বাঙালি এবং বাংলা
🟣 বিশ্বরূপ দাস
➡️ "মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা"
এই ভাষা আপামর বাঙালির প্রাণের ভাষা, মনের ভাষা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্য তার মৌচাকে নানা বিদেশি ভাষার আগমন ঘটবে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর আমরা শ্রমিক ও রানী মৌমাছির মতো "ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে এবং বুকের রক্ত দিয়ে" মৌচাক সম সেই ভাষার মর্যাদা রক্ষা করব সুনিশ্চিত।
কিন্তু মাঝেমধ্যেই মধু আনার নামে অনেকেই সেই মৌচাকে অহেতুক আঘাত করে। আর তার ফলেই মধু সৃষ্টির কারিগর বাঙালি চরিত্রের হয় তালভঙ্গ। বহু কষ্টে হাজার হাজার শ্রমিক মৌমাছি এতদিন ধরে বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্ৰহ করলেও তার পবিত্রতা আমরা অনেকেই রক্ষা করতে পারছি না।বরং সেই মধুকে চাক সমেত কেটে নিয়ে বাজারে গুড় মিশিয়ে বিক্রি করে দিতে উদ্যোত হচ্ছি বারে বারে। মধু নিয়ে মাধুকরী করলে তার একটা সম্মান থাকে। কিন্তু তার পরিবর্তে মাঝেমধ্যে যা হচ্ছে তা ছেনানীগিরি ছাড়া আর কিছু নয়। মাফ করবেন। মাতৃভাষার করুণ দশা দেখে বলতে বাধ্য হলাম।
আসলে আমরা অনেকেই কথায় কথায় ইংরেজি বলে তথাকথিত বাবু হতে চাই। জাহির করতে চাই আমাদের পাণ্ডিত্য। বন্ধুবান্ধব মহলে ইংরেজিতে কথা বলতে না পারলে স্টেটাস রক্ষা করা যায় না। পাওয়া যায় না অলিখিত হাততালি। আর সেই আভিজাত্যের দোহাই দিয়ে আমরা যেমন মাতৃদুগ্ধ সম মাতৃভাষাকে অবহেলা করছি একদিকে আর অন্যদিকে বাঙালি হিসেবে বড়াই করে কৌলিন্য বজায় রাখার চেষ্টা করছি। ভাবের ঘরে এ চুরি চলছে প্রতিদিন প্রতি নিয়ত, নানা আঙ্গিকে।আসলে আমাদের অন্তর ও বাহির এক নয়। সেই কারণে দ্বিচারিতারও জন্ম দিচ্ছি অতি শৈশব থেকে। স্কুলের রোল কল থেকে শুরু করে, অ্যাটেনডেন্স এর খাতায়, হিসাব বইয়ের পাতায়, মিড ডে মিলের আয়োজনে ইংরেজির ছড়াছড়ি। শুধু স্কুল কেন অফিস-আদালত, কোর্ট-কাছারি, পার্ক, শপিংমল, হোটেল, রেস্তোরাঁ, সাংস্কৃতিক ও বিনোদনের লোকমঞ্চ, সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন স্তরে আমরা বাঙালিরাই বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলছি। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে জন্মদিনের উৎসব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ এবং বিবাহ অনুষ্ঠানে বাঙালিয়ানা ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। বলা যেতে পারে ইন্টারনেটের রঙিন দুনিয়া আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রাস করছে বাঙালিয়ানাকে। তাই ধীরে ধীরে গৌরব হারাচ্ছে মাতৃভাষা। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্ৰিয় সেই ঘটিবাটি সানকি, তালাই, চাটাই গুলো। তার পরিবর্তে এসে যাচ্ছে ঝাঁ-চকচকে জিনিসপত্র। সেই কারণে ঠোকাঠুকি টাই বেশি হচ্ছে। তার ফলে জন্ম নিচ্ছে কিম্ভুতকিমাকার বকচ্ছপ জাতীয় শব্দ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাঙালি হয়ে কি ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষাচর্চা অপরাধ। উত্তরে বলি ভাষাচর্চা অপরাধ হতে যাবে কেন। যেকোনো ভাষার চর্চা নিজস্ব ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। শব্দ ভান্ডারের কায়া বৃদ্ধি হয়। ভাষা প্রতিমাও তিল তিল সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে হয়ে ওঠে তিলোত্তমা । মধু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে কেতকী কুশারী ডাইসনের মতো আধুনিক যুগের শত শত কবি-লেখক তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বাঙালি হয়ে অন্য কোন ভাষা চর্চা করতে পারবে না এমন মাথার দিব্যি কেউ কখনো দেয়নি। দেবেনা। আবার অবাঙালি কেউ বাংলা ভাষা চর্চা করতে পারবেনা এমন কাজির হুকুম কেউ কোনদিন করেনি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা বর্তমানে বাঙালি বলবো কাকে? আর তার সাথে বাংলা ভাষার সম্পর্ক কতটা মধুর হওয়া উচিত বা হবে? ধুতি-পাঞ্জাবি কিংবা কোর্তা পাজামা আর শাড়িতেই কী বাঙালিয়ানার প্রকৃষ্ট নিদর্শন? এতদিন পর্যন্ত সেই ধারণায় আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল ছিল। কিন্তু দ্রুত সময় বদলাচ্ছে,বদলাচ্ছে দিন। যুগের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়াটাই যুগের ধর্ম। তাই বর্তমান দিনে কোন একটি বিশেষ পোশাক কোন একটি জাতির নিদর্শন নয়। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে আমাকে বা অন্য কাউকে বিশেষ কোন জায়গার পোশাক পরিধান করতে হতেই পারে। বা ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছে করতেই পারে অন্য কোন জাতির প্রচলিত পোশাক গায়ে চাপিয়ে নিজের মনোবাসনা চরিতার্থ করা। এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে আহার ও পোশাকের ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধ থাকা হওয়া উচিত নয় বলে আমি মনে করি।
তবু সাদামাটাভাবে একথা বলা যায় পুরুষানুক্রমে যারা এই বাংলাদেশে আছেন এবং বাংলার সংস্কৃতিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে বাংলা ভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে এদেশের মাটিতেই লালিত-পালিত হয়েছেন তারাই বাঙালি। প্রশ্ন উঠতেই পারে তাহলে কি প্রবাসি বাঙালি, বাঙালি নয়। এর উত্তরে বলা যেতে পারে প্রবাসী বাঙালির শিকড়টা অবশ্যই বাঙালি। কিন্তু ডালপালাগুলো সে দেশের জল হাওয়ায় পুষ্ট হয়ে অনেকটাই অবাঙালি হয়ে গেছে। দোষটা অবশ্য ডালপালার নয়, শিকড়ের।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে পোশাক বা স্থান বদলালেও জাতির চরিত্র বদল হয় না। বাঙালি জাতির স্বাজাত্যবোধ, ভাষা প্রীতি, আতিথেয়তা, উৎসব প্রিয়তা, বৈঠকি মেজাজ যাবে কোথায় ? ঈদ মহরম, দুর্গাপূজা, নবান্ন উৎসব, ভাইফোঁটা, পিঠেপুলি পার্বণ, ঘুড়ির মেলা, বনোভোজন, মেলা খেলা, মাছ ভাত, পান্তা ভাত, হাডুডু, খোখো, কিতকিত, চোর পুলিশ, পুতুল বিয়ে, টোয়েন্টি নাইন, পুকুরে স্নান, ভোরের টহল, কীর্তন, বাউল গান, আকাশ প্রদীপ, বায়োস্কোপ, কাঠের নাগরদোলা এবং জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে আম কুড়াবার ধুমের মতো নানান টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে আছে বাঙালিয়ানা। আছে বাঙালি জাতির আভিজাত্য বোধ। যা সম্পূর্ণরূপে বাংলার বায়ু, বাংলার মাটি, বাংলার জল দিয়ে তৈরি। সেখানে অন্য কারোর স্থান নেই।
কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে। তাই বাঙালি যে দেশে যেখানেই থাকুন না কেন সেখানে সুযোগ পেলেই তারা নিশ্চিতভাবে তাদের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করবেন। জীবনধারণের ফাঁকফোকর দিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে আসবে বঙ্গ সংস্কৃতির সৌরভ সুগন্ধ। আর সেখানে স্বদেশীয় কাউকে পেলে আর তো কথাই নেই। কুলের কথা যতক্ষণ না খুলে বলছেন ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি পাবেন না। তখন মনে হবে আপনার জীবনের ধারাপাত থেকে ক্রমশ হারিয়ে জেগে থাকা বাংলাদেশটাই বুঝি উঠে এসেছে আপনার কাছে। সেই সময় এক চিলতে শরতের আকাশ, দিঘী ভরা জল, আম্রকানন, অন্ধ বাউলের একতারার ঝংকার, ভাটিয়ালি ও মুর্শিদীর গান শোনার জন্য আপনার মন যদি উচাটন হয়ে ওঠে তাহলে বুঝবেন আপনি বাঙালি। বাংলায় পড়ে আছে আপনার প্রাণ ভোমরা। আসলে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বাঙালি দূরে গেলেও, "নেভে না তার যন্ত্রণা যে, দুঃখ হয় না বাসি হারায় না তার বাগান থেকে কুন্দ ফুলের হাসি"… তাই গানে গানে, কথায় কথায়, সুরে সুরে এবং বঙ্গ প্রকৃতির আনাচে-কানাচে সমস্ত সত্তা দিয়ে সে তাকে খুঁজে ফেরে।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা স্মরণ করে এ আলোচনার পরিসমাপ্তি করব। তিনি তার "নব নব সৃষ্টি" প্রবন্ধে বলেছেন, "বাঙালির চরিত্রে বিদ্রোহ বর্তমান। " তবে সেই বিদ্রোহ অবশ্যই কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রতি নয়। রাজনীতি থেকে শুরু করে ধর্ম সাহিত্য এবং সমাজ জীবনে বাঙালি যখনই কোন ব্যভিচার, অসুন্দর এবং অশালীনতা দেখেছে তখনই তার বিরুদ্ধে "বিদ্রোহ করে "সত্য শিব সুন্দরের" প্রতিষ্ঠা করেছে। আবার সে বিদ্রোহ উচ্ছৃংখলতায় পরিণত হলে বাঙালি তার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করেছে। মনে রাখতে হবে এ বিদ্রোহ বাঙালি হিন্দুর ভিতরে সীমাবদ্ধ নয়। বাঙালি মুসলমান এ কর্মে পরম তৎপর। ধর্ম বদলালেই জাতির চরিত্র বদলায় না। "
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক