মহালয়া একটি সংস্কৃতির নাম
রাধামাধব মণ্ডল
যা চন্ডী মধুকৈটভারী, দৈত্য দলনি, যা মহিষমর্দিনী, যা দূর্গে চন্ড মুন্ডোমালিনী, যা রক্ত বিজশ্বরী, শক্তি সুন্দরি সুন্দর দৈত দলনি—যা—। আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জিল (যদিও এবার ভাদ্র সংক্রান্তি)। ধরনীর বর্হিআকাশে-অন্তরিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তর আকাশে জাগরিত জোর্তিময়ী জগত্মাতার আগমন বার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে ঊঠে রূপলোক ও রসোলোকে আনে নবভাব মাধুরীর সঞ্জিবন, ত্রাহি আনান নন্দিতা শামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে-মৃন্ময়ীকে আবাহন। আজ শক্তিরূপীনি বিশ্বজননীর শারদও শ্রীমন্ডিত প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানগ্রহিতা। মহামায়া-সনাতনী শক্তিরূপা গুনাময়ী-হে ভগবতী মহামায়া তুমিই ত্রিগুনাতিকা। তুমিই রজগুনে ব্রহ্মার গৃহিনী বাগদেবী। সপ্তগুনে বিহ্মার পতি। লক্ষ্মী, তমগুনে শিবের বনিতা পাবর্তী। আবার ত্রিগুনাতিত তুমিই অর্নিবচ্চনিয়া। আবার দেব ঋষি কণ্যা কাত্যায়নের কণ্যা কাত্যায়নী, তিনিই কণ্যাকুমারী আখ্যাতা দূর্গে, তিনিই দাক্ষ্যয়নি সতি, তিনিই আদিশক্তি, দেবী দূর্গা। নিজদেহ সম্ভুত তেজপ্রবাহে শত্রুদহনকালে অগ্নিবর্ণা, অগ্নি লোচনা। এই উষা লগ্নে—হে মহাদেবী তোমার উদ্বোধনে প্রানের ভক্তিরসে আলোকিত হোক দিকে দিকে, হে অমিতজ্যোতি, হে মা দুর্গা, তোমার আবির্ভাবে ধরনী হোক প্রাণময়ী, জাগো জাগো মা।
এভাবেই রেডিও-র কাকভোরের রেকডিং শুনে আমাদের দেবীপক্ষের সূচনা হয়। এপ্রথা সেই আদিকাল থেকে চলছে। কোনোদিন এসব নিয়ে ওঠেনি প্রশ্ন।
আর সবার মতো শিবনাথ বাগদিও আজ মহালয়ার দিন তর্পণ করতে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। এক অদৃশ্য ভয়ে সে জড়সড়। সবকিছু ঠিকঠাক না হলে, কিছু না কিছু অমঙ্গল ঘটবেই এটা বলে আসছে সকলে। বছরের অর্ধেক দিন না খেয়ে থাকার থেকেও আরো বড়ো কোনো অমঙ্গলের ভয় আজন্মকাল থেকে বয়ে আসছে, শিবনাথ বাগদির মতো অসংখ্য মানুষের মধ্যে। রক্তে মিশে আছে এই সংস্কৃতি। তাকেই বইতে হয় আমাদের। কোনো হেলদোল নেই। এই ব্রক্ষ্মান্ডে এমন শক্ত পোক্ত ধর্মীয় সাংস্কৃতিক শৃঙ্খলা দ্বিতীয়টি আর নেই।
কয়েকবছর আগে জয়দেব মেলায় রামজীবন বন্দোপাধ্যায় নামে একজন বাবু শিবনাথের মাথাটা খেয়ে গেছে। তারপর থেকে মাটির ঠাকুরের মূর্তির সামনে দাঁড়াতে কেমন মন চায় না। নানা ভাবনা ঘুরপাক খায়। পঞ্জিকাবর্ষ দূরে চলে যায়। ব্যবসা ব্যবসা লাগে। বরং জমির মাটির সঙ্গে কথা না বলতে পারলেও যত্ন করলে সে মাটি শিবনাথকে ফসল দেয়। তখন খুব আনন্দ হয়। ঢাক কাঁধে নিয়ে ক্ষেতের চারিদিকে মাতঙ্গ করার ইচ্ছা জাগে। মনে হয় মাটি আমার সব কথা বোঝে। আমিই দেবী। মাটিই ঈশ্বর।
তবুও মহালয়ার দিন অজয়ে গিয়ে হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে তর্পণ করতে হয় শিবনাথকে। সমাজে থাকার জন্য, তার এই অভ্যাস ধরে রাখা। সবাই বলে, অমঙ্গল হয়। আজ যা মঙ্গল, কাল তা অমঙ্গল! খুব কাছে দাঁড়িয়ে দেখেছে শিবনাথ। তার মনে হয়েছে সবই আপেক্ষিক। সবই মানুষের জন্য, মানুষের ভোটে তৈরি। কি সংস্কার, কি সংস্কার ভাঙ্গা। এইবছর মহালয়া আর বিশ্বকর্মা পুজো এক দিনে। এদিকে জীবনের শাশ্বত দুঃখ, দাবী, খিদে, পুষ্টি ভোলার জন্য তর্পণ না করে জেডি খাওয়া যাবে না শিবনাথের। বিশ্বকর্মা পুজো মানে টানা তিন দিন জেডি আর জেডি। জয়দেব মেলার বাবুর সঙ্গে মেশার পর শিবনাথ অনেক পাল্টে গেছে। এখন আর অজ্ঞান হয়না, সারা দিন রাত একটু একটু করে গলায় ঢালে আর নেশার ভান ধরে সকলের অজ্ঞান হয়ে যাওয়া দেখে। বাবুর কথার মিল খোঁজে। সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা জেডির জোগানের উৎস খোঁজে। তখন এমনই কত উৎস এসে দাঁড়ায় তার সামনে।
বাবু বলেছিল, মহালয়া হোলো ভারতের আদি নিবাসীদের রাজা মহিষাসুরের সঙ্গে বাইরে থেকে আসা আর্য্যদের, জল জমি জঙ্গল দখলের ষড়যন্ত্রের দিন। মহিষাসুর একজন পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। তাঁকে পরাস্ত করতে না পারলে দক্ষিণ ভারত দখল করা অসম্ভব ছিল। আর্যরা অনেক খোঁজখবর করে জানতে পারেন যে, একমাত্র নারী আসক্তি মহিষাসুরের দূর্বলতা। তাই তাঁকে নারী দিয়েই শেষ করা হয়েছিল।
শিবনাথ তখনও হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ভাবে, বাবার কথা। তাকে নিজের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখার কথা।
একটি সংস্কৃতির জন্য, মন তৈরি করতে হবে আমাদের। তার চর্চা হোক। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ একটি সংস্কৃতির নাম। সেটা মনে রাখে শিবনাথ বাগদি।