চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কবি শঙ্খ ঘোষ



চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কবি শঙ্খ ঘোষ


 🟣 রাধামাধব মণ্ডল 


 ➡️ চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কবি শঙ্খ ঘোষ। জানুয়ারির পর ফের অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন গত দিন কয়েক আগেই। এবার মহামারির কবলে কবি। নিজের বাড়িতেই ছিলেন, হোম আইশোলেশনে। বুধবার সকালে নিজের বাড়িতেই করোনা কেড়ে নিল, প্রিয় কবিকে আমাদের থেকে। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তিনি যখন আমাদের প্রকাশনার প্রিয় "সৃষ্টির একুশ শতক" কাগজে লিখছেন "বট পাকুড়ের ফেনা" স্মৃতির গদ্য, সে সময় মতামত জানতে চাইতেন ফোন করলেই। এমনই মানুষ ছিলেন। কোনো দিন এত বড় মাপের মানুষ হয়েও নিজেকে প্রকাশ করতেন না। সভাপতি হয়ে অনুষ্ঠানে গিয়ে শুনতেন তরুণ কবিদের লেখা। এমন মানুষ। বাড়িতে গেলেও দেখা করতেন, আলোচনায় অংশ নিতেন, নিয়ম করে। 

বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ, কবি শঙ্খ ঘোষ চলে যাওয়া শোকের ছায়া বাংলা শুধু নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষও আজ শোকাতুর। বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক ছিলেন তিনি। ১২ এপ্রিল থেকে সর্দি, কাশিতে ভুগছিলেন তিনি! তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না। এবাংলার নাগরিকদের মুক্ত কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। ছিলেন মহীরুহ। 

আজ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কবির পরিবারকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে সম্মানিত করতে চাইছেন। তবে কবি গানশ্যালুট পছন্দ করতেন না। 

কবি শঙ্খ ঘোষ ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২ জন্মগ্রহণ করেন। একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও সাহিত্য সমালোচক ছিলেন তিনি। একজন শক্তিশালী বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। তিনি কাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাসের উত্তরসূরী ছিলেন। আমাদের যৌবন তৈরি হয়েছে শঙ্খ ঘোষের কবিতায়।

তাঁর প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনাও করেছেন সারা কর্ম জীবন। "বাবরের প্রার্থনা " কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ খ্রিঃ লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল "মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে", "উর্বশীর হাসি", "ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ" বেশ জনপ্রিয়।

তাঁর পিতা মনীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং মা অমলা ঘোষ। তিনি বাংলাদেশের বর্তমান চাঁদপুর জেলায় ১৯৩২ খ্রি ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। বংশানুক্রমিকভাবে পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামে। শঙ্খ ঘোষ বড় হয়েছেন পাবনায়। পিতার কর্মস্থল হওয়ায় তিনি বেশ কয়েক বছর পাবনায় অবস্থান করেন এবং সেখানকার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় কলা বিভাগে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন।

পরে কবি বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন দীর্ঘদিন। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে অবসর নেন। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে আইওয়া রাইটার্স ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। কবি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, শিমলাতে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভান্স স্টাডিজ এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন কিছু দিন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গুলি হল "দিনগুলি রাতগুলি (১৯৫৬)", "এখন সময় নয় (১৯৬৭)", "নিহিত পাতালছায়া (১৯৬৭)", "শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭০)", "আদিম লতাগুল্মময় (১৯৭২)","মূর্খ বড় সামাজিক নয়ে (১৯৭৪)", "বাবরের প্রার্থনা (১৯৭৬)", " মিনিবুক (১৯৭৮)", " তুমি তেমন গৌরী নও (১৯৭৮)", " পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ (১৯৮০)","কবিতাসংগ্রহ -১ (১৯৮০)", " প্রহরজোড়া ত্রিতাল (১৯৮২)", "মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে (১৯৮৪)", "বন্ধুরা মাতি তরজায় (১৯৮৪)", "ধুম লেগেছে হৃৎকমলে (১৯৮৪)", "কবিতাসংগ্রহ - ২ (১৯৯১)", "লাইনেই ছিলাম বাবা (১৯৯৩)", "গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ (১৯৯৪)", " শঙ্খ ঘোষের নির্বাচিত প্রেমের কবিতা (১৯৯৪)", "মিনি কবিতার বই (১৯৯৪)", "শবের উপরে শামিয়ানা (১৯৯৬)", "ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার (১৯৯৯)", জলই পাষান হয়ে আছে (২০০৪)", "সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি (২০০৭)", "মাটিখোঁড়া পুরোনো করোটি (২০০৯)", "গোটাদেশজোড়া জউঘর (২০১০)",হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ (২০১১)","প্রতি প্রশ্নে জেগে ওঠে ভিটে (২০১২)", "প্রিয় ২৫ : কবিতা সংকলন (২০১২)"," বহুস্বর স্তব্ধ পড়ে আছে (২০১৪)", "প্রেমের কবিতা (২০১৪)", "শুনি নীরব চিৎকার (২০১৫)", "এও এক ব্যাথা উপশম (২০১৭)"।

কবির গদ্যের হাতও ছিল চমৎকার। তাঁর জনপ্রিয় গদ্যগ্রন্থ গুলি হলঃ " কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক (১৯৬৯)", "নিঃশব্দের তর্জনী (১৯৭১)", "ছন্দের বারান্দা (১৯৭২)", "এ আমির আবরণ (১৯৮০)", "উর্বশীর হাসি (১৯৮১)", "শব্দ আর সত্য (১৯৮২)", "নির্মাণ আর সৃষ্টি (১৯৮২)", "কল্পনার হিস্টোরিয়া (১৯৮৪)", " জার্নাল (১৯৮৫)", " ঘুমিয়ে পড়া এলবাম (১৯৮৬)", "কবিতার মুহূর্ত (১৯৮৭)", "কবিতালেখা কবিতাপড়া (১৯৮৮)", "ঐতিহ্যের বিস্তার (১৯৮৯)", "ছন্দময় জীবন (১৯৯৩)", "কবির অভিপ্রায় (১৯৯৪)", " এখন সব অলিক (১৯৯৪)", " বইয়ের ঘর (১৯৯৬)", " সময়ের জলছবি (১৯৯৮)", "কবির মর্ম (১৯৯৮)", " ইশারা অবিরত (১৯৯৯)", " এই শহর রাখাল (২০০০)", " ইচ্ছামতির মশা : ভ্রমণ (২০০২)", "দামিনির গান (২০০২)", "গদ্যসংগ্রহ ১-৬ (২০০২)", " অবিশ্বাসের বাস্তব (২০০৩)", "গদ্যসংগ্রহ - ৭ (২০০৩)", সামান্য অসামান্য (২০০৬)", "প্রেম পদাবলী (২০০৬)", "ছেঁড়া ক্যামবিসের ব্যাগ (২০০৭)", "সময়পটে শঙ্খ ঘোষ : কবিতা সংকলন (২০০৮)", "ভিন্ন রুচির অন্ধকার (২০০৯)", "আরোপ আর উদ্ভাবন (২০১১)", "বট পাকুরের ফেনা (২০১১)", " গদ্যসংগ্রহ - ৮ (২০১৩)", "দেখার দৃষ্টি (২০১৪)", " আয়ওয়ার ডায়েরি (২০১৪)", 

"নির্বাচিত প্রবন্ধ : রবীন্দ্রনাথ (২০১৪)", " নির্বাচিত প্রবন্ধ : নানা প্রসঙ্গ (২০১৪)", " নির্বাচিত গদ্যলেখা (২০১৫)", "গদ্যসংগ্রহ - ৯ (২০১৫)", "হে মহাজীবন : রবীন্দ্র প্রসঙ্গ (২০১৬)", "বেড়াতে যাবার সিঁড়ি (২০১৬)", "অল্প স্বল্প কথা (২০১৬)", " নিরহং শিল্পী (২০১৭)", "গদ্যসংগ্রহ-১০ (২০১৮)", " লেখা যখন হয় না (২০১৯)", "পরম বন্ধু প্রদ্যুমন (২০১৯)", " সন্ধ্যানদীর জলে : সংকলন (২০১৯)"। কবি শঙ্খ ঘোষ শিশুকিশোরদের জন্যও কলম ধরেছেন!

ছোট ও কিশোরদের জন্যে তাঁর লেখা

"বিদ্যাসাগর (১৯৫৬)", "সকালবেলার আলো (১৯৭২)", "শব্দ নিয়ে খেলা : বানান বিষয়ক বই {কুন্তক ছদ্মনামে লেখা }(১৯৮০)", "রাগ করো না রাগুনী (১৯৮৩)", "সব কিছুতেই খেলনা হয় (১৯৮৭)", "সুপারিবনের সারি (১৯৯০)",

"আমন ধানের ছড়া (১৯৯১)", "কথা নিয়ে খেলা (১৯৯৩)", "সেরা ছড়া (১৯৯৪)","আমন যাবে লাট্টু পাহাড় (১৯৯৬)", "ছোট্ট একটা স্কুল (১৯৯৮)", "বড় হওয়া খুব ভুল (২০০২)", "ওরে ও বায়নাবতী (২০০৩)", " বল তো দেখি কেমন হত (২০০৫)", "অল্পবয়স কল্পবয়স (২০০৭)", "আমায় তুমি লক্ষ্মী বল (২০০৭)", "শহরপথের ধুলো (২০১০)", "সুর সোহাগী (২০১০)", "ছড়া সংগ্রহ (২০১০)", "

ছোটদের ছড়া কবিতা (২০১১)", "ইচ্ছে প্রদীপ (২০১৪)", "ছোটদের গদ্য (২০১৭)", "আজকে আমার পরীক্ষা নেই (২০১৮)", 

বক্তৃতা / সাক্ষাৎকার ভিত্তিক সংকলন

১. অন্ধের স্পর্শের মতো (২০০৭)

২.এক বক্তার বৈঠক : শম্ভু মিত্র (২০০৮)

৩. কথার পিঠে কথা (২০১১)

৪. জানার বোধ (২০১৩)

কবি শঙ্খ ঘোষ এর প্রাপ্তি 

১৯৭৭ খ্রিঃ "মূর্খ বড়, সামাজিক নয়" নরসিংহ দাস পুরস্কার। ১৯৭৭ খ্রিঃ "বাবরের প্রার্থনা" র জন্য সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার। ১৯৮৯ খ্রিঃ "ধুম লেগেছে হৃদকমলে" রবীন্দ্র পুরস্কার সরস্বতী পুরস্কার "গন্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ"।

১৯৯৯ খ্রিঃ "রক্তকল্যাণ" অনুবাদের জন্য সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার। ১৯৯৯ খ্রিঃ বিশ্বভারতীর দ্বারা দেশিকোত্তম পুরস্কার।

২০১১ খ্রিঃ ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কার।

২০১৬ খ্রিঃ জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।