চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

তৃণমূল সুপ্রিমোর স্বপ্নের উত্থান এবং বঙ্গের ভবিষ্যৎ


 

তৃণমূল সুপ্রিমোর স্বপ্নের উত্থান এবং বঙ্গের ভবিষ্যৎ


🟣 বিশ্বরূপ দাস 


 ➡️ শুধুমাত্র প্রখর ব্যক্তিত্ব আর লড়াকু মানসিকতার জন্য নয় কর্ম ও ধর্মের নিরিখে, ন্যায় ও আদর্শের খতিয়ানে, প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়নে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রীর নাম সর্বাগ্রে আসে তার মধ্যে অন্যতম হলেন গণতন্ত্রের পূজারী মানবতার সেবক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

হয়তো আমাকে সবাই ঘাসফুলের মালী বলে ভাবতে শুরু করেছেন। ভাবতেই পারেন। আসলে যে কোনও ফুলই আমার প্ৰিয় সে জলফুল আর স্থলফুল হোক। সৌরভ সুগন্ধ পেলেই হলো, ফুল বিচার করে কী হবে। মানুষের মঙ্গল উৎসবে সেটাই কাম্য। তাই হাতে কাস্তে নিয়ে চাঁদের আলোয় মাঠে এসেছি ফুলেল হাওয়ায় ফুলের সাথে মাটির সাথে প্রাণের কথা বলবো বলে। ইচ্ছে হলে একতারাটা আপনারা বাজাতে পারেন । সুযোগ পেলে খোলা মাঠে দু-একটা জীবনমুখী গান গাওয়া যাবে।

কোনও রাখঢাক না রেখে প্রথমেই বলি তৃণমূল সুপ্রিমো মমতাদি এক দিনের নেত্রী নন। এমনকি কোনও স্বার্থ নিয়ে অন্যদের মতো বেনো জলে ভেসে আসেননি। ১৯৭০ সালে কলকাতার যোগমায়া দেবী কলেজে পড়ার সময় থেকে রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি। তারপর সুদীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী ধরে লড়াই করে করে তিনি শক্ত করেছেন পায়ের তলার মাটি। তবে তার এই যাত্রাপথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল কন্টকাকীর্ণ। সেই কন্টকে কতবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তার পা। তবুও তিনি থামেননি। ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাইয়ের মতো জান কবুল করে ন্যায় সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য এগিয়ে গেছেন। সিপিএমের গুন্ডাবাহিনীর হাতে কতবার মার খেয়ে হয়েছেন মৃত্যু পথযাত্রী। তবুও দমেননি । তাকে দমানো যায়নি। আবার জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা, দাদাগিরি, বাংলার অনুন্নয়ন এবং দিল্লি কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই শুরু হয় মতান্তর। সেই মতান্তর থেকে একদিন ঠিক করেন এই সার্কাস পার্টিকে বিদায় জানাতে হবে। বাংলার মানুষকে সৌরভে সুগন্ধে ভরিয়ে দিতে হলে তার বুকে ফোটাতে হবে নতুন ফুল। তারই চরম পরিণতি হিসাবে জাতীয় কংগ্রেস কে (মাদার) টাটা জানিয়ে তিনি শুরু করেন একলা চলার নীতি। মনে মনে বলে ওঠেন কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গান, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে "। সেই গানের সাথে প্রাণকে এক করে মাত্র গুটিকয়েক বিশ্বস্ত সেনাকে নিয়ে তিনি পথ চলতে শুরু করেন। যা আজ সত্যিই ইতিহাস। সেই ইতিহাসের আজ তিনি কিংবদন্তি নায়িকা। দীর্ঘ ১১ বছর পশ্চিমবঙ্গের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। বিরাট একটা রেকর্ডের মুখে দাঁড়িয়েও লড়াইটা তার কিন্তু থামেনি। বরং যতদিন যাচ্ছে ততবেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি। এ চ্যালেঞ্জ শুধু গদি টিকিয়ে রাখার নয়। এ চ্যালেঞ্জ সাম্প্রদায়িকতার, ধর্ম নিরপেক্ষতার। তার এ লড়াইয়ের প্রতিটি অণু পরমানুতে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার উন্নয়ন। আছে গরিব, শ্রমিক, কৃষক, পিছিয়ে পড়া সাধারণ মেহনতি মানুষের স্বার্থ। আছে কুটির শিল্প, হস্তশিল্প থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন। সংখ্যালঘু মানুষ থেকে শুরু করে তপঃশীল জাতি, উপজাতি মানুষের স্বার্থ। আছে নব শিক্ষার্থী থেকে নতুন প্রজন্মের ভবিষৎ। তাই তাকে প্ল্যান করে মেরে ফেলার জন্য (পড়ুন পরাজিত করার জন্য) মহাভারতের সপ্তরথীর মতো যেন ঘিরে ধরেছে কেন্দ্রের রথী মহারথীরা। তার সাথে হাত মিলিয়েছে ঘর শত্রু বিভীষনের দল। তারও বাইরে অপেক্ষা করছে নানুর, সাইঁবাড়ি, মরিচঝাঁপি, নন্দীগ্রাম, তাপসী মালিক হত্যাকান্ডের যোদ্ধারা। যাদের এক হাতে রয়েছে গুন্ডা মাফিয়া লুঠেরা আর অন্য হাতে উগ্র ধর্ম সম্প্রদায়ের নায়করা। তারা একের পর এক শক্তিশেল হানছেন। কখনও কদর্য কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ শানাচ্ছেন, কখনও ধর্মের বিষ দিচ্ছেন উগড়ে, কখনও বা সিবিআই কিংবা সেন্ট্রাল ফোর্স লেলিয়ে দিচ্ছেন। কখনও ব্যক্তি আক্রমণ করে ভেঙে দেবার চেষ্টা হচ্ছে তার মনোবলকে। অন্যদিকে তিনি মহাবীর কুম্ভের মত একা হাতেই রক্ষা করছেন নকল বুঁদিগড়ের মতো মমতায় ভরা বাংলার কেল্লাকে।

তিনি বিলক্ষণ জানেন এ লড়াই কঠিন। কেন্দ্রের বিষ নজরে তিনি। সারদা, নারদা থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে ফাঁসানো হতে পারে তাকে এবং তার সেনানীদের। কিন্তু তিনি এসব ভয় করেন না। তাই কালি ছেটালেও সে কালি তার গায়ে লাগেনি। সাদা শাড়িকে বিন্দুমাত্র কলঙ্কিত করেনি। বরং সেই কালি দিয়ে লিখেছেন বাংলার ভবিষ্যতের ইতিকথা।

 গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের একটা মাখামাখি সম্পর্ক আছে বৈকি। উন্নয়ন না হলে, ক্ষমতাসীন দল ঠিকঠাক কাজ করতে না পারলে মানুষ তাকে গ্রহণ করবে কেন ? দুই একবার অপরের দেখে টোকাটুকি করে পাশ করা যায়। কিন্তু বারবার নয়। যদি তাই হয় তাহলে তা পরীক্ষকের নজরে পড়বেই। প্রথা মত শাস্তিও পেতে হবে। ঠিক তেমনি মানুষের জন্য এক্কেবারে কিছু না করতে পারলে মানুষই একজোট হয়ে তাঁর ক্ষমতা কেড়ে অন্য দলকে উপহার দেবে। যেমনটি হয়েছিল বাম ও কংগ্রেস জমানায়। এবার কার পালা সেটা সময় উত্তর দেবে। তবে তার আগে আমরা অবশ্যই বাম ও ডান জমানায় ঠিক কী কী উন্নয়ন হয়েছিল এবং কেনই বা তাদের পতন হলো একটু দেখে নেওয়া যাক।

 বাম আমলে ভূমি সংস্কার হয়। পাট্টা এবং বর্গা সহ অধিক ফলনশীল বোরো চাষের বিস্তার হলে গরিব মানুষের সত্যিই অনেক উপকার হয় । এছাড়াও পঞ্চায়েত ত্রিস্তর বাস্তবায়িত হয় । স্কুল সার্ভিস কমিশন চালু হলে বহু শিক্ষিত বেকার যুবকের স্বপ্ন পূরণ হয়। পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের সম্মানজনক বেতন ক্রম চালু করে বাম সরকার। অবৈতনিক শিক্ষা চালু করলেও কোন এক অজানা কারণে ইংরেজি তুলে দেওয়া হয়। তার ফলে শুরু হয় জেনারেশন গ্যাপ। ঠিক সেই কারণেই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে ইংলিশ মিডিয়ামের মত বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত অনেকটাই ঠিক ছিল কিন্তু গোল বাধে শিল্পের নামে গরিব মানুষদের কাছ থেকে জোর করে জমি কেড়ে নিতে শুরু করলে। শুরু হয় সীমাহীন সন্ত্রাস, লুঠতরাজ এবং স্বজনপোষণ। স্কুল কলেজ থেকে সরকারি দপ্তরে কার চাকরি হবে আর কার হবেনা তা ঠিক করে দিতেন পার্টির নেতারা। এমনকি পরিবারের ছোটখাটো ঘটনায় পার্টি অফিসের খবরদারি এবং নিজের ভোট নিজে দিতে না পারার যন্ত্রণা সাধারন জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তাই মানুষের ক্ষোভের চোরা স্রোতের দুর্বার বন্যায় দীর্ঘ ৩৪ বছরের মসনদ বাস্তিল দুর্গের মতো ভেঙে পড়তে দেরি হয়নি ।


স্বাধীনতা লাভের পর দেশের সর্বত্র ছিল জাতীয় কংগ্রেসের রাজত্ব। তাই প্রথমদিকে অতটা খাওয়াখায়ি শুরু হয়নি। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, নবরত্ন শিল্প প্রভৃতির মধ্য দিয়ে দেশের উন্নয়ন শুরু হয়। যদিও বিভেদের বীজ জওহরলাল এবং গান্ধী নিজের হাতেই বপন করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ব্যাঙ্ক ও কয়লা জাতীয়করণ হয়। ডিফেন্স সিস্টেম কে ঢেলে সাজাবার চেষ্টা করেন। পঞ্চায়েত ত্রিস্তর ব্যবস্থার প্রস্তাব আনা হয়। রাজীব গান্ধীর আমলে কম্পিউটার ও আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার পালে লাগে নতুন হাওয়া। মনমোহনের সময় অর্থনীতি দেশকে নতুন দিশা দেখায়। তার আমলেই শুরু হয় ১০০ দিনের কাজ এবং মিড ডে মিলের মতো জনহিতকর কাজ। কিন্তু কথায় আছে পাপ বাপকে ছাড়ে না। তাই সিদ্ধার্থ শঙ্করের আমলে নকশাল দমনের নামে বেকার যুবক নিধন উল্লাস, ইন্দিরার মৃত্যুর পর শিখ নিধন, গুন্ডারাজ থেকে শুরু করে বোফর্স কেলেঙ্কারি, কয়লা কেলেঙ্কারি, জি জা জি কেলেঙ্কারি, স্পেক্টট্রাম কেলেঙ্কারি দেশের মানুষ ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি পরিবার তন্ত্রের একাধিপত্য এবং গরিব মানুষদের সীমাহীন শোষণ চক্রান্তকে। তাই ৭৭ এর নির্বাচনে কংগ্রেসের পায়ের তলার মাটি নড়বড়ে হয়ে যায়। জনতা দলের হাত ধরে ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট।

বাম আমলের দুর্নীতি আর ঔদ্ধত্যের উপর শেষ আঘাত টি হানেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১এর নির্বাচনে ২৯৪ টি আসনের মধ্যে ২২৭ টি আসন লাভ করে কার্যত বামফ্রন্টের মৃত্যু ঘন্টা তিনি বাজিয়ে দেন। কিন্তু এর মধ্যে নয় নয় করে পেরিয়ে গেছে আরও দশটি বছর। কালীঘাটের পাশের গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল।বেনোজলও ঢুকেছে অনেক। তবুও তার মধ্যে রাজ্যের উন্নয়নের তালিকা নেহাত কম নয়। তবে তৃণমূল যে ধোয়া তুলসীপাতা তা বলছি না। তার নামে ভোট সন্ত্রাস থেকে শুরু করে পায়ে দেওয়া রাজনীতি, অনুদান, সংখ্যালঘু তোষণ, স্বজনপোষণ এবং সিন্ডিকেট রাজের মদত দেওয়ার অভিযোগ গুলি রয়েছে। তা সত্বেও মানুষ কিন্তু খোলা চোখে তার উন্নয়ন গুলি দেখতে পাচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করছে স্বাস্থ্য সাথী, সবুজ সাথী থেকে শুরু করে রূপশ্রী, কন্যাশ্রী, কৃষি কল্যাণের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা। দিদিকে বলো কিংবা দুয়ারে সরকারের মতো ব্যবস্থাপনায় বহু মানুষ যে উপকৃত সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলার এমন কোন গ্রাম নেই যে সেখানে বিদ্যুতের আলো পৌঁছায় নি, রাস্তা ঘাট উন্নত হয়নি কিংবা পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়নি। জঙ্গলমহলের মতো বিভিন্ন জায়গায় ২ টাকা কেজি চালের ব্যবস্থা মমতার সরকার প্রথম করেন। লকডাউনে রাজ্যের সর্বত্র বিনা পয়সায় রেশন, ইমাম- পুরোহিত -বিধবা -বেকার ভাতা, ক্রীড়া ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদানের জন্য ক্লাবগুলোকে অর্থ সাহায্য, দুর্গা পূজার অনুদান, পড়াশুনার সুবিধার্থে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের বিনা পয়সায় ট্যাব বিতরণ এর আগে কোন সরকার স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি। বাম ডান কোন আমলেই এ ধরনের কোনও প্রকল্পের সুবিধা বাংলার মানুষ পেয়েছে বলে জানা নেই। তাই বলতেই হয় এই ধরণের কর্মের নিরিখে তৃণমূল সুপ্রিমো তার পূর্বসূরীদের থেকে অনেক এগিয়ে । সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অর্গানাইজেসনের দেওয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে তৃণমূলের শাসনকালে (২০১১-২০১৫ রিপোর্ট অনুযায়ী ) কৃষি, শিল্প, পরিসেবা ছাড়াও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার বাম এবং ডান আমলের তুলনায় অনেক বেশি হয়েছিল। তারপর আবার (১৬-১৯ সালে) নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের জি ডি পি দাঁড়ায় ৫.৩% যা গোটা দেশের তুলনায় খুবই কম। এছাড়াও শিল্পের ক্ষেত্রে মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই সরকার । শিক্ষাক্ষেত্রেও অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ অনেকটাই পিছিয়ে। যদিও তার দায় সবটাই রাজ্যের নয়। দেশজুড়ে মন্দাক্রান্তা শিল্পপরিবেশ এবং কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষা আয়োগ নীতি এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। এত কিছু সত্বেও কন্যাশ্রী আজ বিশ্বশ্রী হয়ে গোটা বিশ্বের দরবারে সমীহ আদায় করে নিয়েছে। তার জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের আওতায় আসেননি এমন মানুষ বঙ্গে খুবই কম। এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয় যে তৃণমূলের শাসনকালে যে উন্নয়ন পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গঞ্জে শহরে ঘটেছে তা দুর্ভাগ্যবশত বিশেষ প্রচার পায় নি। ছোটখাট নানা দুর্ঘটনা, অপপ্রচার ও রাজনৈতিক সংঘাতে তা চাপা পড়ে গেছে।

তৃণমূলের এই অভাবনীয় সাফল্যের পিছনে আছে অবশ্যই মমতাময়ী মমতার সদাসতর্ক নজরদারি এবং মাস্টারপ্ল্যান। ক্ষমতায় আসার পর তিনি শুধু নবান্নে বসে তার পূর্বসূরী মুখ্যমন্ত্রীদের মতো ছড়ি ঘোরান নি। নিয়ম করে বারেবারে জেলা সফর করেছেন এমনকি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বেরিয়েছেন । ঘুরেছেন গ্রামে গ্রামে। কোথায় কি কাজ হয়েছে আর কী হয়নি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ খতিয়ান নিয়ে স্থানীয় নেতৃত্বদের সাথে বিডিও, এসডিও এসপি এবং ডি এমের মতো প্রশাসনকেও জুড়ে দিয়েছেন। যাতে দ্রুত সেই সব সমস্যার সমাধান হয় এবং এলাকার উন্নতি হয়।

উন্নতি হলেও তৃণমূল সুপ্রিমোর বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। তাঁর ঔদ্ধত্য, সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার মানসিকতা অনেকেরই না পসন্দ। অভিযোগ, অন্যরা নামেই নেতা। আসল চাবিকাঠি তাঁর হাতে। তিনিই যে কোনও বিষয়ে শেষ কথা বলবেন। প্রকৃত কর্মসংস্থান না করে দান, অনুদান, ভাতা আর পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে অনেকেই তিতিবিরক্ত। দীর্ঘ দিন এস এস সি বন্ধ রেখে তিনি শিক্ষিত জনগণের একটা প্রজন্মকে শেষ করে দিয়েছেন। বেকার সমস্যার সমাধানে স্বনির্ভর শিল্পে উৎসাহ এবং অনুদান প্রদান করলেও আখেরে লাভ কিছু হয়নি। রাজ্য সরকারের চাকরিতে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা এবং স্বজনপোষণের অভিযোগ। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তিনি যেমন সাধারণ কৃষক কেও মাওবাদী তকমা দিয়েছেন তেমনই ভোট যুদ্ধে দেশের প্রধানমন্ত্রীকেও আক্রমণ করেছেন অসংযত, অশালীন, অশোভন ভাষায়। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘিরে ধরে অন্যদের ভোট দেবার জন্য প্ররোচিত করেছেন।

তবে এই অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মাঝেও মমতাদি কিন্ত নিজের লক্ষ্যে অবিচল। হুইল চেয়ারে বসেই বঙ্গবাসীর স্বার্থ পূরণের জন্য একাই লড়ে যাচ্ছেন রথী মহারথীদের বিরুদ্ধে। 


এখন প্রশ্ন হলো পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি'র এত বাড়বাড়ন্তের কারণ কী ? দু-এক কথায় এর উত্তর দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তথ্যভিজ্ঞ মহল মনে করছেন এর নেপথ্যে আছে কেন্দ্রীয় সরকারের সুচতুর গেম প্ল্যান। আছে বঙ্গের ক্ষমতা দখলের জন্য ধর্মীয় মেরুকরণের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত। ২০১১ সালে বামেদের চরমতম পরাজয় আর কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসতে না পারার ক্ষোভকে হাতিয়ার করে বিজেপি তাদের দলে টানতে শুরু করে। তৃণমূলের হাতে মার খাওয়া থেকে রক্ষা পেতে তখন অনেকেই তলায় তলায় বিজেপির দ্বারস্থ হয়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোট দিতে না পারার যন্ত্রনাকেও হাতিয়ার করে কোমর বাঁধে বিজেপি। এরমধ্যে বঙ্গে সক্রিয় হয় আরএসএসের প্রশিক্ষিত কর্মী-সমর্থকরা। তাদের নিখুঁত পরিকল্পনায় এককালের আদর্শবাদী হিন্দু বামেরা এবং দুর্নীতিগ্রস্থ বিক্ষুব্ধ তৃণমূলীরা পিঠ বাঁচাবার জন্য বিজেপিতে নাম লেখাতে শুরু করে। তখনই সিপিএমের প্রায় ১৬% ভোট এবং বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর প্রায় ৮%ভোট চলে যায় বিজেপির থলিতে। তার ফল গত লোকসভা ভোটে বিজেপি হাতে হাতে পেয়ে যায়। হাতে চলে আসে ৪২ টির মধ্যে ১৮ টি আসন। ঠিক তারপরেই নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। শুরু হয় ঘর ভাঙাবার খেলা। নারদা, সারদা, কয়লা কাণ্ড এবং গরু পাচারের মতো বিভিন্ন কেসে তৃণমূলীদের ফাঁসিয়ে তাদের দলে টানবার জন্য তৎপর হয় তারা। অন্যদিকে NRC এবং CAA এর মতো নাগরিকত্ব আইনের কথা বলে জনগণের মনে ভয় দেখাতে শুরু করে যাতে তারা তাদের স্মরণাপন্ন হয়। পাশাপাশি হিন্দুত্বের জিগির তুলে ধর্মের সুড়সুড়ি দিতে শুরু করে বিজেপি নেতৃত্ব। এছাড়াও আছে টাকা এবং পদের লোভ। সেই লোভে পরক্ষে পা দিয়েছে অধুনা আব্বাস সিদ্দিকীর সংযুক্ত মোর্চার দল। মুখে বিজেপি বিরোধিতা শোনা গেলেও তিনি বিলক্ষণ জানেন মুসলিম ভোট কাটলে তৃণমূলের নয় আখেরে লাভ হবে বিজেপির। তাই ভোট পেরোবার অপেক্ষায় তারা আছেন। হাতে দু চারটে সিট পেলেই তারা দেদার বিক্রি হবেন নয়তো ঝোপ বুঝে কোপ মারবেন বলেই তথ্যভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।


এ বছরের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের বুকে ক্ষমতায় কে আসবে আর কে আসবে না তা নিশ্চিত করে কেউ ভবিষৎ বাণী করতে পারে না। জেতার ব্যাপারে যদিও প্রত্যেকেই আশাবাদী। তবুও বিজেপি ক্ষমতায় এলে "সোনার বাংলা" না গুজরাত হবে তা সময়ই বলবে। অন্যদিকে তৃণমূল সুপ্রিমো এলে বাংলার জয়গাথা না পরাজয়ের ইতিহাস লিখিত হবে তা জানার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে আরও কিছুদিন।

তবে যেই ক্ষমতায় আসুক লড়াকু, সংস্কৃতি মনস্ক, অসাম্প্রদায়িক নেত্রী হিসাবে এবং ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় পরবর্তী বাংলার রূপকার হিসেবে তার নাম বঙ্গ রাজনীতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।