চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

বিদ্যাসাগর : এক মহান শিক্ষাব্রতী ও কর্মযোগীর নাম


 

বিদ্যাসাগর : এক মহান শিক্ষাব্রতী ও কর্মযোগীর নাম


🔸 বিশ্বরূপ দাস


 ➡️ রত্ন প্রসবিনী ভারত জননী। যুগে যুগে কালে কালে কত না মহামানব ভারত ভূমির এই পবিত্র অঙ্গনে জন্মগ্রহণ করেছেন। কি ধর্মীয়, কি সাহিত্য, কি বিজ্ঞান সব ক্ষেত্রেই সফল ও জনপ্রিয় নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু সেকালের সাথে একাল সম্পূর্ন অন্য চেহারার। অন্ধকার যুগের এই তমিস্রায় মন আজও হাতড়ে মরে তার প্রাচীন রত্ন পেটিকার আনাচে কানাচে। স্মৃতি ও সত্তায় ভেসে ওঠে অতীতের জলছবি। নতুন তেমন কিছু না পেয়ে পুরানো কে আঁকড়ে ধরে মানব মন শান্তি পেতে চায়। তাই বারে বারে এসে পড়ে সেইসব মহামানবের একশো স্মৃতি প্রদীপ জ্বালাবার পুণ্য বাসর। কালের সেই পথ ধরে এসে গ্যাছে ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগন্ধর মহাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ।


শুধু শতবর্ষের হিসাবে নয় জ্ঞান, কর্ম ও ধর্মের ত্রিবেণী সঙ্গমে বিদ্যাসাগর এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। যার আলোয় আজও আমরা আলোকিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেই পবিত্র আলোকের ঝর্না ধারায় স্নাত হবে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।স্বীকার করতে দ্বিধা নেই তিনিই বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ।যিনি ভারতীয় সংষ্কৃতি, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অফুরন্ত জ্ঞান আর বাঙালি মায়ের স্নেহপরায়নতা নিয়ে বাঙালির আত্মিক উন্নয়নে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।তিনি ছিলেন দয়া-মায়া-মমতার মূর্ত প্রতীক। বাংলা গদ্যের যথার্থ শিল্পী। নারী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহের প্রবর্তক। বাল্য বিবাহ প্রথা ও বহু বিবাহ প্রথা বন্ধের জনক। তাঁর এই আলোকসামান্য প্রতিভা ও মানবসেবামূলক অবদান দেখে পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ দেব বলেছিলেন, "এতদিন খাল, বিল, নদী দেখেছি এবার সাগর দেখলাম"।


তিনিই প্রথম অনুধাবন করেন মা শিক্ষিত না হলে সন্তান শিক্ষিত হবে না। আর সন্তান শিক্ষিত না হলে অজ্ঞ ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী এবং কুসংস্কারগ্রস্থ ভারতবাসীর দুঃখ দুর্দশা কোনো কালে দূর হবে না। এমনকি সমাজ ও সংস্কৃতির কোনো উন্নতি সাধিত হবে না। তাই গৃহবন্দিনী নারীকে শিক্ষার আলোয় আনার জন্য শুরু হয় তার নবাভিসার। কাজটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না। কারণ তৎকালে রক্ষণশীল সমাজপতিদের দৃষ্টিতে গৃহচারিনি নারী ছিল শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। তাদের বাইরে যেতে মানা।পরপুরুষের সামনে মুখ দেখাতে মানা। কথা বলতে মানা। লেখাপড়া শেখা বাতুলতা মাত্র! সে তো পুরুষদের একচ্ছত্র অধিকার। সেখানে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। অপরাধ বলে বিবেচিত। তাছাড়া গৌরী দান(বাল্য বিবাহ) সমাজের তখন শ্রেষ্ঠ পুণ্য কর্ম বলে বিবেচিত ! একদিকে সমাজপতিদের উল্লাস অন্যদিকে নারীদের অব্যক্ত হৃদয় যন্ত্রনা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করলেন বিদ্যাসাগর। অন্তর দিয়ে অনুভব করলেন এই সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি না দিলে মেয়েরা কোনোদিন পাবে না শিক্ষার অধিকার। পাবে না মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সম্মান। সীমাহীন কুসংস্কার, অজ্ঞতা, অশিক্ষা এবং কুশিক্ষার যুপকাষ্ঠে বলি হবে অনন্ত সম্ভাবনায় ভরা ফুলের মতো সুন্দর কতশত নারী।তাই ড্রিংক ওয়াটার বেথুন সাহেবের সহায়তায় তিনিই প্রথম ১৮৫৬ সালে কলকাতায় স্থাপন করলেন হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়।যা পরবর্তীকালে বেথুন স্কুল নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৫৭ সালে বর্ধমানে এবং ১৮৫৯ সালে মুর্শিদাবাদের কাঁন্দিতে তিনি একটি ইরেজি-বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। মূলতঃ তাঁর হাত ধরেই প্রজ্জ্বলিত হলো নারীশিক্ষার দীপশিখা। সেই আলো ছড়িয়ে পড়লো গোটা বাংলা ময়। বিদ্যাসাগরের আহবানে একে একে গৃহবন্দিনী নারী সংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে এলো শিক্ষাঙ্গনে। যেসব মেয়েদের পুতুল খেলা বয়সে শ্বশুড় বাড়ি যেতে হতো তারা পেলো জীবনের এক নতুন ঠিকানা। পেলো আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। শুরু হলো তাদের স্বপ্নের উড়ান। ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যেই নদীয়া, বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুরে গড়ে উঠলো প্রায় ৩৫ টি বিদ্যালয়। যেখানে প্রায় ১৩০০ ছাত্রী পেলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আলো। 

তারপর মাত্র আট বছরে সেই নারীশিক্ষার গাঙে এলো নতুন জোয়ার। বিদ্যাসাগর বিভিন্ন জেলায় জেলায় গঠন করলেন স্ত্রীশিক্ষা বিধায়নী সম্মিলনি। তার ফল স্বরূপ ১৮৬৪ সালে বাংলদেশের দিকে দিকে গড়ে উঠলো ২৮৮ টি বিদ্যালয়। এইভাবে ১৮৭২ সালে তিনি তাঁর শৈশব ও কৈশরের লীলাক্ষেত্ৰ শহর কলকাতার বুকে গড়ে তুললেন "মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন" যা পরবর্তীকালে (১৯১৭সালে) বিদ্যাসাগর কলেজে পরিণত হয়। গোটা পশ্চিমবঙ্গ তখন শিক্ষার জোয়ারে উত্তাল। নব জাগরণ হয়েছে বাংলার। গৃহ কোণে বন্দি নারী আর অসূর্যমস্পর্শা রইলো না।বিদ্যাসাগরের দৌলতে বিভিন্ন অফিস কাছাড়িতে তারা শুরু করলো নিজেদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের লড়াই। সমাজের বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো একদা গৃহবন্দিনী নারীরা। শুধু এখানেই শেষ নয় এই মহান শিক্ষাব্রতী, কর্মবীর মাতৃসম্মানার্থে বীরসিংহ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন "ভগবতী দেবী" বিদ্যালয়। এইভাবে শিক্ষাতরীর পালে লাগলো নতুন হাওয়া।কান্ডারী ঈশ্বর শিক্ষার অমৃতকুম্ভ পূরণ করার জন্য কলম ধরলেন। তার হাত ধরেই হলো আমাদের বর্ণপরিচয়। হলো বোধোদয়। কথামালা আর আদর্শ লিপি দিয়ে তিনি শুরু করলেন বাল্যশিক্ষা।কুঞ্জে কুঞ্জে মুকুলিত হলো আমাদের জীবনের আখ্যান মঞ্জরি।

এবার আশা যাক বিধবা বিবাহ প্রসঙ্গে। সে এক নিদারুণ সামাজিক যুদ্ধ। যেখানে বিদ্যাসাগর প্রায় একাই তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি বুদ্ধি আর অসামান্য সাহসিকতাকে হাতিয়ার করে তৎকালীন সংখ্যাগরিষ্ঠ সংকীর্ণ মানসিকতার সমাজপতিদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। গোটা সামাজিক অরাজকতার বিরুদ্ধে তিনি একাই লড়ে যাচ্ছেন। রাধকান্ত দেবরা প্রকাশ্যে আর বঙ্কিমচন্দ্রের মতো লোকেরা আড়ালে আবডাল থেকে বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। এমনকি বড়লাট ডালহৌসিও ইতস্ততঃ করে বলছেন,"ইয়ে মানে প্রস্তাবটা ভালো, তবে শাস্ত্রে যদি কোনো উল্লেখ না থাকে তাহলে সবাই কে চটিয়ে কী করে সম্ভব?" এই সময় বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে বড়লাটের কাছে জমা পড়লো মাত্র ৫৭ টি চিঠি আর তার বিপক্ষে জমা পড়লো প্রায় চারগুণ চিঠি। তবুও তিনি দমলেন না। বরং সেই অসম্ভব কে সম্ভব করার জন্য তিনি তন্ন তন্ন করে পুরাণ, বেদ, সংহিতা খুঁজতে শুরু করলেন।তারপর বিজ্ঞানী নিউটনের মতো তিনিও পেয়ে গেলেন এক অভ্রান্ত অকাট্য তথ্য। খুঁজে পেলেন পরাশর সংহিতার একটি শ্লোক যেখানে লেখা আছে "নষ্টে মৃতে প্রবর্জিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ পচশ্বাপত্সু নারীনাং পতিরণ্যে বিধয়তে"। অর্থাৎ "যদি স্বামী মারা যায়, সন্ন্যাস নেয়, নিখোঁজ হয়, সন্তান গ্রহণে অক্ষম হয় কিংবা সে যদি অত্যাচারী হয় তাহলে স্ত্রী আবার বিবাহ করতে পারে"।এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর কাঁটা দিয়েই যেন কাঁটা তুললেন। তাঁর শাস্ত্রীয় প্রমাণ ও যুক্তির জোয়ারে ভেসে গেলো সমাজপতিদের যাবতীয় প্রতিরোধ। ১৮৫৬ সালে ১৬ই জুলাই পাশ হলো বিধবা বিবাহ আইন। ঐ বছরই ৭ ডিসেম্বর শহর কলকাতার বুকে তিনি নিজে হাতে দিলেন প্রথম বিধবা বিবাহ। 

তাঁরই অক্লান্ত পরিশ্রমে হাসি ফুটল ফুলের মতো সুন্দর বাংলার শত শত বিধবা নারীর মুখে। তিনি না থাকলে হয়তো আজও এই সামাজিক অপরাধ এবং কলঙ্ক জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকতো আমাদের সমাজের বুকে। বৈধব্যের যন্ত্রনা ঘুঁচত না।নারীরা পেতো না শিক্ষার অধিকার।

তাই তাঁর এই জন্মদিনে তাঁকে প্রণতি জানিয়ে বলি 

"তুমি বারে বারে এসো ধরা মাঝে

স্মৃতি তোমার বিরাজে এ হৃদি মাঝে"।


                          (লেখক  পরিচিতি : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক)