চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

২২শে শ্রাবণ

 ২২শে শ্রাবণ

 🔸 শিবানন্দ পাল

  ➡️ ‘অসত্য থেকে আমাকে সত্যতে নিয়ে যাও, অন্ধকার পেরিয়ে জ্যোতিতে, মৃত্যু পার হয়ে অমৃতলোকে উত্তীর্ণ করো।’ 

রবীন্দ্রনাথ আজীবন এই প্রার্থনা করেছেন। বলেছেন সেই কঠিন অধ্যাবসায়ের কথা। বলেছেন, ‘রোজ শেষ রাত্রে জেগে সূর্যোদয়ের আগে পর্যন্ত নিজের মনকে আমি স্নান করাই। ... শেষ রাত্রে আমার নিজের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার কাজ চলতে থাকে। সেই সময়টা খুব ভালো সময়। বাইরের কোনো কোলাহল থাকে না, নিজেকে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।’

ইউরোপে সর্বত্র কবি রাজার মতো সম্মান পেয়েছেন। কবির অভিজ্ঞান ‘গীতাঞ্জলি শুধুই যদি কবিতা হতো, তাহলে জনসাধারণের মনে এমন করে স্থান পেতুম না, কারণ কয়জনই বা কবিতা বোঝে? এই বড়ো জায়গায় মনকে পৌঁছে দিতে উপনিষদ আমাকে সাহায্য করেছে। যুদ্ধের পর সমস্ত ইউরোপ মনের একটা আশ্রয় পেতে চাচ্ছে, তাই এরা আমাকে এতো ভালবাসে।’

উপনিষদ তাঁর জীবনকে এমনই প্রভাবিত করেছে যা অন্য কিছুর মধ্যে পাননি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে একান্ত প্রিয়জনকে লিখেছেন, ‘যদি দ্বিধা থাকে, তবে সেদিন আমার তপস্যার দিন আসবে, উপনিষদ হবে আমার সখা। তার সঙ্গে আমার নিরাসক্ত সম্বন্ধ প্রত্যহ নিবিড় হয়ে আসছে।’

বলেছেন, “অসতো মা সদগময়’। এর চেয়ে বড়ো প্রার্থনা বোধহয় পৃথিবীতে কেউ উচ্চারণ করেনি। তাই প্রতিদিন নিজেকে বলি তুমি সত্য হও, পরিপূর্ণ সত্যের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো। কখনো কোনো কারণে হঠাৎ আত্মবিস্মৃত হলে পরে লজ্জিত হই কেন? কারণ আমার সত্য- আমিটিকে সে আবৃত করে দেয়, অথচ আমার সারাজীবনের সাধনা ও আকাঙ্ক্ষা যে আমি প্রতিদিন তাকে নির্মল করে তুলবো। 'আবিরাবীর্ম এধি' নইলে আমার মধ্যে তার প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।”

উপনিষদে এতো আত্মস্থ হয়েছিলেন বলেই হয়তো কবি শেষের দিনগুলোতে হাসি ঠাট্টায় প্রিয়জনদের সঙ্গে মশগুল হতে পারতেন। এই বিশ্বে আনন্দ যতখানি সম্ভব আহরণ করে নেওয়া, এই ছিল তাঁর প্রচেষ্টা। আর ছিল বাঁচবার অন্তর্লীন আহ্বান। নইলে শেষের 

সেই দিন হয়ত আর শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আসতে চাইতেন না। ডাক্তাররা বা প্রিয়জনেরা নিশ্চয় তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, তিনি রোগমুক্ত হবেন ... হবেন ... হবেন ... অপারেশনের সাহায্যে।

তাই কলকাতায় আসা। কে জানত সেটাই শান্তিনিকেতন থেকে শেষ যাত্রা। শান্তিনিকেতনের মাটিতেই যে তাঁর শুয়ে থাকার ইচ্ছে ছিল। সেখানেই যে ছিল তাঁর ... প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি ... !

শান্তিনিকেতন থেকে শেষবারের মতো কবি কলকাতায় আসছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কোম্পানির আধিকারিক নিবারণচন্দ্র ঘোষ তাঁর সেলুন কামরায় কবিকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছেন। গাড়ি বর্ধমানের কাছাকাছি আসতে নিবারণবাবু একবার কবির কাছে এসে সাবধানে জানতে চাইলেন, “খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে না তো?”

কবি হাসিমুখে উত্তর দিলেন, না। বেশ আছি। দিব্যি মুণ্ড খেতে খেতে চলেছি।

মুণ্ডু খেতে খেতে চলেছেন !  মুণ্ডু! কার মুণ্ডু? কিসের মুণ্ডু ? 

উপস্থিত সকলে হাসছেন। কবিও হাসছেন।

ট্রেনের কামরার ভিতরের গরমে হাঁসফাঁস করছেন, পথের ক্লান্তিতে সকলে অবসন্ন। নিবারণবাবু ভাবলেন, তাহলে বোধহয় তাঁরই মুণ্ডু খাওয়া চলছে।

নিবারণবাবুর অবস্থা দেখে কবির সঙ্গীরা তাঁকে বুঝিয়ে বললেন যে, কবির অসুস্থতাজনিত কারণে কবিরাজ তাঁকে একটি মণ্ড অর্থাৎ বিশেষ পথ্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কবি তার নামকরন করেছেন মণ্ডের বদলে ‘মুণ্ডু’।

নিবারণবাবু আশ্বস্ত হলেন।

শেষ জুলাইয়ে (২৭ তারিখ, ১৯৪১) জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একটা কবিতা লিখলেন, মনটা বেজায় খুশি। সব ভালো, আর কোন দুশ্চিন্তা নেই। ডাক্তাররা তাঁকে দেখে কিন্তু খুশি নন।

কবির সে কি দুঃখ।

কেউ বুঝি বললেন, দুঃখের কি আছে? এতে তো আনন্দ হবার কথা!

কবি বললেন, তুমি কিচ্ছুটি বোঝ না, রোগী আছে, ডাক্তার আছে, রোগ নেই, ওঁরা চিকিৎসা করবে কার? এতে ওঁদের মন খারাপ হয় না?

সকলে হেসে অস্থির।

অস্ত্রোপচারের পরের দিন। জোড়াসাঁকোয় যন্ত্রণায় অবসন্ন কবির শরীর। সকলে গম্ভীর। কি হয়, কি হয়! যেন সেই চরম মুহূর্তের প্রতীক্ষা চলছে। কবি চোখ খুলতেই দেখতে পেলেন একটি বিষাদ ভরা মুখ তাঁকে নিরীক্ষণ করছে। তাঁর দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে এমন মুখ ভঙ্গি করলেন যে সে মুখে বিষাদ উধাও। ... হাসি ফুটে উঠলো।

এই তো, তা না গম্ভীর মুখ করে এসে দাঁড়ালেন! এতো গম্ভীর কেন? এবার একটু হাসো!

কবির কথায় বিষণ্ণ সে মুখে তখন হাসি ফুটে উঠলো, চোখে জল।

এতো যন্ত্রণার মধ্যেও কবি হাসছেন।

সকলে অবাক।

নির্মলকুমারী মহালনবিশ তাঁকে দেখেছেন একেবারে পাশে থেকে। তিনি বলেছেন, চলে গেছে পুত্র, পুত্রসম আরও অনেকে। একমাত্র দৌহিত্র তাঁরও মৃত্যু বিদেশে। টেলিগ্রামে খবর এসেছে, খড়দহ থেকে রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমাদেবীকে ডেকে এনে ওঁদের উপস্থিতিতে কবিকে সে খবর জানানো হয়।

শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে র‌ইলেন, দু ফোঁটা জল বুঝি গড়িয়ে পড়েছিল তাঁর চোখে।

কি অসাধারণ ধৈর্যের সঙ্গে সেই সংবাদ গ্রহণ করেছেন। ... আছে মৃত্যু, আছে দুঃখ ... তিনি লিখেছেন, ‘খুব কষ্ট হয় তা জানি, তবু একথাও অস্বীকার করলে চলবে না যে মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোনো মূল্যই থাকে না, ... অনেক সময় আমরা চেষ্টা করে আর খুব ঘটা করে শোকটাকে জাগিয়ে রাখি, তা না হলে যেন যাকে হারিয়েছি তাঁর প্রতি কর্তব্যের ত্রুটি হল বলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কিন্তু আমার মতে সেইটেই অপরাধ, কারণ এটা মিথ্যে।’

মিথ্যে! মিথ্যে! মিথ্যে!

রবীন্দ্রনাথ ডুবে গিয়েছেন লেখায়। শেষ সপ্তক, পুনশ্চ লিখেছেন নিতুর অসুখ ও মৃত্যুর গভীর বেদনা নিয়ে। একমাত্র পুত্র হারা মা- মীরা। তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন আপন পুত্রশোকের কথা শুনিয়ে।

লিখেছেন, ‘শমী যে রাত্রে গেলো তাঁর পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তাঁর লক্ষ্মণ নেই। মন বলল কম পড়েনি সমস্তর মধ্যেই সব রয়ে গেছে, আমিও তারি মধ্যে।’

কিন্তু ৭ আগস্ট তিনি চলে গেলেন। ৮ আগস্ট, ১৯৪১ ইংরাজি দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকা লিখেছিল- “TODAY India mourns. yesterday at Calcutta, in the house where he was born, Rabindranath Tagore came to the end of a long life. He had long his country’s pride, and though the riches that he poured out remain for his country;s perpetual use, the fine brain and the fine figure are no more. The multitude, that loved and admired him hoped against fear in his months of illness. The bulletins were read with painful emotion. Now the deserved rest has come to one who labored magnificently for his generation and generations to come.

It does not befall all writers to win fame in their lifetime. Tagore won it early and in many fields. His selection for the Nobel Prize was only a recognition by men far away of what Bengal had known for some time, that there was a new voice worth the world’s while to listen carefully to, whose tones were not to be heard elsewhere.”

১২ আগস্ট, ১৯৪১ ওই স্টেটসম্যান পত্রিকা প্রকাশ করেছিল তাঁর শেষ রচিত ‘মৃত্যু’ কবিতার ইংরাজি অনুবাদ। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এই কবিতার অনুবাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ডঃ অমিয় চক্রবর্তীকে।

“Sorrow’s dark night, again and again,

 Has come to my door.

Its only weapon I saw,

Was pain’s twisted brow, fear’s hideous

 Gestures

Preluding its deception in darkness.

Whenever I have believed in its mask of

 dread

Fruitless defeat has followed.

This game of defeat and victory is life;s delusion

From childhood, at each step, clings this spectre.

Filled with sorrow’s mockery.

A moving screen of varied fears-

Death’s skilful handiwork wrought in scattered gloom.” দ্রঃ THE STATESMAN An Anthology Compiled by NIRANJAN MAJUMDAR, THE STATESMAN, CALCUTTA and NEW DELHI, 1975.

২৪ সে আগস্ট, ১৯৪১। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে নিখিল ভারত মহিলা সমিতি আয়োজিত রবিহারা সভায় নির্মলকুমারী বলেছিলেন, ‘প্রিয়জনের মৃত্যু বেদনা কি রকম শান্তচিত্তে গ্রহণ করতে হয় তাও যেমন দেখেছি, নিজের মৃত্যু যন্ত্রণা কি রকম ধৈর্যের সঙ্গে বহন করতে হয় তাও দেখলাম। 

২১ মে, ১৯৬০।তারিখের ‘স্বাধীনতা’  পত্রিকার একটি  ছোট্ট খবরে যখন চোখ পড়ে আলোড়িত হই। খবরে প্রকাশ ট্রাম কোম্পানির শ্রমিক সংগঠন ১৯৬০ সালের ২০ মে কলকাতার ভারত সভা হলে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করে দাবি জানায় কবির শতবার্ষিকী বছরে সরকারকে শ্রমিকদের জন্য স্বল্পমূল্যে রবীন্দ্রসাহিত্য দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। সেদিন ওই দাবির পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন ট্রাম শ্রমিক ইউনিয়নের তৎকালীন নেতা ধীরেন মজুমদার, সুবোধ দত্ত প্রমুখ। বিশিষ্ট উর্দু কবি সালেখ লখণৌভী উর্দু সাহিত্যে রবীন্দ্র প্রভাব বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। আর সেদিনের সেই সভার সভাপতি ছিলেন সাহিত্যিক গোপাল হালদার। 

আমাদের অনেকের বাড়িতেই হয়তো পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সেই রবীন্দ্র রচনাবলী আজও হয়তো সুরক্ষিত অবস্থায় শোভা বর্ধন করে। কিন্তু আমরা কী একবারও ভাবি ‘গণ থেকে ব্যক্তিসর্বস্ব’ চিন্তার বিশ্বায়নের এই বাজারে অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে আমরা যে উত্তেজনার প্রকাশ ঘটাই সেখানে ‘মানুষের মতো মানুষ’ হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায় ‘রবীন্দ্রনাথের মতো সাহিত্য পড়বো’ এরকম কোনও দাবি কী এখন থাকে?

 "অসতো মা সদ্‌গময় 

তমসোমা জ্যোতির্গময়

মৃত্যোর্মামৃতং গময়।

আবিরাবীর্ম এধি।

রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং

তেন মাং পাহি নিত্যম্‌।"


“অসত্য হইতে মোরে সত্যে লইয়া যাও

আঁধার হইতে মোরে আলোকে লইয়া যাও

মরণ হইতে মোরে অমৃতে লইয়া যাও

হে আবি:, হে প্রকাশ, তুমি তো চিরপ্রকাশ,

একবার তুমি আমার হও, আমার হইয়া প্রকাশিত হও।” প্রণাম নিবেদন আমার বিশ্বকবিকে। 

 

 তথ্য সংগ্রহঃ উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, ওয়েস্টবেঙ্গল অনলাইন মিডিয়া, নিজস্ব ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং THE STATESMAN An Anthology Compiled by NIRANJAN MAJUMDAR, THE STATESMAN, CALCUTTA and NEW DELHI, 1975.

২৪ সে আগস্ট, ১৯৪১।