চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

সদর ঘাটের মেলা

.                                              ছবি : জিন্নাত আলি

 🟣 রমজান আলি



 ➡️ ল্যাখাপড়া শিখলেইবা,  গেরস্ত ঘরের ছেলে ধান কাটাই-মাড়াইয়ের সময় হাত লাগাতে হবে না , তাই কি হয়। যত তাড়াতাড়ি মড়াইয়ে ধান তোলা যায় ততোই মঙ্গল।  পাকা ধান মাঠে পড়ে থাকবে আর ছেলেপুলেরা গুলিডাঙ্ খেলে বেড়াবে  এমনটা হবেনা। গতর দিলে কুটি মাড়াই হোক আর না হোক বাপ গাড়িজুড়ে  সদর ঘাটের মেলা দেখিয়ে আনবে। কোনো কোনো বদছেলে বলে , কী আর দেখবো ?  সেই তো হাঁড়ি, গাড়ি, দাড়ি আর ঘুড়ি । 



          লোক অভিজ্ঞতায় এই চার ঐতিহ্য নিয়েই সদর ঘাটের মেলা। তারিখ একদম পাক্কা। ১ লা মাঘ, কৃষিবর্ষের প্রথম দিন। চাষীবাসি মানুষের নিজস্ব ক্যালেন্ডার। মাঘ থেকে পৌষ। তাদের নিজস্ব বারোমাস্যা। পৌষের শেষে গোলায় ভরেছে ধান। বাগাল-কিরসেনদের বাঁধালি-বছর গতকালই শেষ হয়েছে। মিটেছে পাওনা-গণ্ডা। গেরস্ত বাড়িতে সারা বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় তাদের । এক এক মাসে এক এক রকম কাজ। ফাল্গুন-চোত মাসে  জমিতে গোবর সার বওয়া। ভোর রাতে উঠে গাড়ি জুড়ে ধারকূল থেকে পলিমাটি মিশ্রিত দাদনের সার আনা। হাফ-বাগাল হলেও যেতে হয়। বোশেকে একটু ছাড় তো, জোষ্টি-আষাঢ়ে ভরপুর চাষ, ধান রোয়া। সদুর মতো চাষীরা আবার ধান রোয়াতে শ্রাবণ পার করেনা। ভাদর-আশ্বিনে নিড়ানের কাজ সেরে দলিজে বসে একটু বাগবন্দি খেলার সুযোগ ।  কার্তিক-অঘানে কেলেসজমির ধান উঠে । আলু আর সব্জি চাষের আগচটকায় ভালো দাম। গেরস্ত সুযোগ ছাড়বে কেন । ঘরে তো বাগাল-কিরসেন আছেই। এর উপর সারা বছর গরু ছাগল দেখা। কাজের ভুলে, বকাঝকা খেলেও তারই মধ্যে চাষীগিন্নির স্নেহ আব্দার পেয়েছে। চালের আঠার পিঠে, ঘরে পালা মুরগির মাংস, আর গোটা ডিম খাইয়ে দিয়েছে শেষদিন। ছেলেটা এতদিন রইলো। আহা রে ? আগামী বছরের জন্য নতুন চুক্তিও হয়েছে কারো কারো। বাগাল-কিরসেনের  আনন্দ তো হবেই। সেই আনন্দেই চলো সদর ঘাট।


   পাকা ধান তোলার কাজে গেরস্ত বাড়ির বৌদের কম কসরত করতে হয়নি। গাদা-গোণ্ডা মুনিসের ভাত রাঁধা থেকে ধান পাচুরা, খামারে গোবর দেয়া । ঘর-দুয়োর ল্যাপামোছা।  ঘরে ধান উঠেছে । আগড়া পাচুরা ধানের অধিকার তার। সেটা বেচেই এবার একটু খানি শখ পুরোন। ছেলেপিলেরা পিঠে খাবে। ঢেঁকিতে নতুন ধানের আটা কুটা হয়েছে। ঘরের বৌদের নতুন বছরে  চাই  মাটির নতুন তাওয়া, সরা, ধুঁকি পিঠের জল ফোটানো কলসী, দুধ আওটানো মাটির হাঁড়ি, চাল রাখা গুলি, জল-পানি খাওয়ায় কালো কলসী, জালা , আমানি রাখা ডাবা, হোলা, মুড়ি ভাজা। খোলা আরো কত কী। তার আব্দারও তো রাখতে হবে। ঘরের ছেলেমেয়েরাই বা সারা বছর কি উপহার পায় ? বাবা বলেছিল খড়-কুটির ধান বেঁচে এবার সদরঘাটের মেলায় শাঁখালু, জিলিপি কিনে দেবে । ছেলে বায়না ধরে বাঁশের বাঁশি কিনবে। মেয়ে কিনবে মাটির পুতুল। বাবা, না করেনি। এতো জিনিস আনতে হবে সবাই যাবে মেলায় । গাড়ি না হলে চলে ? গরুর গাড়ি। কাঠের চাকার উপর, বাঁশের বডি। ছেলেপুলেগুলো যাতে পড়ে না যায়, মেলার দিন কেউ কেউ ছদরি চাপায়। সারি সারি গাড়ি এগিয়ে চলে সদর ঘাটের মেলার দিকে।


      ওদিকে বদ্দুয়ান শহরের বাবুরা ঘুড়ি ওড়াতে আসবে। একসময় স্বয়ং রাজাও নাকি ঘুড়ি ওড়াতেন। ল্যাজ লাগানো বড়ো বড়ো ঘুড়ি, চায়না ঘুড়ি , লাটাইয়ে রিল রিল সুতো। ঘুড়ি লুটতে ছেলেরা বালুচরে ছুটোছুটি করবে আছাড় খাবে। শহরে গঞ্জের বাজারীরা  বাজার বসাবে । কতো লোতুন লোতুন খেলনা বাপ , কতো লোতুন লোতুন গামছা , ইয়াত্তা নেই। বালির চড়া, লোকে লোকারণ্য। গাঁ আর শহর মিলে যাবে।  চল কত কী দেখবি ---এই বলে নিয়ামত চাচা তার সাদা দাড়িতে মেহেদী মাখায় । হিরিমপুরের হাট থেকে কিনে আনা সাদা হেলে দুটোর গায়ে নারকেল তেল মাখায়। পাগুলো দলে দ্যায়। এবার সবাইকে কাটিয়ে তার গাড়ি এগিয়ে যাবে। এবার আর মাদানগরের সিদ্ধেশ্বর দাঁ-র কাছে হারবে না।  গতকাল বিকেলে একা গাড়ির চাদরার কাছে কাঁধ রাখে। নিঙেতে সেদবাই লাগিয়ে চাকায় শোণ-চর্বি লাগিয়ে রাখে। এবার গরুর পোঁদে পাচন মারলেই  হড়হড় করে গাড়ি ছুটবে ।



   সদর ঘাট  দামোদর ( < দামুড়হুদা ) নদ পেরিয়ে বর্ধমান শহর যাওয়ার  প্রধান ঘাট । যেখান দিয়ে দক্ষিণ দামোদরের রায়না-খণ্ডোঘষের মানুষ মূল শহরে নৌকা যোগে প্রবেশ করতেন। তাই সদর ঘাট। এই পথে বিদ্যাসাগর কতবার গেছেন। তার আগে ধর্মমঙ্গল কাব্যের নায়ক লাউসেনের গৌড় যাত্রার পথ। এক সময়ের এই গরুর গাড়ি পথেই পুরুলিয়ার টসু আন্দোলনের কর্মীরা কোলকাতার পথে যাত্রা করেছিলেন।


       বাঁকুড়া মোড় বা চক পুরোহিত থেকে বাদশাহী রোডের মূল অবস্থান ফেলে একটু পূর্বে  সরে এসেছে । মূলকাটির পশ্চিমে সেই মোঘল যুগের যুদ্ধক্ষেত্রকে পাশে রেখে মুলকাটির পূর্বে আজ পাকা রাস্তা । মেলার দিনে এই বাদশাহী রোড ধরে ধুলো উড়িয়ে সারি সারি গরুর গাড়ি সদর ঘাটের মেলায় প্রবেশ করতো। দামুড়হুদা পার হয়ে পেয়ারা বাগানের পথ শুরুতেই তটে কোথাও হয়তো ছিল শের আফগানের প্রাসাদ । মেহেরুন্নিসার  আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তো।     


          পথ সেই একই আছে, তবে এখন আর নৌকাযোগের প্রয়োজন হয় না। ইন্দিরা আমলে সেঁতু নির্মাণ হয়েছিল। মানুষ এখন সেই 'কৃষক সেতু'-র উপর দিয়ে যাতায়াত করেন । সেতুর ওপর থেকে গোটা মেলা দ্যাখেন। বর্ধমান শহরের এদিক থেকে সদর আর ওদিক থেকে  পলেমপুর । এখানটাকে ঘিরেই মহমদুল হকের কবিতা দানা বাঁধে, অধ্যাপক শহীদুল হকের ক্যামেরা লোকায়ত সংস্কৃতির রূপরেখার আলোকচিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেয়। 


       এক সময় নদের চড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই মেলা বসতো। এখন শহরের দিকে ফিস্ট করার উঁচু জায়গাটাকে কেন্দ্র করে মেলা বসে । কবে এই মেলার সূচনা হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না।           


         লোককথায় উল্লিখিত ' হাঁড়ি' বলতে মাটির তৈরি হাঁড়ি। সঙ্গে মাটির তৈরি অন্যান্য দ্রব্যাদি। সংস্কৃত নাটকে মাটির শকটের কথা তো আছেই। পোড়া মাটি  রাঢ় সভ্যতার প্রাচীন ঐতিহ্য। প্রাচীন মিশরে গিলগামাসের পোড়ামাটির উপর লেখা কাব্য যে রাঢ়ের শিল্প ঐতিহ্য বহন করছে না -- সে কথা জোর গলায় কে বলতে পারে ?