চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

জেনেটিক ডিজিজ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি


    By courtesy :                                                                          National Human Genome Research indicate


জেনেটিক ডিজিজ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি 



 🟣 ডাঃ এন. সি. মন্ডল



 জেনেটিক্স একটি ল্যাটিন শব্দ। জেনেটিক্স বা জিনতত্ত্ব বা সুপ্রজননবিদ্যা হল বংশগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমূহ কেমন ভাবে বংশপরম্পরায় এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে প্রবাহিত হয় অর্থাৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত বিজ্ঞান যেখানে পিতা-মাতা ও সন্তানের পরস্পরকে নিয়ে বিগত প্রায় দুই শতাব্দী যাবৎ এর শিক্ষা ও গবেষণা শুরু হয়েছে। অস্ট্রিয়ার গ্রেগর জোহান মেন্ডেল উদ্ভিদবিজ্ঞানের মটর গাছ নিয়ে গবেষণার শেষে ইংরেজি 1860 সালে এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছান যে "কতগুলি বৈশিষ্ট্য এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে স্থানান্তরিত হয়"। পিতামাতার কাছ থেকে আবার কোন কোন রোগ/ব্যাধি তাদের সন্তানদের দেহে প্রাপ্ত হয়। এইসব রোগকে বংশগত রোগ বা জেনেটিক ডিজিজ বলা হয়। পিতা-মাতার জেনিস বা বংশানুগতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক উপাদান সন্তানদের রোগের উৎপত্তি স্থল বলে মনে করা হয়। মানুষের দেহ অসংখ্য কোষ দিয়ে তৈরি। প্রতিটি কোষের মধ্যস্থলে থাকে নিউক্লিয়াস যা কোষের কাজ কে নিয়ন্ত্রণ করে। নিউক্লিয়াসকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মধ্যস্থিত নিউক্লিওলাস। নিউক্লিওলাসের মধ্যে থাকে ক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোম কে নিয়ন্ত্রণ করে জিন নামক বস্তুকণা । এই জিনকেই বংশগতির ধারক ও বাহক বলা হয় । জিন নিয়ে গবেষণা করার জন্য ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী ডঃ হরগোবিন্দ খোরানা কে 1968 সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।1910 সালে মার্কিন বৈজ্ঞানিক থমাস মর্গান বলেন যে ক্রোমোজোমে জেনিস অবস্থান করে এবং ক্রোমোজোম সহ জিনগুলি সন্তানদের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। প্রায় বিগত 70 বছর যাতে আর.এন.এ(RNA) ও ডি.এন.এ(DNA ) সম্পর্কিত বিদ্যার গবেষণা করা হয় এবং বৈজ্ঞানিকরা প্রমাণ করেন যে এইগুলির নিউক্লিক অ্যাসিড অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। কোন জিনের ডিএনএ তে পরিবর্তন ঘটলে জিনের মিউটেশন হয় এবং এই জেনেটিক মিউটেশন এর জন্যই জিন বাহিত রোগের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে মিরস্কি এবং রিস প্রমুখ বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় ক্রোমোজোমের রাসায়নিক গঠন এর একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। ক্রোমোজোমের সংখ্যা প্রতিটি প্রজাতির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট। আমরা জানি সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে 23 জোড়া অর্থাৎ 46 টি ক্রোমোজোম থাকে, যার মধ্যে 44 টি অটোজোম বা দেহজ 2টি লিঙ্গ নির্ধারক বা সেক্স ক্রোমোজম পুরুষদের সেক্স ক্রোমোজোম একটি 'X' এবং অপরটি 'Y' (XY)। স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে দুটিই 'X'(XX)। সাধারণ ক্যারিওটাইপ 46, XX | 46 XY। এই অটোজোম ও সেক্স ক্রোমোজোমগুলির গঠনগত এবং আকৃতিগত তারতম্যের জন্য মানবদেহে বেশকিছু ব্যাধি পরিলক্ষিত হয়। ক্রোমোজোমের এই জাতীয় পরিবর্তনকে ক্রোমোজোমাল বিচ্যুতি বা ক্রোমোজোমীয় অপেরন বলা হয়। ক্রোমজোমের ভাঙ্গন সংখ্যা, ভাঙ্গন স্থানএবং ভাঙ্গন স্থানের সংযুক্তির ধাঁচ অনুযায়ী ডেলিশন বা ঘাটতি, দ্বিত্বকরণ বা ডুপ্লিকেশন, উৎক্রম বা ইনভারশন, ট্রানসলোকেশন প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার ক্রোমোজোমাল বিচ্যুতি ঘটে থাকে। যেমন -----

ডাউন সিনড্রোম -এইটি একটি ক্রোমোজোম ঘটিত জড়বুদ্ধি জনিত রোগ। এই ক্ষেত্রে ক্রোমোজোমের সংখ্যা 46 টির পরিবর্তে 47 টি হয়।'21'নং ক্রোমোজোম(অটোজোম ) 2টির বদলে 3টি থাকে অর্থাৎ 46টি ক্রোমোজোমের পরিবর্তে 47টি ক্রোমোজোমের উপস্থিতি এবং ইহাদের অস্বাভাবিক সংযুক্তিকরণ। একটি '21'নম্বর ক্রোমোজোমের অতিরিক্ত সংযোজন (ক্যারিওটাইপ 47, XX+21|47, XY+21)।1866 সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক ডাঃ জন ডাউন এই রোগের গবেষণা করেন এবং তাঁর নাম অনুসারে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগের নামকরণ করা হয় ডাউন সিনড্রোম। এই ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ জিনের শিশুর দেহে বিভিন্ন রকম অস্বাভাবিকতা দেখা যায় যেমন খর্বাকৃতি দেহ, চ্যাপ্টা নাক, অস্বাভাবিক মুখমণ্ডল, গোলাকার মস্তক, চোখের পাতায় ভাঁজ, দুটি চোখের মধ্যে ব্যবধান বেশি, পা হাতের ছোট ছোট আঙুল, ট্যারা চোখ, লম্বা কান, বোকা বোকা ভাব, যৌবনে যৌনতা প্রাপ্তি হ্রাস ইত্যাদি ত্রুটিপূর্ণ লক্ষণসমূহ দেখা যায়। এরা জড় বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়ায় এদের মানসিক বৃদ্ধিবৃত্তির (IQ) উন্নতি চার পাঁচ বছরের শিশুর চেয়ে বেশি হয় না। এদের আয়ু খুব কম ঠিক 20 থেকে 30 বছর। গবেষণায় দেখা গেছে বেশি বয়সে গর্ভধারণ বিশেষ করে 35 - 40 বছর বয়সে বা তার বেশি বয়সে কোন মহিলা অন্তঃসত্ত্বা হলে তাদের শিশুদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। 



এডওয়ার্ডস সিনড্রোম- এই ক্ষেত্রে ক্রোমোজোমের সংখ্যা 46 এর পরিবর্তে 47 হয়। 18 নম্বর ক্রোমোজোম (অটোজোম) দুটির বদলে তিনটি (ক্যারিওটাইপ 47, XX+18|47, XY+18) এই ত্রুটিপূর্ণ জিনের দেহে বিভিন্নরকম অস্বাভাবিকতা দেখা দেয় যেমন ছোট হাত, ছড়িয়ে থাকা আঙ্গুল, বাঁকানো পা, মাথা পাশাপাশি ভাবে চ্যাপ্টা, ছোট চোয়াল,অস্বাভাবিক কান, মানসিক অপূর্ণতা ইত্যাদি। এরা সাধারণত 4-5 মাসের মধ্যেই মারা যায়। বেশি বয়সে মাতৃত্ব বা গর্ভধারণ কে এই রোগের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।


               Image courtesy : prezi.com

প্যাটাওস সিনড্রোম - এক্ষেত্রে ক্রোমোজোমের সংখ্যা 46 এর পরিবর্তে 47 টি হয় । এবং 13 নম্বর অটোজোম পৃথক হওয়ার অক্ষমতার জন্য এই রোগ দেখা যায়। (ক্যারিওটাইপ 47, XX+13/47, XY+13) এই ত্রুটিপূর্ণ জিনের শিশুরা কিম্ভুতকিমাকার দেখতে হয়। এদের বিকৃত হাত,পা,মুখ, হাতে-পায়ে অতিরিক্ত আঙ্গুল, মানসিক জড়তা,কান,চোখ, নাক বড় বড়, মাথা পাশাপাশি চ্যাপ্টা এবং দুটি চোখের মধ্যে ব্যবধান কম ইত্যাদি লক্ষণ সমূহ দেখা যায়। এরা সাধারণত বাঁচে না, জন্মের পরই মারা যায়।



          Image courtesy : slideplayer.com


টারনার সিনড্রোম -এইক্ষেত্রে ক্রোমোজোমের সংখ্যা 46এর পরিবর্তে 45টি । যার মধ্যে 44টি অটোজোম এবং 1 টি সেক্স ক্রোমোজোম অর্থাৎ 1টি সেক্স ক্রোমোজোম কম। (ক্যারিওটাইপ 44+X0)। এরা দেখতে বেঁটে, ছোটখাটো, অস্বাভাবিক মুখমন্ডল এবং 1টি 'X' ক্রোমোজোম এর ঘাটতি থাকায় এরা বাহ্যিক দিক থেকে মেয়ে হলেও যৌবনে যৌন চরিত্রের কোন বিকাশ ঘটে না। অর্থাৎ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিম্বাশয়ের বৃদ্ধি ঘটে না, জরায়ুর বৃদ্ধিও হয় না, শারীরিকভাবে বক্ষের পরিপূর্ণতা ঘটে না এবং ঋতুস্রাবও দেখা দেয় না।



         Image courtesy : Pinterest.com


ক্লিন ফেল্টার সিনড্রোম (44+XXY |44+XYY) - এদের ক্রোমোজোমের সংখ্যা 46 টির পরিবর্তে 47টি । যার মধ্যে 44 টি অটোজোম এবং 3 টি সেক্স ক্রোমোজোম(2 টি X এবং 1টি Y ক্রোমোজোম)। অর্থাৎ ক্রোমোজোমের সংখ্যা বৃদ্ধিটা অটোজোমের নয়, বৃদ্ধিটা সেক্স ক্রোমোজোমের। এই ক্ষেত্রে সেক্স ক্রোমোজোম XX থাকলেও লোকটি মহিলার রূপ পায় না। Y ক্রোমোজোমের জন্য পুরুষের মতো দেখতে হয় আবার পুরুষের মতো দেখতে হলেও এদের সঠিক যৌবন প্রাপ্তি বা গঠন হয় না। আবার এও দেখা গেছে অনেক ব্যক্তির 44টি অটোজোম এবং 3টি সেক্স ক্রোমোজোম(1টি 'X'এবং 2টি 'Y') অর্থাৎ 44+XYY । 2টি 'Y' ক্রোমোজোম থাকার জন্য এরা অপরাধ প্রধান হয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে প্রমাণিত যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ অপরাধী এই (44+XYY) ক্রোমোজোমের অধিকারী।


   Image courtesy : scienceoveracuppa.com

মায়েলয়েড লিউকেমিয়া- এই রোগে রক্তের শ্বেতকনিকা বা লিউকোসাইট সৃষ্টিকারী কলাতে অনিয়মিত বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায় ফলস্বরূপ রক্তের শ্বেত কণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে যার বেশিরভাগই অপরিণত। এই সময় রোগীর শ্বেত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় তিরিশ থেকে ষাট গুণ বেশি হয় এবং আনুপাতিক হারে রক্তের লোহিত কণিকার সংখ্যা কমে আসে। মায়েলয়েড লিউকেমিয়া সাধারণত দুই ধরণের দেখা যায়।

    অ্যাকিউট মায়েলয়েড লিউকেমিয়া (AML)- এই রোগে কোষ বৃদ্ধি খুব তাড়াতাড়ি হয় এবং রোগীর আয়ু স্বল্পস্থায়ী হয় এবং ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া (CML) - যখন এই কোষ বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয়, উপসর্গ দেখা দিতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগেএবং রোগী বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকে। এই লিউকেমিয়া হাড়ের মজ্জার ( বোন ম্যারো) মায়েলয়েড আদিকোষের (মায়েলয়েড স্টেম সেল বা কোষ) অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি হয়। রক্তের লোহিত কণিকা, অনুচক্রিকা বা প্লেটলেটস এবং লিম্ফোসাইট ছাড়া সমস্ত শ্বেত কণিকা কে মায়েলয়েড কোষ বলা হয়।

মায়েলয়েড লিউকেমিয়া লিম্ফোসাইট ছাড়া অন্য শ্বেতকণিকা, লোহিত রক্তকণিকা এবং অনুচক্রিকাকে আক্রমণ করে।মায়েলয়েড লিউকেমিয়ার সঠিক কারণ নির্দিষ্ট করে বলা যায় না তবে কারণ হিসাবে পরিবেশ দূষণ, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  

ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া রোগীর(CML) : শরীরে জিনের গন্ডগোলের কারণে এই রোগটি দেখা দেয়। ফিলাডেলফিয়া ক্রোমোজোম নামক একটি অস্বাভাবিক ক্রোমোজোম প্রায় 80 থেকে 90 শতাংশ ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া রোগীর কোষে দেখা যায়। এবার কি এই ফিলাডেলফিয়া ক্রোমোজোম সেই সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত একটু বলে নিই। ফিলাডেলফিয়া ক্রোমোজোম হচ্ছে 22 নম্বর ক্রোমোজোমের কিছু অংশ 9 নম্বর ক্রোমোজোমের সাথে অদল-বদল বা বিনিময়(ট্রান্সলোকেশন) হয়ে সৃষ্টি হয়। এই অস্বাভাবিক ক্রোমোজোম আবিষ্কার করেন আমেরিকার ফক্স ছাসে ক্যান্সার সেন্টারের ডাঃ ডেভিড হাঙ্গারফোর্ড এবং পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির ডাঃ পিটার নো ওয়েন। এই দুটি প্রতিষ্ঠানই আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরে অবস্থান করায় এবং সেই শহরের নাম অনুসারে এই ক্রোমোজোমটির নামকরণ হয়। লিউকেমিয়ায় লক্ষণ হিসেবে জ্বর আসতে পারে, ক্ষুধামন্দা, শারীরিক দুর্বলতা, ওজন কম হওয়া, শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তপাত হওয়া, রাত্রে বেশি ঘাম হওয়া, পেট ফুলে যাওয়া, পেটে জল জমা লিভার এবং প্লীহার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে আবার কখনো রক্তের রুটিন পরীক্ষা( কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট বা CBC ) করতে গিয়ে অকস্মাৎ ধরা পড়ে।


          Image courtesy : Webmd.com

চোখের মধ্যে ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের বৃদ্ধি ঘটে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় রেটিনোব্লাসটোমা বলা হয়। প্রায় শিশু অবস্থাতেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু ঘটে।


           Image courtesy : ijo.in

এপিলোপিয়া এই জিনঘটিত রোগের চর্মের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, মানসিক জড়তা ও অপূর্ণতা, টিউমার প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয় এবং এদের শিশুকালেই মৃত্যু ঘটে।

সিসটিক ফাইব্রোসিস- এই রোগটি জিন ঘটিত বংশগত বিপাকীয় অসঙ্গতির জন্য দেখা দেয়। এই রোগে দেহের শ্লেষ্মা খুব ঘন, আঠালো হয়ে যায় ফলে ফুসফুস এবং অগ্নাশয়,অন্ত্রনালির শ্লেষ্মাঝিল্লি আক্রান্ত হয়। বিভিন্ন বহিঃক্ষরা গ্রন্থি অস্বাভাবিক কাজের জন্য রোগী বদহজম, ফুসফুসের বারবার সংক্রমণ (ব্রঙ্কাইটিস ) বংশগত বধিরতা, অগ্নাশয় ঘটিত অস্বাভাবিকতা রোগে ভোগেন। পলিড্যাকটাইলি( পাঁচ আঙ্গুলের পরিবর্তে ছয় বা তার বেশি আঙ্গুল),  



           Image courtesy : nejm.org

ব্রাকিড্যাকটাইলি( খর্ব আঙ্গুল ), 


         Image courtesy : portal.abczdrowie.pl

সিনড্যাকটাইলি( দুই বা তার বেশি আঙ্গুল জোড়া থাকে),


Image courtesy : childrenshospital.org


 টায় - স্যাকস - এটি একটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ঘটিত রোগ। জন্মের সময় সবকিছু ঠিক থাকলেও কয়েক মাসের মধ্যে তাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয় এবং এর ফলে আক্রান্ত শিশুটির বুদ্ধি কম, অন্ধত্ব, স্নায়ুপেশীর নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি দেখা দেয়। সাধারণত দু চার বছর বয়সের মধ্যে রোগীর মৃত্যু ঘটে। হান্টিনটন কোরিয়া-এই জিন ঘটিত রোগে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে বিকলতা, মানসিক এবং শারীরিক বিপর্যয়তা, সারা শরীরে অনৈচ্ছিক কম্পন দেখা যায় যার উপর নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না এবং এই সব রোগে আক্রান্ত মানুষের সাধারণত 40 থেকে 50 বছর বয়সের মধ্যে মৃত্যু ঘটে।1872 সালে জর্জ হান্টিংটন প্রথম এই রোগটিকে বর্ণনা করেন।

অ্যালবিলিজম- যে সমস্ত লোকের এই ব্যাধি হয় তাদের শরীরে মেলানিন তৈরি হয় না বা খুবই কম তৈরি হয় এবং এর ফলে চর্ম সাদা হয় বা ঈষৎ রক্তবর্ণ হয়, চুল সাদা বা ঈষৎ ধূসর বর্ণ হয়, চোখ গোলাপি বর্ণ হয় এবং তাদের চোখ আলোকে প্রতিক্রিয়াশীল হয় ফলে এরা প্রখর সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না। এই রোগের জিনও পিতামাতার কাছ থেকে লব্ধ।


  Image courtesy : medical news today.com

 শারীরিক রোগ সিকল সেল অ্যানিমিয়াতে রক্তের সেল বা কোষগুলি কাস্তের বা সিকল আকারে অনিয়মিতভাবে সৃষ্ট হয়। ( কাস্তের আকৃতি বিশিষ্ট রক্তের কোষ সহ অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন সৃষ্ট হয়)।1910 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান বিজ্ঞানী জেমস বি.হেরিক রোগগ্রস্ত একজন নিগ্রোর রক্তে বিশেষ ধরনের লম্বাটে কাস্তে আকৃতির লোহিত কণিকা দেখতে পান। ঐ বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণা লব্ধ রচনা "PECULIAR ELONGATED AND SICKLE SHAPED RED BLOOD CORPUSCLES IN A CASE OF SEVERE ANAEMIA"। ঠিক তার পরই এই রোগ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে যায় পৃথিবীর অনেক দেশে এবং "জিন" এর অস্বাভাবিকতায় যে এই রোগের কারণ তা প্রমাণিত হয়। বিজ্ঞানী পাউলিং এবং তার সহকারী গবেষক দল 1949 খ্রিস্টাব্দে গবেষণার দ্বারা প্রমাণ করেন যে সিকল সেল অ্যানিমিয়া রোগটি জিনগত এবং পিতামাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। বিখ্যাত জার্নাল SCIENCE এ প্রকাশিত হয় " Sickle cell anaemia is a molecular disease"।



          Image courtesy : wagmc.org


থ্যালাসেমিয়া- লোহিত রক্ত কণিকার(RBC) জন্য ঘটে থাকা একটি জিন ঘটিত বংশগত রক্তরোগ। একে মাইক্রোসিটেমিয়া বা কুলিস অ্যানিমিয়া ও বলা হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রধান কারণ লোহিত রক্ত কণিকার(RBC) মধ্যে হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয় না এবং এর ফলে রক্তের অক্সিজেন(O2) এবং কার্বন ডাই অক্সাইড(CO2) গ্যাস পরিবহনের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। স্বাভাবিক লোহিত কণিকার জীবনকাল 120 দিন পূর্ণ হবার আগেই এই জিন ঘটিত ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন যুক্ত লোহিত কণিকাগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ফলস্বরূপ রোগীর রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া) দেখা দেয়। থ্যালাসেমিয়া যেহেতু বংশগত বা জিন বাহিত সেহেতু পিতামাতার কাছ থেকে সন্তানরা এই রোগের একটি করে মোট দুটি রোগ বাহিত জিন গ্রহণ করে নিজেরা রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর পিতা-মাতাকে পরীক্ষা করলে(জিন পরীক্ষা) তাদের শরীরে অবশ্যই থ্যালাসেমিয়ার জিন পাওয়া যাবে।



          Image courtesy : Medline plus.gov


হিমোফিলিয়া- এটি একটি জিন ঘটিত দুষ্প্রাপ্য বংশগত রক্ত রোগ। এই রোগে রক্ত জমাট বাঁধে না বা জমাট বাঁধতে সাধারণের থেকে অনেক অনেক বেশী সময় লাগে। 1803 খ্রিস্টাব্দে জন কটো নামক ফিলাডেলফিয়ার এক বিজ্ঞানী এই জন্মগত হিমোফিলিয়া রোগের সন্ধান পেয়েছিলেন। রক্তের মধ্যে ফ্যাক্টর এইট(FACTOR 8) নামক এক প্রকার উপাদান না থাকায় এই রোগটি দেখা দেয় জিন ঘটিত কারণে। একটি বিকৃত জিন Factor 8 কে তৈরি হতে বাধা দেয়। এই রোগের বাহক হয় মেয়েরা। মেয়েরা এই বিকৃত জিনটির বাহক(ক্যারিয়ার)। এরা এই রোগের শিকার হয় না এবং আক্রান্ত হয় পুরুষরাই। পুরুষ সন্তানরা এই রোগ তার মায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত করে এবং এটাও দেখা যায় মামাদের বংশেও এই রোগ থাকে।



              Image courtesy : helloswasthya.com


যদি পিতা-মাতার ক্যান্সার বা ডায়াবেটিস রোগ থাকে তাহলে তাদের সন্তানদের মধ্যে এসব রোগের সম্ভাবনা থেকে যায়। দৈনন্দিন জীবনযাপনে বা খাদ্যাভাসে কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে(জীবনশৈলীর পরিবর্তন বা Lifestyle Modification) কিছুটা ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হতে পারে। তবে নিয়মকানুনে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। নিজের সহ্যশক্তির সীমার মধ্যে থেকেই সবকিছুকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে, না হলে হয়তো একটা রোগের ঝুঁকি এড়াতে গিয়ে শরীরে আর একটা নতুন রোগ বাসা বাঁধতে আরম্ভ করবে। জেনেটিক কাউন্সেলিং বা পেডিগ্রি অ্যানালাইসিস এইসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রতিটি পরিবারের উচিত এই দুটির উপর জোর দেওয়া যা আজকাল অনেক পিতা-মাতারই জানা নেই বা তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায় না। অনেক আগে থেকেই আমরা চিকিৎসা পদ্ধতির কথা জানতে পারি। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটস এসব রোগের জন্য শরীরের চারটি জিনিসের(রক্ত,কালো পিওরস, হলুদ পিওরস,কফ ) তারতম্য কে দায়ী করেন। তিনিই সর্বপ্রথম এসব রোগের চিকিৎসার জন্য ওষুধের ব্যবহার করেন। তাই তাঁকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক( Father of Medicine) বলা হয়। বর্তমানে হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, আয়ুর্বেদ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এইসবের চিকিৎসা পদ্ধতি চালু হয়েছে এবং যা প্রায় অনেক ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে এখানে ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতার ফলে বন্ধ্যাত্বের(Infertility) একটি কেস উপস্থাপনা করছি যেটি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় সফলতা লাভ করে। ঘটনাটি বেশ কিছু বছর আগের। এক দম্পতি বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সহ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিভিন্ন নামী দামী জায়গায় চিকিৎসা করিয়ে কোনো ফল না হওয়ায় অবশেষে কলকাতার স্বনামধন্য প্রজনন বিশেষজ্ঞ ডাঃ বি. এন.চক্রবর্তীর শরণাপন্নে আসেন তখন তার বয়স 40 বছর। ডাঃ চক্রবর্তী 28 শে ডিসেম্বর 2002 সালে বিভিন্ন পরীক্ষার সাথে ক্রোমোজোম অ্যানালাইসিস পরীক্ষা করান স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই। সব রিপোর্ট ঠিক এবং স্বামীর ক্রোমোজোম অ্যানালাইসিস (ক্যারিওটাইপ 44XY) ঠিক থাকলেও ওনার স্ত্রীর রিপোর্টে (28/12/2002) দেখা যায় " G-Banded metaphases showed random chromosomal break in significant number of cells".এরপর উনি IVF(In Vitro Fertilisation/ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) এর কথা বলেন যেটি বন্ধ্যাত্ব বা জেনেটিক সমস্যা চিকিৎসার জন্য একটি সহায়ক প্রজনন কৌশল বা পদ্ধতি এবং এই বয়সে(40বছর) কতটা সফলতা আসতে পারে সেটাও ব্যাখ্যা করেন। সবকিছু চিন্তা করে এবং সফলতার অনিশ্চিত জেনে উনারা IVF এর দিকে না এগিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় আগ্রহী হন এবং আমার চিকিৎসাধীনে থাকেন। প্রায় এক বছরের বেশি চিকিৎসা করে অবশেষে আমার পরামর্শমতো পুনরায় ক্রোমোজোম অ্যানালাইসিস পরীক্ষা করান 18/02/2004 সালে এবং রিপোর্টে দেখা যায় "G Banded metaphases showed 46,XX karyotype এবং এরপর একটি সন্তান লাভ করেন। এই প্রসঙ্গে একজন বিশিষ্ট ডাক্তারবাবু "Tumor... its type, conventional therapeutic assistance and homeopathic approach" নামক একটি প্রবন্ধে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে লেখেন-" It is now not merely and hypothesis that homeopathic medicines can act on chromosome which sometimes become responsible for DNA damage - a factor responsible for tumour formation, rather cancer formation relevant to say that I can remember a case of Dr.N.C Mondal a homeopathic physician, where he cured a case of sterility (The cause of which was "G Banded metaphases showed random chromosomal break in significant number cells" on 28/12/2002 was changed into "G Banded metaphases showed 46,XX" on 18/02/2004 from same laboratory.

এই ঘটনাটির উপস্থাপনা কোন আত্মপ্রচারের জন্য নয়,হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় একটি সাফল্যের নিদর্শন স্বরূপ। সফলতা নিদর্শনের প্রামান্যদলিল সংযুক্ত করা হল।





দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং জিন থেরাপি নিয়ে গবেষণারত ডাঃ আন্ডারসনের কথায় " গত শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনটি মহাবিপ্লব ঘটে গেছে,প্রথম টা হল দূষিত বর্জ্যপদার্থ নিকাশী ব্যবস্থার উন্নতি,দ্বিতীয়টা চেতনানাশক আর অপারেশন পদ্ধতির আধুনিকীকরণ,আর তৃতীয়টা হল টীকা এবং অ্যান্টিবায়োটিকের সার্থক প্রয়োগ। এই শতাব্দীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানে চতুর্থ মহাবিপ্লবের সূচনা হবে জিন থেরাপিকে সামনে রেখে।

     আধুনিক মলিক্যুলার বায়োলজির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় চেষ্টা চলছে জিন থেরাপির। এই পদ্ধতিতে রোগীর দেহকোষস্থিত ক্রোমোজোমে অবস্থিত ডি.এন.এ র অস্বাভাবিক জিনকে পাল্টে দিয়ে নতুন জিন ঢুকিয়ে বা জুড়ে দিয়ে রোগ নিরাময় করতে। জিন কেটে বা জিন জুড়ে অভিনব এই চিকিৎসা পদ্ধতিটির নাম হল 'জিন থেরাপী '। অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। মানবদেহে প্রায় 4000 ত্রুটিপূর্ণ জিনঘটিত রোগ অবস্থিত। হিমোফিলিয়া, থ্যালাসেমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস,কোলন ক্যান্সার......... প্রভৃতি জিনঘটিত রোগের জোরকদমে 'জিন থেরাপি' আবিষ্কারের কাজ এগিয়ে চলেছে। ডাঃ আন্ডারসন বলেছেন 2020 থেকে 2030 সালের মধ্যে জিন থেরাপি এবং জিন নিরাময় নানান ওষুধের সাহায্যে এখন যেসব জটিল রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয় সেই সব রোগের চিকিৎসা সম্ভব হবে এবং হয়তো এই ব্যয়বহুল জিন থেরাপি একদিন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিশা দেখাবে । হয়তো ভবিষ্যতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি যুগে এমন দিন আসবে যাতে অন্যান্য ওষুধের মতোই বলা হবে-" দুই চামচ জিন দিনে তিনবার খাবার আধঘন্টা আগে "।


               
        তথ্য সহযোগিতায় : ডঃ অমিত কুমার দত্ত