Image courtesy : emedicine health.com
"পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ" বর্তমানে মহিলাদের একটি জ্বলন্ত সমস্যা
🟣 ডাঃ এন. সি. মন্ডল
➡️ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা স্টেইন লিভেনথাল সিনড্রোম (ডাঃ স্টেইন এবং লিভেনথাল 1935 সালে এই সিনড্রোম কে ব্যাখ্যা করেছিলেন তাদের নাম অনুসারে স্টেইন লিভেনথাল সিনড্রোম নামকরণ হয়েছে)। পি.সি.ও.ডি বা পি.সি.ও.এস নামক এই হরমোন ঘটিত রোগটি বর্তমানে মহিলাদের কাছে একটি জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পলিসিস্টিক ওভারি একটি নির্দিষ্ট কোনো রোগ নয়, রোগ লক্ষণাবলীর সমষ্টি, সেইজন্য এই উপসর্গগুলি কে একসঙ্গে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা PCOS বলা হয়। সিনড্রোম কথার অর্থ অনেকগুলি লক্ষণ বা উপসর্গ একসাথে দেখা দেওয়া। বেশিরভাগ মহিলারাই এখন এই রোগে ভুগছেন তাই তাদের কাছে এই রোগ বিশেষ পরিচিত। চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখেছি যে এই রোগ 12-13 বছরের কিশোরী থেকে শুরু করে 23 - 24 বছরের যুবতীদের আবার কোন কোন ক্ষেত্রে 34 -35 বছরের মহিলাদেরও হচ্ছে। বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর পর মহিলাদের ওভারি বা ডিম্বাশয় সক্রিয় হতে শুরু করে এর ফলে কোষে পরিবর্তন দেখা দেয়। ওভারি থেকে ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোন এবং পিটুইটারি গ্রন্থি হতে নিঃসৃত লিউটিনাইজিং হরমোন (LH) এবং ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন(FSH) এর স্বাভাবিক ক্ষরণ ঋতুচক্র (Menstrual Cycle) কে স্বাভাবিক রাখে। এইসব হরমোনের অস্বাভাবিকতার কারণে ওভারির কাজ ঠিকমতো হয় না অর্থাৎ ওভারি থেকে ওভাম বা ডিম্বাণু ঠিকমতো নির্গত হয় না ফলস্বরূপ ওভারির মধ্যে তরল পদার্থে পূর্ণথলির সৃষ্টি হয় - যাকে আমরা বলি সিস্ট (এই সিস্ট আসলে অপরিণত থলি) অর্থাৎ যে সকল ফলিকল ঠিকমত ডেভেলপ করলো না সেগুলি মালার মতো ওভারির গায়ে জড়িয়ে থাকে ফলে ওভারি বড় হয়ে যায় যাকে আমরা স্থূল ওভারি (Bulky Ovary) বলি। এই ক্ষেত্রে পুরুষ হরমোন অ্যানড্রোজেন বা টেস্টোস্টেরন এর বিশেষ ভূমিকা থাকে। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজের একটি সাধারণ কারণ হচ্ছে পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লিউটিনাইজিং হরমোন (LH) এর অতিরিক্ত ক্ষরণ। এই অতিরিক্ত লিউটিনাইজিং হরমোন পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন এর ক্ষরণ পুরুষদের শরীরেই বেশি হয়। এই হরমোনের প্রভাবে ওভারির স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হয় । স্বাভাবিক ক্ষেত্রে পলিসিস্টিক ওভারি না থাকলে পিটুইটারি গ্রন্থি নিঃসৃত ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) লিউটিনাইজিং হরমোন (LH) এর থেকে বেশি ক্ষরিত হয়। ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন ওভারি থেকে ডিম্বস্ফুটনে সহায়তা করে, কিন্তু পলিসিস্টিক ওভারির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয় এর উল্টো অর্থাৎ লিউটিনাইজিং হরমোন(LH) এর ক্ষরণ ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন(FSH) এর থেকে বেশি হয়। যদি এই উপসর্গের কোন চিকিৎসা করা না হয় তাহলে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের কিছু অংশ স্ত্রী হরমোন ইস্ট্রোজেনে পরিবর্তিত হতে পারে এর ফলে প্রজেস্টেরন নামক স্ত্রী হরমোনের নিঃসরণ কম হয় এবং এই কম লেভেলের প্রজেস্টেরন বেশি নিঃসৃত হওয়া ইস্ট্রোজেনের কার্যকারিতার মধ্যে কোন সমতা থাকে না অর্থাৎ ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোনের ভারসাম্য বজায় থাকে না। এই অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে জরায়ুর পর্দা বা লাইনিং (এন্ডোমেট্রিয়াম ) পুরু হয়ে যেতে পারে এবং এই রোগটার সম্বন্ধে হয়তো এখনো অনেকেই পরিচিত বিশেষ করে টিনএজার মহিলারা। এর ফলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে এন্ডোমেটিয়াম হাইপারপ্লাসিয়া বলা হয়। ভবিষ্যতের জরায়ুর পর্দা বা লাইনিং এর ক্যান্সার (এন্ডোমেট্রিয়াল কার্সিনোমা) এর সম্ভাবনা কিছু ক্ষেত্রে থাকতে পারে। বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মহিলা বন্ধ্যাত্বের কারণ হিসাবে 15 থেকে 20 শতাংশ মহিলার পলিসিস্টিক ওভারি থাকে। লেখার শুরুতেই বলেছি যে পলিসিস্টিক ওভারি একটি হরমোন ঘটিত সমস্যা। এই রোগটা যে কেন হয় তার আসল কারণ জানা যায়নি। তবে অত্যধিক মোটা বা স্থূল হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ফাস্টফুড বা জাঙ্ক ফুড খাওয়া,পরিশ্রম বিমুখতা, অনিয়মিত খাওয়া বা যখন তখন খাওয়া প্রভৃতি অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাত্রা পদ্ধতির ভূমিকা এর পিছনে থাকতে পারে। এই রোগের উপসর্গ হিসাবে দেখা দেয় অনিয়মিত ঋতুস্রাবের সমস্যা। অনেক মহিলাদের যৌবন প্রারম্ভে বা পিউবার্টির সময় পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব শুরু হয় না আবার অনেক মহিলাদের পিরিয়ড শুরু হলেও তা হয় খুবই অনিয়মিত। এইসব মহিলাদের ওভারি থেকে ডিম্বস্ফুটন বা ওভুলেশন হয় না। এইসব মহিলাদের শরীরে পুরুষ হরমোন বা অ্যানড্রোজেন এর মাত্রা বেশি থাকায় পুরুষদের শরীরের কিছু লক্ষণ দেখা যায় যাকে বলে ম্যাসকুলিনাইজেশন বা ভিরিলাইজেশন।
লক্ষণস্বরূপ দেখা দেয় স্বরের পরিবর্তন, প্রচুর ব্রণ, স্তনের সাইজ ছোট, পুরুষদের মত বুকে, মুখে, শরীরে লোম এর আধিক্য বা হিরসুটিজম। অনেক মহিলাদের পলিসিস্টিক ওভারি সমস্যার সঙ্গে ইনসুলিন হরমোনের সমস্যা জড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলে ইনসুলিন উৎপাদন বা ক্ষরণের পরিমাণ বেড়ে যায় অথবা যে ইনসুলিন ক্ষরিত হচ্ছে তা স্বাভাবিক ভাবে কাজ করে না এবং দেহে ইনসুলিনের প্রতিরোধ বাড়ে যাকে আমরা ডাক্তারি ভাষায় Insulin Resistant বলি, ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ এবং শরীরে মেদ বাড়ে অর্থাৎ ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয় এবং কিছু ক্ষেত্রে পরে ডায়াবেটিস এর সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখেছি, যে সকল মহিলারা পলিসিস্টিক ওভারি তে ভুগছেন তাদের বেশিরভাগই স্থূলাকায়। আবার এও দেখেছি অনেক পলিসিস্টিক ওভারি তে আক্রান্ত মহিলাদের শরীরে লোমের আধিক্য থাকে না, স্থূলাকায় নয় কিন্তু তাদের পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব খুবই অনিয়মিত। রোগীর লক্ষণ এবং রোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করে অনেক সময় পলিসিস্টিক ওভারি সম্বন্ধে ক্লিনিক্যালি রোগ নির্ণয় করা হয়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হরমোন পরীক্ষা যেমন লিউটিনাইজিং হরমোন(LH), ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন(FSH), প্রলাকটিন(PROLACTIN), থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন(TSH), অ্যান্টি মুলেরিয়ান হরমোন(AMH) এবং পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরন (Testosteron) এর মাত্রা দেখে নিয়েও এই রোগ সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যায়। আলট্রাসোনোগ্রাফি (USG) করে বলে দেওয়া যায় পলিসিস্টিক ওভারি আছে কিনা। প্রয়োজনে ট্রান্স ভ্যাজাইনাল আলট্রাসোনোগ্রাফির (TVS) সাহায্যও নিতে হতে পারে। আলট্রাসোনোগ্রাফিতে দেখা যায় যে ওভারিতে ছোট ছোট জল ভরা থলি (ফলিকল) বা সিস্ট রয়েছে। এদের পরিমাপ সাধারণত 2 থেকে 9 মিলিমিটার হয়। প্রয়োজনে সিটিস্ক্যানের (Computerized Tomography Scan) মাধ্যমে ওভারি বা অ্যাডরেনাল গ্রন্থির মধ্যে কোনো টিউমার আছে কিনা এবং যা থেকে পুরুষ হরমোন বেশি তৈরি (ক্ষরিত ) হচ্ছে কিনা জানারও প্রয়োজন হতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা দেয় যে সন্তানের জন্মদান এর পরে পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যা চলে যায়। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজের কোন ম্যাজিক চিকিৎসা নেই অর্থাৎ খুব সহজেই এই রোগকে সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়। চিকিৎসার দ্বারা রোগের উপসর্গ কে কমানো যায়। চিকিৎসার ব্যাপারে রোগীর লক্ষণ কতটা বাড়াবাড়ি, রোগীর বয়স, বিবাহিত জীবনের ইতিহাস এবং তার গর্ভধারণের পরিকল্পনা, হরমোনের অস্বাভাবিকতার কারণ, জীবনযাত্রা মানের ইতিহাস, বিপাকীয় সমস্যা (মেটাবলিক ডিসঅর্ডার) প্রভৃতি জেনে নিয়ে তার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হয়। সাধারণত মুখে সেবন করা ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন হরমোন পিল, ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (যা ওভারি কে স্টিমুলেট করে ওভুলেশনে সহায়তা করে), উচ্চশক্তির প্রোজেস্টেরন হরমোন (যা বর্ধিত পুরুষ হরমোনের কাজ কে ব্লক করে), গোনাডোট্রফিন রিলিজিং হরমোন (যা ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন এবং হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রফিন হরমোন নির্গমন কে স্টিমুলেট করে) দিয়ে পলিসিস্টিক ওভারির চিকিৎসা করা হয়। এইসব ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুবই বেশি এবং দীর্ঘ ব্যাবহারে বিপদ ঘটতে পারে। যদি কারও ইনসুলিন লেভেল বেশি থাকে বা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সে আক্রান্ত হয় তার ক্ষেত্রে ব্যায়াম, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে ওষুধ দিয়ে ( হাইপোগ্লাইসিমিক এজেন্ট ) কমানোর চেষ্টা করা হয়। কিছু কিছু মহিলার ক্ষেত্রে দেখা যায় ওজন হ্রাস করে ইনসুলিন লেভেল কমে গেলে ডিম্বস্ফুটন বা ওভুলেশন শুরু হয়। ওজন-হ্রাস সাহায্য করতে পারে জরায়ুর পর্দা বা এন্ডোমেট্রিয়াম এর ঘনত্ব কমাতে এবং শরীরে অস্বাভাবিক চুলের বৃদ্ধি রোধ করতে। সুতরাং পলিসিস্টিক ওভারি রোগীর ক্ষেত্রে লাইফ স্টাইল মডিফিকেশন বা জীবনশৈলীর পরিবর্তনের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়। যদি ওষুধ দিয়ে লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করেও কোন ফল না হয় বিশেষ করে বন্ধ্যাত্বের ক্ষেত্রে (বন্ধ্যাত্ব নিবারণ এবং গর্ভধারণ করতে গেলে) ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি বা ওভারিয়ান ড্রিলিং সার্জারি করে ওভারি থেকে ওভাম নির্গত হওয়ার রাস্তাকে সুগম করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। তাই শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যারা স্থূলাকায় তাদের শরীরের ওজন কমাতে হবে। ওজন কমানোর জন্য খাদ্য নিয়ন্ত্রণ যেমন কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাদ্য, তেল বা চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ কমাতে হবে। জাঙ্কফুড, ফাস্টফুড, বা চটজলদি খাবার, চিনি বা চিনি দিয়ে তৈরি খাবার, চকলেট, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিঙ্কস খাওয়া বন্ধ বা যতটা কম খাওয়া যায় (আমার মতে না খাওয়াই ভালো) সেদিকটাও নজর দিতে হবে। iনিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে (এক্ষেত্রে প্রতিদিন 45 মিনিট হাঁটা এবং কম বয়সীরা যাদের খুব স্থূল শরীর নয় তাদের লাফদড়ি খেলা বা স্কিপিং করা)। পলিসিস্টিক ওভারি না কমলে ভবিষ্যৎ বা পরবর্তী জীবনে বন্ধ্যাত্ব, ঋতুচক্র দেরীতে বা অনিয়মিত হওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের আশঙ্কা, ইস্ট্রোজেন হরমোন বেশি থাকার জন্য জরায়ুর ক্যান্সার (এন্ডোমেট্রিয়াল কার্সিনোমা), স্তন বা ব্রেস্ট ক্যান্সারের আশঙ্কা থাকে। সেই জন্য সব সময় আমরা লক্ষ্য রাখি জরায়ুর পর্দা বা এন্ডোমেট্রিয়ামের ঘনত্বর দিকে । এন্ডোমেট্রিয়াম এর ঘনত্ব খুব বেশি থাকলে সেই ক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিয়াল কার্সিনোমার আশঙ্কা থাকতে পারে। তবে এই প্রতিবেদনটি পড়ার পর ক্যান্সার নিয়ে কেউ আশঙ্কায় ভুগবেন না। পলিসিস্টিক ওভারি হওয়া মানেই যে ক্যানসার হবে তার কোনো মানে নেই। পলিসিস্টিক ওভারির চিকিৎসা বিভিন্ন রোগীর উপর রোগের উপসর্গ দেখে বিভিন্নভাবে করা হয়। তাই এই ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসা বিধান না দিয়ে রোগ সম্বন্ধে একটা ধারণা উপস্থাপন করলাম মাত্র। আশা করি, এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা উপযুক্ত অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসকের নির্দেশ বা পরামর্শ মেনে এই রোগ সারিয়ে তোলার ব্যাপারে চিকিৎসকের সহিত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজেকে রোগ মুক্ত করবেন।