চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

হৃদরোগ ও ভোজ্য তেল



হৃদরোগ ও ভোজ্য তেল


🔸 ডাঃ এন. সি মন্ডল


 ➡️ খাদ্য হচ্ছে আমাদের শরীরের জ্বালানি (FUEL), যা থেকে আমরা শক্তি (ENERGY) লাভ করি। পৃথিবীতে প্রধানত ৩ রকমের খাদ্য আছে যা আমাদের শক্তি বা ক্যালোরির যোগান দেয়। এরা হচ্ছে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয়, প্রোটিন জাতীয়  এবং ফ্যাট বা চর্ব্বি জাতীয়। ১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট ৪ ক্যালোরি, ১গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ ক্যালোরি এবং ১গ্রাম ফ্যাট থেকে ৯ ক্যালোরি শক্তি পাই।  ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় পদার্থ আমাদের শরীরের পক্ষে বিশেষ দরকার তাই আমরা আমাদের খাদ্য তালিকা থেকে একে একেবারেই বাদ দিতে পারি না। যারা হার্টের রোগী,  হাই কোলেস্টেরল, হাই ট্রাইগ্লিসারাইড বা হাই প্রেসারের রোগী তাদের খাদ্য নির্বাচনের সময় ভোজ্য তেলের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।  আমরা খাদ্যের এই ফ্যাট পাই মূলত দুটি উৎস থেকে ১) কোলেস্টেরল ২) ট্রাইগ্লিসারাইড। কোলেস্টেরল পাওয়া যায় প্রধানত প্রানীজ খাদ্য থেকে।  ট্রাইগ্লিসারাইড পাওয়া যায় প্রধানত আমাদের খাদ্যে ব্যবহৃত ভোজ্যতেল থেকে। সব তেলেই থাকে পরিপূর্ণ মাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইড।  ভোজ্যতেলের প্রধান উপাদান স্যাচুরেটেড  এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড। স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকে প্রাণিজ খাদ্যে।  উদ্ভিজ তেলে এর পরিমাণ খুবই কম তবে নারকেল তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকে।  স্যাচুরেটেড ফ্যাটি  অ্যাসিড ফ্রিজে রাখলে জমে যায়। তাই ঘি, মাখন, নারিকেল তেল, হাইড্রোজেন দিয়ে জমানো তেল যেমন বনস্পতি বা ডালডা যতটা সম্ভব কম খাবেন। আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকে উদ্ভিজ ভোজ্য তেলে এরা ফ্রিজে রাখলেও জমে না যেমন বাদাম তেল, তিল তেল, সয়াবিন তেল, সূর্যমুখী তেল, কুসুমবীজ তেল, সরিষার তেল।  এদের মধ্যে সরষের তেলে সবথেকে বেশি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে।  আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড আবার দু'রকমের ১)পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড(PUFA), ২) মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড(MUFA)। PUFA বেশি থাকে, সূর্যমুখী, স্যাফোলা, তুলাবীজ তেল, সয়াবিন তেল, ভুট্টার তেলে MUFA বেশি থাকে বাদাম, সরষে,রেপসিড ইত্যাদি তেলে।
     সব তেলেরই ভালো-মন্দ দুদিকই আছে সুতরাং কোন তেল খাবেন সেটা নিয়ে আমরা ধন্দে পড়ে যাই।  কিছুসংখ্যক চিকিৎসক বলেন সরষের তেল খাবেন না। সরষের তেল খেলে কোলেস্টরল বাড়বে এবং হৃদ রোগ হওয়ার সম্ভবনাও বাড়বে, সূর্যমুখী খান, স্যাফোলা খান ইত্যাদি ইত্যাদি। বিজ্ঞানসম্মত ভাবে দেখা যায় যে সরষের তেলের মধ্যে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি  অ্যাসিড প্রচুর পরিমানে থাকে(৯০-৯৫ শতাংশ) এবং লিনোলেনিক অ্যাসিড, আলফা লিনোলেনিক অ্যাসিড নামক এক ধরনের ওমেগা ৩ (OMEGA 3) ফ্যাটি অ্যাসিড  থাকে (যেটি হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত) বেশি পরিমানে থাকে এই সরষের তেলে। সরষের তেলের মধ্যে ইউরিসিক অ্যাসিড নামে যে ক্ষতিকারক ফ্যাটি অ্যাসিড আছে তা খুবই কম এবং এই ইউরিসিক অ্যাসিড যে হৃদরোগ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে তার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি এবং সরষের তেল উচ্চ উষ্ণতা বা  তাপমাত্রায় ভাঙ্গেনা, অবিকৃত থাকে অর্থাৎ উচ্চ উষ্ণতায় এর কোন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে না।  তেল খান পরিমিত মাত্রায়।মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড হার্ট এর পক্ষে ভালো এবং সমীক্ষায় এও দেখা গেছে মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড ট্রাইগ্লিসারাইড, রক্তচাপ এবং রক্ত শর্করা যেগুলি হৃদরোগের বিপদ সম্ভবনাময় কারণ তা কমাতে সাহায্য করে এবং এটাও লক্ষ্য করা গেছে খাদ্যে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিবর্তে মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড খারাপ কোলেস্টেরল লো ডেনসিটি লাইপ্রোপ্রোটিন(LDL) কমাতে সাহায্য করে এবং শুনলে আরও অবাক লাগবে যে সরষের তেল খেলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভবনা কমে। তবে দোকানের পোড়া তেলে তৈরি ভাজাভুজি খাবেন না কারণ এই তেল পুড়ে পুড়ে এক ধরনের রাসায়নিক যৌগের সৃষ্টি হয় (Trans Fat) যা আমাদের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক।  সূর্যমুখী (সানফ্লাওয়ার), কুসুমবীজ তেল(শ্যাফোলা) এর প্রতি আমাদের দুর্বলতা বেশি।  আমরা তেল প্রস্তুত কোম্পানির বিজ্ঞাপনের প্রচার এর দৌলতে এইসব দামি তেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি অথচ হৃদরোগ প্রতিরোধকারী লিনোলিনিক অ্যাসিড এবং আলফা লিনোলিনিক অ্যাসিড এতে প্রায় নেই বললেই চলে।  বর্তমানে বাজারে প্রচুর কোম্পানির তেল পাওয়া যাচ্ছে।  এই তেল প্রস্তুত কোম্পানি সবসময় আমাদের বুঝিয়ে যাচ্ছে যে তাদের তৈরি তেলই  সব থেকে ভালো।  তেলের বিজ্ঞাপনে তারা এই সব স্লোগান ব্যবহার করছে। আমাদের তেল হার্টের বন্ধু (HEART FRIENDLY OIL) কোন কোম্পানি বলে আমাদের তেল খান।  আমাদের তেল খেলে আপনার পরিবারের সকলে সুস্থ ও অটুট থাকবে তাদের ভাষায় (OUR OIL KEEPS YOUR FAMILY ACTIVE AND FIT) আবার কোন কোম্পানির  স্লোগান থাকে আমাদের তেল কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে (HELPS REDUCE CHOLESTEROL) এবং যদি আমাদের তেল খান আপনি সারাদিন তরতাজা থাকবেন (FEELS ACTIVE THROUGHOUT THE DAY) ইত্যাদি ইত্যাদি।  দামি তেলের বাজার ধরতে বিজ্ঞাপন ও প্রচারের মাধ্যমে হৃদরোগ সম্বন্ধে ভুল বুঝিয়ে মানুষের মনে সরষের তেলের প্রতি একটা ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করাই এসব কোম্পানির উদ্দেশ্য। আমি প্রথমেই বলেছি যে উদ্ভিজ তেল এর মধ্যে কোন কোলেস্টেরল থাকে না।  থাকে পরিপূর্ণ মাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইড।  এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন চানাচুর, ভুজিয়া কোম্পানিও আমাদের ভুল বোঝাচ্ছে।  তারা  তাদের তৈরি চানাচুর, ভুজিয়ার প্যাকেটে লিখে দিচ্ছে 'ZERO CHOLESTEROL' বা CHOLESTEROL FREE ।  আমি দেখেছি এই লেখা দেখে অনেক হৃদরোগী যাদের কোলেস্টেরল/ ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি থাকা সত্ত্বেও এইসব জিনিস কিনে খাচ্ছে নিয়মিত।  কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করায় তারা বলল 'ডাক্তারবাবু এর মধ্যে ZERO CHOLESTEROL থাকায় আমাদের ক্ষতি কি? 'তাদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলি যে সকল ভোজ্যতেলে (EDIBLE OIL) এইগুলি ভাজা তাতে কোলেস্টেরল না থাকলেও থাকে ১০০ শতাংশ ট্রাইগ্লিসারাইড যা হৃদরোগীর কাছে সমান ক্ষতিকারক এবং করোনারি আর্টারি ব্লকেজে এদের অবদান সমান।  সুতরাং হৃদরোগীরা যতটা পারবেন তেল কম খাবেন তা স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (SAFA) পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (PUFA) এবং মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (MUFA)  যাই হোক না কেন সব তেলে কোলেস্টেরল না থাকলেও থাকে পরিপূর্ণ মাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইড যা করোনারি আর্টারি ব্লকেজের কাজকে  ত্বরান্বিত করে।
        পরিশেষে বলি, পুষ্টি বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে একরকম তেল ব্যবহার না করে ২ থেকে ৩ রকম তেল নানা পরিমাণে মিশিয়ে রান্নায় ব্যবহার করাই ভালো।  যেমন সরষের তেল, সানফ্লাওয়ার তেল এবং স্যাফোলার সমপরিমাণ মিশ্রণ।  অবশ্য এই নির্দেশ করোনারি আর্টারি ব্লকেজ এবং জটিল হৃদরোগীদের জন্য নয়