সাক্ষরতা দিবস ২০২০
🔸 শিবানন্দ পাল
➡️ রাষ্ট্রসংঘের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৩ সালে তৈরি সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক অনুসারে পৃথিবীর ৭৭.৫ কোটি পূর্ণবয়স্ক নিরক্ষরের প্রায় ৭৫% মানুষ ভারত, চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, এবং গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, এই১০ টি রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাঁদের হিসেব বলেছে বিশ্বে পূর্ণবয়স্ক নিরক্ষরের সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মহিলা। তাঁরা বলছেন সর্বনিম্ন সাক্ষরতা হার বিশ্বের তিনটি অঞ্চলে ঘনীভূত দেখা যাচ্ছে। এগুলো হল : দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার সাব-সাহারান এলাকাগুলি। আবার সারা বিশ্বে ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব সামগ্রিক জনসংখ্যায় সাক্ষরতা হার হল ৮৪.১%। পুরুষ সাক্ষরতা হার সেই জায়গায় ৮৮.৬% এবং মহিলা সাক্ষরতা হার ৭৯.৭%। বিশ্বের মানুষকে সাক্ষরতার সীমায় পৌঁছে দেবার জন্য ১৯৬৬ সাল থেকে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বর দিনটি আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। আমাদের দেশেও সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগে দিনটি যথেষ্ট মর্যাদাপূর্ণ ভাবগম্ভীর পরিবেশে পালিত হয়। এবছরও করোনা পর্বে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
২০১১ জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে সাক্ষরতার হার ৭৭.০৮ শতাংশ। ২০০১-এর জনগণনার সময় ছিল ৬৮.৬৪ শতাংশ। বৃদ্ধির হার দেখা গেছে ৮.৪৪। ২০১৮ এর শুরুতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক হিসেব অনুযায়ী কেরালা রাজ্যে সাক্ষরতার হার ধরা পড়েছে ৯৩.৯১ শতাংশ। অনুপ্রেরণাময় পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যতত্ত্ব কোথাও চোখে পড়েনি। এর মধ্যে মার্চ, ২০২০ থেকে প্রায় সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল কলেজগুলি বন্ধ। কোভিড মহামারী মোকাবিলায় দেশজুড়ে লকডাউনের পর্ব চলছে। ছ'মাস পর এখন সেই লকডাউন পর্ব উঠবে উঠবে করছে। স্কুল কলেজগুলি আবার আগের মত খুলবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। যদিও স্কুল কলেজের বাইরে বিশাল জনসংখ্যার মধ্যেই নিরক্ষর মানুষের অবস্থান। ইতিমধ্যে সারা দেশে ২০ থেকে ৩০ কোটি মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছে। তাদের কাজ নেই, কাজ হারিয়েছেন।
২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে বর্ধমান শহরের জনসংখ্যা ছিল ৩১৪,২৬৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫২% এবং নারী ৪৮%। সাক্ষরতার হার ৮৮.৩১%, পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৯১.৭৭% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৮৪.৭৪%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৭৯.৫%, সুতরাং দাবি করা হয়েছিল সারা ভারতের চেয়ে বর্ধমান-এর সাক্ষরতার হার বেশি। তারপর বর্ধমান জেলা ভাগ হয়েছে পূর্ব এবং পশ্চিম বর্ধমান। বর্ধমানের সাক্ষরতার হার তাই নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। যদিও সরকারি ওয়েব সাইটে দাবি করা হয়েছে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৭.১৫ শতাংশ। এবং প্রতি ১০০০ পুরুষের মধ্যে নারী সংখ্যার অনুপাত ৯৫৮ জন।
বর্ধমানবাসী হিসেবে তাই সাক্ষরতার জাতীয় পরিসংখ্যানে গর্বিত বোধ করতে পারি কিনা সংশয় থেকে যায়। ইতিহাসে জেনেছি স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত গত শতকের তিরিশ-চল্লিশের দশকে বর্ধমানে কৃষক সংগঠন করতে এসে হাটগোবিন্দপুর অঞ্চলে নৈশ বিদ্যালয় বা 'ম্যাজিক ল্যান্টার্ণ' বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে লেখাপড়া শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আজ তাঁকেই স্মরণ করে সেখানে তাঁর নামে একটি মহাবিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে তাও সাতটি দশক অতিক্রম করেছে।
সাক্ষরতার জন্য আন্দোলন আমাদের রাজ্যে বিগত বামফ্রন্টের সময় উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল। আমাদের জেলা পূর্ণ সাক্ষর জেলা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই মর্যাদা আমরা ধরে রাখতে পারিনি।
বর্তমানে সারা দেশের সঙ্গে আমাদের লক্ষ্য কেবল স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি নয়। শিক্ষার হার বৃদ্ধি ...যদিও ঐতিহ্যবাহী সাক্ষরতা আন্দোলন এখন পরিবর্তিত পথে হাঁটছে। বর্তমানে কম্পিউটার নির্ভর সাক্ষরতার ওপর আমরা বেশী বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। কম্পিউটার না শিখলে আজ কর্মহীন হয়ে পড়বে দেশের যুব সমাজ। সেজন্য লেখাপড়ার চাইতে তাদের লক্ষ্য হ'ল কম্পিউটার শেখা। তথ্য সাক্ষরতার এখন যেন প্রয়োজন নেই, ধরে নেওয়া হয়েছে।
সাক্ষরতা অর্জন স্বাধীনতার পথে, সামাজিক ও ন্যায়ের স্বার্থে এসব পুরনো ধ্যান ধারণা পরিত্যক্ত হয়েছে। সাক্ষরতার লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা কতটা অগ্রসর হতে পেরেছি সময় বলবে। সাক্ষরতা আন্দোলন কর্মসূচিতে প্রাথমিক সাক্ষরতার সঙ্গে ... ৮০% সাক্ষরতা অর্জন করার লক্ষ্যে পৌঁছতে যেসব কর্মসূচি বিগত বছরগুলোতে নেওয়া হয়েছিল সেসব পরিত্যাগ করে সমাজ এগিয়ে চলেছে। এতে
সামগ্রিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটা পূরণ হয় বলার সময় হয়তো আসেনি। কিন্তু মানুষের রুটি রুজির স্বার্থে চাকুরির যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা এবং পাঠ্যক্রমগুলি দিনের পর দিন জনপ্রিয় হতে চলছে। মানুষ আজ যন্ত্রের ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে। এই পরিসরে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের অঙ্গীকারে সাক্ষরতার আন্দোলনের কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমেই ভাবতে হচ্ছে করোনা পর্বে লকডাউন জনিত সমস্যায় কাজ হারিয়েছেন যাঁরা তাঁদের কথা। বেকারদের হাতে প্রথমে কাজ দিতে হবে। কর্মসংস্থানের পথে সাক্ষরতার উত্তোরণ যদি ঘটানো যায় তবেই আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে আমাদের ভাবনা দিশা পেতে পারে বলেই মনে হয়। নচেৎ নিরক্ষরতার অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে সমাজকে কলুষিত করবে বলেই মনে হয়।