চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

মোদের গরব মোদের আশা


 

মোদের গরব মোদের আশা



 🟣 বিশ্বরূপ দাস


 ➡️ " মোদের গরব , মোদের আশা /আ মরি বাংলা ভাষা ''। হ্যাঁ আজ একুশে ফেব্রুয়ারি , আমাদের সাধের মাতৃভাষা দিবস। অনেক রক্তের বিনিময়ে নিকানো উঠানে ঝরেছিল রোদ, অন্ধ বাউলের একতারা উঠেছিল বেজে। নদীও হয়েছিল নর্তকী। বিষাদ সিন্ধুর ওপার থেকে আমরা সেদিন ভাটিয়ালী সুরে শুনেছিলাম মহজীবনের গান। কাননে ফুটেছিল কুসুমকলি । আসমুদ্র হিমাচল তথা তামাম বঙ্গদেশে উঠেছিল ভাষাপ্রীতির ঢেউ। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ অর্ধ শতাব্দী পরেও সমগ্র বাংলায় '' বাংলা ভাষা '' বড় বিপন্ন। কবি শামসুর রহমানের কথায় বলতে হয় '' বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা '' ॥ খাতায় কলমে সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রচলন থাকলেও দু একটা ব্যতিক্রম বাদে কোথাও সেই ভাষা প্রীতি নজরে পড়ে না । স্কুলে হাজিরা খাতায় সই করা থেকে শুরু করে শ্রেণি কক্ষে ছাত্রদের রোল কল (নাম ডাকা) সর্বত্রই ইংরাজির ছড়াছড়ি ! অফিস , আদালত , মহাবিদ্যালয় , বিশ্ববিদ্যালয় , ক্লাব, ধর্মপ্রতিষ্টান , পার্ক, জাদুঘর , ভ্রমণ , ডাক্তারখানা, হসপিটাল সর্বত্রই রাক্ষস ইংরাজি আমাদের সাধের বাংলা ভাষা কে খেয়েছে। বরং বলা ভালো আমরাই নষ্ট করেছি '' মাতৃদুগ্ধ সম '' মাতৃ ভাষার মর্যাদা॥ তাই কালের নিয়মে একুশে ফেব্রুয়ারি এলেও সেই ভাষা প্রীতি আসবে কীনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। কারণ বর্তমান প্রজন্মের বেশির ভাগ ছাত্র আজ মডেল স্কুল যাত্রী। আমাদেরও কথায় কথায় ইংরাজি না বললে যেন আত্মসম্মান বজায় থাকে না ! প্রকাশ করা যায় না পান্ডিত্যের অভিব্যক্তি ! অপরের কাছ থেকে সমীহ আদায় করতে হবে তো ? তাই তাদের পেটে কালির আঁচড় পড়তে না পড়তেই আমরা সদম্ভে বলতে চাই "বাংলাটা ঠিক তার আসে না "! এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা খুবই প্রচলিত আছে। কথাটি হলো স্বল্প শিক্ষিত কোনও রিক্সাওয়ালাকে "বিশ্ববিদ্যালয়" নিয়ে চলো বললে সে বুঝতে পারে না। কিন্তু যখন তাকে বলা হয় আরে ভাই "ইউনিভার্সিটি"চেনো না। তখন সে নিঃসংকোচে বলে ফেলে বাবু বাংলায় বলুন। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় নয় ইউনিভার্সিটি তার কাছে বাংলা। ভাবুন একবার।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে বর্তমানে বহু ইংরেজি শব্দের বঙ্গিকরণ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হবে।কালের নিয়মে আমাদের তা মেনে নিতে হবে।তবে বাংলা ভাষায় ইংরাজি শব্দের আগমন অনভিপ্রেত নয়। এতে ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়।রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে বর্তমান দিনের কবি সাহিত্যিকরা বহু ইংরেজি শব্দ বাংলায় ব্যবহার করেছেনও করছেন এবং ভবিষ্যতে আরও করবেন।ভাষার কলেবর এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য আমরা এই বঙ্গীকরণ মেনে নিলেও কখনই বকচ্ছপ জাতীয় শব্দ মেনে নিতে পারবো না।মেনে নিতে পারবো না বাংলা ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা বা সেই ভাষাকে নিয়ে খিস্তি খেউর। তাতে মাতৃসম মাতৃভাষার অসম্মান হয়। নষ্ট হয় তার গরিমা।তাই আমাদের সজাগ হতে হবে।কেউ সেই ভাষার অসম্মান করলে আমরা আবার সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের মতো মাতৃভাষার বেদিতলে ৫২ অক্ষর নিয়ে বাহান্ন বার বুকের রক্ত দিয়ে রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি দেবো। সগর্বে বলবো 

"বাংলাই আমার দৃপ্ত স্লোগান

ক্ষিপ্ত তীর ধনুক

আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, 

দেখি বাংলার মুখ"।


সত্যি বলছি জীবনের প্রয়োজনে, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে নিত্য নতুন বাংলা ভাষার আমদানি হোক। শত ফুলে বিকশিত হোক মাতৃদুগ্ধ সম মাতৃভাষার কমল কানন। তবে তা যেন কখনই শালীনতার মাত্রা না ছাড়ায়। 

যুগের সাথে তাল মেটাতে যারা মাতৃভাষা বাংলাকে ব্যাকডেটেড বলেন তাদের খেয়াল রাখা উচিত এই মাতৃভাষায় চর্চার জন্যই কিন্তু দেশের প্রথম নোবেলটি এসেছিল। জগদীশচন্দ্র বোস, প্রফুলচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানীরা এই ভাষাতেই বিজ্ঞানচর্চার পথটিও বিকশিত করেছিলেন ।বিবেকানন্দের মতো মনীষীরা এই বাংলা ভাষার ভাব মন্দাকিনির ধারাস্রোতকে বিদেশের মাটিতে বইয়ে দিয়ে গোটা পৃথিবীর হৃদয় হরণ করেছিলেন।চৈতন্য মহাপ্রভু এই বাংলা গানেই আদ্বিজচন্ডাল কে একসূত্রে বেঁধেছিলেন। অন্যায়ের সাথে আপোষহীন বিদ্রোহের পাশাপাশি নজরুল শুনিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেই অমোঘ বাণী 

"মোরা একবৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান

মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ"।


তারা যদি পেরে থাকেন তাহলে আমাদের দোষ কোথায়। কেন আমরা সেই ধারাপথ টিকে সযত্নে বইয়ে নিয়ে যেতে পারবো না। কীসের ভয়, কীসের হীনমন্যতা। এ বিষয়ে অশেষ ধন্যবাদ জানাই প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ কে । তারা আজও সরকারী প্রতিটি স্তরে বাংলা ভাষার মর্যাদা টিকিয়ে রেখেছেন । তারা যদি পারেন আমরা কী পারবো না ? উত্তর দেবে ভাবীকাল ।

তবে সবশেষে বাংলা ভাষার প্রতি অন্তরের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানিয়ে কবির ভাষায় বলি,

"আমি বাংলায় গান গাই,

আমি বাংলার গান গাই ,

আমি আমার আমিকে এই বাংলায় খুঁজে পাই"।