চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ নিয়ে কিছু কথা (প্রথম পর্ব)



জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ নিয়ে কিছু কথা  (প্রথম পর্ব)  🔸 অভিজিৎ মিত্র ➡️ ১৯৮৬ সালের দীর্ঘ ৩৪ বছর পর এই ২০২০ সালে করোনা আবহের মধ্যেই এক নতুন ন্যাশনাল এডুকেশনাল পলিসি বা ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ নিয়ে এল এবারের বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১৯-এ ইসরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান কে কস্তুরিরঙ্গনের নেতৃত্বে এক কমিটি ৪৮৪ পাতার এই শিক্ষানীতির খসড়া পেশ করেছিল যা এবছর জুলাই মাসে কেন্দ্র সরকার অনুমোদন দেয়। যদিও এই শিক্ষানীতির খসড়া বিজেপি সরকার ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অনলাইন পোর্টালে জনসাধারনের জন্য রাখা ছিল এবং কেন্দ্র সরকারের দাবী অনু্যায়ী এ যাবৎ প্রায় আড়াই লাখ পরামর্শমূলক চিঠি সেই খসড়ার প্রেক্ষিতে এসেছে, তবুও এই শিক্ষানীতি অনুমোদন ও প্রকাশের সাংবিধানিক দিক নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাচিহ্ন রয়েই যায়। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর এরকম গুরুত্বপূর্ণ এক নীতি পার্লামেন্টে আলোচনা করে গনতান্ত্রিক উপায়ে রাজ্যগুলোর মতামত নিয়েই বলবৎ করা উচিৎ ছিল, এরকম মাফিয়ার মত গায়ের জোরে (অথবা চোরের মত সবাইকে এড়িয়ে গিয়ে) হঠাৎ প্রকাশ করা অনুচিৎ। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্বেও আলোচনায় সরকারের এত ভয় কেন? তাহলে কি পার্লামেন্টের প্রয়োজন ফুরল? এবং এই করোনা-সংকটে এই শিক্ষানীতি এভাবে চটজলদি প্রকাশ করা কি খুবই জরুরি ছিল? এরকম বেশ কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন। অবশ্য এটাও ঠিক, ১৩৮ কোটির ভারতবর্ষে ৮-১০ টা রাফাল ফাইটার প্লেন এনে চিনের নাক ফাটিয়ে দেওয়া বা অযোধ্যায় রামমন্দিরের ইঁট গেঁথে করোনা তাড়িয়ে দেওয়া, এইসব আজগুবি ব্যাপার নিয়েই বেশি চায়ে-পে-চর্চা হয়, শিক্ষা নিয়ে কেউ অত তলিয়ে দেখে না। যাই হোক, আসুন আমরা একবার এই নতুন শিক্ষানীতির প্রধান অংশগুলো জেনে নিই।প্রথমেই খুব ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এই নতুন শিক্ষানীতি, ১৯৮৬ সালে আগের শিক্ষানীতিতে যেমন শিক্ষা মন্ত্রক-এর (MoE) নাম বদলে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক (MHRD) রাখা হয়েছিল, ২০২০ সালে আবার সেই পুরোন নাম শিক্ষা মন্ত্রক ফিরিয়ে এনেছে। তারপর এই নীতিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে – স্কুলশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা। এই লেখায় আমরা শুধু স্কুলশিক্ষা নিয়েই আলোচনা করব। ১) ১৯৮৬-র নীতিতে যেমন ১৯৯০ এর ভেতর ভারতের ১০০% শিশুকে শিক্ষার আঙিনায় আনার কথা বলা হয়েছিল (যদিও আজ অব্ধি সেটা সম্ভব হয় নি), ২০২০-র নীতিও ঢাক পিটিয়ে সেই একই ঘোষনা করেছে, লক্ষ্য ২০৩০। এরমধ্যে নাকি ২ কোটি স্কুলছুট শিশুকেও স্কুলে ফিরিয়ে আনা হবে (হলে তো খুবই ভাল, বেঁচে থাকলে দেখতে পাব)। ২) এই নতুন শিক্ষানীতিতে ভারতে আগামি দিনের স্কুলশিক্ষাকে বর্তমান ১০+২ সিস্টেম (মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক) থেকে সরিয়ে এনে ১৫ বছর করা হয়েছে ও চার ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ ৫ বছর (ফাউন্ডেশনঃ নার্সারি, এল-কে-জি, ইউ-কে-জি, অথবা তিন বছর অঙ্গনওয়ারি প্রি-স্কুল, এবং ক্লাশ ওয়ান, ক্লাশ টু) + ৩ বছর (প্রিপারেটরিঃ ক্লাশ থ্রি থেকে ক্লাশ ফাইভ) + ৩ বছর (মিডল-স্কুলঃ ক্লাশ সিক্স থেকে ক্লাশ এইট) + ৪ বছর (সেকেন্ডারি-স্কুলঃ ক্লাশ নাইন থেকে ক্লাশ টুয়েলভ)। ৩) ৩ থেকে ৬ বছরের শিশুদের মানসিক বিকাশ যেহেতু খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই তাদের জন্য প্রি-স্কুলে বিশেষ স্কুলপাঠ্যের বন্দোবস্থ করতে হবে (এই আইডিয়াটা আমাকে পুরো নাড়িয়ে দিয়েছে)। ৪) শিশুদের শিক্ষার ভিত শক্ত করার জন্য ক্লাশ টু অব্ধি তাদের ভাষায় স্বাক্ষরতা ও অঙ্ক শেখানোয় নজর দেওয়া হবে। বিশেষ করে লেখা, পড়া, বলা, সংখ্যা চেনা ও গোনা এবং যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ। ৫) ক্লাশ ফাইভ অব্ধি বাচ্চাদের মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষাতেই লেখাপড়া শেখানো হবে। কমিটির মতে বাচ্চারা মাতৃভাষায় যেহেতু ভাল বুঝতে পারে, তাই এর ফলে তারা ভাল করে শিখবে (আমার মতে এটা ভুল সিদ্ধান্ত)। ৬) প্রতি ক্লাশে তিনটে ভাষা শিখতে হবে। যে কোন ক্লাশেই (এমনকি উচ্চশিক্ষাতেও) সংস্কৃত ভাষাকে একটা বিকল্প হিসেবে রাখতে হবে। ক্লাশ সিক্স থেকে বিদেশি ভাষাও শেখা যেতে পারে (ফ্রেঞ্চ, জার্মান, স্প্যানিশ, জাপানিজ, পোর্তুগিজ ইত্যাদি)। ৭) পরীক্ষা ব্যাপারটা অনেকটাই বদলে যাবে। বছরের শেষে অ্যানুয়াল পরীক্ষার ওপর কিছুই নির্ভর করবে না, বরং সারাবছর একজন ছাত্র/ছাত্রী কিরকম চিন্তা-ভাবনা করছে, ক্লাশে পড়ানো বিষয়গুলো কতটা শিখছে এবং কিভাবে বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা করছে, তার ওপরে বছরশেষের রেজাল্ট নির্ভর করবে। ক্লাশ টেন বা টুয়েলভের বোর্ড পরীক্ষা অনেক সহজ হয়ে যাবে, প্রাইভেট টিউশনের আর দরকার পড়বে না (এটার প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়ন দেখতে চাই)। ৮) এবার থেকে স্কুলের বাৎসরিক মূল্যায়ন পরীক্ষা হবে ক্লাশ থ্রি, ফাইভ আর এইটে। এটা করার জন্য ‘পরখ’ নামক এক ন্যাশনাল আসেসমেন্ট সেন্টার বা জাতীয় মূল্যায়ন কেন্দ্র খোলা হবে। তারা যেরকম গাইডলাইন দেবে, স্কুলগুলো সেভাবেই পরীক্ষা নেবে। ৯) সমস্ত ক্লাশের স্কুলপাঠ্য বই বানাবে NCERT ও SCERT এবং প্রতি রাজ্যে একটা করে স্টেট স্কুল স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি তৈরি হবে। এই অথরিটির কাজ হবে স্কুলগুলো গাইডলাইন ঠিকঠাক মেনে চলছে কিনা, সেটা দেখা ও তাদের মান্যতা দেওয়া। ১০) স্কুল শিক্ষায় মেয়েদের জন্য ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া গ্রামীন বাচ্চাদের জন্য আলাদা ফান্ড থাকবে (এটা খুব ভাল উদ্যোগ)। ১১) হাতেকলমে পরীক্ষামূলক পড়াশোনার ওপর জোর দেওয়া হবে। সেকেন্ডারি স্কুলে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা আর্টস, কমার্স, সায়েন্স থেকে যেরকম খুশি বিষয় পছন্দ করতে পারবে। এবং ২০২৫-এর ভেতর ক্লাশ সিক্স থেকেই বাচ্চারা বৃত্তিমূলক শিক্ষা পেতে শুরু করবে। এর জন্য স্কুলগুলো স্থানীয় কল-কারখানা, ITI, কামার, কুমোর, তাঁতী, ছুতোর, রাজমিস্ত্রি ... এদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে ও স্কুলের বাচ্চাদের ১০-১২ দিনের জন্য সেখানে হাতেকলমে কাজ শিখতে পাঠাবে (যদিও ক্লাশ সিক্সের বাচ্চা কি বুঝবে, কি শিখবে আর কল-কারখানায় কতটা নিরাপদ থাকবে, সেই নিয়ে বেশ চিন্তার কারন আছে)। ১২) সবশেষে, স্কুল শিক্ষকদের উন্নয়নের জন্য ভাবনা চিন্তা। এই এত যে কর্মযজ্ঞ (বলা ভাল, দক্ষযজ্ঞ) হবে, তার জন্য শিক্ষকদের বিশেষভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হতে হবে। সে কারনে NCTE, NCERT ২০২২-এর ভেতর বলে দেবে কি রকম বি-এড বা অন্যান্য ট্রেনিং করতে হবে। ধরে রাখা যায়, ২০৩০ সালের ভেতর স্কুল শিক্ষক হতে গেলে চার বছরের বি-এড ডিগ্রি হবে ন্যূনতম যোগ্যতা।এবার ওপরে লেখা এই ১২ টা পয়েন্ট নিয়ে কাটা-ছেঁড়া। প্রথমেই বলে রাখি, এই সমালোচনা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত। শিক্ষাজগতের সঙ্গে দীর্ঘ ২২ বছর জুড়ে থাকা একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে। যা কোনভাবেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। এবং এটাও ঠিক, আমি মূলত একজন উচ্চশিক্ষাবিদ, একজন প্রযুক্তিবিদ। আমার বিশ্লেষণ স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে ভুল হতেই পারে।প্রথমেই বলি, ওপরের ১২ টা পয়েন্টের ১,৪,৭,৮,৯,১০,১২ নিয়ে আমি খুশি। এগুলো বাস্তবায়িত হলে সারা দেশে স্কুলশিক্ষায় একটা ভারসাম্য আসবে। যদিও ১ নম্বর পয়েন্ট নিয়ে আমি সন্দিহান। করোনার পর সারা দেশে এখন ৭০ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে। তাদের বাচ্চারা স্কুলে আসবে তো? অজস্র গ্রামে স্কুল বলতে বোঝায় গোয়ালের মত ছাদহীন দেয়ালহীন একটা ঘর। সেখানে পড়াশোনা করা যায় না। কোথাও শিক্ষক মাত্র একজন। কোথাও ছাত্র-ছাত্রী ১-২ জন। তারা পেটের ক্ষিদে নিয়ে স্কুলে আসে দুপুরের খাবারটা খেতে। তাও পায় না কারণ সেই খাবার হয়ত অর্ধেকদিন গ্রামে পৌঁছয় না। এত সুন্দর ১ নম্বর সিদ্ধান্তটা লেখার আগে এই কমিটি সেইসব কেস-স্টাডি করেছে তো? সেজন্যই আমার প্রথম আপত্তি ঐ কমিটি নিয়ে। কস্তুরিরঙ্গন একজন স্বনামধন্য প্রযুক্তিবিদ হতে পারেন, উচ্চশিক্ষায় ওনার মতামত খুব গুরুত্বপূর্ণ হতেই পারে, কিন্তু স্কুলশিক্ষায় উনি অথরিটি হতে পারেন না। এবং আমার মনে হয়েছে স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে এই কমিটি যথেষ্ট হোম-ওয়ার্ক করে নি। বাচ্চাদের সাইকোলজি নিয়ে সারা পৃথিবীর সেরা ব্যবস্থাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়ে দেখে নি। এজন্যই এই স্কুল কমিটির পুরোধা হিসেবে রাখা উচিৎ ছিল কয়েকজন বিদগ্ধ ও প্রবীণ হেডমাস্টারকে যারা স্কুলশিক্ষার পরিবেশেই সারাজীবন কাটিয়েছেন। এবং সামনে রাখা উচিৎ ছিল এই মুহুর্তে গোটা পৃথিবীতে যারা স্কুলশিক্ষায় এগিয়ে আছে, তাদের মডেল। এখন যে দশটা দেশ সারা পৃথিবীতে তাদের স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সমাদৃত, তারা হলঃ ১) আমেরিকা, ২) সুইজারল্যান্ড, ৩) ডেনমার্ক, ৪) ইংল্যান্ড, ৫) সুইডেন, ৬) ফিনল্যান্ড, ৭) নেদারল্যান্ড, ৮) সিঙ্গাপুর, ৯) কানাডা ও ১০) অস্ট্রেলিয়া। এবং এই সমস্ত দেশে বাচ্চাদের জন্য বাধ্যতামূলক স্কুলশিক্ষা শুরু হয় ন্যূনতম ৫ বছর বয়সে (কোথাও কোথাও ৬ বছরে, আবার সুইজারল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে তো ৭ বছর বয়সে)। বাচ্চাদের খেলাধূলো করার জন্য প্রি-স্কুল এই সমস্ত দেশেই আছে, কিন্তু সেগুলো হিসেবের মধ্যে ধরা হয় না এবং সেখানে যাওয়াও বাচ্চাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। কারণ এই সমস্ত দেশ মনে করে শিশুরা যেন তাদের শৈশব খেলাধূলোর মাধ্যমেই উপভোগ করে। এবং বর্তমান শারীরবিদ্যাও বলছে যে ৩ বছর বয়সের শিশুদের যাতে ব্রেনের কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট সম্পূর্ণ হয় - যার মধ্যে রয়েছে চিন্তা করা, নতুন কিছু শেখা বা ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করা, এবং এটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কারন এর ওপরেই ব্রেনের অন্যান্য অংশের বিকাশ নির্ভর করে - তার জন্য শিশুদের দরকার খেলাধূলো, বাবা-মায়ের আদর-ভালবাসা আর তার সামনে কোন রঙ্গিন ছবির বই থেকে পড়ে শোনানো। এগুলোর জন্য বাবা-মা-ই যথেষ্ট। অথচ ভারতের মত উন্নয়নশীল এক দেশে এই নতুন শিক্ষানীতিতে দেখছি এই সমস্ত ব্যাপার অগ্রাহ্য করে শিশুকে মাত্র ৩ বছর বয়সেই স্কুলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের জন্য বিশেষ স্কুলপাঠ্যের বন্দোবস্থ করা হচ্ছে। আমার তো মনে হচ্ছে, সারা দেশে এখন প্রতিযোগিতা করে সমস্ত প্রাইভেট স্কুলগুলো যেভাবে নার্সারি থেকেই বাচ্চাদের নিতে শুরু করেছে লাখ লাখ টাকা ডোনেশনের মাধ্যমে, এটা প্রকারান্তরে সেই ব্যবস্থাকেই সিলমোহর দেওয়া। ফলে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এক অন্যায় অনৈতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করা হল এই নতুন শিক্ষানীতিতে, হয়ত কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপে। খুব খুশি হতাম যদি দেখতাম, যে কোন প্রাইভেট স্কুলে, যেখানে ১০ বা ১২ ক্লাশ অব্ধি পড়া যায়, এখন যেমন ঢাকঢোল পিটিয়ে তিন বছর বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চাদের শক্ত এক ইন্টারভিউ-এর মাধ্যমে (পড়ুন, সচ্ছল বাবা-মায়ের থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে) ভর্তি করা হয়, সেই প্রক্রিয়াকে এই শিক্ষানীতি বেআইনি ঘোষনা করছে। এবং ঘোষনা করছে এই সমস্ত স্কুল যদি পাঁচ বছর বয়সের আগে কোন বাচ্চাকে ভর্তি করে, তাহলে সেই স্কুলকে বাতিল করা হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, নতুন নীতিতে এর উল্টোটাই হল।এবার আসব ভাষাশিক্ষার কথায়। পৃথিবীতে যেহেতু ইংরাজি-কেই গ্লোবাল কমিউনিকেশনের ভাষা হিসেবে গন্য করা হয়, তাই নেদারল্যান্ড বা ফিনল্যান্ডের মত কট্টর মাতৃভাষার মত সমর্থক দেশও তাদের প্রাইমারি শিক্ষা ব্যবস্থায় একদম শুরুর ক্লাশ থেকেই ৭০% মাতৃভাষায় পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ৩০% ইংরাজি ভাষায় পড়ানোর মিশেল রেখেছে। অথচ ভারতে এই নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে ক্লাশ ফাইভ অব্ধি বাচ্চাদের শুধু মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষাতেই পড়ানো হবে, যাতে তারা পড়াশোনা সঠিকভাবে বুঝতে পারে! অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত। এর ফলে যারা উচ্চবিত্ত, স্কুলের বাইরেও ইংরাজির জন্য টিউটর রাখতে পারেন, তাদের বাচ্চারা কিন্তু কম বয়স থেকেই চোস্ত ইংরাজি শিখে যাবে। মার খাবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা, যাদের স্কুলের বাইরে ইংরাজি শেখার জন্য আলাদা টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই। ফলে একটা ক্লাশের ভেতরেই আরেকটা ‘এলিট ক্লাশ’ তৈরি হবে। অথচ খুব সহজভাবে এই শিক্ষানীতিতে ক্লাশ ওয়ান থেকেই নেদারল্যান্ড-এর মডেল অনুসরন করা যেত এবং ইংরাজী ও আরো একটা/দুটো বিষয় ইংরাজী মাধ্যমেই পড়ানো শুরু করা যেত (বাকীগুলো মাতৃভাষায় পড়ানো হোক)। এটা সবসময় মাথায় রাখা উচিৎ, কোন এক বাচ্চা খুব কম বয়সে যেভাবে একটা ভাষা আয়ত্ত করতে পারে, বয়স বেড়ে গেলে সেভাবে আর পারে না, এবং লিখতে পারলেও সে সেই ভাষায় কথা বলতে গিয়ে ভবিষ্যতে আড়ষ্টতা অনুভব করে। যে সমস্ত বাঙালি ছেলেমেয়েরা ক্লাশ ফোর অব্ধি বাংলায় সবকিছু পড়ে এসে ফাইভ থেকে ইংরাজি শিখেছে, তাদের জিজ্ঞেস করুন আমি ঠিক বলছি না ভুল। তবে হ্যাঁ, আমি ছোট থেকেই বাচ্চাদের তিনটে ভাষা শেখানোর বিরুদ্ধে। আমার মতে মাতৃভাষা ও ইংরাজি যথেষ্ট। এবং সংস্কৃত ভাষার ওপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হয়েই বলছি, সংস্কৃত-পালি-প্রাকৃত-পার্সি এইসব মৃত ভাষা স্কুলজীবনের শুরু থেকে জোর করে না শিখিয়ে বাচ্চাদের ছোট থেকে শেখান উচিৎ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধিত প্রাকৃতিক বিষয়। সূর্য পূর্বদিকে কেন ওঠে? ফুল সকালে কেন ফোটে? হাওয়া দিলে পাতা কেন নড়ে? আম গাছ থেকে নিচে কেন পড়ে? এইরকম ছোট ছোট সহজ ঘটনার ভেতর দিয়ে একজন বাচ্চা যখন বিজ্ঞান শেখে, সে কার্য আর কারণ বুঝতে শেখে। ফলে বড় হয়ে সে তার আশেপাশে ঘটে চলা ঘটনাগুলো নিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে। ভাল আর মন্দ বুঝতে শেখে। করোনা সংকটে কিছু না বুঝেই হাততালি দিয়ে আর কাঁসর বাজিয়ে পরেরদিন বাড়ি থেকে ভাড়াটে ডাক্তারকে বের করে দেয় না। মন্দিরে ইঁট গেঁথে আর ভজন গেয়ে করোনা দেশ ছেড়ে চলে গেল ভেবে নেয় না। রবি ঠাকুর খুব দুঃখ করেই বলেছিলেন যে ‘শিক্ষাকে আমরা বাহন করিলাম না, বহন করিয়া লইয়া চলিলাম’। খাঁটি কথা বলেছিলেন। ২০২০ সালে এসেও দেখছি সরকার সেই বহন আর বাহনের পার্থক্য এখনো বুঝে উঠতে অপারগ।১১ নম্বর পয়েন্ট নিয়ে আমার একটাই বক্তব্য। বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা ভোকেশনাল এডুকেশন বা ইন্টার্নশিপ বোঝার মত মানসিক পরিপক্কতা ক্লাশ সিক্সের বাচ্চার মধ্যে আসে না। বরং তাকে হাতেকলমে শিক্ষা দিতে কারখানায় নিয়ে যেতে প্রত্যেক বাবা মায়েরই আপত্তি থাকবে। এই ইন্টার্নশিপ বা কমিউনিটি সার্ভিস ব্যাপারটা ক্লাশ নাইন থেকেই আসা উচিৎ। সেক্ষেত্রে বাচ্চারা এটার প্রয়োজন বুঝতে পারবে ও মনোযোগ সহকারে করতেও পারবে। তবে এই পয়েন্টের কথা যখন উঠলই, আমি বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করতে চাই যে নতুন শিক্ষানীতিতে এই সরকার ঠিক কি উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়েছে? বাচ্চাদের প্রকৃত শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে নাকি তাদের বৃত্তিমূলক শিক্ষার ফাঁদে ফেলে যে কোন জীবিকার জন্য তৈরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে? দ্বিতীয়টাই যদি উদ্দেশ্য হয় (শিক্ষানীতি দেখে তো সেটাই মনে হচ্ছে), তাহলে এত কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে MHRD কে MoE করার কোন দরকার ছিল কি? হিউম্যান রিসোর্স বা মানব সম্পদ বা মানুষকে উপার্জনক্ষম বানিয়ে দেশের সম্পদ উৎপাদন, সেটাই যখন আসল উদ্দেশ্য। যাইহোক, এর পরের লেখায় আমরা এই জাতীয় শিক্ষানীতির উচ্চশিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করব।
(লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যক্ষ এবং আই-আই-টি গুয়াহাটির প্রাক্তন অধ্যাপক)