চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

সম্প্রীতি ও স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণ দিবস পেরিয়ে একটি আলোচনা


সম্প্রীতি ও স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণ দিবস পেরিয়ে 
একটি আলোচনা


  🔸 শিবানন্দ পাল

 ➡️ বিবেকানন্দ তাঁর একজন মুসলমান অনুরাগীকে পত্রে লিখেছিলেন―
"For our own motherland a junction of the two great systems, Hinduism and Islam — Vedanta brain and Islam body — is the only hope. I see in my mind's eye the future perfect India rising out of this chaos and strife, glorious and invincible , with Vedanta brain and Islam body. I see in my mind's eye the future perfect India rising out of this chaos and strife, glorious and invincible , with Vedanta brain and Islam body." (Written to Mohammed Sarfaraz Husain of Naini Tal, later compiled in The Complete Works of Swami Vivekananda by Swami Vivekananda Volume 6, epistles, second series).

আমাদের মাতৃভূমি দুটি মহান ব্যবস্থার মিলনক্ষেত্র—হিন্দুত্ব এবং ইসলাম। একমাত্র আশা যদি এর মস্তিষ্কটি বেদান্ত হয়ে ওঠে দেহটি ইসলাম। আমি মানস চক্ষে দেখি এই বিশৃঙ্খলা এবং সংঘাতে থেকেই একদিন আদর্শ ভারতের জন্ম হবে, গৌরবময় এবং অপরাজিত; যার মস্তিষ্কটি হবে বেদান্ত আর দেহটি হবে ইসলাম।

বিবেকানন্দ অনুভব করেছিলেন ইসলামের অনন্য এবং মহান বৈশিষ্ট—সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব। তিনি চেয়েছিলেন এই গুণটি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সঞ্চারিত হোক। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শুদ্র, ইত্যাদি জাতপাত এবং অস্পৃশ্যতা দূরে সরিয়ে আধুনিক হিন্দুত্বের আবির্ভাব ঘটুক। আর তাই চেয়েছিলেন হিন্দু ধর্মের আশু সংস্কার। তাঁর ধারণা ছিল ইসলাম থেকে সাম্যের শিক্ষাটি গ্রহণ করলে হিন্দুত্ব বিপন্ন হবে না, বরং শক্তিশালী হবে।


বড় আগে তিনি চলে গিয়েছেন, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে। আরো চল্লিশ বছর তিনি যদি থাকতেন হয়তো কোনো দিশা দিয়ে যেতে পারতেন। আজ  আধুনিক বিশ্বের অবস্থানে প্রশ্ন জাগে ইসলামেও কি আদৌ সাম্য আছে?

স্বামীজির ইতিবাচক পর্যবেক্ষণ ইসলামের যে সমস্ত আকর গ্রন্থগুলি পাঠ করার ফলশ্রুতি। বর্তমান তথ্য বিপ্লবের যুগে, যখন ইন্টারনেট, ইউ-টিউব থেকে শুরু করে মত বিনিময় এবং পর্যবেক্ষণ যেখানে অনেক বেশি শক্তিশালী, স্বামীজীর সেই ইতিবাচক পর্যবেক্ষণগুলি কী বর্তমানে প্রাসঙ্গিক?

মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, অমানুষিক রক্তপাত তিনি দেখে যেতে পারেন নি। বেদান্তের সঙ্গে ইসলামের একটি সার্থক সমন্বয়ের স্বপ্নটি দেখেছেন আমরণ। উপলব্ধি করেছিলেন বেদ বেদান্ত যখন মূলত তাত্ত্বিক তথা দার্শনিক অনুসন্ধান বা আত্মজিজ্ঞাসা, ইসলাম সেখানে একটি যাপন রীতি, দৈনন্দিন জীবন—জন্ম থেকে মৃত্যু প্রতিটি মুহূর্ত এবং কাজকে নির্দিষ্ট অনুশাসনে বেঁধে রাখার অভূতপূর্ব আয়োজন।

একজন মুসলমান কি খাবেন বা খাবেন না, ঘুমোবেন, কিভাবে মল মূত্র ত্যাগ করবেন, এমনকি যৌন সম্পর্ক চলাকালীন কি কি করবেন বা করবেন না― সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট অনুশাসন আছে যা এই ধর্মটিকে ধরে রাখতে সহায়ক হয়েছে। তাই বেদান্তের মস্তিষ্ক আর ইসলামের শরীর দুইয়ের সমন্বয় যদি সম্ভব হয় তবে একটি সার্থক ভারতীয়তার জন্ম হতে পারে এমন আশা তিনি করেছিলেন। একটি ভেতর থেকে আমাদের মননকে নিয়ন্ত্রণ করবে, আর একটি বাহ্যিক অনুশাসন যা দেবে আমাদের শারীরিক শক্তি।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা নিশ্চয় ভুল হবে না, তিনি দেখেছেন ভারতীয় মুসলমানদের। যাঁরা অন্য দেশের মুসলমানদের চেয়ে আলাদা। তাঁর চোখে ধরা পড়েছে এদেশের মুসলমানের মধ্যে হিন্দু সংস্কৃতি তথা বেদ বেদান্তের প্রভাব আছে। এদেশের মুসলমানদের মধ্যে মুক্ত চিন্তার যথেষ্ট প্রভাব আছে। তাই বাইরে থেকে এদেশের মুসলমানদের না খেপালে তারা উন্মত্ত হয়ে ওঠেন না। স্বামীজির এই পর্যবেক্ষণটি মনে হয় সঠিক ছিল। হিন্দুত্বের সংস্পর্শে থাকা ভারতীয় মুসলমানরা মধ্য এশিয়ার আরব সংস্কৃতি থেকে অনেকটাই ভিন্ন এবং বিচ্ছিন্ন। তাই এই উপমহাদেশের মুসলমানেরা সঙ্গীত চর্চা করেন, চলচ্চিত্র তৈরি করেন, অভিনয় করেন, হিন্দু আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেন। যা গোঁড়া ইসলামে একেবারেই করা যায় না, হারাম বলে বিবেচিত। এই উদারতার ফলশ্রুতি হিসেবেই আমরাও মনে করি বিশ্বে সুফিবাদের জন্ম হয়েছে। বিবেকানন্দ তাঁর জীবদ্দশায় এই সুফিদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এও বলেছেন তাঁদের সাথে হিন্দুদের তেমন কোনো প্রভেদ নেই।

স্বামীজি তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতে আলোচনা করেছেন। বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাঁর যুগের বিস্তর ফারাক। এখন ভারতীয় মুসলমানদের উত্তেজিত করতে হলে বাইরের মুসলমানদের দরকার হয়না। তথ্য প্রযুক্তির দ্বারা সুদূর মধ্য এশিয়া থেকে ঘরে বসে এদেশের মুসলমানদের কাছে উত্তেজক বাণী পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। শারীরিকভাবে উপস্থিত হওয়ার দরকার পড়ে না। ইউরোপে সাম্প্রতিক উগ্র ইসলামের হানা এবং শরণার্থী সমস্যা ইত্যাদি তিনি দেখে যেতে পারেন নি। উপলব্ধি করতে পারেন নি তথ্য প্রযুক্তির আবহে ইসলামিক গোঁড়ামো তথা হিংস্রতা কতটা ছড়িয়ে পড়তে পারে। সংঘাত ক্রমশ বাড়ছে, বাড়ছে হিংস্রতা। কেবল ভারতেই নয়। সমগ্র বিশ্বে। লণ্ডন থেকে ফ্রান্স, স্পেন থেকে বেলজিয়াম, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। আধুনিক মননের সঙ্গে সংঘাত।

স্বামীজি কিন্তু একটা জায়গায় সঠিক। তিনি অনুভব করেছিলেন ইসলাম তথা মুসলমানকে বাদ দিয়ে ভারতভূমিকে কল্পনা করা যাবে না। তাই বলেছিলেন ইসলামকে বাদ দিয়ে বা ধ্বংস করে নয়, আত্তীকরণের মধ্যেই দেশকে উঠে দাঁড়াতে হবে। নৈনিতালবাসী মহম্মদ সরফরাজ হোসেনকে তিনি বার বার এই কথাটিই বলতে চেয়েছিলেন।

ইসলাম ধর্মের অনেক মানুষের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত আলোচনা, কথোপথন হত। অনেকের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। ইসলাম ধর্মের অনেক মানুষ তাঁকে চিঠি লিখতেন, প্রশ্ন করতেন। তিনি যত্ন করে তাঁদের উত্তর দিতেন। সরফরাজ হোসেনকে লেখা সেই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটির আর একটি অংশে তিনি লিখেছেন―

"We want to lead mankind to the place where there is neither the Vedas, nor the Bible, nor the Koran; yet this has to be done by harmonising the Vedas, the Bible and the Koran. Mankind ought to be taught that religions are but the varied expressions of THE RELIGION, which is Oneness, so that each may choose that path that suits him best."

প্রিয়,মানবজাতিকে এমন একটি ভুবনে নিয়ে যেতে চাই যেখানে কোনো বেদ, বাইবেল, কোরান কিছুই থাকবে না। আর এই লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে বেদ, বাইবেল এবং কোরান-এর একটি সার্থক সমন্বয়ের মাধ্যমে। মানুষকে শেখাতে হবে সব ধর্মগুলি আসলে সেই “মহান ধর্মটির” ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ যা কেবল একেশ্বরবাদকেই নির্দেশ করে , যাতে প্রতিটি মানুষ তাঁর  পক্ষে উপযুক্ত পথটি নির্বাচন করতে সক্ষম হয়।

সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের স্বপ্নটি লালন করলেও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ইসলাম এত সহজে হাত বাড়িয়ে দেবে না। তাই হিন্দুকেও ঐক্যবদ্ধ এবং সবল হতে হবে। আর অনুশাসন ছাড়া কখনও একাত্মবোধ আসেনা। আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষা তথা মনন মানুষকে যেমন অগ্রগামী করে, তেমনই একা এবং বিচ্ছিন্ন করে। আধুনিকতার অন্যতম ফলশ্রুতিই হল alienation, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শক্তি হল unification! এই ইউনিফিকেশন যতটা না শারীরিক, চাই তার শতগুণ মানসিক। তাই বিবেকানন্দের মত আধুনিক মননের মানুষটিকেও আজ পিছিয়ে যেতে হয়। তিনি কেবলই ছবি। রবিঠাকুরের মতো জন্ম এবং প্রয়াণ দিবসে একটু ধূপধুনো আর একটি বাসি রজনীগন্ধার মালায় শোভিত হোন।

তাঁর মৃত্যুর পর ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে টালাবাহনা চলে। শেষকৃত্য কোথায় হবে, কে করবেন, সেসব নিয়েই বিতর্ক হয়। সমাধি মন্দির কেন হবে সে প্রশ্ন উহ্য থাকে! রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ভগিনী নিবেদিতাকে সরে যেতে হয়।


কৃতজ্ঞতা : বিবেকানন্দের চোখে ইসলাম-দেবাশিস লাহা।
চতুরঙ্গ। ৪ জুন, ২০১৮