চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

শ্রাবণ মাসে শরতের ছোঁয়া, বাংলার এক ঐতিহ্যমণ্ডিত উৎসব মহিষমর্দিনী পুজো


 


শ্রাবণ মাসে শরতের ছোঁয়া, বাংলার এক ঐতিহ্যমণ্ডিত উৎসব মহিষমর্দিনী পুজো


🟣 পুলক মন্ডল 


➡️ বাতাসে কাশের দোলার এখনও ঢের দেরী। দেরী আছে শরত মেঘের আনাগোনারও। তবুও ফি বছর এইসময় শ্রাবণের পূর্ণিমা তিথিতে কালনার আকাশ-বাতাস জুড়ে থাকে শারদীয়ার আমেজ। গত বছর অতিমারি আবহে সম্ভব হয়নি উৎসব আয়োজনের। এবারেও হবেনা। তবুও মনের উৎসব কি থেমে থাকে ! তাই এক মনকেমন করা বিষাদ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্মৃতিচারণ চলে কালনাবাসীর। 

দেবী দুর্গার আর এক নাম মহিষাসুরমর্দিনী। সেটাই কালক্রমে রূপ নিল মহিষমর্দিনী। দেবীর এই ভিন্ন রূপের আরাধনা হয় পশ্চিমবঙ্গের পূর্ববর্ধমান জেলার কালনা শহরে। হাওড়া-কাটোয়া রেলপথে দূরত্ব আশি কিমি। ভাগীরথীর পাড়ে ছোট শহর কালনা। কিন্তু স্থাপত্যে ও ঐতিহ্যে রাজ্যের অন্যতম সাংস্কৃতিক পীঠস্থান। একদা বর্ধমান রাজ পরিবারের উদ্যোগে এখানে গড়ে উঠেছিল একের পর এক স্থাপত্য ও পুরাকীর্তি। তৈরি হয়েছিল শহরের শেষ প্রান্তে ভাগীরথীর পাড়ে নয়াগঞ্জ। তখনকার এই নয়াগঞ্জে ছিল ব্যবসায়ীদের রমরমা। সারাদিন রাত তখন ভাগীরথীর ঘাটগুলিতে ভিড়তো একের পর এক পণ্য বোঝাই নৌকা আর জাহাজ। কালনা তখন দেশের মধ্যে এক নামকরা বাণিজ্যকেন্দ্র। নদীপথে চাল, ডাল, তেল, নুন সহ নানা সামগ্রী তখন কালনা থেকে যেত দেশের নানা প্রান্তে।

জনশ্রুতি প্রায় আড়াইশো বছর আগে ১৭৬৪-৬৮ সাল নাগাদ এই নয়াগঞ্জেই ছিলেন ঈশ্বরী প্রসাদ পালচৌধুরী নামে এক আড়তদার। তিনি এসেছিলেন নদীয়ার রানাঘাট থেকে। সৎ ও মিশুকে মানুষ হিসেবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল। তিনি নাকি মহিষমর্দিনী দেবীর স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে জানতে পারেন ভাগীরথীর ঘাটে ভেসে আসবে একটি কাঠের পাটাতন। ঘুম ভাঙার সাথেসাথে ঈশ্বরী প্রসাদ ছোটেন ঘাটে। দেখেন সত্যি সত্যিই একটি পাটাতন হাজির হয়েছে নদীর ঘাটে। জল থেকে তোলা হয় পাটাতন। 

সেকালে শহরে সংস্কৃত চর্চার জন্য ছিল অনেক টোল। খবর পাঠানো হয় টোলের পণ্ডিতদের কাছে। তাঁরা পুজোর সম্বন্ধে নানান নিদান দেন। শুধু ঈশ্বরী প্রসাদই নন, দেবীকে পুজো করতে এগিয়ে আসেন অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও। তাঁরা মিলিত ভাবে ঠিক করেন পুজোর জন্য ব্যবসার লাভের একটা অংশ জমিয়ে রাখবেন। পুজোর বন্দোবস্ত হলেও ব্যবসায়ীদের চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে দেবীর মূর্তি কেমন হবে ? এইসময় আচমকাই ভবতারন পাল নামে এক যুবক এসে হাজির হন রানাঘাট থেকে নয়াগঞ্জে। তিনি জানালেন, দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েই তিনি এসেছেন দেবীমূর্তি গড়তে। কয়েক দিনের চেষ্টায় তিনি গড়ে তোলেন দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি। প্রতিমার চালচিত্রে আঁকা হয় নানান দেবদেবীর মূর্তি। দু’পাশে রাখা হয় চামর ব্যজনরত জয়া ও বিজয়ার মূর্তি। 

মূর্তি গড়ার পর শুরু হয় দেবীর বাসস্থান নির্মাণ নিয়ে তোড়জোড়। কাছাকাছি এলাকা থেকে হোগলা পাতা নিয়ে এসে তৈরি হয় দেবীর মন্দির। প্রথমে চৈত্র মাসে দেবীর পুজো শুরু হয়েছিল। পরে ব্যবসায়ীদের হালখাতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-সহ নানা কারনে পুজোর সময় পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে এই পুজো শ্রাবণী শুক্লা সপ্তমী বা শ্রাবণী পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয়।

দেবীর হোগলা পাতার মন্দির বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তৈরি হয় পাকা ও স্থায়ী মন্দির। এরপর একে একে মন্দিরকে ঘিরে তৈরি হয় বিশাল আটচালা, যাত্রামঞ্চ, নহবৎখানা, অতিথিশালা, রন্ধনশালা সহ অনেক কিছু। সময়ের সাথে বাড়তে থাকে উৎসবের জৌলুস। ব্যবসায়ীদের পুজো একসময় সার্বজনীনে পরিনত হয়। এককালে পুজোর সময় হোরমিনার কোম্পানির স্টিমারে করে আসতো বেলোয়ারি ঝাড়। সে আলোর রোশনাইয়ে ঝলমল করত মন্দিরের ভেতর-বাহির। এখন অবশ্য সে রেওয়াজ নেই।

১৯২২ সালে রামবিহারি চাল নামে এক ব্যবসায়ির সহযোগিতায় তৈরি হয় পাকা ও স্থায়ী নহবৎখানা। মন্দিরে প্রবেশের মুখে প্রায় ৩০ ফুট উঁচু নহবৎখানা তৈরি করেন স্থানীয় শিল্পী প্রিয়লাল মিস্ত্রী। সুউচ্চ এই নহবৎখানাটির ওপরের অংশটি দেখতে অনেকটা হাতলহীন পাল্কির মতো। পুজো চারদিনের- সপ্তমী থেকে দশমী। কিন্তু নহবৎখানায় ষষ্ঠীর সকাল থেকেই সানাইয়ের সুর বাজতে থাকে, শুরু হয় উৎসবের আমেজ। মন্দির লাগোয়া ভাগীরথীতে স্নান করে ভক্তরা পুজো দেন, দেবীর কাছে মানত করেন। পুজো উপলক্ষে মন্দির চাতালে জড়ো হন হাজার খানেক দুস্থ মানুষ, তাদের জন্য খুলে দেওয়া হয় অতিথিশালার দরজা। নিয়ম অনুযায়ী পুজোর তিনদিন মন্দির চত্বরে বসে অন্নসত্র। সপ্তমীর দিন অন্নসত্রের পর শুরু হয় চাল ও বস্ত্র বিতরন। বিশালাকৃতি আটচালার ভেতর পুজোর উপাচার নিয়ে বসেন পুরোহিত। পুজো হয় তান্ত্রিক মতে। পাশে সাজানো থাকে ভক্তদের দেবীর উদ্দেশ্যে মানত করা নানা মুল্যবান সামগ্রী। প্রতিমাকে সাজানো হয় বহু মুল্যবান সোনার অলঙ্কার দিয়ে। কথিত আছে, বহু আগে পণ্ডিতদের হাতে পুজোর সময় তুলে দেওয়া হতো ধর্মর্গ্রন্থ, নগদ অর্থ ও পিতলের সামগ্রী। পণ্ডিত বিদায়ের রেওয়াজ ভাঙলেও দেবীর পাশে আজও পিতলের সামগ্রী রাখার রেওয়াজ আছে।

পুজোর চারদিন যে অসংখ্য মানুষ আসেন তাদের মনোরঞ্জনের জন্য রাতে হয় যাত্রাপালা, চলে দ্বাদশী পর্যন্ত।

একসময় হতো ঢপ ও তরজার আসর। সময়ের সঙ্গে তা বন্ধ হয়ে গেলেও পুজোর জৌলুষ আগের তুলনায় বেড়েছে অনেক। উৎসবের একটি পুরনো রেওয়াজ পুতুল নাচ। আগে পুতুল নাচ আসত ঘাটাল থেকে। প্রায় চল্লিশ বছর যাবত তা আসে দক্ষিন ২৪ পরগণার খাগড়াকোনা থেকে। ভাগীরথীর বাঁধানো পাড়ে সুদৃশ্য পার্কে সকাল থেকে রাত অবধি চলে পুতুল নাচের আসর। উৎসব উপলক্ষে মন্দির চত্বরে প্রায় আধ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসে মেলা। একমাস ধরে চলে তার প্রস্তুতি। মহকুমা প্রশাসন, পুরসভা ও পুজো কমিটির মধ্যে হয় বৈঠক। মেলা চত্বর মুড়ে ফেলা হয় সিসিটিভি ক্যামেরায়। মেলায় প্রবেশের মুখে থাকে পুলিশ ও নানা স্বেছাসেবী সংস্থার ক্যাম্প। লাগোয়া ভাগীরথীতে পারাপারের জন্য লাইফ সেভিং বোট থেকে নানা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। 

দশমীতে প্রতিমাকে নিয়ে শহর পরিক্রমার রেওয়াজ এখনও রয়েছে। প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য আসে বিশেষ ধরনের চাকাওয়ালা লোহার একটি গাড়ি। নিচু এই গাড়িটিতে দেবীকে চাপিয়েই শহর পরিক্রমা হয়। তা শেষ হয় মন্দির লাগোয়া ভাগীরথীর ঘাটে। সেখানেই বিসর্জন। 

চেনা শহরটা দিন চারেকের জন্য উৎসবের আলোয় কেমন যেন অচেনা হয়ে ওঠে। মাটির প্রতিমা জাতপাতের ব্যবধান ঘুচিয়ে দেয়। কাশফুল ফোটার আগেই যেন অকালবোধন শুরু হয়ে যায় কালনায়। ছোট এই শহরটিতে লক্ষাধিক মানুষের সমাগমে যেন শারদোৎসবের আগমনী সুর বেজে ওঠে। 

যদিও অতিমারি আবহে গতবছর এবং এবছরও উৎসব পালন সম্ভব হয়নি। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে চলতি সপ্তাহেই শ্রাবণী পূর্ণিমায় উৎসবে মেতে উঠত কালনা। কিন্তু হয়নি! তাই হয়ত মনখারাপ শহরবাসীর, তবে ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে/ পৃথিবী আবার শান্ত হবে’, হয়তবা নচিকেতার এই বিখ্যাত গানের সুরেই মন বাঁধছেন তারা যে আগামী শ্রাবণে ফের কালনায় শোনা যাবে শরতের আগমনী সুর, নহবতখানায় বেজে উঠবে সানাই। শুরু হবে বাংলার এক ঐতিহ্যমণ্ডিত উৎসব- মহিষমর্দিনী পুজো। 

                                     -----------

                          লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক