চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

জয়দেব কেন্দুলির বাউল মেলা ও বিস্মৃত কথন


 

জয়দেব কেন্দুলির বাউল মেলা ও বিস্মৃত কথন


🟣 রাধামাধব মণ্ডল


➡️ বাউলমেলা ২০২১ এবছর তাল কেটেছে করোনা। আইন, রাজনীতির বাইরে গিয়েও এবছরও মকরের পূর্ণ স্নানে হয়েছে কেন্দুলির বাউলমেলা। তবে কোভিড প্রোটকল মেনে এবছর, সরকারি ভাবে মাত্র দু'দিন হয়েছে জয়দেব মেলা। চার শতাধিক স্থায়ী, অস্থায়ী আখড়ায় এবার পড়েছে ছেদ। স্থায়ী আখড়া গুলি অনেকেই যেমন তাদের অনুষ্ঠান বন্ধ করেছে। তেমনই সরকারি ভাবেও ১০০ বেশি অস্থায়ী আখড়া করা যাবে না বলা হয়েছে। তবুও শেষ পৌষের অজয় নদে মকরের পূর্ণ স্নানের জন্য, এবারও বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে সরকার। অজয় তীরে বীরভূমের ইলামবাজারের অদূরে, প্রাচীন কেন্দুলী গ্রাম। নদের তীরবর্তী ওপাড়ে কেন্দুলীর কুশেশ্বর ঘাট, এপাড়ে শাল গাছের বহু প্রাচীন গড়কেল্লার জঙ্গল। জঙ্গলের উপর ইশত মাথার চূড়ো দেখা যায়, জয়দেবের নদী ঘাটে বসেই স্বাধীন সামন্ত রাজা ইছাই ঘোষের একরেখ দেউল। মঙ্গলকাব্যের যুগেও এই অজয় নদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও তার গুরুত্ব রয়েছে। লাউসেন ও কালুবীরের রক্তস্নাত ভূমি। প্রথম ধর্মযুদ্ধ হয়েছিল এখানেই। এই অজয়ের তীরেই লাউসেন তলায়। মাঝে বহতা স্রোতের অজয়, ওপাড়ে বর্ধমান জেলার সেনপাহাড়ির জঙ্গল, এপাড়ে বীরভূমের জয়দেব কেন্দুলী। ওপাড়ে রাজা লক্ষ্মণ সেনের হাত ধরে গড় জঙ্গলে শাক্তির দেবী, শ্যামারূপার মন্দিরে আজও নিয়মিত পুজো হয়। কথিত আছে দেবী শ্যামারূপার পুজো করতে গড় জঙ্গলে বৈষ্ণব কবি জয়দেব গোস্বামী শ্যামার মধ্যেই শ্যামের রূপ দর্শন করাণ রাজাকে। তখন থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে নরবলি, এগল্প আজ এঅঞ্চলের সবার মুখে মুখে।




সেই বৈষ্ণব কবি জয়দেবের খ্যাতিতেই আজ কেন্দুলীর গুরুত্ব ছড়িয়ে পরেছে দেশে বিদেশে। কেন্দুলীর এই তিনটে দিনের বাউল গানের মেলাকে ঘিরে, গোটা বিশ্বের মানুষ আসেন বীরভূমের জয়দেবে। জয়দেবের বাউলরা গুপীযন্ত্রে তোলে, মনের মানুষের গান। মিলনের সুরে, ভিজে যায় শেষ পৌষের অজয় চরাচর। একদিকে বাউল, অন্যদিকে গৃহের ভিতরে বসে পদাবলি কীর্তনের সুর তোলে, বৈষ্ণব সমাজের সাধকরা। কেন্দুলীর বিল্লমঙ্গলে বসে আজও অন্ধগায়ক অনাথবন্ধু ঘোষ দু'হাত তুলে গান " গীতগোবিন্দম্" এর পদ। অজয় তীরে জয়দেবের মাটির বাউল আখড়ায় আখড়ায় বসে সাধু, কাঙ্গাল, লক্ষ্মণ, বাঁকাশ্যাম, বাপী দাসরা দোতরায়, তোলেন মাটির বাউল গানের সুর। তাদের মাটির সুরে কখনো দুবরাজপুরের আশানন্দন, জয়দেবের দাস রসময়, তো কখনো কেন্দুলীর সাধক বাউল সুধীর দাসের পদ উঠে আসে।

কদমখণ্ডি শ্মশানে ধূনি জ্বালিয়ে, পৌষ সংক্রান্তির রাত থেকেই মকরস্নানের বাউলমেলার পাঠ শুরু করে দেন, বাউল, বৈষ্ণব, নেড়ানেড়ি সম্প্রদায়ের সাধুরা। কাক ভোরে মহান্ত আখড়ার সন্ন্যাসীরা দলবেঁধে, বৈষ্ণব কবির স্মৃতিতে অস্তিত্বশীল গঙ্গারূপী অজয়ের জল নিয়ে গিয়ে বসে, কবির শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে আখড়ায়। তার মধ্যে দিয়েই, স্রোতস্বিনী অজয়ে পুর্ণার্থীর স্নান সেরে রাধাবিনোদ মন্দিরে পুজো দিয়ে, একটু আশ্রয়ের খোঁজে আশ্রম, আখড়ায় মাথা গোঁজা। সেই জনকোলাহলে, আশ্রম আখড়ায় বাউল, ফকির, কীর্তনের উম্মাদ সুরে ভেসে যায় কেন্দুলী। তিন দিনের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় শুরু হয় মেলা। সরকারি ভাবে তিন দিনের মেলা হলেও, চলে পাঁচ দিন। তবে তিন দিনে গোটা মেলায় দুই শতাধিক আখড়া, আশ্রমে মচ্ছব খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকে। সরকারি বাউল মঞ্চের অনুষ্ঠানও, তিন দিন পর আর হয় না। বাউল কীর্তনের টানেই দেশ বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ, আসেন জয়দেবের গানমেলায়। গভীর রাতেও অজয়ের মাঝ বালিয়াড়িতে, বয়ে চলে জনতার স্রোত। সে কেবল বাউলের টানেই।




বৈষ্ণব কবি জয়দেব মাঘ মাসের কৃষ্ণচতুর্দশী তিথিতে, কেন্দুলীর মন্দিরা গ্রামে ১১২৩ খ্রিঃ, ১০৪৫ শকাব্দে জন্মে ছিলেন। জয়দেব গোস্মামীর জন্মের অনেক আগেই মেলার শুরু হয়েছিল কেন্দুলীর অজয় তীরে। স্নানের সেই মেলাকে সকলে মকরমেলা বলেই জানতো কুশেশ্বর মন্দির ছাড়া সে সময় কেন্দুলীর মেলায় কোনো মন্দির ছিল না। এটি কুশান যুগের মন্দির। নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যেই মন্দিরটি এখনো রয়েছে দাঁড়িয়ে। কবি মোহন দাসের "ভক্তমালা" গ্রন্থে রয়েছে, "কেন্দুবিল্ল গ্রাম আছে অজয় কিনারে। জয়দেবের বাস সেথা গ্রামের বাইরে। জয়দেব রাখেন করয়া কৌপিন। বৃক্ষের তলাতে বাস, সদা উদাসীন।" কবি বনমালি দাসও তাঁর "জয়দেব চরিত্র" গ্রন্থে লিখছেন, "চারি সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব আইলে শত শত, /অজয় কিনারে সভে আখড়া বাঁধলো/ অজয় কিনারে সভে পরমানন্দে মচ্ছব করে রাত্রি দিনে"। মকরের সেই স্নানের মেলার হাত ধরেই, আজকের এই জয়দেবে এসেছিলেন সেদিনের নেড়ানেড়ি সম্প্রদায়, বাউল সম্প্রদায়, চার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লোকজনরা। শুধু তাই নয়, অতীতের বহু যুগ আগে থেকেই এখানে বসবাস করে আসছেন কামার ও ব্রাহ্মণরা। অনেকেই বলেন, বর্তমান কেন্দুলী গ্রামের কামার জাতিরা এসেছে অতীতের বিভিন্ন ধারা পেরিয়ে, গড় জঙ্গল লাগোয়া ঢেক্কার কামারদের বংশ থেকেই। 




 কেন্দুলীর পৌষ মেলায় গেলেই চোখে পড়বে প্রাচীনতম বাউল আখড়া গুলির মধ্যে অন্যতম হলো শ্রীশ্রী কাঙ্গাল সেবাশ্রম আখড়াটি। আখড়াটি জয়দেবের বাউলদের একটি আবাস ভূমি। ১২৮৫ বঙ্গাব্দে সাধক কাঙ্গাল খ্যাপা অতীতের কেন্দুলী গ্রামে, বৃন্দাবন থেকে এসে আখড়াটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ১৩১০ বঙ্গাব্দে ১৭ মাঘ, পূর্ণিমা তিথিতে কেন্দুলীর নিজের আখড়াতেই দেহ রাখেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে কাঙ্গালের সমাধি রয়েছে। কাঙ্গাল একাধারে যোগী সাধক ও বাউল কবি ছিলেন। তিনি প্রচুর বাউল গান লিখেছেন, তবে তিন চারটি গান এখনও পাওয়া যায় জয়দেবের বাউলদের মুখে মুখে। ১২৯৬ বঙ্গাব্দ থেকে কাঙ্গালের আশ্রমে মচ্ছব শুরু হয়। মাথায় পিঙ্গল জটা, গলায় ঝোলানো করটি ও একটি ছোট্ট ঝাঁটা এবং কোমরে কাষ্ঠ নির্মিত কোপনি, হাতে মাটির করোয়া, কাঁধে ছেঁড়া কম্বল। এই ছিল কাঙ্গালের বেশ। তিনি গান গেয়ে ঘুরতেন পথে পথে। মেদিনীপুরের খালিনগরে তাঁর জন্ম। বাবা কামদেব মুখোপাধ্যায়, ছিলেন সে যুগের পরিচিত মানুষ। চতুষ্পাঠীতে পড়াশোনা করেন কাঙ্গাল এবং ১৮ বছর বয়সে ব্রহ্মচারী হিসেবে গৃহত্যাগী হন। কাঙ্গালকে নিয়ে দুটি বই পাওয়া যায় তাঁর নাম, "বালকের সাধুসঙ্গ" ও "কাঙ্গালের সাধনা"।

অজয় তীরের সাতকাহনিয়ার রজনীকান্ত হালদার তাঁর প্রধান ও প্রথম শিষ্য ছিলেন। তিনি তাঁর সম্পত্তি কাঙ্গালপর আশ্রমকে দান করেন।

আশ্রমের ভিতরে পঞ্চমুণ্ডির আসন রয়েছে, যেখানে শক্তির সাধনা করতেন কাঙ্গাল খ্যাপা। কেন্দুলীর আরও এক বাউল সাধুর কথা শোনা যায়। তিনি খোটরে বাবা নামে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর জয়দেবে আগমন ১৩৪০ বঙ্গাব্দে বা ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়। প্রকৃত নাম নরত্তোম দাস ভারতী। তিনি বটতলায় খোটরে বসবাস করতেন বলে, তাঁকে খোটরেবাবা বলতো কেন্দুলীর মানুষ। বটতলায় রয়েছে তাঁর সিদ্ধাসন পঞ্চমুন্ডী। দেহ রাখেন জয়দেবে, ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের ৭ মাঘ। খোটরে বাবার একটি বিখ্যাত গান রয়েছে, গবেষক রণজিৎ মুখোপাধ্যায় তা শুনিয়েছিলেন -

" চল যাই কেন্দুলীর প্রেম বাজারে,/ প্রেমের মানুষ দেখিবার তরে/ যেথা নাই হিংসা নিন্দা কামের গন্ধ, প্রেমিকজনার আচারে।"




তবে আর কোনো তেমন পদ পাওয়া যায় না। জানা যায়, তুর্কি আক্রমণের সময়, রাজা লক্ষ্মণ সেন পড়েছিলেন মহাবিপদে। সে সময় কবি জয়দেব গোস্বামীও তুর্কি আক্রমণের কালে, তাদের ভয়ে তিনি বীরভূমের কেন্দুলী থেকে চলে যান রাধামাধবকে সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনে। বৃন্দাবনে গিয়ে ওঠেন নিম্বার্ক সাধুদের আশ্রমে। পরবর্তী কালে কবি জয়দেব গোস্বামী নিম্বার্ক আখড়ার সাধুদের আশ্রমে গিয়ে গুরু হিসেবে ৮০ বছর জীবিত থেকে সেখানেই দেহরাখেন। সেখানে তাঁর সমাধি রয়েছে। যদিও রাজস্থানের ঘাঁটি শহরে, নিম্বার্ক আখড়াতে বর্তমানে রয়েছে কবি জয়দেবের রাধামাধব। কবি জয়দেবের মৃত্যুর পর সেই নিম্বার্করা কেন্দুলীর জয়দেবে এসে রাধারমন ব্রজবাসীর নেতৃত্বে নিম্বার্ক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেটিই কেন্দুলীর সব থেকে প্রাচীন আখড়া। নিম্বার্ক আখড়া, আজও কবি জয়দেবের স্মরণে নানা অনুষ্ঠান করেন। সম্ভবত এটি ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে প্রতিষ্ঠিত ধরা হয়। নিম্বার্ক সাধুরাই কবি জয়দেবের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান শুরু করেন, পৌষসংক্রান্তিতে জয়দেবে। আজও সেই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, অনুষ্ঠান হয় নিম্বার্ক আখড়াতেই পৌষসংক্রান্তির মেলার দিন। হরিকান্ত ব্রজবাসীর প্রয়ানের পর, বর্তমানে নিম্বার্ক আখড়ার দায়িত্বে রয়েছেন নরসিমাব্রজবাসী স্মরণদেব। আরও এক প্রাচীন বাউল আখড়া রয়েছে জয়দেব কেন্দুলী গ্রামে। সেটি গঙ্গামাতা বেদান্ত আশ্রম। ১৩৪০ বঙ্গাব্দে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। গঙ্গামাতা নামের এক তান্ত্রিক এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। চুলের খোঁপায় ছোট্ট ত্রিশূল গেঁথে, ডালি নিয়ে ভিক্ষা করতে বের হতেন কেন্দুলীর পথে পথে। আখড়ায় একাই থাকতেন যোগী। আজকের জয়দেবে রয়েছে মনোহর খ্যাপার প্রতিষ্ঠিত বেদনাশাবট আশ্রম। এ আশ্রমের প্রতিষ্ঠা ১৩৫০ বঙ্গাব্দের ৩ রা মাঘ। মনোহর খ্যাপা প্রচুর বাউল গান লেখেন। তাঁর জনপ্রিয় বাউল গানের মধ্যে, আজও রাঢ়ের বিখ্যাত বাউলরা গাই "রাখিতে নারিলি প্রেমজল, কাঁচা হাড়িতে"। তাঁর গুরু ছিলেন সদানন্দ স্বামী। তিনি কবি জয়দেব গোস্বামী-র ভক্ত ছিলেন। মনোহর খ্যাপার প্রকৃত নাম স্বামী বিরজানন্দ ভারতী। তিনি দেহ রাখেন পুরুলিয়ার কাশিপুর থানার সোনাথলি আশ্রমে গিয়ে, সেখানেই তাঁর সমাধি রয়েছে। 

জয়দেবে " শ্যামসখা" নামের একটি বাউল আখড়া প্রতিষ্ঠা হয় ২০১৫ সালের মেলায়। স্থায়ী সেই আখড়ায় সাড়া বছরই চলছে বাউলগানের চর্চা। শ্যাম হালদারের সেই আখড়ায় নিয়ম করে বসে গীতগোবিন্দম গানের আসর। বাউল গবেষক শক্তিনাথ ঝা, শুভেন্দু মাইতিরা আসেন সেখানে নিয়মিত বাউলদের নিয়ে, মাটির সুরে ভিজতে। 

আত্মানন্দ বাবার হরিঔঁ অখণ্ড মিলন আশ্রম। এই অখণ্ড মিলন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন আত্মারাম ব্রহ্মচারী, ১৩৮৭ বঙ্গাব্দে।  




কেন্দুলীতে সহজিয়া বৈষ্ণব সাধক ফুলচাঁদ বাবাজীর আশ্রম হলো কাঙ্গাল ঠাকুর আশ্রম। ১৩৬২ বঙ্গাব্দে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। মেয়ে পূর্ণিমা এবং ফুলচাঁদ বাবাজীর স্ত্রী মালতি দাসী এখনও ১০০ বছর বয়সেও রয়েছেন জীবিত, আখড়াতে।

জয়দেবে বাউলদের পরিচিত আশ্রম, হরিজন আশ্রম, হালাকাঁপা বাবা এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ১৩৭০ বঙ্গাব্দে। বিল্লমঙ্গলের সাধু প্রেমদাসের কাছে তিন বছর কাটিয়ে, হালাকাঁপা বাবা জয়দেবে চলে আসেন। পুরুলিয়া জেলার লধুরকা গ্রামে জন্ম তাঁর জন্ম। জয়দেবে এসে অন্তঃজ শ্রেণির মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি শিষ্য করেন। এই আশ্রমেই থাকতেন পায়েড়ের জনপ্রিয় শম্ভুদাস বাউল। হালাকাঁপা বাবা ১৪০৬ বঙ্গাব্দে দেহ রাখেন। 

 জয়দেবে যে আশ্রমকে ঘিরে, সাংস্কৃতিক উদ্মাদনার ঝড় উঠেছিল ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে সেই শ্রীশ্রী ঠাকুর হরিদাস আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন কবি কুমুদ কিঙ্কর। এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে তিনি মা আশালতাকে নিয়ে, এই জয়দেবেই থাকতেন। ওনার আসল নাম ছিল কাজী নূরুল ইসলাম। পরবর্তী কালে উনি, বর্ধমানের কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে, কুমুদ কিঙ্কর নাম নিয়েছিলেন। উনিই দুবরাজপুরে চণ্ডীদাস প্রেস ও জয়দেব থেকে চণ্ডীদাস পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। জয়দেব অনুসন্ধান সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৫ এ, কুমুদ কিঙ্করই। তাঁর উদ্যোগে কবি জয়দেব সাধারণ পাঠাগার ও সরকারি বাউল মঞ্চ আজ রূপ পেয়েছে। "বেনারসি ছিঁড়ে গেল হাসাপাথরে" কিংবা "ও নাগর জল লেগেছে তোমার বাকুরি খ্যতে" র মতো অসংখ্য জনপ্রিয় বাউল গান লিখেছেন। জয়দেবের তারক দাস বাউল, বেণীমাধব দাস বাউলরা সে গান গাইতেন। 

কেন্দুলীতে বাউলের শ্রীশ্রী বড়ো আখড়া,প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাথরকুচি গ্রামের কাঁথা ছেঁড়া বাবাজীর হাত ধরে। এটিও কেন্দুলীর প্রাচীন আখড়া। এটি মূল কদমখণ্ডী শ্মশানের উপরে, আজও মেলার কয়েকদিন অস্থায়ী বসে। কিছু অলৌকিক কর্মকাণ্ড আজও এই আখড়াই ঘটে। 

কেন্দুলীর সে যুগের পুরোনো বাউল'রা হলেন কোটার পঞ্চানন ঠাকুর, পরম বাবাজী, জগৎ খ্যাপা, জগৎ খেপী, সুবল দাস, ললিতা মাতা, শম্ভু দাস বাউল, পাগল রাম দাস, চুরুক দাড়ি রামদাস বাবাজী, সুধীর দাস বাউল, দীনবন্ধু দাস, বিশু বাউল, বেণীমাধব দাস বাউল, বিশ্বদাস বাউলরা। এছাড়াও জয়দেবে নিয়মিত আসতেন নবনী দাস বাউল। পূর্ণ দাস বাউল ১৯৭৫ সালে জয়দেব মেলায়, একটি আখড়া করেন, নবনীবালা ব্রজধাম আশ্রম নম দিয়ে। তাঁর মা ও বড়ো দিদি অন্নপূর্ণা দাসী, জয়দেবে বহুকাল ছিলেন শান্তি রজকের বাড়িতে। 




কদমখণ্ডী তমালতলা আশ্রম, বাউলদের নিজস্ব বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন ১৩৬৩ বঙ্গাব্দে, তখন হালাকাঁপা বাবার আশ্রমে থাকতেন সুধীর দাস। তিনি হালাকাঁপা বাবার শিষ্য। যদিও নবসনের কাঙ্গাল গোসাঁই তাঁর দীক্ষা গুরু। কেন্দুলীর সে যুগের বাউলদের তিনি প্রধান। তিনি ১৪০৭ বঙ্গাব্দে ৫ আশ্বিন দেহ রাখেন জয়দেবে। তাঁর দীক্ষা গুরু টিকরবেতা আশ্রমের কৃষ্ণ খেপা চাঁদ। তাঁর গুরু খেপা চাঁদের আনন্দমঠ আশ্রম রয়েছে জয়দেবের পাশের গ্রাম টিকরবেতায়। খেপা চাঁদের তিন হাজার শিষ্য ছিল। অতীতের কেন্দুলী গ্রামের পাশে মন্দিরময় মন্দিরা গ্রামেই জন্মে ছিলেন ভোজ দেব আর বামা দেবীর সন্তান কবি জয়দেব। আজ আর সে গ্রামের কোনো অস্তিত্ব নেই। চলে গেছে অজয় গহ্বরে। তবে সে সময় মন্দিরা গ্রামে মাধবের যে মন্দিরটি যুবরাজ লক্ষ্মণ সেন নির্মাণ করে দিয়েছিলেন তা আজ আর নেই। চলে গেছে অজয় গহ্বরে। সে ঘটনার অনেক কাল পর বর্ধমান মহারানি ব্রজকিশোরী দেবী, নতুন করে ১৬৯৬ বঙ্গাব্দে কেন্দুলীতে বর্তমান এই মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। মাধবের নব রত্ন মন্দির। আর সেই নবরত্ন মন্দিরে গড় জঙ্গল থেকে রাধাবিনোদকে এনে মাধবের জায়গায় স্থাপন করা হয়। ৩৬০ বিঘে জমি দান করেন রাধাবিনোদের সেবাপুজোর জন্য। সম্পত্তি বাঁচাতে রাণিমা বিনোদ রায় নাম উল্লেখ করে এক অজ্ঞাত পরিচয়হীন ব্যক্তির নামে উল্লেখ করে যান। ব্রিটিশরা যাতে দখল না করে নিতে পারে।

কেন্দুলীর এই বাউল মেলার খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বজুড়ে। মেলার আয়োজন এখন বহু গুণ বেড়ে গেলেও, মেলার মূল আকর্ষণ এখনও ধরে রেখেছে জয়দেবের বাউলরা। বাউল সাধক সাধন দাস বৈরাগী জয়দেবের বাউল মেলাতে, এসে "মনের মানুষ" নামের একটি বাউল আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন ২০০৪ সালে। বাউল সাধন দাস বৈরাগী অজয়ের কোলে রামপুর মাঠের কাছে, বাউলের সেই আখড়ার দায়িত্বে এখানে রয়েছেন তন্ময় দাস বাউল। চার বিঘা জায়গায়, নদী তীরে তৈরি এই সাধনের এই "মনের মানুষ" বাউল আখড়া। 

পশ্চিমবঙ্গ ও তার বাইরে থেকে হাজার দশেক বাউল গানের শিল্পী, গবেষকরা আসেন এই বাউলবাগান বাড়িতে, মেলার কদিন। জয়দেব মেলার কদিন এখনও "মনের মানুষ" - এ এসে থাকেন গুরু সাধন দাস বৈরাগী, সঙ্গে জাপানি বাউল মাকি কাজুমিও। তাঁদের উপস্থিতিতে "মনের মানুষ" আখড়ায় বসে বাউল গানের মেলা। হাজার হাজার বাউলপ্রেমী মানুষ ছুটে আসেন, শেষ পৌষের এই জয়দেব মেলায়। যেখানে তমালতলি কেঁপে ওঠে, গাবগুবির তারে।