পিতা -এক পরম নির্ভরতা
🟣 বিশ্বরূপ দাস
➡️ এই জগতের আলো দেখার সৌভাগ্য যার হাত ধরে হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলেন আমার আপনার সকলের জন্মদাতা পিতা। তাদের জীবনের আনন্দময় ফসল হয়েই এ পৃথিবীতে আমাদের আগমন। টেস্টটিউব বেবি এবং পিতৃ পরিচয়হীন শিশুদের কথা অবশ্যই আলাদা। আবার যারা শৈশবে পিতাকে হারিয়েছেন বা অন্য কোন কারণে তার সাহচর্য, স্নেহ-ভালোবাসা পাননি তারা অবশ্যই দুর্ভাগা।
পিতা মানেই বটবৃক্ষ। কল্পতরু। জীবনের পরম নির্ভরতা। ফ্রেন্ড, ফিলোজফার, গাইড। নীলকন্ঠ শিবের মতো বিষহরি। আমাদের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না ব্যথা-বেদনার চিরসাথী। কখনো তিনি প্রখর রোদ্দুরের মত রাশভারী, কালবৈশাখীর মত দুর্বার দুর্দম, কখনো বা জলভরা মেঘের মতো নরম কোমল। কখনো তিনি আমাদের কাছে দুর্বোধ্য এক কবিতা। কখনও তিনি যেন বিশল্যকরণী খুঁজে ফেরা ধ্যানমগ্ন এক ঋষি।
সন্তানের জন্য প্রত্যেক পিতা যেন অলকানগরমুখী হাওয়ায় বীজ বপন করেন। কত পবিত্র স্বপ্নের আঁকিবুকি কাটেন। তার ছেঁড়া জামা আর বুক পকেটের ছোট্ট খাতায় ফুটে ওঠে আমাদের চাওয়া পাওয়ার কত শুকতারা। আবার সেখানেই জমা হয় অঙ্কে শূন্য পাওয়া ছেলের হাড় হিম করা বেদনার পূর্বাভাস। কখনও শুনতে পাই যাযাবরের মর্মর ধ্বনি। এলোমেলো ধুলোঝড়। শুনতে পাই আল্লাহতালার খোদা-ই খিদমত। পাই জীবনের সমস্ত রান্নার স্বাদ গন্ধ। এইভাবেই অচিন পাখি হয়ে তারা তাদের খোকাকে শিখিয়ে যান জীবনের সহজ পাঠ। দিয়ে যান অনাবাদি জমিতে সূর্যমুখী ফুল ফুটাবার মন্ত্রধ্বনি।
আমরা বারবার আম্পায়ারের ভূমিকায় দেখি তাকে। রেফারি হিসেবে তার কোনও সমঝোতা নেই। লাইন্সম্যান মা মাসিদের ম্যাজিক রংপতাকাও মাঝেমধ্যে অকেজো হয়ে যায়। সূর্য ঘুড়ি তখন ছড়ি হাতে টকটক করে সহবত শেখাতেই ব্যস্ত। এমনি করেই তাদের তেজস্ক্রিয় অক্ষরে পুড়তে পুড়তে কখনো মায়াবী রাতের জ্যোৎস্নার চন্দন গায়ে মেখে আমরাও এক সময় ফুসফুস-ভরা হাসি নিয়ে সোনাঝুড়ি কিংবা ঝুমকোলতা হয়ে উঠি।
তিনিই আমাদের জীবনের গোলকিপার। বুক দিয়ে আটকে দেবার চেষ্টা করেন শত শত বাধা বিপত্তি।দুপাশের দুটো বার পোস্ট ভেঙে গেলেও আমাদের সংকটকালে তিনি একাই মেরুদন্ড সোজা রেখে ডিফেন্স এর মত লড়াইটা লড়ে যান।
ব্যক্তি মানুষের জীবনে আরো দু'রকম পিতার ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি। প্রথমজন অবশ্যই জন্মদাতা পিতা, দ্বিতীয়জন জ্ঞানজ পিতা অর্থাৎ আমাদের শিক্ষাগুরু। যিনি আমাদের অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোতে নিয়ে যান। জানা থেকে অজানা জগতে নিয়ে গিয়ে এই পৃথিবীর সুনাগরিক হিসেবে আমাদের গড়ে তোলেন। সকল মানবিক গুণের বিকাশ সাধন করেন। "মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে মুছে" মানুষের মত মানুষ করে তোলেন। তাই এই পিতৃ দিবসে তাকেও জানাই আমার বিনম্র প্রণাম।
সবশেষে আর একজন পিতার কথা বলতেই হয় তিনি হলেন পরম পিতা বা জগত পিতা। আমাদের চরিত্র গঠনে তার ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। জীবনের কান্ডারী সেই জগৎ পিতার নির্দেশ মেনে চললে আমাদের জীবনতরী সমস্যা-সঙ্কুল সমুদ্রের মাঝেও পালতোলা নৌকার মতো পৌঁছে যাবে কাঙ্খিত লক্ষ্যে।
তাই আমাদের জীবন গড়ার কারিগর, আমাদের সুখে দুখের নিত্য সহচর সেই পিতাকে বিনম্র প্রণাম জানিয়ে কবির ভাষায় বলি-
" পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম
পিতাহি পরমং তপহঃ
পিতোরি প্রিতিমাপন্নে
প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতায় নমঃ "
---------------
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক