চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

শিক্ষা ও চাকরি



শিক্ষা ও চাকরি


🟣 বিশ্বরূপ দাস 


➡️ বর্তমানে পড়াশোনার যা হাল হকিকত এবং চাকরি বাকরির যা অবস্থা তাতে এই প্রজন্মের এবং আগামী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাবে এবং কী করবে তা নিয়ে অভিভাবক মহলে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। তাই তথ্যভিজ্ঞ মহল মনে করছেন এমতাবস্থায় প্রত্যেক অভিভাবক অভিভাবিকার উচিত হবে পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের সন্তান-সন্ততিকে এমন কিছু শিক্ষার তালিম দেওয়া যাতে করে আগামী দিনে তারা সেই শিক্ষায় বলিয়ান হয়ে সম্মানের সঙ্গে সামান্য কিছু রুজি রোজগার করতে পারে। নইলে এমন হতাশাজনিত সামাজিক অবক্ষয় শুরু হবে যা আর কোন ওষুধ দিয়ে নিরাময় করা যাবেনা। তাই সেদিকে খেয়াল রেখে প্রতিটি ছাত্র ছাত্রীকে পড়াশুনার পাশাপাশি জীবিকা অর্জনের শিক্ষা দিতে হবে। যাতে তারা ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারে।

অনেকে মনে করেন ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা নার্সিংএ ভর্তি হলেই তাদের চাকরি পাক্কা। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এটা বহুলাংশে সত্যি হলেও বর্তমান দিনে এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারেনা।এমন অনেক ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা ছেলে মেয়েকে দেখেছি যারা খুব সামান্য বেতনে প্রাইভেট সেক্টরগুলিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। নয়তো অন্যান্যদের মতো বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলছে। ঘাবড়ে যাবেন না। এটাই স্বাভাবিক চিত্র। শুধু একটু ভাবুন। ভেবে সময় থেকে পরিকল্পনা করুন কিভাবে আপনাদের সন্তান-সন্ততির সামনে রুজি রোজগারের দরজা খুলে দেবেন। মনে রাখতে হবে ছাত্রজীবনের ৯০/৯৭ শতাংশ মার্কস বা ভাল রেজাল্ট কোন কাজে লাগবে না যদি তা বাস্তব জীবনে জীবিকা অর্জনে সহায়তা না করে।

 পরিসংখ্যান যা বলছে তাতে আগামী দিনের চিত্র খুব উজ্জ্বল নয়। সি.এম. আই এর রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যাচ্ছে দেশের বেকারত্বের হার ৯.৩ শতাংশ। সবথেকে বেশি বেকারত্বের হার বিজেপি শাসিত হরিয়ানায় ২৫.৬ শতাংশ আমাদের রাজ্যে বেকারত্বের হার ১১.২ শতাংশ। বেকারত্বে নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ এখন গোটা দেশের তুলনায় ৬ নম্বরে আছে বলে জানা যাচ্ছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আন্তর্জাতিক যুব দিবসে এক টুইটে বলেন, " গোটা দেশে যখন বেকারত্ব কমার হার ২৪ শতাংশ সেখানে আমাদের বাংলার সেই হার ৪০ শতাংশ। এর অর্থ হলো পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হার দ্রুত কমছে। এই বঙ্গ আগামীদিনের গোটা দেশকে দিশা দেখাবে"।
 প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী যাই বলুন না কেন বাস্তবের চিত্রটা একটু অন্যরকম। এস.এস. সি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। হাজার হাজার কোর্ট কেসের নাগপাশে বন্দি যুবক যুবতীদের শিক্ষক-শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন। রাজ্যের বুকে একাধিক ক্ষুদ্র শিল্প হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম। সেখানে কর্মসংস্থানও আশানুরূপ নয়। সেই ঘাটতি পূরণ করতে রাজ্য সরকার অবশ্যই নানাবিধ প্রকল্প, অনুদান এবং ভাতা শুরু করেছেন। কিন্তু সেই অনুদান এবং ভাতা কখনোই রাজ্যের যুবক-যুবতীদের ভবিষ্যৎ নয়। বরং বলা যেতে পারে এইসব প্রকল্প "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়" হওয়া থেকে রক্ষা করার প্রয়াস মাত্র। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো।
আসলে একদিকে অতিমারি অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং রাজনৈতিক সংঘাতে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পঙ্গু হতে বসেছে। কর্মসংস্থানের জন্য উন্নয়ন ক্ষেত্রগুলি বিভিন্ন কারণে ভেঙে পড়ছে। বিশ্ববাজারে শিল্পেরও মন্দা দেখা দিয়েছে। রেল, ব্যাংক, কয়লা এবং উড়ানের মতো বিভিন্ন লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারিকরনের চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো এসে উপস্থিত হয়েছে করোনা ভ্যাকসিনের সংকট এবং তা যোগান দেবার জন্য কেন্দ্র রাজ্যের সংঘাতে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা টলমল।রাজ্যের রাজকোষ থেকে বিরাট পরিমাণ অর্থ সেখানে চলে যাচ্ছে। তার ফলে গোটা দেশের মানুষকে ভুগতে হচ্ছে এবং হবে। এই অবস্থায় লোকসানের গতিপথ ঘুরিয়ে লাভের মুখ দেখতে হলে তথা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে সচল করতে হলে বিভিন্ন সরকারি উপদেষ্টা এবং বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ মেনে চলতে হবে। দেশ ও রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে, কর্মসংস্থানের প্রশ্নে কোন কিছুর সাথে আপোষ করলে চলবে না। বরং পা ফেলতে হবে খুব সাবধানে। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভুলে নিতে হবে সদর্থক ভূমিকা। স্বনিযুক্তি প্রকল্প থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। ট্যুরিজম, কৃষি বিপনন, থেকে শুরু করে অচিরাচরিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বেকারদের মুখে হাসি ফোটাবার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে হবে। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন সরকারি স্তরে চাকরি ক্ষেত্রগুলি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। পরীক্ষা পদ্ধতির জটিলতায় এবং নিয়োগের দীর্ঘ টালবাহানায় বহু জনের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কল-কারখানায় নতুন করে শ্রমিক নিয়োগ ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। অতিমারির সময়ে সেটা আরো প্রবল হয়েছে। ছাঁটাই প্রক্রিয়া অব্যাহত। বিভিন্ন পাবলিক সেক্টরের ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। নামিদামি কোম্পানিগুলো নতুন কর্মীদের সামনে এমন টার্গেট খাড়া করে দিচ্ছে যে তারা সেটাকে স্পর্শ করতেই নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। তাই সবসময় একটা ভয় এবং চাকরি হারাবার হতাশা তাদের প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে। পাবলিক সেক্টর গুলো স্পষ্ট কথা, "হয় টার্গেট পূরণ করো নয় চাকরি ছাড়ো"। সেজন্য দেখবেন বিভিন্ন কোম্পানির এজেন্ট ও কর্মীরা জ্যৈষ্ঠের এই কাঠফাটা রোদেবাড়ি বাড়ি ঘুরে তাদের চাকরি বাঁচাবার প্রাণান্তকর লড়াই করছেন। আবার অনেকে কেউ কেউ বাড়ি বাড়ি ঘুরে টিউশান করছেন। জীবিকা অর্জনের জন্য খবরের কাগজ থেকে শুরু করে দুধের প্যাকেট বিক্রি করতেও দেখছি বহুজনকে। ফাস্টফুডের দোকান করে কিংবা টোটো চালিয়েও অভাব মিটছে না। মিটবে কি করে। দীর্ঘ লকডাউন আর অতিমারি কেড়ে নিয়েছে বেকারদের সব স্বপ্ন। অর্ধাহার-অনাহার হয়ে উঠেছে এদের অনেকেরই নিত্যদিনের সাথী। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার লড়াই দেখলে সত্যিই চোখে জল এসে যায়। আবার এমন অনেক শিক্ষিত যুবকযুবতীকে দেখেছি যারা সরকারি চাকরির তালিকাভুক্ত হয়েও দীর্ঘদিন নিয়োগপত্র পাননি। বা তাদের নাম টপকে কোন এক অজানা কারণে অন্যদের চাকরি হয়ে গেছে। এইভাবে শিক্ষিত বেকারদের স্বপ্নগুলো প্রতিমুহূর্তেই মুখ থুবড়ে পড়ছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে কি করবে তারা ? কোথায় যাবে ? সবাই তো আর ঝান্ডা ধরে মনকে ঠান্ডা করতে পারবে না। আবার এরা এমন কেউ রাজপুত্র বা রাজকুমারী নয় যে সম্রাট পিতার সিংহাসনে বসে বাকি জীবন মহাসুখে কাটিয়ে দেবে। কিংবা মালিয়াদের মত ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা টাকা লুঠ করে বিদেশ পাড়ি দেবে। না আমাদের তরুণ প্রজন্ম কাউকে দোষ দিচ্ছে না ! বিশেষ কোনো সরকারের উপরে ও তাদের ক্ষোভ নেই ! তারা দোষারোপ করছে নিজেদের পোড়া কপালকে ! আত্মধিক্কার দিচ্ছে নিজেদের ভাগ্যকে ! বিবেকের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছে কেন এই পড়াশোনা ? কেনএই ডিগ্রী ? কেন এই অর্থ অপব্যয় ? কারণ তারা ভালোভাবেই জানে "সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"। জানে বাঁচতে গেলে লড়াই করতে হবে। কেউ তাদের হাতে এসে দানপাত্র ধরিয়ে দেবে না। দেবে না চাকরির নিয়োগপত্র। ব্যবসা করতে গেলেও টাকা চাই। চাই উপযুক্ত জায়গা। কিন্তু তা পাবে কোথায় ? তাদের তো কোনও গৌরী সেন নেই। তাই সর্বস্য বেচেকুচে ব্যবসা করলেই কাল থেকেই মা লক্ষ্মী স্বয়ং তাদের ঘরে এসে বাসা বাঁধবেন এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং অভাবের তীব্র দহনে গণেশ উল্টানোর সম্ভাবনাই বেশি। তাই তরুণ প্রজন্ম কাউকে দোষ দিচ্ছে না! যতদিন তাদের কিছু না হচ্ছে ততদিন তারা খৈনি, বিড়ি, সিগারেট, গাঁজা, ভাং, মদ খেয়ে কাটাবে। নয়তো লোকের পকেট কেটে কিংবা দেহ বিক্রি করে চাকরির সুখ অনুভব করবে। অনুভব করবে কর্মসংস্থানের আনন্দ।

                                            লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।