চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

সাঁওতাল বিদ্রোহ (৩য় কিস্তি)


সাঁওতাল বিদ্রোহ  (৩য় কিস্তি)


 🔸শিবানন্দ পাল

  ➡️ ১৫ জুলাই (১৮৫৫)  মুর্শিদাবাদের  ম্যাজিস্ট্রেট  হাতি ও ২০০ সেপাই নিয়ে মহেশপুরের অভিমুখে সাঁওতাল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। অভিযান চালান। মহেশপুরের দখল করেন তিনি। ১০০ জনের মতো বিদ্রোহী নিহত হয়। আহতের সংখ্যা অগণ্য। আহতদের মধ্যে সিধুও ছিলেন। ওদিকে বীরভুমের ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর অধীনস্ত সেনাদল নিয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়েছিলেন সাহেবগঞ্জের দিকে। সাহেবগঞ্জ পেরিয়ে পিয়ালাপুরের নিকটবর্তী পীরপৈঁইতির ময়দানে বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাঁর লড়াই হয়। লড়াইয়ে তিনি পিছু হটেন। সাঁওতালরা বিপুল উৎসাহে সিউরির দিকে ধাবমান হয়। ১৬ জুলাই (১৮৫৫) তিনি সরকারকে খবর পাঠান- রাজমহল থেকে ১০০০০ সাঁওতাল সিউরির দিকে যাচ্ছে- অবস্থা সংকটজনক।

২৪ জুলাই (১৮৫৫) ভোরবেলা মুর্শিদাবাদের ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ টগুড বারহেটের দিকে অভিযান করেন। তিনি সেখানে কানুর দলবলকে পরাজিত করে ভগনাডিহিতে প্রবেশ করেন। সিধু পালায়। টগুড ভগনাডিহি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। তাঁর বাড়ি থেকে বেশকিছু কাগজপত্র উদ্ধার হয়। ২৭ জুলাই (১৮৫৫) বৃন্দাবনী ও বাঁশকলিতে বিদ্রোহীদের কাছে কোম্পানির সেনাদল পরাজিত হয়। লেফটেন্যান্ট টৌলমিন বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়। ব্রিগেডিয়ার বার্ড বীরভূমের মহম্মদবাজারের অস্তিত্ব বিপন্ন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা পাঠান। দেওঘর ও দুমকাতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। দেওঘরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হরেন্দ্রকৃষ্ণ সাঁওতালদের ভয়ে রানীগঞ্জে পালিয়ে যান।
বিদ্রোহীরা রাজমহল ও ভাগলপুরের মধ্যে ডাক চলাচল বন্ধ করে দেয়। ভাগলপুরের সমস্ত ইংরেজ ভয় পেয়ে নৌকায় করে মাঝ গঙ্গায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। বিহারের
একাংশ, বাঁকুড়া, বীরভুম, মুর্শিদাবাদ নিয়ে সমগ্র অঞ্চলে সাঁওতালরা প্রাধান্য বিস্তার করে।সরকার‌ও বিদ্রোহ দমন করার চেষ্টা চালাতে থাকে নির্মমভাবে। দেশের ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সহযোগিতা চাওয়া হয়। ব্যারাকপুর ও দানাপুর থেকে সৈন্য নিয়ে আসা হয়। কলকাতা থেকে পুলিশ নিয়ে গিয়েও কাজে লাগানো হয়। মুর্শিদাবাদের নবাব ২৯ টি হাতি, বেশ কিছু ঘোড়া ও ১০০ জন সিপাই পাঠায়। শ্রীগোপাল পালচৌধুরী, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, সারদাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, রানী রাসমণি, প্রাণনাথ চৌধুরী, রমাপ্রসাদ রায়, মহারাজা শ্রীশচন্দ্র, বর্ধমানের মহারাজা, সত্যচরণ ঘোষাল প্রমুখ হাতি ও অন্যান্য সাহায্য পাঠায়। ইতিমধ্যে ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৫ হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ রেল চলাচল শুরু হয়। ওইদিন বর্ধমানে রেল চলাচল সূচনার মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গভর্নর জেনারেল ডালহৌসির উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও “on account of indisposition”-এর দোহাই দিয়ে তিনি রেল ভ্রমণে অংশ নেননি। হাওড়া স্টেশনে রেল যাত্রার উদ্দেশ্যে বিশপের প্রার্থনা সভায় উপস্থিত ছিলেন শুধু।

রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণ হওয়ায় ইংরেজদের পক্ষে দ্রুত রসদ ও সৈন্য নিয়ে আসা সম্ভব হয়।বিদ্রোহী নেতাদের গ্রেপ্তারের জন্যে ভাগলপুরের কমিশনার মোটা টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। বিদ্রোহ দমনে সরকার পক্ষে অমানুষিক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেওয়া হয়। জানা যায় ২৭ জুলাই থেকে ২ আগস্টের মধ্যে মেজর শাকবার্গ ৪০ টি সাঁওতালদের গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। (Judicial Pros. No. 159, 30-08-1855.)

১৮ আগস্ট (১৮৫৫) অন্য মতে ১৫ আগস্ট মিঃ বিডওয়েল বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে একটি পরওয়ানা জারি করেন। বিদ্রোহীরা ঘৃণার সাথে সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে। বীরভূমের কালেক্টর সম্ভবত রিভার থমসন অথবা রিচার্ডসন ২ অক্টোবর (১৮৫৫) তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, “When Santhals got the Proclamation they said they would rather be cut In pieces than give up” (Judicial Pros. No. 76, 4-10-1855.)।

১৯ আগস্ট (১৮৫৫) কয়েকজন সাঁওতাল বিশ্বাসঘাতকতা করে সিধুকে মেজর শাকবার্গের হাতে তুলে দেয়। ২৮ আগস্ট সিধুকে ভাগলপুর জেলে পাঠানো হয়। সিধুকে যে ধরিয়ে দেয়, বিশ্বাসঘাতক সেই মুনিয়া মাঝিকে সাঁওতালরা কানুর কাছে নিয়ে এসে হত্যা করে। সরকার তাঁর স্ত্রীকে মাসিক পাঁচ টাকার পেনশন মঞ্জুর করেছিল। সিধু ধরা পড়ার পরেও বিদ্রোহের গতি মন্থর হয়না।রিচার্ডসন ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, বিদ্রোহীরা সিউরির ১৫ মাইল উত্তরের গ্রামগুলিতে লুটতরাজ চালাচ্ছে।জামতাড়ার ১৭ টি গ্রাম বিদ্রোহীরা দখল করে নিয়েছে। দেওঘর ও সিউরির মধ্যে ডাক চলাচল বন্ধ। ২৫ সেপ্টেম্বর মিঃ ওয়ার্ড সরকারকে জানায়, সারা দেশে আগুন জ্বলছে। (The population has fled, panic struck and here we now are positively powerless.” (Judicial Pros. No. 76, 4-10-1855.)

পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করতে থাকে। এসব করেও বিদ্রোহীদের মনোবল ভাঙতে না পেরে সমগ্র দামিনকো এলাকা উপদ্রুত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। ১০ নভেম্বর (১৮৫৫) মার্শাল ল জারি করা হয়। বীরভুম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ নিয়ে প্রায় সমগ্র দামিনকো সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর অত্যাচারে সাঁওতাল গ্রামগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।সাঁওতালদের গবাদি পশু ও খাদ্যশস্য আটক রাখা হয়। জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ায় বিদ্রোহীদের লুকিয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সৈন্যরা সব সময় ওদের পিছু ধাওয়া করছিল। এসবের মধ্যে বিদ্রোহীদের মনোবল ভেঙ্গে যেতে শুরু করে। তাদের নুন ও মাটির পাত্রের অভাব দেখা দেয়। কাঁচা খাদ্য খেতে বাধ্য হওয়ায় তাদের মধ্যে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে তখন সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হয় তারা। জেলগুলো সাঁওতাল বন্দিতে ভরে যায়।জেলেও তাদের প্রতি নির্মম ব্যবহার চলতে থাকে। ১৫ নভেম্বর (১৮৫৫) বীরভূমের সিভিল সার্জেন সিউরি জেল সম্পর্কে রিপোর্ট দেয়,  বন্দি সাঁওতালদের অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় রাখা হয়েছে। তাদের পর্যাপ্ত খাদ্য দেওয়া হয়না, পোশাকের ব্যবস্থা অত্যন্ত নিম্নমানের।(the santhal Prisoners were allowed but one and two pice daily for their subsistence and many of them almost upto the present time and have lain all but naked upon the bare earthen floors. (Judicial Pros. No. 273, 27.12.1855.)

তখন শীতকাল। শীতের হাত থেকে সাঁওতালদের রক্ষা পাবার মতো শীত বস্ত্র দেওয়া হয়নি, খালি মেঝেতেই তাদের শুতে হয়। সার্জেনের লেখালেখির ফলে কতটা উন্নতি হয়েছিল তা অবশ্য জানা যায়না।
সব দিক থেকে যখন বিদ্রোহীরা বিপর্যস্ত, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে অপর দুই ভাই ও কয়েকজন সঙ্গী সহ বিদ্রোহীদের নেতা কানু হাজারিবাগের কাছাকাছি ধরা পড়ে।জারোয়ার সিং নামে এক ব্যক্তি তাঁকে ধরিয়ে দেয়। তাঁদের প্রথমে ওপরবাঁধে, তারপর রানীগঞ্জে, সেখান থেকে সিউরিতে চালান করা হয়।

১ ডিসেম্বর (১৮৫৫) চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে কানু ধরা পড়েছে। লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। যদিও এর পরেও সাঁওতালরা কিছুদিন বিক্ষিপ্ত আক্রমণ চালায়। সৈন্যবাহিনীর তৎপরতাও চলতে থাকে। বিদ্রোহী হোক আর না হোক সাঁওতাল দেখলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে চালান দেওয়া হচ্ছিল।

৪ ডিসেম্বর (১৮৫৫) ক্যাপ্টেন ফিলিপস কাজুরিয়া থেকে ১৫ মাইল দূরে জঙ্গল থেকে এরকম ২৫০ জন নিরস্ত্র সাঁওতালকে বন্দি করেন, তাঁদের সঙ্গে প্রায় ৪০০০ গবাদি পশু আটক করা হয়। ১৩ ডিসেম্বর (১৮৫৫) মেজর জেনারেল লয়েড অবশ্য সরকারকে জানায়
অবস্থা পুরপুরি আয়ত্তে, সেনাবাহিনীর আর প্রয়োজন নেই। সরকার অবশ্য তখনই সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে না।

বিদ্রোহী নেতা সিধুর বিচার শেষ করে ভাগলপুরের সেশন জজ সিধুর মামলা নিজামত আদালতে পাঠায়। নিজামত সিধুকে ফাঁসির আদেশ দেয়। এই সংবাদ ৫ ডিসেম্বর (১৮৫৫) ভাগলপুরের কমিশনারকে জানান হয়। প্রশাসন স্থির করে দারোগা মহেশ দত্তকে যেখানে হত্যা করা হয়, সেখানেই প্রকাশ্যে সিধুকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে।নির্দেশ ওই অঞ্চলে ভালো ভাবে প্রচার করা হয়। ডিসেম্বর মাসেই সিধুকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।নঞ কবে, কখন, কিভাবে এই দণ্ড কার্যকর হয়, বা কে কে উপস্থিত ছিল কোনও বিশদ নথি নেই।

ধরা পড়ার পর মহাজনদের অত্যাচার সম্পর্কে সিধু মিঃ ইডেনের কাছে বলেছিল, মহাজনরা এক টাকা ধার দিয়ে পাঁচ টাকা আদায় করে এবং যা খুশি দামে ফসল কেনে। দিতে না চাইলে তারা কান মুলে দেয়, মারধোর করে।ধরা পড়ার পর কানু ১ ডিসেম্বর, (১৮৫৫) ব্রিগেডিয়ার বার্ডের কাছে মহাজনদের বিষয়ে অভিযোগ করেছিল, ১ পয়সা দিয়ে তারা আমাদের কাছে ২০ পয়সা আদায় করে।
কানু-র জবানবন্দি হিসেবে যে নথি মিলেছে
তাতে এইরকম কথোপকথন ছিল, “মহাজনেরা বড় দারোগার কাছে অভিযোগ করেছিল যে সিধু ও কানু ডাকাতি করার জন্য টাকা জোগাড় করছে। মহাজনেরা দারোগাকে ১০০ টাকা দিয়েছিল তাঁকে ধরে আনার জন্য।দারোগা আগেই বাবুপাড়া  থেকে একজন বরকন্দাজকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল।
সে আমার লোকসংখ্যা গুণে নিলো এবং তাঁর হাতে একটা পরোয়ানা তুলে দিলাম এবং বললাম আমিই মহাজন। ঠাকুর এসেছিল।আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি। কিন্তু আপনারা গোলমাল করছেন কেন? দারোগা ওখানে দুদিন ছিল এবং তারপর চলে গেল।আমি তাঁকে খবর দিলাম কিন্তু তিনি মহাজনদের সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
আমি বললাম ‘আমি আপনাকে যে পরোয়ানা পাঠিয়েছি সেটার জন্য।‘
তিনি বললেন তিনি পরোয়ানাটা দেখেছেন এবং তিনি ভয়েই আসেন নি এবং মহাজনরা তাঁকে একটা পরোয়ানা দেখিয়েছে যাতে দারোগাকে এখানে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। এটাও তাঁকে বলা হয়েছে যে তাঁর সঙ্গে সৈন্য নিয়ে আসতে হবে নতুবা সাঁওতালরা তাঁর মাথা কেটে নেবে। তখন আমি বললাম আমি আপনাকে সেই পরোয়ানা পাঠাইনি। এটা মহাজনরাই ভাষা পালটে আপনাকে পাঠিয়েছে।
'তাহলে আপনি এসেছেন কেন?’
তিনি বললেন ‘আমি একটা সাপে কাটা মৃত্যুর তদন্ত করতে এসেছি।‘
তিনি তখন বললেন ‘তুমি ডাকাতি করার জন্য লোক জোগাড় করছো?’
আমি বললাম ‘প্রমাণ করুন যদি আমি চুরি বা ডাকাতি করে থাকি তাহলে আমাকে জেলে পুরে দিন।‘
মহাজনরা বলল, “যদি এক হাজার টাকাও খরচ হয় তবুও তোমাকে আমরা জেলে পুরবোই। মহাজনরা এবং দারোগা সবাই খুব খেপে গেল এবং আমাদের বেঁধে ফেলার নির্দেশ দিল। মহাজনরা আমার ভাই সিধোকে প্রথমে বাঁধতে শুরু করল। তখন আমি আমার তরোয়াল খুললাম এবং আমার ভাইয়ের দড়িগুলো কেটে ফেললাম। মানিক মুদির মাথা কেটে উড়িয়ে দিলাম। সিধো দারোগাকে কেটে ফেললো—আরও পাঁচজনকে মেরে ফেলল—ওদের নাম আমি জানি না। তারপর আমরা ভানডুয়াদির দিকে রওনা দিলাম।“
তারিখ ২০-১২-১৮৫৫, (সাঁওতাল বিদ্রোহের রোজনামচা- তারাপদ রায়, দে’জ পাবলিশিং, কোলকাতা, ২০০৬,পৃ, ১১)।

কানু ও তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, লুট-তরাজের মামলাটি চলছিল স্পেশাল কমিশনার এলিয়টের হাতে। কানুকে মৃত্যুদণ্ড, চাঁদ ও ভৈরবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডের নির্দেশে কানুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য তাঁকে কড়া পাহারায় ভগনাডিহিতে নিয়ে আসা হয়। সিধু-কানু যে বাড়িতে বিদ্রোহের সূচনা করেছিল সেখানেই ফাঁসিমঞ্চ তৈরি করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৮৫৬) বেলা ২ টো নাগাদ কানুকে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হয়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর দৃঢ়তা ও মানসিক প্রশান্তি সবাইকে অবাক করেছিল। ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তে কানু বলেছিল, ছ’বছরের মধ্যে আমি আবার আসব, আবার নতুন করে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেব।

ছ’বছর অপেক্ষা করতে হয়নি। ভারতের সিপাহীরা পরের বছরই ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা তুলে ধরেছিলেন। ৮ এপ্রিল, ১৮৫৭-র সকালে কোলকাতার ব্যারাকপুরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসি হয়। সিপাহী বিদ্রোহ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ স্বীকৃতি পেয়েছে। এই তথ্য বিতর্কিত হয়ে র‌ইলো।

সাঁওতালদের বিদ্রোহ ছিল অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রাম। সাঁওতালদের লড়াই ছিল অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সঙ্কল্প ছিল শোষণমুক্ত স্বাধীন এক রাজ্য প্রতিষ্ঠার। শুধু তীর ধনুক আর কুড়ুল তলোয়ার নিয়ে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ইংরেজবাহিনীর মুখোমুখি হবার ফলে যা হবার তাই হয়েছিল। সাঁওতাল মেয়েরাও এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিল। সিউরির জেলে শিশু সন্তান কোলে বহু সাঁওতাল রমণীকে আটক করা হয়েছিল। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালিরা এই বিদ্রোহ দমনে সরকারকে সাহায্য করলেও সমাজের নিম্নস্তরের গোয়ালা, তেলি,
লোহার, ভুমিহার, মুসলমান জোলা,
হাড়ি, বাউরি এবং অন্যান্যরা বিদ্রোহে সাঁওতালদের সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিল।বীরভূমের কালেক্টরের অভিযোগ ছিল,
মহম্মদবাজারের বাঙালিরা সাঁওতালদের নুন, তামাক ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করছে।

অনেকেই বলেছেন, বিদ্রোহ অসফল হওয়ার একটা গুরুতর কারণ, বিদ্রোহ শুরু হবার পর সাঁওতালদের একটা অংশে খুন ও লুণ্ঠনের নেশা পেয়ে বসেছিল। শুধু অত্যাচারীদের প্রতি তাঁদের আক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিলনা। নিরীহ লোকেরাও তাঁদের আক্রমণের শিকার হয়। মিঃ বিডওয়েল তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, “The first attack object of enmity, the Mahajons, the Police and the Railway, but when they had tasted the wild excitement of plunder and bloodshed, the distinction of persons was lost, and the Bengalee ryut who had done them no injury, his defenceless wife and children, the traveler and the beggar were sacrificed with equal barbarity to their inhuman revenge.” (Judicial Pros. No. 157, 14.3.1856)

উপরের মন্তব্যের সমর্থনে যথেষ্ট নথি বা প্রত্যক্ষ কোনও ঘটনার কথা জানা যায় না। যেকোনো কারণেই হোক বিদ্রোহীরা জনসমর্থন হারাতে শুরু করেছিল। বিদ্রোহ শুরুর পর বর্ষা নেমেছিল। বর্ষাকাল পাহাড়ে কঠিন সময়। পর্যাপ্ত রসদ থাকে না। বর্ষায় চাষ হয়, তিন মাস পর ফসল ওঠে। বিদ্রোহীদের রসদ সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়ে। আবার ঠাকুরের বিশ্বাস ইত্যাদি নেতাদের প্রতিশ্রুতিগুলোর অবাস্তবতা বিদ্রোহীদের সামনে প্রকট হয়েছিল, যা তাঁদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরায়। সিধুর কাছে লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়- “Two persons of Bhugaya are dead with balls. Mercy and justice of Thakurjee, how can (our) lives be protected. Send medicines, and you Thakurjee must come to. The Sahebs are fighting many battles. We are very dissatisfied….”(Judicial Pros. No. 79, 06.09.1855).  (চলবে)


 ছবি লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ-ভগনাডিহির প্রান্তরে যে বটগাছের নীচে সিধু-কানু বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিল। সেই গাছটাই কিনা বলা অসম্ভব। বটগাছ দেড়শো দু'শো বছর বাঁচে। তবে খুব পুরনো বটগাছ। সিধুর ভগনাডিহির বাড়ি থেকে গাছের দূরত্ব ১০০ মিটারের মধ্যে।

যে ব‌ইগুলির সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
১। সাঁওতাল বিদ্রোহের রোজনামচা- তারাপদ রায়, দে’জ পাবলিশিং, কোলকাতা, ২০০৬।
২। সান্থাল পরগণা, সান্থাল আর পাহারিয়াকোওইয়াঃক ইতিহাস-- চৈতন্য হেব্রাম কুমার। ৩। দি এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল- ডবলু ডবলু হান্টার। ৪। সানথাল পরগণা ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার- এল এস এস ও’মালী। ৫। গণ অসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ- স্বপন বসু, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৮৪। ৬। দি সান্থাল ইন্সারেক্সান অফ ১৮৫৫-৫৭---কে কে দত্ত। ৭।সাঁওতাল গণ-সংগ্রামের ইতিহাস-ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে, পার্ল পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮০। ৮। গণ অসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ- স্বপন বসু, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৮৪।

     
                                      পরবর্তী অংশ আগামী মঙ্গলবার