চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

সিনেমার ইতিহাসে এই প্রথম প্রিমিয়ার শো হতে চলেছে গ্রামে


 

সিনেমার ইতিহাসে এই প্রথম প্রিমিয়ার শো হতে চলেছে গ্রামে




রাধামাধব মণ্ডল



আজ অনেকখানি এগিয়ে গেছেন পরিচালক। ২০ শে অক্টোবর ছবির প্রিমিয়ার শো হবে, এই প্রথম কলকাতা শহরের বাইরে। নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রামের ফুটবল মাঠে। দেওয়ালে দেওয়ালে ঘুরছে তার ছবির পোস্টার। মহামারির আগেই, কলকাতা প্রেস ক্লাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে তার ছবির টেলার লঞ্চ হয়ে গেছে। চাঁদরা সে দিন হাটে এসেছিল, ভিক্ষাবৃত্তির নির্মাণে গড়া এক ছবির জন্য। ছবির সুরকার জয় সরকার, অভিনেত্রী দামিনী বেণী বসু, শিবানী মাইতি, কৌশিক রায় থেকে মাস্টার হর্ষিল ও ছবির পরিচালক উজ্জ্বল বসু, ছবির সম্পাদক অনির্বাণ মাইতি সহ ছবির কলাকুশলীদের সঙ্গে একঝাঁক আড়ংঘাটা ও বীরভূমবাসী। 

পরদিন কলকাতার কাগজে কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল, সে সব কথা। তবে ছবির আরও বড় মাধুকরী জুগিয়ে ছিলেন, বীরভূমের জয়দেবের এক বাউল আখড়া "শ্যামসখা"। শুধু বাংলা সিনেমা নয়, বিশ্ব সিনেমার জগতেও এ-ইতিহাস বিরল। কোনো বাউলদেশের আখড়া বাংলা ছবির মাধুকরীবৃত্তির সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলবেন, তা ভাবা কঠিন।




ছবির টেলার লঞ্চের পর, অভিনবত্ব ছবির প্রচারও। কোনো মাইকিং নয়, বাউল, আদিবাসীরা নিজেদের ফেসবুকে এক লক্ষ অ্যাকাউন্ট এ ছবির প্রচারে নিজের নিজের বক্তব্যের ভিডিও পোস্ট করেছে। এই ভাবনাও নতুন। এটিও মাধুকরী। আজ সারা পৃথিবীর বাঙালিরা জেনে গেছে, তার এই মাধুকরী বৃত্তিতে ছবি বানানোর কথা। বিশ্বের ক্রাউড ফাণ্ডিং ছবির ইতিহাস থাকলেও, এমন মাধুকরী ছবিকে কেন্দ্র করে এই প্রথম। এক পড়ন্ত শীতের বিকেলে, এসব বসে বসে বলছেন নতুন ভাবনায় একটি সম্পূর্ণ গ্রামের দানে গড়ে তোলা পূর্ণদৈর্ঘ্যের বাংলা ছবি "দুধ পিঠের গাছ" নিয়ে, ছবির পরিচালক উজ্জ্বল বসু। পরিচালকের কথায়," প্রথম দিকের কিছু কথা। তখন আমি একটা মর্নিং স্কুলে শিক্ষকতা করি। সকাল ১১ টা অবধি স্কুল। তারপর ট্রেনে করে বেলঘরিয়া থেকে আড়ংঘাটা, প্রায় আড়াই ঘন্টা, ওখানে একটা ঘর ভাড়া নেওয়া ছিলো, স্নান করে বেরিয়ে পড়তাম অর্থ সংগ্রহের কাজে। তখনও চঞ্চল দা, রাজীবদারা সেভাবে যুক্ত হননি এই জগতে। বন্ধু বিজয় আর আমি বিভিন্ন স্কুল, অফিস এবং পরিচিত অল্প পরিচিতদের কাছে গিয়ে সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতাম। কাছাকাছি সিনেমাহল না থাকার ক্ষোভের কথা তারা বলতেন, এভাবেই প্রসঙ্গক্রমে 'দুধপিঠের গাছ' নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে কথা হতো, এবং অনেকেই সাধ্যমতন অর্থ সাহায্য করতেন, এসব একদম শুরুর দিকের কথা। তখন তো স্বপ্ন দেখতাম নির্মাণের। 




যাইহোক, মর্নিং স্কুল করে নদীর আড়ংঘাটা। সেখানে সারাদিন অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা, তারপর ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে আবার আড়াই ঘন্টা ট্রেন জার্নি করে প্রায় রাত ১২ টায় বাড়ি ফেরা, এইছিলো আমার দৈনন্দিন রুটিন। একদিন ফিরছি আড়ংঘাটা থেকে। প্রায় রাত ১০টা। ট্রেনে মাত্র কয়েকজন যাত্রী। আমার পাশেই জনাচারেক বৃহন্নলা। ফোনে মানবের সাথে ছবি নিয়ে কথা হচ্ছিলো ফিরতি ট্রেনে। সম্ভবত সেদিন আমি কোনো কারণে আপসেট ছিলাম। ফোন রাখতেই পাশের জন বললেন,

"এই বাবু, তোমার বইতে পোসেনজিত না দেব আছে?" 


আর একজন আমার অপেক্ষা না করে বলতে শুরু করেছে, "ফোনে শুনলি না, চাঁদা তুলে বই করবে, ওরা থাকলে আর চাঁদা তুলতে হয়?" 




অনেক গল্প হলো তারপর ওদের সঙ্গে। গ্রামের মানুষেরা অভিনয় করবেন, তাদের টাকায় ছবি তৈরি হবে, অনেক অনেক গল্প। স্বপ্নের যাত্রা পথের সে সব গল্প।

জানতে পারলাম, আড়ংঘাটার যুগল মেলায় বেশ কয়েকবার তারা গেছেন। দেখেছেন গৌরের পূর্ণ ভূমি।

মদনপুরে ট্রেন থামতেই সবাই নেমে পড়লেন। নামার সময় তাদের একজন আমার হাতে ১০০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিলেন, আর বিনম্র বললেন,

"তোমায় চাঁদা দিলাম গো, হিজড়ের টাকা পেয়ে গেলে, আর তোমার চিন্তা নেই.. ছবি হবেই."

ট্রেন ছেড়ে দিলো। রাতের কালির সঙ্গে মিশছে, ট্রেনের কালো ধোঁওয়া। খুব ইচ্ছে ছিলো, ফোন নাম্বারটা চেয়ে নিই, জিজ্ঞেস করি তোমরা কোথায় থাকো? ছবি দেখতে আসবে তো? তোমরাও এই ছবির প্রযোজক। - না, এসব আর বলতে পারিনি, ট্রেন ততক্ষণে মদনপুর ছাড়িয়ে অনেক দূর....




আজ যাত্রা শেষ হয়েছে রাধামাধব, ছবির সঙ্গে বহু মানুষ যুক্ত হয়েছেন। শ্রমের রক্তদানে ছবিও এগিয়েছে বহুপথ। ছবির হলমুক্তিতে আড়ংঘাটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বীরভূম, বর্ধমানসহ বাংলা ও বাংলার বাইরের মানুষও। তবে আমি যা চেয়েছিলাম, তা হল না ভাই। থামিয়ে রেখেছি গ্রামবাসীদের। এই পেণ্ডেমিক এর কারণে বাংলার কীর্তন, বাউল, আদিবাসীসহ হরিবাসরের শিল্পীরা ছবি মুক্তির দিন, আগামী ২১ অক্টোবর কলকাতা ও জেলা শহর গুলোর রাজপথে রাজপথে প্রচারের অভিনব দায়িত্ব নিলেও, তার অনুমতি দিতে পারিনি আমরা। তবুও এই উত্তরণের ছবি, এক শিশুর যাত্রাপথের ছবি দেখবে আপামর বাংলা ভাষাভাষী মানুষ।

কথাগুলো বলতে বলতে দু'চোখ স্বপ্নের উজ্জ্বতায় রাঙা হয়ে উঠছিল, "দুধ পিঠের গাছ"এর স্রষ্টা উজ্জ্বল বসু। এর আগেও, তিনটি বাণিজ্যিক সফল ছবির পরিচালক হয়েও, এমন আনন্দের বহিঃপ্রকাশ আগে কখনো তাকে দেখিনি।

 জনগণের আওয়াজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, গণঅর্থায়নের এই বাংলা ছবিকে। এবাংলার সিনেমা তৈরির পরিবেশে প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে পরিচালক উজ্জ্বল বসু, তাঁর নতুন ছবি নির্মাণের বিষয় করে তুলেছিলেন, একটি সম্পূর্ণ গ্রামের মাধুকরীকে। বাংলা সিনেমার প্রযোজক হয়ে উঠেছে, নদীয়া জেলার ধানতলা থানার বাহিরগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের আড়ংঘাটা গ্রাম।

টাকার জন্য পরিচালক উজ্জ্বল বসু, তাঁর নতুন ছবি "দুধ পিঠের গাছ" এর নির্মাণে তিনি প্রযোজকদের দরজায় দরজায় না ঘুরে, ঘুরেছেন গ্রামের বাড়ি বাড়ি। তাই বাংলা সিনেমার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, গ্রাম আড়ংঘাটার নাম।




গ্রামের চাষি, সবজি বিক্রেতা, মাস্টার, রিকসাওয়ালাসহ সমস্ত স্তরের মানুষ এগিয়ে এসে, "দুধ পিঠের গাছ" ছবিটির নির্মাণে হাত লাগিয়েছেন। শুধু অর্থ দিয়েই নয়, ছবির শুটিং চলাকালীন গ্রামের প্রতিটি বাড়ি ছিল, অভিনেতা, অভিনেত্রী ও কলাকৌশলীদের নিজেদের বাড়ি। উজ্জ্বল বসুর চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ক্রাউণ্ড ফাণ্ডের এই ছবিতে, নদীয়া জেলার ছোট এই সিনেমা প্রেমী গ্রাম আড়ংঘাটার ৯৩০ টি পরিবারের, ২৭.০০০ মানুষ, ২২ লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছেন। এটাই ইতিহাস। বাংলার ছবি নির্মাণের ইতিহাসে এতথ্য গৌরবগাঁথা হয়ে থাকবে।




উজ্জ্বল বসু'র এই "দুধ পিঠের গাছ" ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, এক গাঁয়ের ছেলে গৌর এর জীবন যাপন। তাকে ঘিরেই ছবির কাহিনি এগিয়েছে, বদলেছে বাঁক। গৌর এর বয়স সাত বছর। বাক শক্তির প্রতিবন্ধকতায়, সে এখনও ভালো করে কথা বলতে পারে না। এই ভাঙ্গাচোরাই জীবন। গৌরের চঞ্চলতা আর দূরন্তপনায় ভরা শৈশব। গৌরের শিশুমন বিশ্বাস করে, আম, জাম, কাঁঠালের মতো পিঠেরও গাছ হয়। সে বিশ্বাসেই সে মাটিতে পুঁতে রাখে পিঠে, নিয়মিত জল দেয় আর অপেক্ষা করে এবুঝি পিঠের গাছ বের হবে। সে নিয়ে তার দিদিরা হাসাহাসি করে। এক সময় সে নতুন দেশের সন্ধান পায়। ঈশ্বরের দেশ! সেখানকার বাগানে নাকি, নানা রকম পিঠের গাছ আছে। কল্পনায় শিশুমন উড়ে যেতে চায়। স্কুলের মাস্টারের গল্পে মেশে তার চেনা অনেকে। সে সময় তাদের বাড়িতে আসে গৌরের দিদা। সে কাশী যাওয়ার আগে দেখা করতে আসে। গৌর তার কাছেও নানা গল্প শেষে পিঠে গাছের কথা শোনে। তীর্থে যাওয়ার পথে একদিন দিদার ট্রেন ধরতে যাওয়া পথে, গৌরও লুকিয়ে পেটে ব্যথার গল্প বলে স্কুল পালিয়ে এসে ট্রেনে চাপে। এবার শুরু হয় গৌরের নতুন জীবন জার্নি। তারপর সবই ছবির গল্পে। ছবির বেশির ভাগ শুটিং হয়েছে আড়ংঘাটা, বহিরগাছি গ্রাম ও তার আশপাশের গ্রামে। ছবির সংগীত পরিচালক জয় সরকার, নেপথ্য কণ্ঠে অনাথবন্ধু ঘোষ। ছোট্ট গৌরের ভূমিকাতে অভিনয় করেছেন হার্সিল দাস, গৌরের মায়ের ভূমিকায় দামিনী বেণী বসু, বাবা কৌশিক রায় ও গৌরের দিদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শিবানী মাইতি, তেমনই গ্রাম আড়ংঘাটার সাধারণ মানুষরাও করেছেন অভিনয়। এভাবেই বাংলা সিনেমার ইতিহাসে জড়িয়ে গেছে আড়ংঘাটা গ্রামের নাম। এই ছবিতে প্রথম বারের জন্য, বেশ কয়েকজন গ্রামের শিশুও অভিনয় করেছে। ছবিতে সুরকার জয় সরকারের আয়োজনে গান গেয়েছেন বাংলার একমাত্র কিংবদন্তি গীতগোবিন্দম এর গায়ক অনাথবন্ধু ঘোষ।