফল্যের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে সে সম্বন্ধে তার অমোঘ বাণী আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তিনি বলেছিলেন, " সাফল্য লাভ করিতে হইলে প্রবল অধ্যবসায়, প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি চাই। অধ্যবসায়শীল সাধক বলেন,'আমি গন্ডুষে সমুদ্র পান করিব, আমার ইচ্ছা মাত্র পর্বত চূর্ণ হইয়া যাইবে' এইরূপ সংকল্প আশ্রয় করিয়া খুব দৃঢ় ভাবে সাধন করো নিশ্চয়ই লক্ষ্যে উপনীত হইবে। "


ভারত পরিকল্পনা :-

স্বামীজীর দৃষ্টিতে ভবিষ্যত ভারতের পরিকল্পনার প্রধান দুটি বিষয় হলো - ভারতবর্ষের ধর্মীয় আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং পদদলিত ভারতীয় জনসাধারণের পুনরুজ্জীবন। তিনি বলেছেন 'ভারতের একমাত্র ভরসাস্থল জনসাধারণ- কিন্তু অভিজাত সম্প্রদায় তো শারীরিক অতিথি হিসেবে মরে গেছে!!' তাই বেলুড় মঠের নিয়মাবলী প্রস্তুত করতে গিয়ে তিনি সখেদে লিখেছিলেন, "The root of all misery in India is the wide gulf between the lower and upper classes. Unless this difference is made up, there is no hope of any well being for the people. Therefore we must send preachers to all places to give the masses education and religious teaching."

ভারত পরিকল্পনায় তথা দেশ গঠনে পাশ্চাত্য শিক্ষা কে গুরুত্ব দিলেও বিবেকানন্দ পাশ্চাত্যপন্থী গোঁড়া নব্য গোষ্ঠী এবং গোঁড়া সনাতনপন্থীদের তীব্র নিন্দা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, "There are two great obstacles on our path in India, the Scylla of old orthodoxy and the Charybdis of modern European civilization.... We have to find our way between the Scylla of old superstious orthodoxy and the Charybdis of materialism -of Europeanism "

তিনি অনুভব করেছিলেন, " ব্রাহ্মণযুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের বাহুবল,বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ যদি মিলিত করে একটি পূর্ণায়ত জীবনাদর্শ গড়ে তোলা যায় এবং তাকে কার্যক্ষেত্রে প্রতিফলিত করা যায় তবে আসন্ন প্রায় শূদ্র যুগ হবে পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক বিকাশের যুগ।ব্রাহ্মণকে শুদ্রে অবদমিত করে নয় শূদ্র কে ব্রাহ্মণত্বে উন্নীত করেই এই সংস্কৃতি পূর্ণাঙ্গ ভারতীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে"। এর পাশাপাশি তিনি অনুভব করেছিলেন আমাদের সমাজ ও সভ্যতার কান্ডারী শ্রমজীবী সম্প্রদায় কে যথার্থ মর্যাদা ও সম্মান না দিলে ভারতের প্রকৃত উন্নতি কোনদিন সম্ভব নয়। তাই তিনি সেই অবহেলিত শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি বলেছিলেন ,".. ভারতের চির পদদলিত শ্রমজীবী, তোমাদের প্রণাম করি"।


বিবেকানন্দের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা উক্তি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তিনি প্রখ্যাত ফরাসি মনীষী রোমা রোলা কে একসময় বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, " যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও, বিবেকানন্দকে জানো। তার মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক-নেতিবাচক কিছুই নেই"। কবিগুরুর এই কথা থেকে বোঝা যায় কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন আমাদের বিবেকানন্দ। আমরাও আমাদের আত্মিক উন্নয়নে, চরিত্র গঠনে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় এবং বিশ্বশান্তি মৈত্রী প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করার জন্য বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের দেবপম জীবনাদর্শ স্মরণ করবো বারেবারে। কবির সুরে সুর মিলিয়ে বলবো

"তুমি বারে বারে এস ধরা মাঝে

স্মৃতি তোমার বিরাজে এ হৃদি মাঝে "।।

                                            লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক