চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

বর্তমানের আলোয় প্রজাতন্ত্র দিবস



বর্তমানের আলোয় প্রজাতন্ত্র দিবস


 🟣 বিশ্বরূপ দাস 



➡️ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। ততোধিক বৈচিত্র্যময় আমাদের সংবিধান। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান সম্পদের অধিকারী ভারত। আর এই সম্পদের প্রধান কারিগর ছিলেন একজন দলিত জ্ঞানসাগর ডক্টর বাবা সাহেব আম্বেদকর। তার সম্পর্কে পরে আলোচনা করবো।

প্রাক স্বাধীনতা মুহূর্তে নানা রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে তৈরি হয়েছিল নবভারত গঠনের যে কাজ তার মধ্যে ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য "গণপরিষদ" গঠন অন্যতম। সেইসময় পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে জওহরলাল নেহেরুর মতো নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে আসমুদ্র হিমাচল উত্তাল হয়ে ওঠে। সেই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য ব্রিটিশ সরকারের দমন পীড়ন নীতি ছিল অব্যাহত। তবু মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে দেশের জনগণ ১৯২৯ সালে জাতীয় কংগ্রেসের নেতা তথা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে "পূর্ণ স্বরাজ" আনার জন্য শপথ ঘোষণা করে। শুধু শপথ নয়। এবার সত্যি সত্যি স্বাধীনতার জন্য পাগল হয়ে ওঠে দেশের মানুষ।তাই দেশের মানুষের আবেগকে প্রাধান্য দিতেই জাতীয় কংগ্রেস তার পরের বছর ১৯৩০ সালে ২৬ জানুয়ারি তারিখটি স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। কিন্তু ঘোষণা করলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শিকল ভেঙে সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ ভারতবাসী তখনও পায়নি। তাই পূর্ণ স্বরাজ পেতে মরিয়া ভারতবাসীর রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক আন্দোলন ছিল অব্যাহত। এরপর মাতৃ মুক্তির বেদিতলে শত সহস্র শহীদের আত্মবলিদানে দেশের বুকে স্বাধীনতার সূর্যোদয় হয়। শিশু স্বাধীনতা এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পথ চলতে শুরু করে।মূলতঃ তারই প্রয়োজনে তথা দেশের মানুষের স্বার্থে "সংবিধান " রচনা জরুরী হয়ে পড়ে। গঠিত হয় গণ পরিষদ। এই গণ পরিষদে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন অন্যতম। এছাড়াও তফসিলি সম্প্রদায় থেকে ছিলেন ৩০ জন এবং আঙলো ইন্ডিয়ান থেকে একজন। ১৯৪৬ সালে ৯ ডিসেম্বর প্রথম সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয়। এরপর ২ বছর, ১১ মাস ১৮ দিন ধরে চলে সংবিধান রচনার কাজ। এরই মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা তখন তুঙ্গে। তাই আর দেরি না করে ১৯৪৯ সালে ২৬ নভেম্বর ২৮৪ জন সেই সংবিধানে সই করলে তা গণপরিষদে গৃহীত হয়। গৃহীত হলেও তা কার্যকর করার জন্য একটা দিনের প্রয়োজন ছিল। তাই ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যের বিচারে বেছে নেওয়া হয় ২৬ জানুয়ারি তারিখ টিকে। সেই মোতাবেক ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি গণ পরিষদে মোট ৩০৮ জন সদস্য সংবিধান নথির দুটি হাতে লিখিত কপিতে (ইংরাজি ও হিন্দি) সই করেন। তার ঠিক দুইদিন পরে ২৬ জানুয়ারি সংবিধান কার্যকরী হয়। আর সেই দিনটি ভারতবর্ষের ইতিহাসে "প্রজাতন্ত্র" দিবস হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।

এই দিনটিকে ঘিরে আজও দেশের সর্বত্র দেশপ্রেমের ঝড় বয়। আবেগে, ভালোবাসায়, একতায়, মন ও মানসিকতায় আমরা "এক জাতি, এক দেশ" অনুভব করি। আঞ্চলিকতা, প্রদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতার সাথে সমস্ত বৈদেশিক আগ্রাসন ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করার জন্য শপথ গ্রহণ করি। দিল্লির রাজপথে ভারতীয় সেনার প্যারেড ও কুচকাওয়াজের সাথে সমরাস্ত্রের নয়নবিমোহন প্রদর্শন হয়। অভিবাদন গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি। বিরল সাহসিকতার জন্য পুরস্কৃত করা হয় দেশের জওয়ান সহ একাধিক ব্যক্তিত্বকে।আকাশে ওড়ে শান্তির পারাবত এবং রং বেরঙের বেলুন। দেশের প্রত্যেকটি রাজ্যে পুলিশ প্রশাসনের প্যারেড ও কুচকাওয়াজের সাথে মুখ্যমন্ত্রী যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। জাতীয় ছুটির দিবস হলেও দেশের সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে এই দিনটি পালন করা হয়।

 সংবিধানে ভারতকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের কথা আজ এগুলো সব যেন ধীরে ধীরে কাগুজে বাঘ হয়ে যাচ্ছে। অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি, ধর্মনীতি, সমাজ নীতি এবং প্রজাতন্ত্র নীতি। এখনও এদেশে কেউ খেতে পায় কেউ পায় না। লক ডাউনে অর্ধমৃত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। অথচ সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। নেই কর্ম সংস্থানের প্রচেষ্টা। মূলে জল সিঞ্চন না করে ছোটখাটো "ললিপপ" দিয়ে জনগণের মনজয় করতে উঠেপড়ে লেগেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ ভোট বড় বালাই। তাই একদিকে 'রাম' অন্যদিকে 'জয় বাংলা' প্রভৃতি ধ্বনিতে বাজার গরম। পরস্পর পরস্পরকে দেখে নেবার হুমকি। জনগণ মরে মরুক। প্রজাতন্ত্র উৎছন্নে যায় যাক। যেকোনও মূল্যে তখত চাই।নির্লজ্জভাবে চলছে কুর্শি দখলের লড়াই।মেদিনীপুর থেকে ডায়মন্ড হারবার, ভিক্টরিয়া পার্ক থেকে মুর্শিদাবাদ, ঝাড়খন্ড থেকে পঞ্জাব সর্বত্রই একই চিত্র। গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র গুলি মারো। গুল দিয়ে, গুলি মেরে, গুন্ডা লাগিয়ে কিংবা নিদেনপক্ষে গুঁতোগুঁতি করে গণতন্ত্র রক্ষা করো। এটাই বর্তমান স্ট্রাটেজি। তাতে দেশের অর্থনৈতিক সূচক নামল আর গেল, বেকারত্ব -ধর্ষণ-রাহাজানি - ব্যাঙ্কলুঠ - কয়লা পাচার -গরু পাচার - কৃষি আইন - সি এ এ হলো আর নাই বা হলো কুছ পরোয়া নেহি। মোদি থেকে মমতা, নাড্ডা - অভিষেক - শুভেন্দু থেকে যোগী পাওয়ার সবাই এ চিত্র নাট্যের কুশীলব। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। এ এক হীরক রাজার দেশ। জনগণকে বোকা বানাবার কত না কৌশল প্রতিদিন আবিষ্কৃত হচ্ছে। উঁচুতলা থেকে নিচুতলা সবাই কমবেশি করাপ্টেড। অথচ মুখে কত না আদর্শের বুলি। কথা শুনে মনে হয় সত্যি সত্যি এরা যেন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো দেশের জনগণের কল্যাণে পথে নেমেছেন। এইসব মেকি দেশ ভক্তদের দেখলে গা জ্বলে যায়। আসলে লোভ আর লালসা, ক্ষমতা আর দম্ভ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে সংবিধানের প্রাণ। ঘুণ ধরেছে দেশের "প্রাণ ও আত্মার" দোসর সংবিধানের প্রাণে। ডাক্তার কোথায় যে এর রোগ নিরাময় করবে ? দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়েও যথার্থ বিচারের জন্য সুযোগ পাচ্ছে না দেশের মানুষ। রাজনীতির রং বড়ই প্রখর। আর তার সাথে হাত মিলিয়েছে পুঁজিবাদের দল। তাই ব্যাঙ্কের টাকা চুরি করে, খাবারে বিষ মিশিয়ে, গণধর্ষণ করে হত্যালীলা চালিয়ে এবং সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বালিয়ে এরা পার পেয়ে যাচ্ছে। কেউ তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারে না।কারণ তারা সুয়োরানীর ছেলে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা কোটি কোটিপতি ঘরের আদরের দুলাল। নেতাতন্ত্রের দেবালয়ের আড়ালে রক্ষিত হচ্ছে প্রজাতন্ত্র। আপনি সেই মন্দিরে ঠিকঠাক পুজো দিতে না পারলে বিধি বাম।আপনার ছেলের হওয়া চাকরি হবে না। বাড়াবাড়ি করলে প্রকাশ্য রাজপথে আপনি খুন হবেন। নয়তো আপনার স্কুল পড়ুয়া মেয়ে নিখোঁজ হবে।তার ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে থাকবে জঙ্গলে। সেই জঙ্গলের পশুদের বিরুদ্ধে কোনও এফ আই আরও আপনার গ্রাহ্য হবে না।বরং আপনিই অপমানিত, লাঞ্ছিত হবেন পদে পদে।

কিন্তু এমনটি তো কাম্য নয়। আমরা সবাই সুখে শান্তিতে থাকতে চাই। দেখতে চাই কৃষকের গোলা ভরা ধান। দেখতে চাই কারখানায় কারখানায় অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের বাহুতে আন্দোলিত আগামীদিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। শিল্পে, শিক্ষায়, বিজ্ঞানে কৃষিতে আসুক নব জাগরণের ঢেউ।দেশের উন্নয়নের পালে লাগুক সতেজ নির্মল হাওয়া। সেই হাওয়ায় সমস্ত অন্যায়, অবিচার, অপসংস্কৃতি, বিভেদ, বৈষম্য, ব্যাভিচার দূরে যাক।দেশ হয়ে উঠুক স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ। যার তলে দাঁড়িয়ে আজ ৭২ তম প্রজাতন্ত্র দিবসে আমরা "ধনধান্য পুষ্পভরা " এক নয়া বসুন্ধরার জন্য শপথ গ্রহণ করি। শুরু হোক পথ চলা।

জয়হিন্দ। বন্দেমাতরম।


                    লেখক : শিক্ষক, পঞ্চপল্লী এম সি হাইস্কুল।