উপন্যাস ✓ দীর্ঘশ্বাস
🟣 রাধামাধব মণ্ডল
পর্ব : এক
বাতাসে হিস হিস শব্দ। এবার তেমন তাপ নেই। নেই কালবৈশাখির দেখা। আজ দুপুরে একটু ঝির ঝিরে ওই যা হল, তারপর সব চুপচাপ। সন্ধ্যা গড়াতে না গড়াতে আবার বাতাসের গোঁঙ্গানি শুরু। এবার হিস হিস শব্দের একটু ভারি বেড়েছে। যেন গাঢ অন্ধকার ঠিলে বেড়িয়ে আসছে বাকুলির ঠান্ডা হাওয়া। হাওয়াতে ভাঙা রেণুর মতো জলের কুঁচি। শরীর ভেজাবার কোনো ক্ষমতা নেই, তবে ঠাণ্ডার অনুভূতি জাগে। বেশ মনরম। অনেক দিনের ক্লান্তিরা যেন ভেঙে হাওয়াই যাচ্ছে ছুটির অভ্যাসে অন্যত্র। ক্লান্তির কত রকমের গন্ধই না নিত্যদিনের যাওয়া আসা পথে অনধিকার প্রবেশ করে। হারিয়ে যেতে চাইলেও, যাওয়া ভারি শক্ত। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর জীবনের সমস্ত পথ গিয়ে মেলে একস্থানে। বয়সে নুহ্য হওয়ার আগে যার মেধা চেতনা ঈশ্বর মন্দিরে জাগ্রত হয়, সে মিলনের স্থান চেনার ক্ষমতা অর্জন করে। ত্যাগীরা একেই অভ্যাস বলে। অভ্যাস একটা সাধন পথ। এপথের পথিকদের মধ্যে জটিলতা, অন্ধতা, কার্পণ্য লক্ষ্য করা যায়। তবে বিত্তের মধ্যে শুদ্ধতা আনতে লক্ষ্যে স্থির এবং ত্যাগের অভ্যাসচর্চা করে চলা খুবই প্রয়োজন। তা না হলে পথ ঠিক রাখা কঠিন। সহজকে কঠিন এবং কঠিনকে সহজ করে দেখার মানুষ এ সংসারে আছে।
রাজহাঁসের দুধ জলকে পৃথক করে খাওয়ার ক্ষমতার গুণে, তবেই তো সে হাঁসের রাজা, রাজহাঁস। ঠাকুর রামকৃষ্ণও এসংসার থেকে সারবস্তু গ্রহণ করে, সংসার অসার - এর মতো মাটি তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। তবে ঠাকুরই আমার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে ফুঁপি ঠিক করার কথা বলে গেছেন। ও যেন আমারই পথ।
এসব নিয়েই সন্ধ্যার দুর্গামন্দির চত্ত্বরে একদল যুবকের চর্চা, বেশ ভালো লাগে হরিপদ গোসাঁইএর। শ্যামবাজারের নাট চালা ছিল সন্ধ্যার কফি হাউস। পাশেই ছিল কেষ্টার চা চপের দোকান। অস্থায়ী। সন্ধ্যায় বসতো। চারচালার বিভিন্ন দিকের স্থান ছিল, ভিন্ন বয়সীদের আড্ডাক্ষেত্র। মাঝে মাঝে সে আড্ডায় ছেদ পড়ত। গ্রামে কেউ শ্মশান যাত্রী হলে, কিংবা চোর পড়লে। সেনপাহাড়ি জঙ্গল মহলের এ গ্রাম গুলোতে প্রায়ই সন্ধ্যায় শোনা যায়, ডাকাতির খবর। গোয়ালের গরু, বাছুর, মোষ ডাকাতি করতে অজয় পেড়িয়ে, বীরভূমের নদী পাড়ের অভাবি গ্রাম থেকে আসে ডাকাতের দল। ডাকাতির খবরে যেদিন গোটা গ্রাম জুড়ে রে রে পরে যেত, সে দিন বন্ধ হয়ে যেত আড্ডা। এ আড্ডার প্রধান কারিগর নীলো জ্যাঠা, ওরফে হরিপদ গোসাঁই।
বেশ কিছু দিন হল একটা যন্ত্রণার আবহে আড্ডা ছাড়তে হয়েছে হরিপদকে। তবুও তার মন টানে। তাই আড্ডা ভাঙার আগে প্রতিদিন একবার চক্কর কেটে দ্রুত পেরিয়ে যায় দুগ্গাচাতাল।
দক্ষিণ ধারে পিলার ঘেঁষা যুবক দলটির আলোচনা তার প্রাণ ছোঁয়। আধা অন্ধকারে অস্পষ্ট মুখগুলো তার চেনা নয়। তবুও ব্যকুলতা জাগে, জাগে ইচ্ছাও। একবার তাদের কাছে গিয়ে আলোচনায় যোগ দি। কিন্তু সময়ের ধাক্কাটা এখনও ক্ষত জাগিয়ে রেখেছে ; তার মনে।
দিনটি মনে ভেসে উঠলেই পিছিয়ে যায়। আর তখনই জগৎ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগের সেই গানটি গাইতে গাইতে বাড়ির দিকে যায় গোসাঁই। হরিপদর সুমধুর মিষ্টি গলায় তখনও অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতে ভেসে আগে _ মনে মনে বুঝিয়া
পরবাসে প্রিয়া,
কাঁদিছে কৃষ্ণ নামে।
প্রেম বিনা দিন _
বাসাহীন ঋণ,
ধূলা পথ নামে প্রাণে।
তুমি প্রভু হরি
পরম পূজারি,
নিত্য সুধাও কানে।
আলোক মালার সাজে
বিধু কুঞ্জ মাঝে
জীবনক্ষণে ইতি তব মনে।
অন্ধকার দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে গভীর হয়। আর সেই সঙ্গেই হারিয়ে যায় হরিপদ গোসাঁই এর অস্পষ্ট হেঁটে চলার শরীরটা। একদিন যেন এভাবেই অন্ধকার ছুঁয়ে নেবে শরীর। তখনও আড্ডার আসরে মশগুল দল। সেনপাহাড়ি অতীতের রহস্যঘেরা, আত্মগোপনের জঙ্গল। বর্ধমান মহারাজা চিত্র সেন একদা এই জঙ্গলে শত্রুদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইতিহাস ঘেরা এই জঙ্গলের মাঝে মাঝেই রয়েছে অনেক গ্রাম ও গঞ্জ। বন কেটে গ্রাম পত্তন থেকে বনকাটি গ্রাম, পাশেই রয়েছে অযোধ্যা এবং তার পাশের গ্রাম শ্যামবাজার। আরও একটু পশ্চিম দিকে গভীর জঙ্গল চিড়ে এগিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে জঙ্গল মধ্যে গ্রাম নিমটিকুরি পাশে আরও একটু পশ্চিমে বনগ্রাম। জঙ্গল গভীরে আরও কয়েকটি গ্রাম রয়েছে আলিনগর, খেড়বাড়ি, বিষ্ণু পুর, গৌরাঙ্গ পুর, দামোদর পুর, মলানদিঘির মতো।
অজয় তীরের জঙ্গল ছোঁয়া এই গ্রাম গুলোতেই একদা বসবাস করত ঢেকারা কামাররা। যাদের তৈরি লোহার অস্ত্র মহম্মদ, রঞ্জাবতী, কালুবীর, ইছাই ঘোষ এবং লাউ সেনের যুদ্ধ বাহিনী ছাড়াও, সে দিনের বাংলার বিখ্যাত ডাকাতরা ব্যবহার করত। শোনা যায় ঢেকারো কামারদের নাম অনুসারেই এই জঙ্গলভূমিকে একদা ঢেকুর গড় বলা হত। পরে রাজা বল্লাল সেন এ লালভূমির জঙ্গল ঘেরা অঞ্চলে রাজ্যপাট শুরু করলে, ঢেকুর গড় থেকে এ অঞ্চলের নাম হয় সেনপরগণা, পরে হয় সেনপাহাড়ি অঞ্চল।
রাজ রাজাদের সেই শ্যামারূপার মন্দির এখনও রয়েছে জঙ্গল মধ্যে। এছাড়াও রয়েছে ইতিহাসের নানান প্রেক্ষাপট। শোনা যায় এই মা ভবানী র মন্দিরেই একদা বৈষ্ণব কবি জয়দেব গোস্বামী পূজো করতে এসে, ভবানীকে শ্যাম রূপে দর্শন করেন। সেই থেকেই ইছাই ঘোষের পূজিত মা ভবানী হয়ে যান শ্যামারূপা।
এই শ্যামারূপা মন্দিরে বর্তমানে পূজো আর্চা করে হরিপদ গোসাঁই। সেই সকালে সূর্যদ্বয়ের আগে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে, সূর্যেস্তের পর বাড়ি ফেরা। গোটা জঙ্গল পায়ে হেঁটে হেঁটে যেতে হরিপদ দেখে, সেই কাঁদুনে বিল, যেখানে একদিন ইছাই যুদ্ধে নিহত হলে মা ভবানী ভক্তের জন্যে কেঁদে বেড়াতো অজয়ে, স্রোতের সেই গতিপথে রক্তনালা পেড়িয়ে প্রতিদিন মন্দিরে যাতায়াত হরিপদ গোসাঁই এর।
ইতিহাসের স্থান গুলো দিয়ে যেতে যেতেই প্রতিদিন তার নিজেকে নিয়ে খোঁড়া শেষ হয় না। কোনো কোনো দিন জঙ্গলে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আলিনগর গ্রামের রূপাই বেদের সঙ্গে। রূপাই নবাব আলিবর্দির গল্প শোনাই হরিপদকে। হরিপদ শোনে — একদা এ গ্রামের পত্তন করেন, এখানে তাঁবু পাতেন বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ।
ইতিহাসের এ সব সত্যি জানা হয়ে যায় হরিপদ গোসাঁই এর। ঘুমের ভিতর গভীর স্বপ্নেও হরিপদ খেড়বাড়ির ঘোড়দৌড় মাঠে ঘোড়া ছুটিয়ে যুদ্ধে যায়। কোনো এক অসভ্যতার বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ। পরে স্বপ্নের গভীর বাসে উঠে আসে শ্যামল রক্ষিতের ছবি। শ্যামল রক্ষিত তার প্রতিবেশি। দারুণ একটা কাণ্ড করে হরিপদর মুখ পুড়িয়েছিল শ্যামল। সে ঘটনা কখনও ভোলার নয়। ভাবনা গড়াতে না গড়াতেই প্রচণ্ড ঘামের মধ্যেই ঘুম ভেঙে যায় হরিপদ গোসাঁই এর।
তারপর দারুণ অস্থিরতায় কাটে সারারাত। আর ঘুম আসে না। মাটির দু'চালা উপরে প্রচণ্ড ঘামতে থাকে, একটা দারুণ প্যাচ প্যাচে গরমে। দম বন্ধ হয়ে আসে। অস্বস্তি লাগে। তখন বাড়ির বাইরে বাতাসের হিম হিম শব্দ। অশক্ত জানালার গায়ে আঘাত করে চলছে অনবরত।
একটু স্বস্তি পেতে বাইরে, খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ায় হরিপদ গোসাঁই। তখন শেষ বেলার চাঁদ, মেঘের কোলে মুখ ঢাকতে ব্যস্ত। কাঁটাছেড়া মেঘের লুকোচুরি। হিম পরার মতো বৃষ্টি ভেজা সরছে।
দূরে অন্ধকার ঠেলে দৌড়ে গেল গলির ভিতর একজন। ক্ষণিকের জন্যে চোখে এল সে দৃশ্য। হরিপদ ডাক দেয় কে — কে রে। ঘরের ভিতর থেকে নারী কণ্ঠের আওয়াজ — চোর চোর গো। হরিপদ, ভাবতে থাকে ! এত রাতে চোর !
পর্ব : দুই
ধূ ধূ অজয় বালিয়াড়ি। বেলা হেসে বসেছে অজয়ের পশ্চিম চড়ে। দূরে রাখালিয়া বাঁশের সুর ধরা বাঁশির মাটি গন্ধ ভেসে আসছে। শাল, মহুয়া, পিয়েল, সোনাঝুড়ি গাছের ফাঁকে ফাঁকে বন দপ্তরের হরিণ খেলা করে ফেরে। দেউলের সংকীর্ণ মাটি পথ বাঁ হাতের কারুকার্যে বোনা ডুগডুগিতে খেলা ছেড়ে গম্ভিরা নৃত্যের তালে তালে লাল মাটি পথে হেঁটে বাড়ি ফিরছে বাঁদর ও তার প্রভু খেলোয়াড়। পাগলা ষাঁড় তার উদ্মাদনা ভুলে, ক্লান্ত শরীরে ঠিকানার খোঁজে ফেরা। আর সে পথেই শ্যামবাজারের নীলো জ্যাঠা কীর্তন আঙ্গিকের গান ধরে বাড়ি ফিরছে—
রাধা বিনোদ সনে, লীলা করে মনে
বিভূতি মহিমা ধনে, এমনই সঙ্গোপনে।
বাঁশের বাঁশড়ি বিনে, রাধা যুগলমনে
দীনের দিনতা মনে, বিনোদ সাধন ঋণে।
দোছোট, হাঁটু মোড়া — বিদ্যাসাগরি ধুতি। কণ্ঠে তুলসি মালা। কালো দেহে বগলদাবা — সাদা গা কাপড়। পায়ে কালো পলিথিনের, গোড়ালি ঢাকা চটি। পায়ের শব্দে মাথায় লাল মোরাম চাপে, তবুও হুঁশ নেই নীলো জ্যাঠার। ফাঁক ফাঁক চুলে অদ্ভুত পায়ড়া চাঁদা টাক। গালে ও কপালে অজস্র পরিশ্রমী বলিরেখার ভাঁজে বোনা মধ্যবয়সী জীবন।
গ্রামের ২৪পহরে রাধামাধবের মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ, পূজাপাঠ, ছয় মহান্ত, দ্বাদশ গোপালের সেবা পুজো দেওয়ার কাজে তার জুড়ি মেলা ভার। শুধু তাই নয় নদী তীরের গ্রাম গুলোতে মনসা পুজোর একটা রেওয়াজ চলে আসছে অতীত দিন থেকেই। এখনও নিমটি,কোটালপুকুর, বনকাটি গ্রামের মনসা পুজোর দায় দায়িত্ব এসে পড়ে হরিপদ গোসাঁই এর হাতে।
সংসার না করেও সংসার থেকে দূরে নয় সে। ষোলআনা জীবনের অংশীদারিত্ব নিয়েই তার পথ চলা। মায়া, মমত্ব, ভ্রম, ত্যাগ, ভোগের যে জীবন প্রতিদিন জীবন নাটচালায় অভিনয় করে চলে, তার থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে মাইলস্টোন দেখে বোধের হিসাবে। দিনের শেষে এত কথা ভিড় করে আসে কেন! বুঝতে পারে না হরিপদ। মা ভবানীর মন্দির থেকে ফেরার পথে, ব্যয় করা বয়সের পাতা উল্টায় সে। আর তখনই যোগ বিয়োগের লেজার বুকে নিজেকে নিয়ে ভগ্নাংশের কষাঘাতে বলি করা। এও এক ত্যাগ করার পথ। সে পথেই ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে হরিপদ গোসাঁই। ভবদেব গোসাঁই এর একমাত্র পুত্র হরিপদ এখন কাকাতো ভাইদের সংসারের আমন্ত্রিত অতিথি। সম্পত্তি বাবার দেওয়া বিঘে দশ কাচি-বাকুলি মিলিয়ে। এছাড়াও ১৫ কাটা বাস্তুর উপর বসত ভিটে। পাশেই দু'বিঘার ঘামাইতলা। যেখানে পূর্ব পুরুষরা ঘুমিয়ে আছে, মাটির আসনে। তাদের অষ্টাঙ্গিক তিলক মাটি, বগলিঝোলা নিয়ে পূর্ব পুরুষ ধরে সাধনের পথেই মাটির ঘরে, মায়া জাল পেতে রেখেছে সামাইতলার মাটিবিছানায়।
পূর্ব পুরুষেরা সবাই জোছনা রাতে কথা বলতে আলপথে হেঁটে চলে সামনাসামনি। জ্যোৎস্না ভেজা মাটি পথের সেই বাকুলি ধারেই হরিপদর কুমড়ো খেত। চাঁদ নিভু নিভু আলোতে পুকুরের জল ছলছল করে ওঠে। মায়াময় লাগে অমৃতকুণ্ডের মাঠের চরাচর। এত কথা ভাবতে ভাবতেই কখন এসে মাদনা বুড়োর তলায় ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পরে হরিপদ। ঘুম ধরা ক্লান্ত চোখ, এ তার প্রথম পরা নয়। মা শ্যামারূপাট মন্দির থেকে ফিরতে ফিরতে প্রতিদিন পথে বার দশেক হুমড়ি খেয়ে পরে হরিপদ। তারপরই তার সম্বিত ফেরে।
গ্রাম ঢোকার আগে ভদরপুকুর পাড় থেকেই সে শুনেছে চিৎকার। আকাশ ফাটা চিৎকারে পাড়া সুদ্ধ লোক ঝাপিয়ে পড়েছে। শাল, পিয়েল, কুশিবাড়ি আম গাছের ফাঁক দিয়ে টর্চের আলো এসে পরছে বিক্ষিপ্ত ভাবে। ভাঙা আলোর কুঁচিতে একদল মানুষের মাথা চোখে পরছে হরিপদর।
রাস্তার বাঁক পেড়িয়ে একটু এগিয়ে এলেই অযোধ্যার কার্তিক বলে — কে রে হরি নাকি?
— হ্যাঁ, কী হল রে। সকলে এমন হাতার পাতার করছিস? চোর টোর পরল নাকি রে!
— বড়ো চোর! মেয়ে চোররে! গরু মোষ দড়ি খুলে দিয়ে পালায়। এটা একটা দৃষ্টি ঘোড়ানো বিষয় বুঝলি। আজ বোঝা গেল। চুরি আসল জায়গায়।
— সে কী রে! কে.... কে.... রে!
— দেখ না কে জানতে পারবি। এই ধরা পরলো বলে। বাবু এখানেই গা ঢাকা দিয়েছে আর ওই দেখ কদমগাছে মাগিটাকে বেঁধে রেখেছি।
হরিপদ গোসাঁই হতভম্বি হয়ে এগিয়ে যায় কৌতুহলে। গ্রামের মধ্যভাগে প্রধান রাস্তার দুই পাড়ে দুই গ্রাম শ্যামবাজার ও অযোধ্যা। আর শ্যামবাজার গ্রামের উল্টো দিকে বনকাটি গ্রাম। রাস্তা জুড়ে তিন গ্রামের লোক ঢলে পড়েছে। এত বড়ো ঘটনা বলে কথা। মাথার ফাঁকে ফাঁকে শরীর গলিয়ে এগিয়ে যায় হরি, চার চালা দুর্গাচাতালের দিকে। একদল মেয়ে মানুষ ঘিরে রেখেছে মুড়ো কদমের গোড়া। আর সকলেই বলছে — পোড়া মুখি তোর লাজ নাই। সরম, মান কী সব পুড়িয়ে ফেলেছিস? ঘরে ছেলে মরদ থাকতে এমন কেন বাছা। এত যদি জ্বলন তোর, তা সমাজে কেন! খারাপ পাড়াতে গেলেই তো পারিস। মাঝ বয়সী একদল মেয়ের দল বলতে যাচ্ছে — ছিঃ, কী হল বল দেখি, ও মাগির ঘর পুড়লো দেখ!
হরিপদ গোসাঁই এ সব শুনতে শুনতে এগিয়ে গিয়ে দেখে অনন্যার চোখ। গভীর ক্লান্ত, মুর্জমান লাজুক দুটি চোখ নত। খানিকটা হলেও মৃম্ময়মান, ভিজে দেখাচ্ছে অনন্যাকে।
কপাল গরিয়ে রক্ত ভেজা সিঁদুর নেমে এসেছে নাকের তারাফুলের উপর। দু'চার ফোঁটা রক্ত এসে ছিটকে লেগেছে গাছকোমর করে পরা, কাঁচা সুতির ন্যাতানো শরীর লেপা আটপৌরে পুরোনো শাড়িটার উপর। আধখোলা চওড়া পিঠে চাঁদের আলো চুপিসারে, ডাক দিয়ে যাচ্ছে বন্যার। অল্প সময়ের জন্য হলেও নিজেকে হারিয়ে ফেলে নীলো গোসাঁই।
শেষবারের জন্য বারণ করলেও কোনো পরিবর্তন তাকে ঠেকাতে পারেনি। এই ভেবে ধীরে আঙ্গুল গোনা পায়ে ধুলো মাখতে মাখতে বাড়ির দিকে চলে যায় হরিপদ। তখনও পাড়ায় উৎসুক ছেলের দল গ্রামের এগলি ওগলি, পুকুরপাড়, ঝোপঝাড়, পালুইতলা, মরাইগাদার ফাঁকফোকর তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদের এই সমাজ বাঁচানোর দায় ও দায়িত্ব দেখে আমারও আশঙ্কা জাগে। তবুও এই উম্মাদনার ঘেরাটোপে না নেমে, নিজেকে সামলে নিয়ে গোসাঁই পাড়াতে এগিয়ে গেলাম। তখন অনেকেই উৎসুক উত্তেজনা ত্যাগ করে ঘুমের আহ্বানে বাড়ির পথে গোসাঁইপাড়ার সামাইতলা, রাতে আজও জাগ্রত হয়ে ওঠে এখনও বয়স্কদের, গল্পে। সেই সামাইতলার পাশেই কুমোড়দের শাল। যেখানে মাটি পোড়ানো হয়। গ্রামীণ কুটির শিল্পের আসনে এখনও কুমোড় জাতির মৃৎশিল্প উজ্জ্বলতার সুতোয় বাঁধা। মাটির আড়া, শাল, চুল্লি, পাক চাকার চাতাল, পকলেন — সবই যেন রাতের অন্ধকারে মায়াময় হয়ে উঠেছে।
আর ভাটি জ্বেলে শালে বসে মাটি পোড়াচ্ছে, সাদা কাপড় ওড়ছে, সে ধূপদীপ পাল। আচমকা এ দৃশ্যটা অনুভূত হতেই গোটা শরীর জুড়ে মদন কাঁটায় লোমকূপ খাঁড়া হয়ে যায় হরিপদর। ধূপদীপ ছিল সেকালের কুনোরপাড়ার গৌরব। দেশ বিদেশের মানুষ তার সামনে এসে থেমেছে, কুমোরপাড়ার ভাটিশালের দাওয়াতে। কাগজে, টিভি রেডুয়াতে কত নাম। জয় জয় উঠেছে কুমোড় পাড়াতে। এমন মৃৎশিল্পী ধূপদীপ পাল।
তখন হরিপদ খুব ছোট, বুনিয়াদির নিম্ন পাঠে মন স্থির রেখে; খোলাধুলো নিয়েই দিন কাটায়। কখনও সখনো সুযোগ আদি এলেই গ্রামের হরিনামের দলের সঙ্গে আটপ্রহর করতে চলে যাওয়া, দূর গ্রামে।
রাত জেগে 'রাধা রাধা' বলে চেঁচানো। আরও রাত বাড়লে গাছের আম, নারকেল পেরে আটপ্রহরতলায় এনে নামের দলে ভাগ করে খাওয়া, এই ছিল দিনপাঠ।
এমনই এক হরিনামের সময়! গ্রামে ভজাই কাকার নামের দলে একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা ছিল নীলুর। ভজাই শখ করে বলতো নীলু, যাবি রক্ষিতপুরে হরিনাম আছে চারদিন। তখন বৈশাখ সবে শেষ হয়েছে, জৈষ্ঠ্যমাসের শুরু হবে হয়তো। ঠিক মনে পরে না।
হঠাৎ রক্ষিতপুরে খবর যায় ভজাই তোর কাকা ধূপে, মারা গেছে জোলের আগুনে পুরে। গ্রামের হরির মুখের কথা শুনেই সেই রাতেই সবাই বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় আসতে আসতে হঠাৎ ভজাই কাকার সাইকেলে চেন পরে, আরেকাটে আটকে যায়। কোনো ভাবেই বের করা যাচ্ছিল না। এমত অবস্থায় দলের সবাই একটু এগিয়ে যেতেই, ভজাই কাকার ভিত চিৎকার।
— চলে যাস না। আমাকে নিয়ে যা!
— কাকা! সকলে মিলে আবার পিছিয়ে এসে দেখে, ভজাই কাকা সাইকেল ছেড়ে রাস্তা ধরে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। আমরা সবাই সাইকেলটা আনতে যেতেই দেখি, সাদাকাপড়ে গা মুড়ি দিয়ে ঢাকা নেওয়া এক ব্যক্তি সাইকেল ছেড়ে উঠে হঠাৎ জঙ্গল মধ্যে মিলিয়ে গেল। এদৃশ্য দেখে সকলেই আশ্চর্য হয়ে পরি। ভজাই কাকা আর পিছিয়ে যেতে পারে না — কেবল গোঁঙাতে থাকে।
আর ভজাই চাপা ধরা গলায় বলে, — আ আ আ..মার কাকা! সকলে সাইকেলের কাছে গিয়ে দেখি, যেমনকার সাইকেল তেমনই আছে পরে। চেনও লাগানোই আছে।
সে রাতের ঘটনা এখনও সবার স্মরণে। কুমোড়পাড়ার ধূপদীপের আরও অনেক অলৌকিক ঘটনা ছবির মতো ভেসে ওঠে হরিপদ গোসাঁই এর কাছে।
শ্মশানে ধূপের শবদেহ, দাহ হচ্ছে, আর এদিকে বাঁধা বিড়ি কেনার টাকা মেটাতে স্বশরীরে অযোধ্য তাম্বুলী পাড়াতে উপস্থিত সে! এ ঘটনায় সকলেই চমকে গেছিল।
কুমোরপাড়া পার হওয়ার সময় এসব কথা স্মরণে আসতেই কেমন যেন ভয় ভয় অনুভূত হয় হরিপদ গোসাঁইয়ের। অনেক রাত হলো, এই ভেবে আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় নীলো গোসাঁই।
তখন মধ্যগগনে জ্বল জ্বল করছে চাঁদ। আম পাকুর নাকুর পাতার মোটা মোটা ছায়াই ভরে উঠেছে উঠোন চাতাল। সারা উঠোন জুড়ে মায়াবদ্ধ জ্যোৎস্নার কুচিগুলো ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আলতো তরলে। উঠানে পা দিতেই আচমকা নারী কণ্ঠের মৃদু চিৎকারের শব্দে বুক নড়ে ওঠে হরিপদর। কিছুক্ষণের জন্য রক্ত মাংসের পুরুষ শরীরে বসত করতে শুরু করে কাম! আষ্টেপৃষ্টে জরাজীর্ণ ভাবে আঁকড়ে ধরে মোহমায়ায় হরির রক্তমাংসের শরীরে।
যৌনতা নিভু নিভু হয়েও ধীক ধীক জ্বলে ওঠে, কখনো সখনো। ঠাণ্ডা হাওয়ায় তুষ আগুন জ্বলে ওঠার মতো। হরিপদর স্মৃতির বনে উঁকি মারে যৌনতা, প্রেম হারানোর দিন ভেসে ওঠে। কতকিছু স্বপ্নের উড়নি। স্বপ্নের ভিতর বাস্তবের রক্ত ভূমিতে উঠে দাঁড়ানোর লড়াই। আত্মস্খলনের পর নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়ে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করাতে অনেক যুদ্ধ করতে হয় হরিপদকে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সরণিতে দাঁড়িয়ে — আত্মখননের নিবেদনে সতর্ক নির্ভরতা নিয়ে নিজের শোবার ঘরে গিয়ে ওঠে। ঘরের ভিতর তখন ছোট ছোট জ্যোৎস্নার ভাঙা কুঁচির লড়াই। জানালা বেয়ে এসে আলো করেছে ঘর। অন্ধকারেও আলো। পাতা বিছানার মসৃণ চাদরে কে যেন ঢাকা পড়ে, শুয়ে আছে। হঠাৎ চমকে যায় হরিপদ। এ ছবি কার, যেন চেনা চেনা মনে হয়। একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সময়টা। বিছানায় শুয়ে এই মেয়েটা, ঠিক যেন অনন্যা গোস্বামী। হ্যাঁ অনন্যাই তো বটে! হঠাৎ দেখে, চমকে ওঠে! চারদিকে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই! কেবল গাঢ অন্ধকারের লুকোচুরি।
পর্ব : তিন
গত সন্ধ্যার ঘটনাটা কিছুতেই পিছু ছাড়তে চাইছে না নীলোর! আদরের বাড়ির গোপালের মতো। সেবা পুজো করে যাওয়ার পর সারা দিন যেন রাঙা দুটি চরণ ফেলে মিষ্টি মিষ্টি করে ধীর পায়ে পিছু পিছু হাঁটে নীলোর। অনুভূতিটা কিছুতেই যেন নীলোর সঙ্গ ছাড়ে না। আষ্টেপৃষ্টে গিলে রেখেছে তাকে! এমনিতেই সে একটু অনুভূতি প্রবণ দূর্বল মনের মানুষ। তাই যে যার মতো সুযোগ নেয় তার থেকে। তাতে নীলো গোসাঁই এর কোনো পরিবর্তন নেই।
বয়স ক্রমশ পেড়িয়ে যাচ্ছে জীবনের উপর দিয়ে। চেনা মানুষের দল হারিয়ে, কাছ ডেকে নিচ্ছে অচেনার চেনা হয়ে ওঠার ভিড়। তবুও মনমরা আকাশের নীচে ঈশ্বর বৃক্ষের মতো এখনও একা দাঁড়িয়ে, হরিপদ ওরফে গ্রামীণ সাদাসিধেই চেনা নীলো গোসাঁইয়ের জীবন। মাথার উপর আকাশ। পায়ের নীচে মাটি। যা কিছু পঞ্চভূতের দ্রব্য! সবই কেমন যেন অনুভূতিময়!
সামাজিক দায়দায়িত্বের পথ ধরেই, তার উপলব্ধির আকাশে খানিক গল্পবোনা। জীবন চলে যাচ্ছে রূপান্তরের হাত ধরে, তার সঙ্গে সহমিল খোঁজে হরিপদ গোসাঁই। এক ভাবনা যেতেই অজস্র ভাবনা এসে তার পড়শি হয়। তবুও জীবনের বেদে দাঁড়িয়ে তত্ত্ব ও তথ্যে এখনও ধ্রুবক হরির আদর্শ।
সকাল সকাল এতসব সাতপাঁচ, ভাবনা কেন বাপু! মনের ভিতরের মানুষটির সঙ্গে নিজেই প্রশ্ন উত্তর খেলে। গায়ের মানুষ গুলো তাকে দেখে বলে যায়, ছায়া বেজেছে গো। — বদ্দি, রোজা দেখিও, কে শোনে করা কথা!
এত কথা, এত রটনার মাঝেও নিরুত্তর এক জীবন যেন মায়া কাননের অশত্থ বৃক্ষ। শত দুঃখেও যাকে কোল দেওয়া যায়। নীরব, নিথর — সে তবুও মর্মভেদী এক বোধের উপর বোধের লড়াই। ধুলো খেলা জীবনে সেই যে ছন্দ ভেঙে গেছে একবার। সে যন্ত্রণাই কাত করে রেখেছে তাকে। নীলের দূর সম্পর্কের এক মাসতুতো বোন, খুব প্রিয় ছিল। টিয়া নামেই তাকে চিনতো বনকাটির মানুষ। টিয়া তার সুখ দুঃখের অংশীদার। যন্ত্রণা ভাগ নেওয়ার মেয়েমানুষ। এক সাথে ঘোরাঘুরি, এমব কী দুপুর ও রাতের বিছানায় এক সঙ্গে ঘুমুতে যাওয়া; এমনই সম্পর্কে বোনা দুটি নারী পুরুষের জীবন। তখন খুব বেশি হলে ১৯—২০ বছর বয়স, কাঁচা কাঁদা ঠেলা বয়স! টিয়া এক বছরে ছোট, আর নীলো বড়ো। আগুনে ঘি গলা সময়! বাড়িতে কেউ আটকের নেই। তাই বাঁধাও নেই। ভাই বোনের অবাদ বিচরণ। আলোচনা রাত গভীরে গাঢ হতে থাকে। ধীরে ধীরে অন্ধকার গভীর হলে, দু'জনার নিশ্বাসও মোটা হয়। অলস বিছানায় একে অপরে ভিতরে ভিতরে ভিজে ছিলোই প্রতিদিন এভাবে।
সে দিন গ্রীষ্ম কাল। বাইরে পাকা রোদের ঘোরাঘুরি। টিয়া টিউশন পড়িয়ে একটি মোবাইল কিনেছে। ওদের ওখানে টিউশনির কদর আছে। শিল্পাঞ্চলের শহর দুর্গাপুর। সেই মোবাইলই আগুন জ্বালালো সেদিন। এগান, সেগান শুনতে শুনতে হঠাৎ ভিডিও ক্লিপিং এ হাত দিতেই চালু হয়ে ওঠে ছবি। নেংটা ছবি। একজন পুরুষ নারীর মিলনের ছবি।
নীলোকে টিপে ধরে অকস্মাৎ চুম্বন করতে শুরু করে টিয়া। তারও পুরুষ শরীর বাগ মানে না। সাধনায় লিপ্ত হয়। অনেক পর বৃষ্টি নামলে — কাগজে লাগা আগুন নিভে যায়। তখন অনেক খানি পাপি, দায়ি বলে মনে হয় নিজেদের। জীবনের সেই ভুল এখনও পিছু ছাড়েনি নীলোর। এখন টিয়া অন্যের স্ত্রী। প্রেম করে নতুন সংসার পেতেছে বাপের বাড়ির পড়শি গ্রামে। কালেকবুলে দু'জনার মুখোমুখি দেখা হলে, একটু নুইয়ে পরে নীলো।
দিন যায়, সময় এগিয়ে যায়। শরীরের ভাঙন ধরে। চঞ্চলতাও স্থির হয়। এখন বেলা শেষের পথিক হরিপদ গোসাঁই। তবুও জীবনের ক'টা অচেনা বাঁকে বেসামাল হুমড়ি খেয়ে পড়াটা এখনও মানিয়ে নিতে পারে না সে।
সমাজ সংসার, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন কেউ জানেনা সে কথা। তবুও অন্তরে বাজে। মনের গভীর কোণে দুটি মানুষের লড়াইয়ে পরাজিত হতেই হয় তাকে। আর সে পরাজয়ের যন্ত্রণা সহ্যের ক্ষমতা থাকে না তার।
এত কিছুর মধ্যেও নতুন করে বাঁচার লড়াই — এগিয়ে নিয়ে গেছে হরিপদকে। এখন তার সংসার করার কোনো মানেই হয় না। যেন দায় দায়িত্বহীন গ্রামজীবন বাসীর জীবনটার গোটা বেলা পড়িয়ে গেল। এবার সন্ধ্যা নামার অপেক্ষা। এই মন্দির জুড়ে আরতি শুরু হল বলে।
মাঝে মাঝে যেটুকু চঞ্চলতা এসে ভিড় করে মতিচুড়ে, তা কেবল যৌবনের বাঁক পেড়নো কিছু রূপালি দিনের প্রতিধ্বনি।
তাতেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় হরিপদর। মাঝে মাঝে মনের সঙ্গে মনের লড়াই এ নামে সে। নিরালা নদী তীরে বসে দুটি সত্ত্বা শরীরের ভাষ্যকার ও মনের ভাষ্যকার! টানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিতর্কে শরীরের পরাজয়ে মনের জয় হলেও, শরীরের আহ্বান থাকে তার অনেকখানি জুড়ে। হরিপদ ভাবে যারা শরীরের বাহ্য আহ্বানকে ত্যাগ করতে পারে সহজেই তারাই মানুষ, তারাই বরেণ্য, তারাই মহাপুরুষ। এ কী চাট্টিখানি কথা বাপু! মনের মধ্যে দুটি মনের লড়াই। একটি শরীরের মন, অন্যটি মনের মন! বাল্যজীবনের আর এক ঝাঁক পরিবর্তনে খুব কেঁদেছিল হরিপদ। তখন সবে পঁচিশ বছর, ছন্নছাড়া জীবনের সকালবেলা।
গ্রামের হবু বামুনের দুগ্গাকে খুব পছন্দি হত তার। হবু পূজারি বামুন। চাষা ঘোষেদের পাড়া থেকে কলাটা, মুলোটা এনে তবে তার হাঁড়ি চাপে। দুগ্গা বাপের কথা না শুনেই গায়ে গায়ে নাটকের ফিমেল সেজে অভিনয় করতে যায়।
বনকাটিতে কোনো দিন চোখে পরেনি দুগ্গার অভিনয়, হরের। দেখা হল যেদিন কালকেপুরে, দূর বাবুদের দুর্গাদালানের চাতালে নবমীর রাতে। কালকেপুর গাঁয়ে নবমীর রাতে গাঁয়ের দলের নাটকে স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করবে বলে ফিমেল ভাড়া গেছে দুগ্গা।
হরিপদ ওরফে হরেও গেছে একপাল ছেলের দলে, সাইকেল করে নাটক দেখতে। সাজা নাটকের পালা জমে ছিল বেশ। নাটক শেষে গ্রামের বেশির ভাগ ভিড় চলে গেল বাবুদের দালানের গা ঘেঁষে পশ্চিম ও দক্ষিণ পাড়ায়। এবার শুনশান দুর্গাদালান। মঞ্চ থেকেই দুগ্গা দেখেছে হরিপদকে।
সেই মতো বিশ্বাসও ছিল, নাটক শেষে, ও ঠিক আমাকে সাইকেল করে বাড়িও নিয়ে যাবে।
শরতের আকাশ। বনে ঢাকা কালিকাপুর গ্রাম, স্থানীয়দের মুখে মুখে কালকেপুর বলেই পরিচিত। মন্দিরময় গ্রামটির অপরূপ সৌন্দর্য যে কোনো ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরই ভালো লাগবে। বর্ধমান রাজাদের সাতমহলা বাড়ি রয়েছে এখানে। অতীতের এই গ্রামেই ছিল বর্ধমান রাজাদের গোপন আস্তানা। এলাকার বিখ্যাত সব লাঠিয়ালরা থাকতো রাজবাড়ির নিরাপত্তায়। বেলজিয়ামের ঝাড়বাতি, পেন্ডুলাম ঘড়ি, উড়িষ্যার নবাবের দেওয়া সে সব মূল্যবান সামগ্রী লাগানো থাকতো দুর্গাদালানের ভিতর।
এখন দুর্গাপুজোর রাজকায়দা থাকলেও, আড়ম্বর কমেছে। কমেছে জৌলুশ। তবুও সাংস্কৃতিক পরিবেশটি বজায় আছে। মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী গান বাজনার আসর বসে। নবমীর রাতে হয় গাঁয়ের দলের নাটক। আর মহাদশমীর পরদিন হয় ধামাকা গানের রঙিন অনুষ্ঠান। এখন বেশির ভাগ বাংলার গ্রামে 'হরিনামের থেকে তেরে নামের' খরিদ্দার বেশি। তবুও এ গ্রামের আঙ্গিনায় লোকঘরানার কৃষ্টি, সংস্কৃতির ধারাটি ধরে রেখেছে।
রাজত্বহীন এ প্রজন্মের দৌহিত্র রাজ রাজা লাজপত রায়। তিনিই এই নাটকের উদ্যোক্তা। লাজপত ওরফে লালুবাবু ফিমেল দুগ্গাকে বাড়ি পাঠানোর জন্য ব্যবস্থা করছেন। এমন সময় দুগ্গা তাকে বলে লালুবাবু আমার এক প্রতিবেশি দল নাটক দেখতে এসেছে, আমি কী ওদের সঙ্গে চলে যাবো।
দুগ্গার পিছনে হাত দেখানোতে, ধীর পায়ে নত মাথায় লালুবাবুর সামনে এসে দাঁড়াল হরিপদ গোসাঁই।
ততক্ষণে চাঁদনির জলে এসে অবগাহনে নেমেছে মধ্যরাত্রির চাঁদ। দূরে জঙ্গল গভীর থেকে ভিজে ভেসে আসছে মাদলের বোল আর অন্যমনা করে তোলা মোহনবাঁশির সুর। পাগল পাগল হয়ে উঠেছে বাতাসে গন্ধ, পোড়া ধূপ ধুনো ও শিউলির আলত আহ্বানে।
পর্ব : চার
কী এক ভুলোলাগা পথ ধরে জীবনের বয়স কমে অনবরত। তা ভাবতেই অন্যরকম হয়ে ওঠে মন। সে রাত্রি ছিল জ্যোৎস্না উজ্জ্বল — নরম।
দুগ্গা চলেছে হরিপদর সাইকেল চড়ে গ্রামের পথে। জঙ্গলের বড়ো বাঁক ঘুরলেই ১১ মাইলের চেকপোস্ট মোড়। এদিকে অন্য সঙ্গীরা তখন অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে হরিদের ফেলে। সে সুযোগের সদব্যবহার করতে একটুও পিছুপা হয় হরিপদ। নিঃঝুম শেষ রাত্রির শাল জঙ্গলে শুধু পাতা বেয়ে শিশির ঝরার টুপটাপ শব্দ। মর্মছেদ করে চলে যাচ্ছে যেন। হরিপদ গোসাঁই বাঁকের পথ পেড়িয়ে একটু জঙ্গলে ঢোকে দুগ্গার হাত ধরে। ছোট শাল ঝোপের ভেতর হেলিয়ে রাখে সাইকেল। তারপর দুগ্গার বুক থেকে ওড়না খুলে শালজঙ্গলের ফাঁকে ঘাসের বিছানায় পাতে। সে সময়ে বড়োশাল গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পরেছে দুগ্গার মুখে। চোখ মুখ ঠোঁট কামনার নম্রতায় কাঁপছে। অকস্মাৎ এক হেঁচকা টানে দুগ্গাকে নিয়ে ঘাসের বিছানায় শুয়ে লেপটে পড়ে হরি। তখন খণ্ড খণ্ড মেঘের বুকে চাঁদের আলো লুকোচুরি খেলায়, আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে শাল, মহুয়া, কেঁদ পাতার জঙ্গলে।
হরির লোমশ বুকে পথ হারিয়ে অসহায় নিবেদন লেখে দুগ্গা ততক্ষণে গোসাঁইয়ের ঠোঁট দুটি,দুগ্গার ঠোঁটে আঁকছে বর্ষার আলপনা। শরীরে শরীর মিশে যাচ্ছে।
হঠাৎ দুগ্গার গোটা শরীরের অন্তবাস খুলে সংগমে লিপ্ত হয় তারা। দু'জনার সংগমে একে অপরে আনন্দ নিতে থাকে অনাবিল। কিছুপর হরির ভজন দণ্ড থেকে বীর্যপতন হলে, দু'জনাই নেতিয়ে পরে একে অপরের বুকে। ক্রমশ নীরব আগুনের শিখা ঠান্ডা হলে আবার নত নয়নে ধীর পায়ে বাড়ির পথে এগিয়ে চলে দু'জনে।
যেন গতি হারানো সাইকেলের কিক কিক শব্দ, রাস্তার নিঃস্তব্ধতা ভাঙে। তখনও স্টেট হাইওয়ের ধারে ধারে গজিয়ে ওঠা হোটেলগুলোতে বিহারি ড্রাইভারের দাপুটে শরীরে ঘাম ঝরাচ্ছে — এঅঞ্চলের অভাবি পরিবারের থেকে আসা কিছু বউ মানুষের যৌবন।
শেষ রাতে তাদের আর আনন্দ নেই। কেবল অলস শরীরে বিছানা পাতা নিয়ে চলছে দরকষাকষি। এসব দেখতে দেখতে এগিয়ে চলে দুগ্গা হরি! আর মনে মনে হয় তাদের শরীরের স্পর্শ কত পবিত্র কত সুখের। কিন্তু পরের দিন সকালটা তাদের জন্য হয়ে উঠলো অন্যরকম। হরির সকালের বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে অনেকটা বেলা গড়িয়ে গেছে। মোড়ে মোড়ে শুরু হয়েছে জটলা। বিছানা ছাড়ার কিছুক্ষণ পর হরিটের পায়, তার কপালে সর্বনাশ লিখে দিয়েছে প্রতিবেশি শ্যামল রক্ষিত। গত রাতের ঘটনার ছবি তুলে পাড়ায় পাড়ায় সাদা কালো প্রিন্ট করে চিটিয়ে দিয়েছে শ্যামল। শ্যামলকে কাকভোরে এমন ভাবে চিটাতে দেখেছে অনেকে। হরিপদ একদিন, দু'দিন সামলে নিয়ে কোনো রকম বাড়ি থেকে বের হলেও, দুগ্গাকে পরদিনই গ্রাম ছাড়তে হয়। তার বাবা তাকে তার মাসির বাড়ি রানিগঞ্জ নিয়ে গিয়ে রেখে এসেছে। দিন চলে যায়। দিনের হাত ধরে পেরিয়ে যায় সময়ও। এক বছর, দুবছর এগিয়ে যায়। গ্রামের সন্ধ্যার ঠেক, চার চালার কপিহাউস তাকেও ছাড়তে হয়েছে এঘটনার পর থেকেই।
মানুষ বড়ো কোনো আঘাত পেলেই তবে, বোধবুদ্ধি হারিয়ে দেশ ছেড়ে কোথায় পালিয়ে গিয়ে, সাধুটাদু হয়ে তবে গাঁয়ে ফেরে। আমি তেমনটা তো হতে পারিনি। তাই গাঁয়ে আর পাঁচ জনের মতো বেঁচে আছি। যন্ত্রণার পথ পরে আছে পোড়া বুকটার উপর।
আজ ২২ বছর হলো, তার আর কোনো খোঁজ নেই। কোথায়, কেমন — কী যে হল মেয়েটার, নিজের নিজেতে বলতে বলতেই দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বিছানায় উঠে বসে সে। প্রায়ই মনের সঙ্গে তার এমনই কথা চলে। হৃদয়পুরের বাসিন্দা হয়ে নিশ্চিন্ত কথারা, সব মাথার মধ্যে জট পাঁকায়। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘড়ির দিকে চোখ পরে হরিপদ গোসাঁই এর। আর তখনই তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়ে সে। সকালের স্নান সেরে তাকে বেরুতে হবে, শ্যামারূপার পুজো করতে। শ্যাম শ্যামার এই মহামিলন ক্ষেত্রে তবেই মন ভরে ওঠে তার। প্রসন্ন হয়ে যায় সময়। গড়কেল্লার রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ। পাশে স্রোতস্বিনী অজয়ের বয়ে চলা। জল পেড়িয়ে চিক চিক বালির চড়, বেনা কেশের ঝোপ। অচেনাকে আরও নীরবতার একাকিত্বের গভীরে নিয়ে গিয়ে আরও মমত্বে বাঁধে।
হরিপদ ভাবে রাজরাজাদের, ইতিহাসের ব্যবসায়ি বণিকের হাত ধরেই নদীতীরে এ জঙ্গলের গৌরবের ইতিহাস গাথা। শান্ত সমাহিত অজয়ের শীতকালীন জল বয়ে যাচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো বালিচড়ের ফাঁক দিয়ে। ওপাড়ে শেষ ঝরা ফুলের ফাঁক দিয়ে বালিরেখার টানা ক্যানভাসে আঁকা ধূসর আকাশ। এপাড় থেকে দেখা যাচ্ছে ওপাড়ের পেঁয়াড়া বাগান পেরিয়ে বালুচরে দাঁড়িয়ে কালু ডোমের স্মৃতিঘেরা লাউসেন তলায় দীর্ঘ দেহী শিমুল গাছ। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বালিতোলা শ্রমিকদের, শ্রমেগড়া কালুবীরের মন্দির। নতুন মেঘের দিন দুই জেলা বর্ধমান ও বীরভূমের ডোমেরা এসে দলে দলে জড়ো হয়ে অজয় চড় সাজিয়ে তোলে। ফুলে পল্লবে, শেওড়া ডালে আর মোরগ হাঁসের বলির রক্তে চড় ভিজে রক্তস্রোত নামে গিয়ে অজয়ের বৈষ্ণব জলে।
নদী না নদ এ কেবল নামের তফাৎ। তবে হরিপদ গোসাঁই ওরফে হরিপদ গোস্বামী ভাবে এসহ্যের নদী। নারী না হলে এত যুদ্ধের, এত বীরের রক্ত ভেসে গেলেও, কেমন যেন অবিচল বয়ে যাওয়া
আজ অনেক পূণার্থি এসেছিল গড়কেল্লার অধিষ্ঠাত্রী শ্যামারূপার মন্দিরে পুজো করতে। এদিকে দিন পেরিয়ে সন্ধ্যার আকাশ মেতেছে অন্ধকারের জলে। ইষৎ লাল জলের কূলে কূলে নদীর ডাক ভয় ভেঙে যাচ্ছে যেন। এক তেঁতুল বিক্রেতা মুসলমান যুবক গৌরবাজারের দিক থেকে হেঁটে হেঁটে এ পথেই আসছে। হরিপদকে নদীতীরে বসে থাকতে দেখে, কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। আলো আঁধারে মুখোমুখি হতেই আহমেদ মিয়া, হরিপদর উদ্দেশ্যে বলে গোসাঁই কেমন আছো! হরিপদও চিনতে পারে এতো অযোধ্যার আহমেদ ভাই। দু'জনে গল্প করতে করতে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরার পথ ধরে। ততক্ষণে পশ্চিম আকাশের কোলে মেঘ ভাঙা চালের উপর দাঁড়িয়ে এক খণ্ড চাঁদের উঁকিঝুঁকি।
পর্ব : পাঁচ
জঙ্গলের সংকীর্ণ পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বনগ্রামের পাশ দিয়ে অন্নপূর্ণা মন্দিরের উত্তর দিকে কাজুবাদামের কয়েকটা ঝোড় পেরিয়ে, মোরাম ঢাল ধরে এগিয়ে যেতেই, একটি শিশুর কান্নার শব্দ। নদীর দিক থেকে ভেসে আসে। এখানটাই কাঁদুনে বিলের কোল ঘেঁষে অজয়ের বাঁকে জলের তোড় এসে ভেঙেছে নদীর পাড়।পাশেই কয়েকটা লেউল বাঁশের বড়ো ঝার। সাপে ব্যঙ্গ ধরার শব্দ। শেষ আর্তনাদ। ইহ জগতের জীবন খেলা শেষ করে ব্যঙ্গ চলে যাচ্ছে সাপের পেটে। একটু দূরে জল পাখির করুণ ডাক। এখানটায় এলোমেলো বইছে দামাল বাতাস। আবার ভেসে আসছে শিশুর কান্না। রাস্তার এপাড় থেকে ওপাড়ের জঙ্গলে ছুটে চলেছে মেঠইঁদুর। হরিপদ বলে না ভাই ও ইঁদুর নয়, বন্য বিঁদুর। ও শিশুর কান্না নয়। বন্য বিঁদুরের মারামারি নয় তো? কী জানি হয় তো বা হতেও পারে। তবে যায় বলি না কেন আহমেদের কোনো স্বস্তি নেই। রাস্তা যত ছোট হয়ে আসছে, ততই জোড়াল হচ্ছে শিশুর কান্না। আহমেদের ভিতর আকুল হয়ে ওঠে। ওঠে মায়া মমতার ঝড়। এখানটায় ফাঁকা ফাঁকা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটু জোড়েই বইছে দীর্ঘ বাতাস। হরিপদ গোসাঁই এবার বুঝতে পারছে, এ কান্না কোনো শিশুরই।
— আহমেদ ভাই, এ কোনো শিশুরই কান্না।
— হ্যাঁ ভাই। শিশুটিকে কে এখানে রেখে গেল?
দু'জনে একটু জঙ্গল মধ্যে এগিয়ে গিয়ে দেখে একটি দীর্ঘদেহী রাজহাঁস একটি বন্য গোখরোকে ক্রমশ গিলে খাচ্ছে, আর বাতাস ভেজা গোখরোর যে চিৎকার ভেসে আসছে শিশুর কান্না হয়ে। জাগতিক এ অচেনা চিরন্তন দৃশ্য দেখে চমকে ওঠে দু'জনে। এখানে বাতাসের গর্ভ ভেদ করে ভয়াবহ এই চিৎকার ছুটে যাচ্ছে জঙ্গল গভীরের মাইলের পর মাইল রাস্তা। চেনা রাস্তার অচেনা এই আকুতি মোহমায়ার জীবনের পরিধি পেড়ুতে জোর তলব লাগায়।
অদূরে নদীর উল্টো দিকে কেন্দুলীর রাধাবিনোদ মন্দিরে সন্ধ্যা আরতির ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে জঙ্গলের এই গ্রাম গুলোতে। আহমেদ মিয়া বলে ওঠে, চলো ভাই — ওই তোমাদের হরিমন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি। রাত এগিয়ে যাচ্ছে ভাই। খুব ক্লান্তি লাগছে। পেটে কোনো দানাপানি নাই। সেই বিয়েন বেলাতে গেছি, গাঁয়ে গাঁয়ে। আজ তেমন বিক্রিও হয় নাই। সামনে পরব আসছে, চাল ডাল কেমন করে কিনি!
হরিপদ বলে — মিয়া সবই তাঁর ইচ্ছা। তিনি যা করাবেন, তুমি তাই করবে। তাঁর অদৃশ্য সুতোয় আমাদের জীবন বাঁধা। তিনি যেমন খেলেন, আমরা তেমন খেলি। এজগৎ সংসারে তাঁর মতো খেলোয়াড় আর কে আছে? আহমেদ ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। হরি হাতে ধরা লণ্ঠনের আলোয়, বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে আহমেদকে। হরিপদ গোসাঁই তার পুজোর থলি থেকে প্রসাদের দুটি কলা ও একজোড়া মণ্ডা আহমেদের হাতে দেয়। পরম আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আহমেদের মুখ। বলে ও গোসাঁই তোমাদের হরি আর আমাদের আল্লা সবাই এক! গীতা আর কোরান এক আলমারিতে পাশাপাশি থাকে।তাদের কোনো বিরোধ নেই।
যারা কোরান গীতা পড়ে না, তারাই ঝগড়া করে। বিরোধের লড়াই জাড়ি রেখে, সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বালায়। তোমাদের সত্যনারায়ণ আর আমাদের সত্যপীর একই বস্তু। কথা গুলো বলতে বলতেই চোখের জলে প্রসাদ খেয়ে নেয়, আহমেদ মিয়া। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হরিপদ গোসাঁই বলে ওঠে, মিয়া পথের কোনো ক্লান্তি নাই, ক্লান্তি পথিকের। পথ যত, পথিকের কাছে, মতও তত। রাত বাড়তে শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের ঝিঁঝিঁ পোকার রব ও ভেকের অন্তরাল রোল জঙ্গলের নীরবতাকে ভেঙে যাচ্ছে।
হাঁটা পথ শেষ হয়ে এসেছে এই। ভদরপুকুর পাড় শেষ হতেই দু'জনের দুটি গ্রামের পথ ভাগ হয়ে গেল; দুই দিকে। যেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দু'জনার দুটি হিসাব — দুইরকম। ততক্ষণে গৌড়বাজার লাউদহ ইলামবাজারের দিকে এই জঙ্গলের রাস্তাটিতে সাইকেল আরোহীদের আনাগোনা বেড়ে উঠেছে। সাইকেল করে একদল মানুষ নিত্যদিন এ পথ দিয়েই চোরায় পথে কয়লা পাচার করে, অজয়তীরে গড়ে ওঠা অজস্র ছোট বড়ো ইঁটভাটায়। সেই বলিষ্ঠ পরিশ্রমী যুবকের দল নেমেছে রাস্তায়। হরিপদ গুণ গুণ করে গান ধরে বাড়ির পথে এগিয়ে যায় —
রূপের মুরতি রূপাতীতে
শ্যাম সখাহে জীবন গীতে
বিপিনে মাধবো মিলনও মহান রাতে।
রাধাবিনোদ রাধাবিনোদ রাধাবিনোদ
পরমোকান্তি মিলনো পথে....
তৃষিত তমালো ছায়াঘন মনে
রূপের মরতি রূপাতীতে
শ্যাম সখাহে জীবন গীতে।
রাত্রি নিশিতে আলোক জ্বালো
আকাশ ঘন নীলের কালো;
রূপের অঙ্গে রূপের আলো।
পর্ব : ছয়
এখন আশপাশ গ্রামের পাণ্ডিত্যে আসনে হরিপদর নাম প্রথম সারিতে। আনন্দ উৎসব, মৃত, অশৌচকর্মে বিধিবিধান দিতে তার মতো পণ্ডিত এ তল্লাটে নেই। গ্রামপঞ্চায়েত, ব্লক জেলা স্তরে কোথাও পাণ্ডিত্যের সরকারি আসর বসলে, বিচারকের আসনে ডাক পরে হরিপদ গোসাঁইয়ের। অপরদিকে অযোধ্যার আহমেদ মিয়াও সরকারি সুযোগে দু'বার হজ করে এসে সাচ্চিক মওলানার সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। নদীর পাড়ের ফকির ডাঙার মসজিদে সে এখন প্রধান মৌলানা।
দুই ধর্মের দুই পণ্ডিত হরিপদ গোসাঁই ও ফকির আহমেদ মিয়া, একে অপরের বন্ধু। বঙ্গে এ সময় ধর্মীয় শক্তির বাড়বাড়ন্ততে প্রায়ই নানা স্থানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দুই জাতির মধ্যে দাঙ্গা লেগেই থাকছে। সরকার বাহাদুর তাঁদের ধর্মীয় পণ্ডিতের কমিটিতে এই দুই বন্ধুকে রেখেছেন। ফলে মাঝে মাঝেই দাঙ্গা কবলিত বিভিন্ন স্থানে তারে একই মঞ্চে বক্তৃতা করতে যেতে হয়। বীরভূমের মুরারই, চব্বিশপরগনার বসিরহাট, বর্ধমানের কাটোয়াতে শান্তি ও সম্প্রীতির সমর্থনে দুই বন্ধুর বক্তৃতা প্রশাসনের আস্থা অর্জন করে। সেই সঙ্গে মানুষেরও আস্থার জনসমর্থন মেলে গণজমায়েত গুলিতে।
একদিন দুই বন্ধু মিলে প্রশাসনিক বৈঠক সেরে গ্রামে ফেরার পথে আকস্মিক এক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। এক কামিনকে নিয়ে গোল বেঁধেছে 'ওয়ান ওয়াইল্ড' কোম্পানির ইঁটভাটায়।
অজয় তীরে অতীতের পালতোলা জাহাজের যুগে পাষাণ চণ্ডী ঘাটেই ফিরতো বণিক জাহাজ ও নৌকা। বাণিজ্য চলতো জল পথ দিয়েই। শোনা যায় গড়কেল্লার একছত্রধীপতি রাজা বল্লাল সেনের পণ্ডিত তান্ত্রিক গুরু মহেশ্বর প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এই পাষাণচণ্ডী ঘাটেই এসে নেমেছিলেন নৌকাতে করে। তারপর অজয়ের গোপন ট্যানেল ধরে গিয়ে ওঠেন সেন পাহাড়ির গড়কেল্লায়।
বর্তমানে ইতিহাসের সে সব দৃশ্যপট পরে রয়েছে রাজকাহিনীর সাক্ষী হয়ে। আর বর্তমানে কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। ট্যানেলের মুখেই বর্তমান বনকাটি গ্রামের শ্মশান আর শ্মশানের পাশে পাষাণ চণ্ডী ঘাটের নাক বরাবর 'ওয়ান ওয়াইল্ড' ইঁট ভাটা। ভাটার পাশেই বিরাট মাল পাড়া। এরা সাপুড়ে, মালপাহাড়ি মাল। অনেকে এদের মল্লার জাতিও বলে। গোল বেঁধেছে সেখানেই। মালেদের এক পুরুষের নাম নূরজাহান। সে নিয়ে হরিপদ সেখানে গিয়েই জিজ্ঞেস করে 'তুমি পুরুষ!' তাহলে তোমার নাম নূরজাহান কেন বাপু?
নূরজাহানের স্বহাস্য উত্তর — ' নামে কী আসে যায় বাপু। পরিচয়ের জন্য নাম একটা হ'লেই হল।'
গোলটা এই নূরজাহানকে নিয়েই। প্রতিবেশি মালেদের অভিযোগ 'নূরজাহান মুসলমান। সে কেন রায়বাবুদের দুর্গাদালানে গিয়েছিল সপ্তমীর বলি দেখতে। নূর মুসলমানের রমজান মাসে রোজা নামাজও করে আবার হিন্দুদের দুর্গাপুজোতেও অংশ নেয়। মালেদের এই রাগ। এই নিয়েই দ্বন্দ্ব, লড়াই। প্রশাসন নেমেছে মাল পাড়াতে।
এদিকে সরকারি শান্তি মঞ্চের দুই প্রধান কারিগরও এসে দাঁড়িয়েছে মালপাড়াতে। মালপাড়ার বেশির ভাগ যুবক যুবতী ' 'ওয়ান ওয়াইল্ড' ইঁট ভাটার শ্রমিক। এদিন নূরজাহানকে তারা কাজে নেয়নি। নূরজাহান দারস্থ হয়েছে প্রশাসনের। সেই নিয়েই এত গোল। নূরজাহান বলে, আমি না হয় বাবু রোজা নামাজ করেছি। কিন্তু গোস্ততো গোটা মাল পাড়া খায়। কেউ সিঁদুর পপে, কেউ পরে না। শাঁখা পলা সবাই পরে না। তুলসিতলা মালেদের কোনো ঘরে নাই। আমরা এক অন্য জাতবাবু। সবার উৎসবই আমাদের উৎসব। কেবল বাপ ঠাকুরদার সাপ ধরাটা আমাদের জাতি আঁকড়ে ধরে রেখেছে। আর আমাদের মেয়েরা এখনও তালাই বোনে। ওই আমাকে নিয়ে যে গোল পাকালো। সে রূপে মালের অন্য লোভ। সবার কুটুম বাড়ির যদি সূত্র খোঁজেন দেখবেন — কেউ না কেউ মুসলমান রীতিনীতি মানে। আমাদের সমাজে কোনো বিধিনিষেধ নাই। যে যার থেকে সুযোগ পায়, সে তাকেই আঁকড়ে ধরে।
যে গ্রামে মুসলমানদের পাশে মালেরা থাকে, সেখানেই মালেরা মুসলমান। আর যেখানে হিন্দুদের পাশে, মালেদের বসতি, সেখানে মালেরা হিন্দু। এই তো মালেদের সমাজ কাহিনী। আর রূপে মালের ত্যজ বাপু, অন্য।
রূপে মাল লাফিয়ে ওঠে। ওদের বনে তেড়ে দাও। ওরা বাপ বেটিতে পাড়া নষ্ট করছে। হরিপদ ও আহমেদ মিয়া রূপকে থামিয়ে দেয়।
নূরজাহান মাল আরও বলতে থাকে — রূপের নষ্ট চরিত্র! প্রতিরাতে ওআমার বাড়িতে আগুর ঠেলে। আমার মেয়ে সোনালিকে দেখে কটুক্তি করে। ওর খুব লোভ। আমরা সাই না দেওয়াতে ও নতুন ষড়যন্ত্র করে। গ্রাম ছাড়া করতে চাইছে। জাতে ওর আরও সুবিধা হয়।
হরিপদরা সোনালিকে দেখে জিজ্ঞেস করলে সোনালি বলতে থাকে — রূপে এগাঁয়ের সম্মান। রূপে বিয়ে পাশ দেওয়া ছেলে। ও ভুল ঠিক বলবেই। তা মানতে বাবার খুব কষ্ট, এতেই যতো গোল। আমিও বাবাকে বলেছি, যতো গোল কথায়, বুঝেশুঝে কথা বল।
ঠিক তখনই আচমকা রূপে বলে ওঠে — ওমন করে বলো না সোনালি, উনিতো তোমার বাবা। হঠাৎ রূপে নিজেকে বদলে নিয়ে উঠে গিয়ে নূরজাহানের হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে নেয়। নূরজাহানও রূপের দোষ ভুলে জড়িয়ে ধরে।
কিছুক্ষণ পরেই ইঁট ভাটার নতুন কালো ধোঁওয়া গিয়ে মেশে আকাশে। কর্মচঞ্চলতার ব্যস্ততায় আবার মেতে ওঠে গোটা পাড়া। রূপে, সোনালি, নূরজাহানরা মাথায় কাঁচা ইঁট চাপিয়ে পাকা করতে গোলায় ঢোকে। মাটি পুড়ে পাকা হয় কাঁচা ইঁট। কথাতেই এসংসারে কাঁচা মন, পুড়ে গিয়ে পাকা হয়ে ওঠে। যা সংসারের উপযোগী। কথা ভাঙে, কথাই গড়েদেয় জীবন, সংসার আর সামাজিক যাবতীয় উত্থান পতনের ধাপ। আবার কর্মমুখর উজ্জ্বলতায় গোটা মাল পাড়া জুড়ে হাসির হুল্লোড় উঠলো। এ যেন অন্যদিন, ভালো লাগার।
পর্ব : সাত
সেদিন কার মতো দিন গড়িয়ে রাত নামলো মাল পাড়ায়। রাত নামতেই মাল পাড়ার রাস্তা জুড়ে শুরু হলো বাবুদের আনাগোনা। রাস্তার দুই পাড়ে, ছোট ছোট ঝুপড়ি চালা। তাতে বাঁশের তৈরি ছোট ছোট খাটিয়া। ভাটা শ্রমিক মালেদের পুরুষেরা এসময় নেশায় চূড় চূড় হয়ে পরে থাকে বাড়ির দাওয়াতে। আর তাদের মেয়েরা এসময়টায় ব্যস্ত থাকে বাবু তোয়াজে। বিহারের বিভিন্ন জেলা ও ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মহিলা শ্রমিকদেরও এসময় হাইওয়ের ওপর গড়ে ওঠা বিভিন্ন হোটেলে নিয়ে যায় এক শ্রেণির মানুষ।
তাদেরও এক ধরনের কণ্টেক্টর রয়েছে এই এলাকায়। যারা তাদের দিনের বেলায় ভাটার কাজে এনে, রাতে নিয়ে গিয়ে তোলে হাইওয়ের ধারে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন হোটেলে। তারপর আবার ভোর রাতে আবার তাদের ঝুপুড়িতে এনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। প্রশাসনের একটা অংশের যোগসাজশে এই চক্র চালাচ্ছেন সমাজের কারিগররাই। আর প্রতি রাতেই অভাব বিক্রি হচ্ছে হোটেল ঘরে। এই অভাবি নারীর বিক্রি হওয়ার পাশে পাশেই বেশকিছু এ অঞ্চলের মেয়ে, প্রতিরাতে শুতে যাচ্ছে অর্থ আর স্বভাবে বিক্রি হবে বলে। গত রাতে মাল পাড়ার বস্তিতে এক মেয়েমানুষকে নিয়ে, গোটা পাড়া ও এঅঞ্চল মাতোয়ারা। চলতি সপ্তাহেই তাকে দুমকা থেকে এনেছে মনমায়া হোটেলের মালিক। ভোর রাতে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে মনমায়ার মালিক ঝুমুরকে এনে রেখেগেছে তার বারের বাউনসার হাবল মালের জিম্মায়। হাবল এ এলাকার নাম করা ডাকাত ছিল একসময়। কিছু দিন সিপিআইএমএল রেডস্টারের সদস্যও ছিল। পরে তা থেকে বিচ্যুত হয়ে, এলাকা জুড়ে মস্তানি রাজনৈতিক দাঙ্গার ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল এবং কয়লা পাচারের কাজ ছেড়ে এই হোটেলে এসে ঢুকেছে। এখন সবই করে। তবে তা মনমায়ার মালিকের অনুমতিতে। পানাগড় মোড়গ্রাম স্টেট হাইওয়ের উপর অবস্থিত মনমায়া, চারের মাইলের কাছে ফাঁকা মাঠে। নেতা কর্তা, মন্ত্রী আমলা, কে না আসে মনমায়ার টানে। সন্ধ্যা থেকে আগুন তরলে ডুবে যায় মনমায়া। গভীর রাত পর্যন্ত ধিক ধিক তুষ আগুনের লাইট জ্বলে, মায়া কুঠুরির ভিতর। আর সেখানেই মায়া ও মোহের বিকিকিনির সওদা হয়, বাজার চড়া দামে। রূপদাসীরা সেজে দাঁড়ায় দ্বারে দ্বারে। তারপর যে যার কৃষ্ণ নিয়ে বিছানায় যায়। দহনের তীব্র লড়াই চলে রাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত। অগ্নি কুণ্ডে পতনের আহূতি দেওয়ার মতো, একে একে নারীসত্ত্বার বিসর্জন চলে কামনার পেশি কুঞ্জে।
সেদিন রাতে ছবি দেখিয়ে মনমায়া হোটেলে আট দশটি লাইন পরেছে ঝুমুরকে পাবে বলে। এদিকে আজই প্রথম টাকার লোভে পরে হাবল মাল, সে রাতের জন্য বিক্রি করে ছিল শ্যামল রক্ষিতের কাছে। এখন শ্যামল রক্ষিত, সমাজের একজন বিশিষ্ট নাগরিক। সরকারের কোনো এক নাগরিক কমিশনের চেয়ারম্যানও সে। এ জেলার দণ্ড মুণ্ডের মাথাও শ্যামল। তার হাত ধরেই এখন রাজনৈতিক উত্থান পতনের শুরু। সে কারণে তাকে চটানোর কোনো ক্ষমতা মনমায়ার মালিকেরও ছিল না। সেও কোনো কিছু বললো না হাবলকে। সে রাত দুর্গাপুরের এক সরকারি আবাসনে কাটিয়ে ভোরের ছুটি পেল ঝুমুর। সেদিন আর তাকে মাল পাড়াতে যেতে দিল না মনমায়ার মালিক। তার ঠাঁই হল মনমায়াতে।
পরদিন রবিবার। সন্ধ্যা থেকেই মনমায়ার গেটে সরকারি গাড়ির ভিড়। কোনো এক সরকারি কমিটির মিটিং আছে, তাই আমলাকর্তারা অনেকেই এসেছেন মনমায়াতে। মিটিং শেষে, সে রাতে আহমেদ মিয়া অতি সন্তপর্ণে ঝুমুরকে নিয়ে হোটেলের এক শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ঢোকে। তারপর রাত বাড়লে যে যার বাড়ি চলে যায়। মনমায়াও গভীর নির্জনতার গাঢ অন্ধকারে মুখ ঢ়াকে আরও একটি সকালের অপেক্ষায়।
পরদিন থেকে আর খোঁজ মেলে না হাবল মাল ও ঝুমুরের। মনমায়ার মালিক পুলিশ লাগিয়েও কোনো কিনারা করতে পারে না সন্ধ্যা পর্যন্ত। আশপাশের গ্রামেও ঢি ঢি পরে যায়, হাবল মাল তাহলে মেয়েটাকে কেটে অজয়ে ভাসিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। পরদিন গভীর রাতে আবার মাল পাড়ায় জটলা হইচই। সকাল না হতেই কানাঘুষো খবরটা শুনে, গ্রামকে গ্রাম ভেঙে পরে মাল পাড়ার পাষাণ চণ্ডী তলায়। তখনও পুরোপুরি সকাল হয়নি। বিয়েন বেলায় মুখ ঢাকা অন্ধকারে ভিজে রয়েছে গ্রামের রাস্তা ঘাট। ফলে সকাল হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে সবাই।
পর্ব : আট
আজকের সকালটা আর পাঁচটা দিনের থেকে একটু আলাদা। বাইরের এক খারাপ পাড়ার মেয়ের জন্য পঞ্চায়েতের ডাকে, গ্রাম বসবে পাষাণ চণ্ডী তলায়। ওখানেই গ্রামের সব মাতব্বররা এসে জরো হবে। শুরু হবে বিচার। এখনকার পঞ্চায়েতের বিচার হয় একতরফা। গাবাবুদের কোল টেনে এক তরফা বিচারে দোষী হয় গরিব। এমন ভাবে সাজানো হয় বিচার মঞ্চ যে গরিব মানুষটি মুখ খুলতেই পারে না। এটাই পৃথিবীর সর্বত্র অঘোষিত নিয়ম। ক্ষমতা বানের জয় আর দুর্বলের পরাজয়। তবুও আইন কানুনে সাজানো রীতিনীতিতে বাঁধা আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। এমনই এক পুরুষ শাসিত সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে ছিল উত্তর প্রদেশের গ্রামের মেয়ে দষ্যুরানি ফুলোন দেবী। ১৯৮১ তে ১৪ ফেব্রুয়ারি বেহমাই গ্রামের সমস্ত পুরুষদের তিনি হত্যা করেন। তার প্রতি অবিচারের বদলা নেন তিনি। কদম তলায় বাঁধা থাকা অবস্থায় এ সব নানা ঘটনার কথা মাথায় ঘুরছিল ঝুমুরের। হাবল মাল ও ঝুমুর রাত গভীর থেকে কদম গাছে বাঁধা। মনমায়ার মালিকের বিরুদ্ধে যেতেই, সে গুটি সাজাতে শুরু করে ছিল। হাবল সেটা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি, তাই আজ পরাজিত লাঠিয়ালের মতো অসহায় হয়ে, তাকে মালিকের পাতা জালে পরতে হয়েছে। মাঝে মাঝেই মদ খেয়ে, বিবেকের দংশনে হাবল যখন হোটেল মালিকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠতো। তখনই মালিক তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে। সে ঠান্ডা মাথার লোক এবং পয়সাওয়ালা। ভিতরে ভিতরে গোটা পারাকে হাত করে পেলে হোটেল মালিক।
বেলা যতো এগিয়ে যাচ্ছে, একে একে গোটা গ্রাম ভেঙে পরছে পাষাণ চণ্ডী তলায়। বনকাটি, শ্যামবাজার, অযোধ্যা, নিমটিকুরি, বনগ্রাম, কোটালপুকুর, খেড়বাড়ি, সাতকাহনিয়া গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ এসে জড়ো হয়। হাবল মাল ঝুমুর কে বলে, আজ আর আমাদের বাঁচার কোনো রাস্তা নেই। ঝুমুর মৃদু হেঁসে বলে ওঠে, মরবেই যখন তখন মৃত্যুর আগে মরছো কেন? একদিন তো মরতেই হবে। না হয় সে দিন, আজই! তুমিনা সস্বস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী। হাবল নীরব হয়ে পরে, আর কথা বলতে পারে না। এতদিন বেশ চলছিল একা একা, কেন যে হঠাৎ এবয়সে....! ভাবতে ভাবতে একটি গরম বাতাসের দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে হাবলের ভিতর থেকে। মনময়ার মালিক, শ্যামল রক্ষিত তার ভাই অঞ্চল প্রধান বিমল রক্ষিত, আহমেদ মিয়া এবং থানার ওসি সুজিত ভট্টাচার্য এসে উপস্থিত হয়। সবাই অপেক্ষায় থাকে হরিপদ গোসাঁইয়ের জন্য। শেষ পর্যন্ত তিনি আসতে দেরি করায়, আলোচনা শুরু হয়। ওসি সুজিত বাবু বলতে শুরু করলেন, ওদের খুলে নিয়ে সামনে আসুন। গ্রামবাসীরা ঝুমুর ও হাবলকে খুলে, সামনের চাতালে এনে বসায়। বিভিন্ন বক্তার মুখের কথায় বন্যা বয়ে নামে। শ্যামল রক্ষিত, আহমেদ মিয়া সকলেই গলা চড়িয়ে বলতে থাকে, ঝুমুরের মতো দেহজীবিকে এপাড়ায় থাকতে দেওয়া যাবে না। ঝুমুর তখনও নীরব। হাবল কিছু বলতে গেলে, মনমায়ার মালিক তাকে ডাকাত আক্ষায় থামিয়ে দেয়। অসহায় হয়ে চুপ করতে বাধ্য হয় সে। এমন সময় জেলার এস পি বিবেক দুবেকে সঙ্গে নিয়ে হরিপদ গোসাঁই ও দুগ্গার বাবা নবনী এসে হাজির হয় পাষাণ চণ্ডী তলায়। আহমেদ মিয়া চিৎকার করে ততক্ষণে গণজমায়েতের পরিবেশ উত্তপ্ত করে তুলেছে। সকলেই প্রায় স্থির হাবলকে জেলে পাঠানো হবে আর গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে ঝুমুরকে।
হঠাৎ হরিপদকে দেখে ঝুমুর চিৎকার করে ওঠে, আমি কিছু বলতে চাই। গণজমায়েতের মুখ তখন ঝুমুরের দিকে। হরিপদ গোসাঁই দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে, পৃথিবীর সর্বত্র নিয়ম, অপরাধীকে তার বক্তব্যের বলার জন্য সময় দিতেই হবে। এবং সবার শেষে বলতে শুরু করল ঝুমুর। মুখ থেকে কাপড়ের আঁচল সরাতেই, দুচোখ ছাপানো জলে ভিজে গেল নবনী ঠাকুর।
ঝুমুর বলতে শুরু করে, আমি অতি সাধারণ, এই শ্যামবাজারেরই মেয়ে। আমি আজ বেশ্যা হয়ে গেলাম! আমার বাবা ওই দূরে বসে আছেন নবনী ঠাকুর, উনিই আমার বাবা। আর আমার নাম ঝুমুর নয়, আমি খাঁটি মমতায় গড়া মাটির দুগ্গা। আজ সে জেলার রাজনৈতিক দলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তিনি আমাকে গ্রাম ছাড়া হতে বাধ্য করেছিলেন ৩৫ বছর আগে। অভাবি বাবা, আমাকে রেখে এলেন রানিগঞ্জের মেসমশাইয়ের বাড়িতে। এক দুবছর বাবা, খোঁজ রেখেছিল। পরে তাকে বলা হয় আমার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে হঠাৎ। ততদিনে মা বলাধন মাসিটাও গেছে মরে। মেসমশাই রণজিৎ সরকার আমাকে বিক্রি করে দিল, শ্যামল রক্ষিতের হাতে, মোটা টাকা দামে। তখন আমি ছোট। নেই সামাজিক জ্ঞান।
এতদিনে শ্যামলবাবুর বেশ নাম খ্যাতি হয়েছে। নামে, বেনামে বাজারে চলছে শ্যামলবাবুর বহু হোটেল। ছোট থেকেই আমার শরীরের প্রতি উনার লোভ ছিল প্রবল। সে ইচ্ছে চরিত্রার্থ করতে আমাকে বেশকিছু দিন, দিঘার হোটেলে নিয়ে গিয়ে ভোগ করে। পরে ঘোরাতে লাগলো বিভিন্ন হোটেলে হোটেলে। মনমায়া তারই হোটেল। ভাগ্যচক্রে এসে এখানে পরেছি তারই জিম্মায়। আর ওই যে হাজী আহমেদ মিয়া মঞ্চে বসে রয়েছেন, উনি গত রবিবার আমার শরীর নিয়ে ভাদুরে কুকুরের মতো খেলেছেন। ওই ধার্মিককে নিয়ে আপনাদের বড়াই। আর তখনই দুগ্গা ওরফে ঝুমুরকে থামিয়ে হাবল বলতে শুরু করে, ওই যে হরিপদ গোসাঁইকে দেখছেন উনিই আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। ফিরিয়ে এনেছেন সঠিক পথে। উনিই তো প্রকৃত বন্ধু, দুগ্গা দিদিকে গড়ার কারিগর। হরিবাবু না বললে আমি দিদিকে এভাবে আনতাম না। হঠাৎ ঘাসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে হরিপদ গোসাঁইয়ের ঘোষণা, দুগ্গা আমার স্ত্রী! তাকে নষ্ট করার জন্য, বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। তবুও ধরিত্রী ধরিত্রীই! মাটিতে বীর্জ পরে, মাটিতেই মানুষ মরে মেশে, বাঁচে। আঁধারের কোনো অপূর্ণতা, নষ্টতা নেই। বিচারের ভার সবার! ভিতরে ভিতরে যে দহণে আমদের প্রতিদিন মরা, লড়াই করি আজ তার কাছে হেরেই আমি সম্পূর্ণের খোঁজে দুগ্গাকে সঙ্গে নিলাম। সর্বসমক্ষে দুগ্গার পরিচিত হাত ধরে, ভিড় ঠেলে গাড়িতে গিয়ে ওঠে হরিপদ গোসাঁই। এস পিও তাদের এগিয়ে দেয়। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হাবলের চোখ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে একটি নতুন দিনের মেঘউৎসবের রোদ।
আকাশে আকাশে তখন সোনামাখা রোদের লুকোচুরি। এই কদিন পেরিয়ে গেলেই, আলোর কোলাহল। দেবী পক্ষের শুরু। উমা আসবে মাটির ঘরে। তারই আয়োজন ঘরে ঘরে।