চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

"তবু অনন্ত জাগে"


 

"তবু অনন্ত জাগে"


🟣 বিশ্বরূপ দাস 



➡️ নব যুগের বাণী নিয়ে এ ধরার বুকে যুগে যুগে কালে কালে যেসব মহামানব জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের একজন হলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরুর ১৬০ তম জন্মদিন। অন্য বছর এই সময়ে তার সেই শুভ জন্মতিথি কে সাদরে বরণ করে নেবার জন্য চারিদিকে চলে কত না আনন্দ আয়োজন। কিন্তু এবার সেই আনন্দের পালে আছড়ে পড়েছে করোনার টর্ণেডো। ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে মানুষের সাজানো সংসার। জীবন সমুদ্রের গহবরে হারিয়ে গেছে কত না সোনার তরী। এক এক করে নিভে গেছে কত স্বপ্নের দেউটি। চারিদিকে ভেসে আসছে শুধু স্বজন হারানো কান্না। ভয় আর হতাশায় প্রতিটি মানুষ যেন বেঁচে থেকে মৃত। তার সাথে হাত মিলিয়েছে রাজনৈতিক হিংসার দানব। সব মিলিয়ে কঠিন এক দুঃসময়ের মুখোমুখি আমরা। কবির কথায় "ওই বেদনা আমার বুকে বেজেছিল গোপন দুখে দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো গভীর হৃদয় ক্ষত"। কিন্তু এই দুঃখ কষ্ট বেদনা মানুষের জীবনের শেষ কথা হতে পারে না। কারণ আমরা জানি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে

"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে

তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে "

সেই চির শান্তি এবং অনন্তের পথ দেখান যিনি তিনি হলেন কবি সম্রাট কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।যার জন্মের এই প্রথম শুভক্ষণে হোম আইসোলেশনে থেকেও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে বলতে পারি -

"হে নূতন

দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ

তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন

সূর্যের মতন।....

ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,

ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চির বিস্ময়। "


তবে ঘরে বসে শুধু" জীবনের জয়" ঘোষণা করলে বা নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে কান্নাকাটি করলে বর্তমান এই সময় কাল থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। তার জন্য রবীন্দ্র চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল শঙ্কা এবং ভয় কে দূরে সরিয়ে সাহসী সেনার মতো পথে নামতে হবে। জগতের মঙ্গলকর্মে সব কাজে হাত লাগাতে হবে। "তাহার পরে আঁধার ঘরে

প্রদীপখানি জ্বালিয়ে "রাখতে হবে। মরণ এলে সপ্রত্যয়ে বলতে হবে "মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো "।

 পাশাপাশি এই বিশ্বধাতার যজ্ঞশালায় আত্মহোমের বহ্নিজ্বালা নিয়ে সকল দুঃখ বিপদ তুচ্ছ করার কঠিন কাজে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য সেই রবীন্দ্রনাথেই ভরসা রেখে বলতে হবে

"আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে

আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে"


আসলে রবীন্দ্রনাথ হলেন এমন একজন কবি যিনি তার সাহিত্যের অমৃতবীনা বাজিয়ে আমাদের 

"নিবিড় অমা -তিমির হতে " "শুক্ল রাতে চাঁদের তরণী "বেয়ে নিয়ে যান "তিথির পরে তিথির ঘাটে"।তৃষিত প্রাণে বয়ে দেন ভাব মন্দাকিনির ধারাস্রোত। আশায় আশায়, প্রেম ভালোবাসায় নবজীবনের আনন্দ দান করেন। দেন সত্যের সন্ধান।

সেইকারনে সেই মহাশক্তি তিমির বিদারী কবির কাছে নতজানু হয়ে আমাদের বলতে ইচ্ছে করে

"অগ্নিশিখা, এসো এসো, আনো আনো আলো

দুঃখে সুখে ঘরে ঘরে গৃহদীপ জ্বালো।

আনো শক্তি, আনো দীপ্তি, আনো শান্তি, আনো তৃপ্তি

আনো স্নিগ্ধ ভালোবাসা, আনো নিত্য ভালো"।


রবীন্দ্রনাথ শুধু কাব্যমালঞ্চের মালাকার নন। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, পরিবেশ প্রেমী, শিক্ষাবিদ, দেশপ্রেমী আবার অন্যদিকে কৃষ্টি সৃষ্টি সংস্কৃতি এবং লাঞ্চিত মানবাত্মার অগ্রদূত। সারাজীবন তিনি শুধু সুন্দরের আরাধনা করেননি, অসুন্দরের প্রতি উচ্চারণ করেছেন ধিক্কার বাণী। সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ যাত্রাতেই তার কবি প্রাণ তৃপ্ত হয়নি বরং মর্ত্য পৃথিবীর প্রতি ধ্বনিত হয়েছে গভীর মমতা প্রীতি। তাই যেখানে তিনি দেখেছেন নৈতিক অধঃপতন, বিবেক বর্জনের দিনলিপি, রাজনৈতিক রাহুগ্রাস, হতাশা, অস্থিরতা, এবং ধন বিলাস সেখানেই তার কলম কাব্যিক তলোয়ারের মতো ঝলসে উঠেছে। কখনও তীব্র শ্লেষের সঙ্গে তিনি বলেছেন "দস্যু -পায়ের কাঁটা -মারা জুতোর তলায়

বীভৎস কাদার পিন্ড

চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে”।

কখনও শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি গভীর সহানুভূতিতে বলেছেন -

"ওরা কাজ করে

দেশে দেশান্তরে

অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের ঘাটে ঘাটে

পঞ্জাবে বোম্বাই গুজরাটে "


আজ পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে আলাদা। চারিদিকে ঝঞ্ঝার ঝঙ্কার, "অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে "। "আঁধার অম্বরে প্রচন্ড ডম্বরু"বাজিছে 'গম্ভীর গরজনে '। কোথাও প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই। নেই জীবনের নিশ্চয়তা। ভয়ার্ত যামিনীর ক্রন্দন দুরন্ত ঝটিকার মতো জীবন আকাশে দুয়ারে আঘাত হানে বারে বারে। এখান থেকে মানুষ মুক্তি চায়। চায় আলো। চায় হিংসা, দ্বন্দ্ব, রক্তপাত, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, ধর্মান্ধতা, এবং মহামারীর হাত এড়িয়ে এক সুখ স্বপ্নে ভরা নির্মল প্রভাত। সেটি পেতে গেলে আমাদের ডুব দিতে হবে রবীন্দ্রসাগরের পবিত্র নীরে। কারণ রবীন্দ্র সাহিত্য তো শুধু জীবনের যথাযথ চিত্রাঙ্কন মাত্র নয়, সমগ্র দেশ ও জাতির আশা আকাঙ্খার এবং সত্যানুসরনের এক অভ্রান্ত পরিচয়পত্র। সাংস্কৃতিক মহামিলনের মহাগীত। তিনি তার কথা দিয়ে, ভালোবাসায় গাঁথা মালা দিয়ে আমাদের অন্তরের সকল দীনতা মলিনতার অবসান ঘটান। চিত্তশুদ্ধি ঘটিয়ে সত্যপোলব্ধির মহৎ প্রেরণা দান করেন। দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। আবার সৌভ্রাতৃত্বের সাথে অসম্প্রদায়িকতা ও একতার গান শোনান। তাই এই শুভ জন্মদিনে তার কাছে করজোড়ে আমাদের সকলকে বলতে হবে -

"আমার এ ঘরে আপনার করে

 গৃহদীপখানি জ্বালো হে

সব দুখশোক সার্থক হোক

লভিয়া তোমারি আলো হে। "