চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

ব্রেষ্ট ক্যান্সার সম্বন্ধে একটি সচেতনতা


                  Image courtesy : Meghan Smith

ব্রেষ্ট ক্যান্সার সম্বন্ধে একটি সচেতনতা


  🔸 ডাঃ এন. সি.মন্ডল


 ➡️ আজ যে রোগটি আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর এবং আতঙ্কের  তা হলো ক্যান্সার। বর্তমানে এই ক্যান্সার নামক রোগটি চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। যদিও আলোচ্য বিষয় ব্রেষ্ট বা স্তন ক্যান্সার তবুও ব্রেষ্ট  ক্যান্সারের আলোচনায় যাবার আগে ক্যান্সার সমন্ধে দু-চার কথা বলে নিচ্ছি। ক্যান্সার শব্দটি ভারতীয় নয়। এটি এসেছে ক্যানক্রাম (CANCRUM) নামক ল্যাটিন শব্দ থেকে। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস এর নামকরণ করেছিলেন  কার্কিনস  যার অর্থ হলো কাঁকড়া। ক্যান্সারকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় কার্সিনোমা(CARCINOMA)। কিন্তু কি এই ক্যান্সার? আমরা সবাই জানি যে আমাদের শরীর অসংখ্য কোষ দিয়ে তৈরি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির শরীরে কমবেশি ৬০ লক্ষ কোটি কোষ  থাকে এবং এই শরীরের বৃদ্ধি ঘটে স্বাভাবিক কোষ বিভাজনের ফলে  এবং এই স্বাভাবিক কোষ বিভাজনের  ঘটনা চলে সারাজীবন ধরে। কোষেদের এই ছন্দবদ্ধ এবং নিয়মমতো কার্যকলাপ শরীরকে সুস্থ রাখে। ক্যান্সার রোগে এই  স্বাভাবিক এবং ছন্দময় কোষ বিভাজনে অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হয় এবং শরীরের কোন কোন স্থানের কোষ অনিয়মিত এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলে এবং এই কোষগুলি আকার ও আয়তনের স্বাভাবিক কোষ থেকে আলাদা এবং অমর এবং এরা সুস্থ কোষগুলি কে ধ্বংস করে ফেলে। আর এই অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের ফলে কোষগুলি ক্রমে এক পিন্ডের আকারে সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা বলি আব বা টিউমার। এই টিউমার প্রধানত দুই ধরনের-- বিনাইন বা নির্দোষ এবং ম্যালিগন্যান্ট বা ক্ষতিকর। এরমধ্যে এই  ম্যালিগন্যান্টকেই  আমরা ক্যান্সার বলি। এই ম্যালিগন্যান্ট টিউমারগুলি শরীরের সুস্থ কোষ বা গ্রন্থিগুলিকে আক্রমণ করে। এই অমর ক্যান্সার কোষগুলি শরীরের অন্যান্য অংশে গিয়ে আবার নতুন নতুন টিউমারের সৃষ্টি করে এবং এর পরিণামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধ্বংস হয় এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের মৃত্যু ঘটে। আমাদের শরীরের যে কোন অংশে ক্যান্সার হতে পারে এবং এই ক্যান্সার যেকোনো বয়সেই হতে পারে এমনকি শিশু অবস্থাতেও। বর্তমানে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, সবজি, ফলমূলে  অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, ভেজাল খাবার পরিবেশ দূষণ এবং সর্বোপরি জিন ঘটিত বিভিন্ন কারণে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সামান্য কিছু রদবদল ঘটিয়ে অনেকাংশে আটকে দেওয়া সম্ভব এই মারণ রোগ ক্যান্সারকে।

       
             Image courtesy : Mount Nittany Health


এইবার আসছি ব্রেষ্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সার সম্বন্ধে একটি সচেতনতা মূলক আলোচনায়। ব্রেষ্ট বা স্তন যেমন একজন নারীবক্ষের সৌন্দর্যবর্ধন করে আবার অন্যদিকে সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ দান করে তাকে বাঁচিয়ে রাখে। মহিলাদের মধ্যে মারাত্মক ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে স্তন ক্যান্সার অন্যতম। সারা বিশ্বে এই স্তনক্যান্সারের স্থান দ্বিতীয়। ভারতবর্ষে প্রতি চার মিনিটে একজন মহিলার স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ছে এবং প্রতি ১৩ মিনিটে একজন করে মারা যাচ্ছে এই ক্যান্সারে। চিন্তা করুন কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। মহিলাদের লজ্জা ও সচেতনতার অভাবই এই স্তন ক্যান্সার বৃদ্ধির কারণ। মহিলাদের সচেতনতাই পারে স্তন ক্যান্সারের সংখ্যা কমাতে। এই সচেতনতার ব্যাপারে সরকারিভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের,  চিকিৎসকদের এবং বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে উদ্যোগী হতে হবে। বেশীরভাগ মহিলারাই অজ্ঞতার জন্য অথবা লজ্জার জন্য এই রোগকে  দীর্ঘদিন গোপন করে রাখে এবং চিকিৎসকদের কাছে এমন সময় এই রোগ ধরা পড়ে তখন হয়তো ক্যান্সারের বিষাক্ত ছোবলে এই রোগ অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে। ব্রেষ্ট বা স্তন ক্যান্সার ব্রেষ্ট কলা বা টিস্যুতে কোষগুলির অনিয়মিত এবং নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূতভাবে ক্ষতিকর বৃদ্ধি। ব্রেষ্ট বা স্তন এর কার্যকারিতা কে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।  একটি দুধ(BREAST MILK) নিঃসৃত করে একে বলা হয় লোবিউলস এবং অন্যটি দুধ বহন করে যাকে বলা হয় নালী বা  ডাক্ট। এই ডাক্ট এই ক্যান্সার বেশি দেখা যায় যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ডাক্টাল কার্সিনোমা(DUCTAL CARCINOMA )। তবে ডাক্ট ছাড়াও লোবিউলস এর মধ্যে ক্যান্সার হতে পারে। স্তন ক্যান্সার কেন হয় এক কথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ কিছু নির্দিষ্ট রিক্স ফ্যাক্টর কে (পরিবেশগত বা জিনগত) স্তন ক্যান্সারের জন্য দায়ী বলে অভিমত দিয়েছেন। স্তন ক্যান্সারে বেশি প্রবণতা থাকে ৪০-৫৫ বছর বয়সের মধ্যে তবে এর কম বা বেশী বয়সেও হতে পারে। স্তন ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণ হিসাবে দৈনিক খাদ্যাভাস ও জীবনযাত্রার মনের পরিবর্তনকে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। অত্যাধিক স্থূলতা বা মেদবাহুল্যের কারণ মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ায় বিশেষ করে ঋতুচক্র বন্ধ বা মেনোপজ এর পরে। প্রতিদিন এক ঘণ্টা হাঁটা এবং কম ক্যালোরি সুষম খাদ্য খেয়ে ওজনকে  নিয়ন্ত্রণে রাখার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান এবং অত্যাধিক মাত্রায় চর্বি জাতীয় খাদ্য, রেডমিট গ্রহণ স্তন ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ায়। যাদের ঋতুচক্র খুব কম বয়সে (১২বছরের নিচে শুরু) এবং যেসব মহিলাদের ঋতুচক্র দেরিতে(৫৫বছরের পরে )বন্ধ হয় তাদের স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে। সন্তানহীন মহিলাদের,  অবিবাহিতা মহিলাদের, বেশি বয়সে সন্তান ধারণ করলে (প্রথম সন্তান ৩০ বছরের পরে) এবং যেসব মায়েরা শিশুকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ায় না তাদের স্তন ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ে। গর্ভনিরোধক বড়ি বা ওরাল পিল,  হরমোন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা স্তন ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ায়, যদিও ওরাল পিল স্তন ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ায় কিনা সেই ব্যাপারে চিকিৎসকদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। যাদের পরিবারে এক বা একাধিক মহিলাদের (রক্ত সম্পর্কিত নিকট আত্মীয় )স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস রয়েছে (যেমন দিদিমা,মা, মাসি, পিসি, দিদি বা বোনের ) তাদের স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে জিন ঘটিত কারণে প্রায় দ্বিগুণ। এই প্রসঙ্গে জিনতত্ত্ব সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে নিই। জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স হল বংশগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাদি সম্পর্কিত বিজ্ঞান যেখানে পিতা-মাতা ও সন্তানদের পরস্পরকে নিয়ে বিগত প্রায় দুই শতাব্দী যাবৎ এর শিক্ষা এবং গবেষণা শুরু হয়েছে। অস্ট্রিয়ার গ্রেগর জোহান মেন্ডেল উদ্ভিদ বিজ্ঞানের মটর গাছ নিয়ে গবেষণার  শেষে ইংরাজীর ১৮৬০ সালে এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছান যে, ' কতকগুলি বৈশিষ্ট্য এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে স্থানান্তরিত হয় '। পিতা-মাতার কাছ থেকে আবার কোন কোন রোগ /ব্যাধি তাদের সন্তানদের দেহে প্রাপ্ত হয়। এই সমস্ত রোগকে বংশগত বা জেনেটিক ডিজিজ বলা হয়। পিতা-মাতার  জেনিস  বা বংশগতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক উপাদান সন্তানদের রোগের উৎপত্তিস্থল বলে মনে করা হয়। মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষের মধ্যস্থলে থাকে নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াস কোষের কার্যকারিতে  নিয়ন্ত্রণ করে। নিউক্লিয়াসকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মধ্যে অবস্থিত নিউক্লিওলাস। নিউক্লিওলাসের  মধ্যে থাকে ক্রোমোজোম। এই  ক্রোমোজোমকে পরিচালনা করা DNA নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ। ১৯১০ সালে মার্কিন বৈজ্ঞানিক থমাস মরগান বলেন যে,  ক্রোমোজোমে জেনিস অবস্থান করে এবং ক্রোমোজোম সহ জিনগুলি  সন্তানদের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। বৈজ্ঞানিকরা প্রমাণ করেন যে এগুলির নিউক্লিক অ্যাসিড অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বৈশিষ্ট্য,  বুদ্ধির-বিকাশ, শরীরের গঠন কে নিয়ন্ত্রণ করে। বিজ্ঞানীরা প্রমান করেছেন যে মানুষের শরীরে কোষে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার জিন আছে। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে স্তন ক্যান্সারের বংশগত কারণ হিসাবে ৭০টি খারাপ বা মিউটেটেড জিনকে  শনাক্ত করেছেন অর্থাৎ এই ৭০ টি  মিউটেটেড জিনের জন্যই মহিলাদের শরীরে স্তন ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়। এই খারাপ বা মিউটেটেড জিনগুলি শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। খাদ্যাভাস এবং জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তনে এই সুপ্ত জিনগুলি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে প্রকট হয়ে উঠলে এরা  স্তন ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।  বি আর সি এ ১(BReast CAncer 1) এবং বি আর সি এ ২ (BReast CAncer 2) নামক দুটি জিন বংশানুক্রমিক স্তন ক্যান্সারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকে। এই জিন দুটিকে টিউমার সাপ্রেশার জিন বলা হয়। টিউমার সাপ্রেসার জিনগুলি সক্রিয় থাকলেই কোষ সুস্থ থাকে। এই জিনগুলি কে কোষের প্রহরী বলা হয়। সুস্থ কোষের ক্যান্সার কোষে পরিবর্তিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে এই জিনগুলি বাধা দেয়। এই দুটি জিনের যেকোনো একটি বংশগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ থাকলে বা মিউটেশন ঘটলে জিনগুলি নিষ্ক্রিয় হয় এবং তখনই কোষগুলি ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হওয়ার পথে এগিয়ে চলে।


         Image courtesy : Virtual medical centre

আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে মার্কিন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলির কথা।  যিনি ২০১৩ সালের মে মাসে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে  দুটি ব্রেষ্ট কে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। বি আর সি এ জিন বহন করার জন্য এবং ভব্যিষতে ব্রেষ্ট ক্যান্সারের আশঙ্কা এড়াতে এবং সেই জায়গায় নিরাপদ কৃত্রিম ব্রেষ্ট  স্থাপন করিয়েছেন।  এর পশ্চাৎপটে রয়েছে তার মা এর ২০০৭ সালে ৫৬ বছর বয়সে ওভারিয়ান ক্যান্সারে মৃত্যু।  তিনি চোখের সামনে তার মায়ের ক্যান্সারের ভয়ঙ্কর মৃত্যু যন্ত্রণা দেখেছিলেন।  পরে ওভারিয়ান ক্যান্সার রুখতে তিনি জরায়ু,ওভারি, ফ্যালোপিয়ান টিউব অর্থাৎ যাবতীয় স্ত্রী জনন অঙ্গ বাদ দিয়েছেন।  কারণ ত্রুটিপূর্ণ বি আর সি এ ১ জিন থেকে ৮০-৮৫ শতাংশ ব্রেষ্ট ক্যান্সার এবং ৫০-৬০ শতাংশ  ওভারিয়ান ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে।
      ব্রেষ্ট বা স্তন ক্যান্সারের অতি সাধারণ লক্ষণ স্তনে কোনো শক্ত গাঁট, দলা, মাংসপিণ্ড বা লাম্প দেখা দেওয়া। সাধারণত প্রথম অবস্থায় এই লাম্পটি  কোন ব্যথা থাকে না আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যথাও থাকতে পারে। স্তনের চামড়ায় কোন গর্ত বা টোল পড়া এবং অমসৃণ ভাব থাকা। স্তন বৃন্ত বা নিপল স্তনের ভিতরে ঢুকে থাকা, স্তন বৃন্তের চামড়ায় শুষ্কতা, ফাটাভাব এবং স্তনের আকৃতির কোনো পরিবর্তন দেখা দেওয়া। স্তন বৃন্ত বা নিপল থেকে কোন অস্বাভাবিক পদার্থ (সেটা রক্ত মিশ্রিতও হতে পারে )ক্ষরিত হওয়া, বগলে কোন গ্ল্যান্ড ফোলা, গর্ভবতী নয় এমন ৪০ বছরের বেশী মহিলার স্তন বৃন্ত থেকে দুধ আসা। এই সকল লক্ষণ দেখা গেলে লজ্জা না করে অবিলম্বে উপযুক্ত কোন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা একান্ত উচিত। এই সব লক্ষণগুলি মহিলারা নিজেরাই নিজের স্তন পরীক্ষা(SELF BREAST EXAMINATION ) করে দেখে নিতে পারেন এবং স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন। এইবার মহিলারা কিভাবে নিজের স্তন পরীক্ষা করবেন সেই সম্বন্ধে একটু আলোচনা করছি।
    প্রতিবার ঋতুচক্রের ৭থেকে ১০ দিন পর অথবা মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে নিজেই  স্তন পরীক্ষা করতে পারেন এইভাবে:-
স্টেপ -১: আয়নার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ান। ডান হাত উপরে তুলে মাথার পিছনে রাখুন। বাঁ হাতের আঙুলগুলি একত্র করে ডান স্তনের প্রতিটি অংশে স্পর্শ করে দেখুন যে স্তনের মধ্যে বা স্তনের চামড়ার নিচে কোন গাঁট বা দলা পাকানো কিছু হাত দিয়ে অনুভব করা যাচ্ছে কিনা। একইভাবে বাঁ হাত উপরে তুলে ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে বাম স্তন পরীক্ষা করুন।
স্টেপ -২: আয়নার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুইটি হাত কে  সাইডে নামিয়ে দিন এবং আয়নায় লক্ষ্য করুন যে স্তনের আকৃতির  কোন পরিবর্তন, স্তনের চামড়ায় কোন টোল, গর্ত বা রংয়ের কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে কিনা, স্তনবৃন্ত বা নিপল হালকা করে চাপ দিয়ে দেখুন যে সেখান দিয়ে কোনো অস্বাভাবিক পদার্থ ক্ষরিত হচ্ছে কিনা বা স্তনবৃন্তে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিনা। একটা স্তনের সাথে অন্য স্তন মিলিয়ে দেখুন কোন অস্বাভাবিক কিছু লাগছে কিনা।
স্টেপ -৩: বিছানার উপর বা মেঝেতে শুয়ে পড়ুন। বাঁ হাতটা মাথার পিছনে রাখুন এবং বাঁ কাঁধের নিচে একটা বালিশ বা তোয়ালে রাখুন। ডান হাতের আঙ্গুলগুলি একসাথে করে হাতের তালুর সাহায্যে আস্তে আস্তে অথচ দৃঢ়ভাবে গোলাকার করে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডান স্তনের ভিতর এবং বাইরে চাপ দিয়ে অনুভব করুন যে ভিতরে  অস্বাভাবিক কিছু অথবা কোন গাঁট দলা বা  মাংসপিণ্ড অনুভব করতে পারছেন কিনা। এই পরীক্ষা বুক থেকে অর্থাৎ স্তনের শুরু থেকে আরম্ভ করে স্তনের অগ্রভাগ পর্যন্ত নিয়ে আসুন।
স্টেপ -৪: অনুরূপভাবে স্টেপ ৩ এর মত শুয়ে হাতের আঙ্গুলগুলি একত্র করে হাতের তালু দিয়ে গোলাকার ভাবে হাত ঘুরিয়ে বাম স্তন এবং বগলের মধ্যে এবং বগলের তলায় কিছু ফোলা, গাঁট বা দলা আছে কিনা অনুভব করুন।
     

                   Image courtesy : Dr. Andrew Kiu

এইভাবে মহিলারা নিজেরাই নিজেদের স্তন পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারেন যে স্তনের মধ্যে কোথাও কোন মাংসপিণ্ড বা লাম্প রয়েছে কিনা।  পরীক্ষার সময় সন্দেহজনক কিছু মনে হলে আপনার গৃহ চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিন এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।  স্তন ক্যান্সারের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ততটা আশাব্যঞ্জক নয় তবে যে যে কারণগুলি ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ায় যেগুলি আগে বলা হয়েছে সেই  কারণগুলি কে দূরে সরিয়ে রাখলে ব্রেষ্ট বা স্তন ক্যান্সারের আক্রমণের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।  তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় হলে উপযুক্ত চিকিৎসা সম্ভব।  তাই তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয়ের জন্য ২০ বছর বয়স থেকে নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করুন। ৪০ বছর বয়সের পর চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বছরে একবার করে ম্যামোগ্রাম করান।  ২০ বছর বয়স থেকে প্রতি ২/৩ বছর অন্তর আপনার গৃহ চিকিৎসক অথবা অভিজ্ঞ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা স্তনের ক্লিনিক্যাল এগজামিনেশন করান।  ক্লিনিক্যাল এগজামিনেশনের সাহায্যে চিকিৎসকরা ক্যান্সার সম্বন্ধে কিছুটা অনুমান করতে পারেন এবং প্রয়োজনে তিনি রোগ নির্ণয়ের জন্য কমবয়সীদের (৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত) HIGH RESOLUTION ULTRASOUND বা SONO MAMMOGRAM (এই পদ্ধতিতে শব্দ তরঙ্গ কে কাজে লাগিয়ে স্তনের লাম্প এর  চরিত্র জানা যায় সেটি শক্ত না তরল পদার্থে পূর্ণ), সাধারণত ৪০ বছর বয়স বা তার বেশি বয়সের মহিলাদের ম্যামোগ্রাফি(স্তনের এক বিশেষ ধরনের এক্সরে যার সাহায্যে স্তনের যেকোনো পরিবর্তনের ছবি পাওয়া যায়), এফ.এন.এ.সি( এই পদ্ধতিতে সরু সূচের সাহায্যে স্তনের লাম্প থেকে তরল পদার্থ বা ফ্লুইড বের করে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করা হয়) প্রভৃতি পরীক্ষা করিয়ে ক্যান্সার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারেন।
      খাদ্য উপাদান ক্যান্সার প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।  অতিরিক্ত চর্বি জাতীয়, অতিরিক্ত প্রোটিন জাতীয় খাদ্য, রেডমিট, জাঙ্কফুড,স্তন ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ায় সুতরাং এই সমস্ত খাদ্যকে বর্জন করে নিয়মিত শাক,সবজি, ফলমূল গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় লুকিয়ে আছে এরকম নানা খাদ্য উপাদান যাদের আমরা ক্যান্সার প্রতিহতকারী বা অ্যান্টিকার্সিনোজেন বলতে পারি।  শাকসবজি,ফলমূলে  প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট,  ভিটামিন, ফাইবার থাকে। এরা কার্সিনোজেন এর সক্রিয়তা কে কমিয়ে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এবং DNA কে সুরক্ষা দিয়ে জিনের মিউটেশন কে  আটকাতে সাহায্য করে।  সুতরাং খাওয়া-দাওয়ার উপর নজর রাখা উচিত।  খাদ্যাভাসের সামান্য পরিবর্তন করে ভিটামিনযুক্ত শাকসবজি প্রায় সব রকম ফল উচ্চতন্তুময় বা আঁশযুক্ত খাবার, তরিতরকারীর মধ্যে বাঁধাকপি, ফুলকপি,টম্যাটো,পেয়ারা, আঙ্গুর, আপেল,  আমলকি ইত্যাদি ক্যান্সার হবার প্রবণতা কে বহুগুণে কমিয়ে দেয়।  হায়দ্রাবাদের  ন্যাশানাল ইনস্টিটিউট অফ নিউট্রেশনের  বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন হলুদ ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।  আদা, রসুন, চা(গ্রীন টি ), মধু ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে বলেও বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। ক্যান্সারের চিকিৎসায় নিম, তুলসি,নয়নতারা, অশ্বগন্ধা প্রভৃতি ভেষজ নিয়েও গবেষণা চলছে এবং এও দেখা যাচ্ছে এইসব ভেষজ ঔষধ ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কার্যকারী ভূমিকা গ্রহণ করছে।  ক্যান্সারের গবেষণায় পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞানীরা নিযুক্ত কিন্তু আজও মানুষের ক্যান্সার সম্পর্কে একটা ভীতি  রয়ে গেছে।  সরকার ক্যান্সার রোগীদের জন্য প্রচুর সুবিধা দিয়েছেন।  অতীতের তুলনায় আজ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা অনেক বেশি উপকৃত বা অনেক ক্ষেত্রে সুস্থ, সুন্দর জীবন যাপনে ব্যস্ত। আমরা কামনা করব ভবিষ্যতে সবাই যেন হাসিমুখেই  সুন্দর জীবন যাপনে ব্যস্ত থাকেন।