চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

ভারতবর্ষে হৃদরোগ বৃদ্ধির কয়েকটি  রিস্ক ফ্যাক্টর সম্বন্ধে কিছু কথা

                   Image courtesy : http://pted.org


ভারতবর্ষে হৃদরোগ বৃদ্ধির কয়েকটি  রিস্ক ফ্যাক্টর সম্বন্ধে কিছু কথা 


 🟣 ডাঃ এন. সি. মন্ডল 



 ➡️  সমগ্র বিশ্বের মধ্যে ভারতবর্ষে বর্তমানে হৃদরোগীর সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গড় পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯২ সালে ভারতবর্ষে হৃদরোগীর সংখ্যা ছিল ১.৫ (দেড়) কোটি। ২০০১ সালে এই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি এবং ২০২১ সালে এই রোগ ভারতবর্ষে মহামারী রূপ ধারণ করবে বলেই WHO এর অভিমত এবং খুবই দুঃখের বিষয় এই হৃদরোগ ৪০ (চল্লিশ ) বছর বয়সের নীচের বয়সীদেরই মধ্যে বেশী দেখা দেবে। হৃদরোগ তো কোনও ছোঁয়াচে নয় তবুও কেন এই রোগ দ্রুত ছড়াচ্ছে ? এই প্রশ্নের উত্তরে একটা কথাই বলা যায় যে, আমাদের সচেতনতার অভাবেই ভারতবর্ষে হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। হৃদরোগের বিপদ সম্ভবনাযুক্ত কারণ (Risk Factor) পৃথিবীজুড়ে  চিকিৎসকদের জানা।  নতুন নতুন গবেষণায় আরো নতুন নতুন কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করে চলেছে।  কোন একটি মাত্র কারণের জন্য হৃদরোগ বেড়ে চলে না। হৃদরোগ বেড়ে চলে বিভিন্ন কারণের জন্য, এইজন্য হৃদরোগকে আমরা Multi Factorial Disease বলে আখ্যা দিতে পারি। আজ এখানে আমি হৃদরোগের কয়েকটি বিপদ সম্ভাবনা যুক্ত কারণ ( Risk Factor) সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করছি যা আমাদের হৃদরোগ বৃদ্ধির কারণ। হৃদরোগ বৃদ্ধির রিস্ক ফ্যাক্টর সম্পর্কিত আলোচনায় যাবার আগে হার্ট বা হৃদপিন্ডের কার্যকারিতা সম্বন্ধে একটু জেনে নিই।  হার্ট বা হৃদপিণ্ড হচ্ছে প্রায় ৩৫০ গ্রাম ওজনের একটি পেশীবহুল শক্তিশালী পাম্প।  এই হার্ট পাম্প করে অক্সিজেন ও খাদ্য ( গ্লুকোজ) মিশ্রিত বিশুদ্ধ রক্তকে শরীরের সমস্ত অঙ্গ সমূহকে সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রাখে। এর কাজ শুরু হয় মাতৃগর্ভে এবং চলে দিনরাত বিরামহীনভাবে। এর বিরাম মানেই মৃত্যু।  আমাদের হৃদপিণ্ড প্রতিদিন গড়ে এক লক্ষ বার সংকুচিত এবং প্রসারিত হয় রক্তকে পাম্প করার জন্য।  সেই হিসাবে একজন ৭০ বছর বয়স্ক মানুষের জীবন দশায় হৃদপিণ্ডকে ২৫০ কোটি বার স্পন্দিত হতে হয়।  আমাদের এই হৃদপিণ্ড প্রতিদিন ৭২০০ লিটার রক্ত সারা শরীরে প্রয়োজন মেটাতে পাম্প করে।  চিন্তা করুন কি ধরনের কঠোর পরিশ্রম করতে হয় আমাদের এই হার্ট বা হৃদপিণ্ডকে।  হার্ট যেমন পাম্প করে সারা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কে অক্সিজেন এবং খাদ্য মিশ্রিত বিশুদ্ধ রক্ত সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রাখছে তেমনি হার্টের নিজের বাঁচার জন্য খাদ্য, অক্সিজেন প্রয়োজন এবং এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য যেসব আর্টারি বা ধমনী বিশুদ্ধ রক্ত জুগিয়ে হৃদপিন্ডের পেশিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখে তাদের বলা হয় করোনারি  আর্টারি বা ধমনী। এই ক্ষেত্রে দুটি মুখ্য করোনারি আর্টারি রয়েছে।  ডান দিকে ডান করোনারি ধমনী ( Right Coronary Artery) এবং বাম দিকে বাম মুখ্য করোনারি ধমনী (Left Main Coronary Artery) এবং এই বাম মুখ্য করোনারি আর্টারির আবার দুটি বড় শাখা আছে । বাম সারকামপ্লেক্স ধমনী ( Left Circumplex Artery) এবং বাম অ্যান্টিরিয়র ডিসেন্ডিং ধমনী ( Left Anterior Descending Artery)। বিভিন্ন কারণে যখন এই করোনারি আর্টারিতে (ভেতরের  দেওয়ালে) কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য চর্বি জাতীয় পদার্থ জমে তৈরি হয় প্লাক এবং এই প্লাক জমে জমে ধমনী সরু হয়ে গিয়ে রক্ত চলাচল ব্যাহত হতে পারে। এছাড়াও এই প্লাকটি ফেটে গিয়ে রক্তের অনুচক্রিকা বা প্লেটলেটস সহ রক্ত জমাট বাঁধার অন্যান্য প্রক্রিয়াগুলি সক্রিয় হয়ে উঠে রক্ত ধমনীর মধ্যে রক্তজমাট বেঁধে রক্তনালী বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে । এই জমাট বাঁধা রক্তকে থ্রম্বাস (THROMBUS) বলা হয় এবং তা ধমনীর মধ্যে জমে এবং এর ফলে রক্ত প্রবাহ বা রক্তের গতিপথ ব্যাহত হতে হতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।  আর এর ফলেই শুরু হয় হার্টের অসুখ বা করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD) বা কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (CVD)।  করোনারি আর্টারির যে ধমনীতে রক্ত প্রবাহ পুরোপুরি ব্যাহত হয় বা করোনারি আর্টারি রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে অক্সিজেন যুক্ত রক্তের অভাবে হৃদপিন্ডের সেই অংশটি অকেজো হয়ে পড়ে অর্থাৎ হৃদপিন্ডের পেশীর  কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়ে সেই অংশটির মৃত্যু হতে পারে।  এই ব্যাপারটায় হার্ট অ্যাটাক বা  চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (Mayocardial Infrction)।


 I 
           Image courtesy : http://texasheart.org

হার্ট অ্যাটাকের প্রথম ২/৩ ঘন্টা খুবই মূল্যবান সময়। আমরা বেশির ভাগই গোল্ডেন আওয়ার বা মূল্যবান সময়টা বুঝতে পারিনা বা গুরুত্ব দিই না।  তাছাড়া হার্ট অ্যাটাক তো আর বলে কয়ে হয় না, রাত-বিরাতেও হতে পারে।  তবে হার্ট অ্যাটাকের মতো ঘটনা আকছার এখন যেভাবে ঘটে যাচ্ছে বিশেষ করে ৪০ বছর বয়সের পর আবার অনেক ক্ষেত্রে ৪০ বছরের নীচে বিশেষ করে ছেলেদের ক্ষেত্রে তাতে একটু বুকে ব্যথা হলেই মনে হয় হার্টের রোগ নয় তো ?  তবে এইসব লক্ষণ যদি দেখা যায় যেমন বুকে প্রচণ্ড ব্যথা বিশেষ করে বুকের মাঝখান থেকে বাঁদিকে প্রচণ্ড চাপ বোধ এবং এই ব্যথা বাঁদিকের ঘাড়-পিঠ বা বাঁ হাতে ছড়িয়ে পড়া সঙ্গে প্রচণ্ড ঘাম, শ্বাসকষ্ট আমরা বুঝতে পারছি না এটা হার্ট অ্যাটাক না অন্য কিছু তখন একটা রক্ত পরীক্ষা করেই  বলে দেওয়া যায় যে হার্ট অ্যাটাক কিনা।  এই পরীক্ষাটির নাম ট্রপ-টি।  হার্ট অ্যাটাক এর ফলে হার্টের মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ট্রপোনিন টি নামক একটি প্রোটিন রক্তে চলে আসে যা বোঝা যায় এই ট্রপ-টি  পরীক্ষার মাধ্যমে।  এই পরীক্ষাটি ঘরে বসেই করা যায়।  আমরা যেমন গ্লুকোমিটার দিয়ে ঘরে বসে আঙ্গুল থেকে রক্ত নিয়ে নিজের সুগার নিজেই পরীক্ষা করতে পারি তেমনি এই  ট্রপ -টি কিট (যেটা ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়) কিনে নিয়ে এসে হাতের আঙ্গুল নিডল প্রিক করে এক ফোঁটা  রক্ত এই কিটের মধ্যে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে রং বদলে গিয়ে জানিয়ে দেয় রিপোর্ট পজিটিভ না নেগেটিভ।  ট্রপ- টি  পজিটিভ হলে দেরি না করে কাছাকাছি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছানো প্রয়োজন।  সেখানে ডাক্তারবাবু প্রয়োজনে ই.সি.জি, কার্ডিয়াক এনজাইম (হার্ট অ্যাটাক এর ফলে হার্টের মাংসপেশী বা কার্ডিয়াক মাসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিছু কিছু এনজাইমের উপস্থিতি রক্তে বাড়তে থাকে এদের বলা হয় কার্ডিয়াক এনজাইম যেমন ক্রিয়েটিন ফসফোকাইনেজ (CPK ),  ক্রিয়েটিন ফসফোকাইনেজ মায়োকার্ডিয়াল ব্যান্ড (CPK-MB), ল্যাকটেট ডি হাইড্রোজিনেজ (LDH)। (এই পরীক্ষাগুলো কে কার্ডিয়াক মার্কার বলা হয়।  হার্ট অ্যাটাকের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রক্তে এদের উপস্থিতির পরিমাণ বাড়তে থাকে) ইত্যাদি পরীক্ষা করিয়ে থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি শুরু করতে পারেন। উদ্দেশ্য একটাই করোনারি ধমনী তে জমা রক্তের ডেলা (থ্রম্বাস ) কে গলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হার্ট মাসলে কিছুটা রক্তের জোগান বাড়ানোর চেষ্টা। এই থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি যতটা তাড়াতাড়ি শুরু করা যায় ততটাই মঙ্গল রোগীর ক্ষেত্রে।  সঙ্গে সঙ্গে রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ (Blood Thiner) এবং অন্যান্য ওষুধও  দিতে পারেন।  কিন্তু যদি এই চিকিৎসায়  আশানুরূপ ফল না দেখা যায় এবং রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে তখন জরুরি ভিত্তিক প্রয়োজনে  হার্ট অ্যাটাক রুখতে বিশেষ করে সার্ডেন  কার্ডিয়াক ডেথ এড়াতে বেলুন অ্যানজিওপ্লাস্টির কথা ভাবা হয়।  এই পদ্ধতিতে শিরার মধ্যে দিয়ে সরু তারের মাধ্যমে বেলুন ঢুকিয়ে করোনারি আর্টারি বন্ধ (ব্লক ) হয়ে যাওয়া জায়গায় নিয়ে গিয়ে বেলুনটি পাম্প করে ফুলিয়ে দেওয়া হয়।  এর ফলে করোনারি আর্টারি বা ধমনীতে  জমে থাকা চর্বি চারিদিকে ছড়িয়ে গিয়ে করোনারি আর্টারি মধ্যে রক্ত চলাচলের রাস্তা প্রশস্ত হয়ে যায়। আর্টারির  ওই জায়গায় বা কালপ্রিট ভেসেলে যাতে পুনরায় চর্বি জমে বন্ধ না হয়ে যায় তার জন্য স্টেন্ট বসিয়ে দেওয়া হয়।  এখন অবশ্য ড্রাগ প্রলিপ্ত স্টেন্ট (Drug Coated Stent ) লাগানো হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ।  এই পদ্ধতিকে বলা হয় বেলুন অ্যানজিওপ্লাস্টি বা পারকিউটেনিয়াস ট্রান্সলুমিনাল করোনারি অ্যানজিওপ্লাস্টি (PTCA ) এবং এর জন্য রোগীকে ৪/৫ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। এবার আসছি রিস্ক ফ্যাক্টর প্রসঙ্গে।


           Image courtesy : http://nurseslabs.com

          এই রিস্ক ফ্যাক্টর বা বিপদ সম্ভাবনাপূর্ণ কারণগুলিকে আমরা প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি।  কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর আছে যেগুলো আমরা জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন (Life Style Modification) করে কমাতে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি।  এতে বলা হয় মডিফিয়েবল রিস্ক ফ্যাক্টর (Modifiable Risk Factor ) যেমন নিম্নে বর্ণিত ১ থেকে ১৪ নম্বর পয়েন্টগুলি। আবার কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর আছে যেগুলো আমরা পরিবর্তন করতে পারি না তাদের বলা হয় নন - মডিফিয়েবল রিস্ক ফ্যাক্টর (Non - Modifiable Risk Factor) যেমন নিম্নে বর্ণিত ১৫ থেকে ১৯ নম্বর পয়েন্টগুলি।

১) রক্তে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি High Cholesterol উচ্চ কোলেস্টেরল করোনারি হার্ট ডিজিজ এর অন্যতম প্রধান কারণ। এই উচ্চ কোলেস্টেরল করোনারি ধমনীর মধ্যে জমে গিয়ে ব্লকেজকে ত্বরান্বিত করে। কোলেস্টেরল আমাদের শরীরের ভিতর লিভারে  তৈরি হয় এবং খাদ্যের মাধ্যমে বিশেষ করে প্রাণিজ উৎস যা ঘি, মাখন,খাসির মাংস, ডিমের কুসুম, পনির ইত্যাদি থেকে কোলেস্টেরল আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।  এইসব খাদ্যকে বর্জন করে বা পরিমিত মাত্রায় গ্রহণ করে আমরা কোলেস্টেরল বৃদ্ধি কমাতে পারি।  রক্তের স্বাভাবিক কোলেস্টেরলের মাত্রা ২০০ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারের নীচে। ১৮০ মিলি গ্রাম প্রতি লিটার এর নিচে রাখতে পারলে তা হার্টের পক্ষে ভালো।

২) উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইড (High Triglyceride): উচ্চ ট্রাই গ্লিসারাইড উচ্চ কলেস্টেরলের মত হৃদরোগের (C.H.D) একটি অন্যতম কারণ।  এই চর্বি জাতীয় উপাদান পাওয়া যায় উদ্ভিজ উৎস থেকে।  বাজারে যত রান্নার তেল পাওয়া যায় সবই হচ্ছে ট্রাইগ্লিসারাইড, সে স্যাচুরেটেড বা আনস্যাচুরেটেড যাই হোক না কেন।  রক্তের স্বাভাবিক ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা ১৫০ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারের নীচে।

৩) রক্তে এইচ.ডি.এল কোলেস্টেরল কম (Low HDL Cholesterol) HDL মানে High Density Lipoprotein (উচ্চ ঘনত্ব যুক্ত লাইপোপ্রোটিন)।  এদের কাজ ধমনী রক্ত থেকে কোলেস্টেরলকে বয়ে  নিয়ে গিয়ে লিভারের জমা করা।  এভাবে এরা রক্তের কোলেস্টেরল কমিয়ে করোনারি আর্টারি ব্লকেজ কমাতে সাহায্য করে।  এদের আমরা বন্ধু কোলেস্টেরল (Good Cholesterol ) বলে আখ্যা দিতে পারি। রক্তে এদের স্বাভাবিক মাত্রা ৪০-৬০ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারে।

৪) উচ্চ রক্তচাপ( High Blood Pressure ): উচ্চ রক্তচাপ হার্টের উপর এবং শরীরের রক্ত সংবহনকারী ধমনির উপর অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি করে।  উচ্চ রক্তচাপের ফলে হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওর, সেরিব্রাল অ্যাটাক (Stroke)

এবং কিডনি ফেলিওরের মত ঘটনা ঘটে। স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০ মি.মি. পারদস্তম্ভ।

৫) ধূমপান (Smoking ) অধূমপায়ীদের থেকে চার গুণ বেশি  হৃদরোগে আক্রান্তর  প্রবণতা থাকে।  ধূমপানের মাধ্যমে নিকোটিন, টার ,উপক্ষার এবং অন্যান্য বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে।  এরা করোনারি ধমনী ভেতরের দেয়ালে জমে কোলেস্টেরল এবং চর্বি জমার কাজকে ত্বরান্বিত করে।

৬) উচ্চ রক্ত শর্করা (High Blood Glucose) : রক্তে শর্করার বৃদ্ধিকে বলা হয় ডায়াবেটিস।  ডায়াবেটিস মেলাইটাস রোগীদের করোনারি হার্ট ডিজিজ এর উচ্চ প্রবণতা থাকে।  হৃদ রোগ ছাড়াও ডায়াবেটিস কিডনি, নার্ভ এবং চোখের ক্ষতি করে।  রক্তের স্বাভাবিক শর্করার মাত্রা খালি পেটে( Fasting Blood Glucose): ১১০ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারের  নীচে এবং খাবার দু'ঘণ্টা পর (Post Prandial Blood Glucose ) ১৪০ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারের  মধ্যে।

৭) পরিশ্রম বিমুখতা (Lack of Physical Activity): আধুনিক জীবনে পরিশ্রম বিমুখতা কে হৃদরোগের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে ধরা হয়।  প্রতিদিন নিয়মিত পরিশ্রম করলে শরীরে জমা চর্বি ঝরে গিয়ে মেদবৃদ্ধি কমায়,  কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড কমায়, রক্ত শর্করা কমায় এবং রক্তচাপ কে  স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে এবং হৃদপিন্ডের মাংসপেশিকে সুস্থ সবল রাখে।

৮) স্থূলতা(Obesity): স্থূলতা বা মেদ বৃদ্ধি হৃদরোগের অন্যতম কারণ। মেদ বৃদ্ধির ফলে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডের বৃদ্ধি (ডিসলিপিডিমিয়া) ঘটে।স্থূল ব্যক্তিদের প্রায় ১৫ গুণ বেশি প্রবণতা থাকে হার্ট অ্যাটাকের।

৯) কম ফাইবার বা তন্তু জাতীয় খাদ্য গ্রহণ( Less intake Fibre): ফাইবার হচ্ছে একটা জালের মত গঠন যুক্ত খাদ্য।  ফাইবার শরীরে শোষিত হয় না।  আমাদের খাদ্যের যে চর্বিজাতীয় উপাদান থাকে, তা এই ফাইবারের জালে আটকে পড়ে এবং ফাইবারের সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।  সুতরাং কম ফাইবার যুক্ত খাদ্য হৃদরোগের অন্যতম কারণ।  শাকসবজি, ফল এবং খোসা সমেত খাদ্যে ফাইবার বেশি থাকে।

১০) খাদ্যে কম অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট(Low Antioxidant ): আমাদের শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কাজের ফলে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন(Oxidation) শরীরে দেখা দেয়, এদের বলা হয় মুক্ত মৌল বা Free Redicals । এই Free Redicals হচ্ছে একটা আহত (Injured) অক্সিজেন (০২) যা একটি করে ইলেকট্রন চুরি করে নেয় স্বাভাবিক কোষ থেকে,এর ফলে শরীরের স্বাভাবিক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে,ফলস্বরূপ হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস প্রভৃতি রোগ দেখা দিতে পারে।এককথায় অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট হচ্ছে আমাদের কোষের শত্রু এই Free Radicals কে ধ্বংস করার অস্ত্র।  ভিটামিন এ, ই, সি এবং কিছু মিনারেলস অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট হিসেবে কাজ করে।


        Image courtesy http://health.harvard.edu

১১) হোমোসিসটিনের মাত্রা বৃদ্ধি(Elevated  Level of Homocysteine): হোমোসিসটিন হচ্ছে রক্তের স্বাভাবিক ভাবে উপস্থিত একটি প্রোটিন।  নিয়মিত ফলিক অ্যাসিড যুক্ত খাবার খেলে হোমোসিসটিনের  মাত্রা কম হয়।  আমরা ভারতীয়রা সবজি রান্না করি উচ্চতাপে এবং দীর্ঘক্ষন ধরে এর ফলে ৯০% ফলিক অ্যাসিড ধ্বংস হয়ে যায়।  ফলস্বরূপ শরীরে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি থেকে যায় এবং এর ঘাটতি ফলিক অ্যাসিডের জন্য রক্তে হোমোসিসটিনের মাত্রা বেড়ে যায় যেটা হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

১২) স্ট্রেশ টেনশন (Stress & Tension ): খুব বেশি মাত্রায় টেনশন স্ট্রেশের ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়,  রক্ত শর্করা বেড়ে যায় এবং এইচ.ডি. কোলেস্টেরল কমে যায়।  স্ট্রেশ অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রিনালিন হরমোন ক্ষরণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়,  ফলে হার্ট রেট বেড়ে যায় এবং হার্টের বেশি চাপ সৃষ্টি হয়।  এর ফলে হার্ট অ্যাটাক ঘটতে পারে। ধ্যান,মেডিটেশন,প্রাণায়ম করে আমরা স্ট্রেসের কুফল কে আটকাতে পারি।

১৩) অতিরিক্ত ভোজ্যতেল গ্রহণ (Excessive oil Consumption): অতিরিক্ত পরিমাণে ভোজ্যতেল গ্রহণ হৃদরোগ বৃদ্ধির একটি কারণ হতে পারে।  এটা আমরা দেখতে পাই যে ভারতীয়রা বিশেষ করে বাঙালিরা খাদ্য তৈরিতে খুব বেশি পরিমাণে তেল ব্যবহার করি।চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে প্রতিদিন তিন চামচের বেশী তেল খাওয়া উচিত নয়। তা যে কোনো তেলই হোক না কেন। সব তেলই হার্টের পক্ষে সমান ক্ষতিকারক (All Oils Are Equally Bad for Heart)।

১৪) টাইপ - এ (Type 'A') পার্সোন্যালিটি মানুষ।  যারা অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী সবসময় কোনও লক্ষের  পিছনে ছুটছেন।  দিনরাত টাকা আর খ্যাতির পিছনে দৌড়াচ্ছেন।  অকারণে টেনশন করেন।  অতিরিক্ত টেনশন মানুষের সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের উপর প্রভাব পড়ে ফলস্বরূপ ধমনীতে চর্বি জমার গতি ( অ্যাথোরোসক্লেরোসিস ) বেড়ে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ে।

১৫) বংশগত কারণে অর্থাৎ বংশে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস থাকলে অর্থাৎ পারিবারিক হৃদরোগের ইতিহাস বিশেষ করে মা-বাবা আত্মীয়দের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আছে এবং তাদের কেউ যদি ৫০ থেকে ৫৫ বছর বয়সের আগে এই রোগে মারা যান। আবার অনেক সময় এও দেখা যায় অনেক মানুষের নির্ধারিত খাদ্যাভাস থাকার পরও তাদের রক্তে লিপিডের মাত্রা খুব বেশি থেকে যায়।  এদের শরীরে বংশগত সূত্রে পাওয়া জিনের জন্য কোলেস্টেরল,  ট্রাইগ্লিসারাইড এর উৎপাদন খুব বেশি হয় এবং উচ্চ লিপিড করোনারি আর্টারি ব্লকেজের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

১৬) বয়স- বয়স্ক ব্যক্তিদের হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেশি থাকে অর্থাৎ বয়স যত বাড়বে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাও  বাড়তে থাকবে।  বয়স বৃদ্ধি অবশ্য কেউ এড়াতে পারবে না।

১৭) লিঙ্গ- ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি হার্টের অসুখে আক্রান্ত হয়।  পুরুষ জাতির বেশি সম্ভাবনা থাকে(৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়স থেকেই ) করোনারি আর্টারি রোগের এবং মহিলাদের বেলায় এটা লক্ষ্য করা যায় আরো ১০ বছর পরে অর্থাৎ মেনোপজের পরে।  মেনোপজের আগে পর্যন্ত ইষ্ট্রোজেন হরমোন এর সুরক্ষা থাকায় এই মহিলাদের মধ্যে এই রোগ হওয়ার প্রবণতা কম থাকে।  মেনোপজ বা রজোনিবৃত্তির পর মহিলাদের সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেকগুণ।

১৮) যাদের আগে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে তাদের দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে।

১৯) লাইপোপ্রোটিন(এ )-(Lipoprotein(a))- এই লাইপোপ্রোটিন (এ) কে জেনেটিক রিস্ক ফ্যাক্টর বলা হয়। এই রিস্ক ফ্যাক্টর কে নির্ধারিত খাদ্যাভাস ব্যায়াম এককথায় জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করে কমানো যায় না অর্থাৎ যে সমস্ত উপায় অবলম্বন করলে কোলেস্টেরল সমস্যা আয়ত্তে আনা যায় সেগুলির দ্বারা এর পরিমাণ বিশেষ কমে না।  এই লাইপোপ্রোটিন(এ ) ধমনীর মধ্যে কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডজমা হতে সাহায্য করে এবং ধমনীর মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে ফলস্বরূপ হৃদরোগের প্রবণতা বাড়ে।  কেউ কেউ তাই এটিকে বলেন মারাত্মক কোলেস্টেরল।  অন্যান্যদের তুলনায় ভারতীয়দের রক্তে এই LP(a) বেশি থাকে এবং ভারতবর্ষে হৃদরোগ বেড়ে যাওয়ার এটাও একটা কারণ বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের নতুন অভিমত।