চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

আগমনী : দুর্গে দুর্গতিনাশিনী


 

আগমনী : দুর্গে দুর্গতিনাশিনী


 🔸 বিশ্বরূপ দাস


 ➡️ আমাদের এই ঋতু রঙ্গময়ী বাংলাদেশ। প্রকৃতির এই ঋতু রঙ্গশালায় এক ঋতু যায় আসে অন্য ঋতু। নব নব রূপ প্রাচুর্যে, রঙের অনুপম বৈচিত্রে এবং সুরের বিমূর্ত মূর্ছনায় নিত্য তার পথ পরিক্রমা। আর এর মাঝে অগ্নিক্ষরা গ্রীষ্মের দহন জ্বালা বৃষ্টির জলে ধৌত করে জল হারা শুভ্র মেঘের তরণী বেয়ে প্রকৃতির নাট্যশালায় শরতের হয় শুভ আগমন। অঙ্গে তার স্বর্নবরণ মোহনকান্তি,চোখে মুখে অপূর্ব স্নিগ্ধতা। তাকে দেখেই শুরু হয়ে যায় "ধানের খেতে লুকোচুরি খেলা"। নদীতীরে কাশ বন ফুলে ফুলে সাদা হয়ে যায়। শিশির সিক্ত তৃণ পল্লবে,আকাশের সীমাহীন নীল নীলিমায়, দোয়েল শ্যামার কলকণ্ঠে, ভ্রমরের গুঞ্জন কেবলই উদাস হাতছানি। শোনা যায় ছুটির সাদর আমন্ত্রণ। তাই গাছে গাছে, ডালে ডালে, দোয়েল পাপিয়ার প্রাণমাতানো সুর মূর্ছনায় এই ধরণী হয়ে ওঠে সৌন্দর্যের অমরাবতী। দূর থেকে ভেসে আসে আগমনী গান --

"বাজলো তোমার আলোর বেণু 

মাতলো রে ভুবন

আজ প্রভাতে সে সুর সুরে

খুলে দিনু মন

বাজলো বাজলো বাজলো তোমার আলোর বেণু

মাতল রে ভুবন"।

আলোর বেণু যখন ভুবন মাতিয়ে দেয় তখন প্রবাসী সন্তানদেরও মন ঘরে ফেরার জন্য কেমন করে ওঠে। এদিকে গর্ভধারিণী জননীও তার সন্তানের গৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। বাঙালির ঘরে ঘরে তখন শুরু হয়ে যায় সাজ সাজ রব। নাড়ু খই মুড়কি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন মায়েরা। ছোটরা গভীর প্রত্যাশায় চেয়ে থাকে কখন তাদের নতুন জামাকাপড় আসবে। আসবে বোম ফটকা, আতশবাজি। এইসময় মাটির বাড়িতে চুন কিংবা খড়ি মাটির প্রলেপ দিয়ে তাকে রঙে রঙে রঙিন করে তোলা হয়। দরজা জানলায় আলকাতরার রং পড়লেই এক সুমধুর গন্ধ ভেসে এসে বাঙালির কানে কানে যেন তখন বলে যায়--

 "শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে ভোরের আগমনী

শিউলি ঝরানো দিন আনে যে চিরদিনের বাণী

সোনার আলোয় জাগবে পৃথিবী 

বাজবে আলোর বাঁশি

আকাশপটে মহামায়ার 

ভুবনমোহিনী হাসি

দিকে দিকে আজ উঠবে বেজে মায়ের পদধ্বনি.."

ঠিক এর মধ্যেই নিহিত আছে আগমনীর প্রাণ ভোমরা।

আগমনী মানেই আপামর বাঙালির হৃদয়মননে আসন্ন উৎসবে আনন্দ জোয়ারে ভাসার দিন। আগমনী মানেই মহামিলনের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হবার দিন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে হৃদয়ের প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে শেফালী সৌরভ ছড়িয়ে দেবার দিন। নতুন বসনে শিউলি বিতানে জীবনের মোহন বাঁশি বাজাবার দিন। অশুভ এবং আসুরিক শক্তির বিনাশ কল্পে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা তথা দেবী মহামায়াকে মর্ত্যে সাদরে বরণ করে নেবার দিন। ঢাকের তালে ধুনুচি নাচে কোমর নাচাবার দিন।পদগত আত্মমর্যাদা ভুলে অতীত স্মৃতি চারনার সাথে মন খুলে বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা দেবার দিন। তাই দেবী পক্ষের সূচনা হতে না হতেই এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ায় ভুগতে থাকে বাঙালি। বহুদিন পর ঘরে ফেরা বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা, খাওয়া দাওয়া, শুভেচ্ছা বিনিময় এবং ছোটখাটো নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কেমন করে পূজার কটা দিন যে হু হু করে কেটে যায় তা ভেবেই পাওয়া যায় না। তখন আমাদের বলতে ইচ্ছে করে

"....দেখো আলোয় আলোয় আকাশ

দেখো আকাশ তারায় ভরা

দেখো যাওয়ার পথের পাশে

ছোটে হাওয়া পাগলপারা

এতো আনন্দ আয়োজন

সবই বৃথা আমায় ছাড়া।

ভরে থাকুক আমার মুঠো 

দুচোখে থাকুক ধারা।

বলে আয়রে ছুটে আয়রে ত্বরা

হেথায় নেইকো মৃত্যু নেইকো জ্বরা.."

আলোয় আলোয় আকাশ ভরলেও কিন্তু আগমনীর এই আলোর নিচে থাকে অনেক অন্ধকার, অনেক দুঃখ এবং অনেক ব্যথা বেদনার অশ্রুসজল কাহিনী। থাকে আমফানের মতো বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ে বাঙালির সাজানো সংসার এবং ফসল ভরা খেতের লন্ডভন্ড হয়ে যাবার কাহিনী। থাকে করোনার মতো মারণ ব্যাধির প্রকোপে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের কর্মহীন হয়ে চোখের জলে দিন গুজরানের কাহিনী। থাকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণহানির ঘটনা।এছাড়া থাকে শিক্ষিত বেকার যুবকদের দীর্ঘশ্বাস। গভীর প্রত্যাশায় তারা দিন গোনে। ভাবে আসছে পূজায় চাকরি পেয়ে মাকে কিনে দেবো নতুন শাড়ি।ভাইকে ভালো স্কুলে ভর্তি করবো।বোনের বিয়ে দেবো। বাবাকে আর পরের বাড়িতে দেবো না কাজ করতে। কিন্তু বছরের পর বছর যায়। একের পর এক এক আগমনির আসে যায়, তবুও তাদের স্বপ্ন অধরা থেকে যায়।কোনও এক দুঃস্বপ্নের চিল এসে ছোঁ মেরে কেড়ে নেয় তাদের আশা আকাঙ্খা এবং স্বপ্ন সাধনার সার্টিফিকেট গুলো। কিংবা মানুষে মানুষে শুরু হয় রক্তের হোলি উৎসব অথবা জাতপাতের নামে জ্বলে ওঠে হিংসার আগুন

তখন বলতে ইচ্ছে করে

"জাগো মা জাগো মা 

জাগো দুর্গা জাগো মা

বিশ্বজুড়ে হিংসা দ্বেষ, যুদ্ধ হানাহানি

কেমন করে গাইবো মা তোমার আগমনী।

ধর্মের নামে আজ দেশে উঠেছে 

হিংসার বিষে গড়া প্রাচীর ও বিভেদ

জাতের পাতের এই বিরোধে মা কতবার

স্বজন হারানো কত অসহায় পরিবার

আর্তি তাদের শোন মা ...."

তবুও আশা রাখি। কারণ আশা মন্দাকিনি একদিন মা মহামায়া রূপে তাদের দুর্গতি দূর করবে।তাঁরই আশীর্বাদে কোনও এক ভগীরথ মা গঙ্গার পবিত্র ধারাস্রোতে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকদের মৃত স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে তুলবে। দেবে নব জীবনের ঠিকানা। কৃষক বধূর ম্লান মুখ ফের রাঙা হয়ে যাবে। কর্মহীন বিশ্বকর্মার দল ফিরবে তাদের পুরনো গন্তব্য স্থলে। তাদের আন্দোলিত বাহুতে শিল্পে, কৃষিতে, শিক্ষায় এবং জীবন ধর্মে আসবে নব জাগরণের জোয়ার।খুশিতে মন ভরে যাবে ছোট্ট কিশোর কিশোরীর। মেঘবালিকা পেখম তুলে নাচবে।

তাই মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে বলি-

"জাগো জাগো মা তুমি বিশ্বরুপিনী

অসুর নাশিনী,  কল্যাণ দায়িনী, দুর্গতি নাশিনী

জাগো"।


                                             লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক