চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

লিভার ক্যান্সার" : সক্রিয় হোন প্রতিরোধে, মেনে চলুন কিছু বিধি নিষেধ

                Image courtesy : hopkinsmedicine.org


"লিভার ক্যান্সার" : সক্রিয় হোন প্রতিরোধে,
মেনে চলুন কিছু বিধি নিষেধ

  🔸 ডাঃ এন. সি. মন্ডল


  ➡️ মানবদেহের উদরের অভ্যন্তরে ডায়াফ্রাম বা মধ্যচ্ছদার ঠিক নিচে পাঁজরের হাড়ের পিছনে অর্থাৎ পেটের উপর দিকে ডানদিক এবং বাঁদিক জুড়ে অবস্থিত দিবারাত্র সক্রিয় সজীব রসায়নাগার বা রাসায়নিক কারখানা।  এই অতি প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির নাম লিভার।  এটা শরীরের সবথেকে বৃহৎ গ্রন্থি।  পুরুষদের ক্ষেত্রে এর ওজন ১ কেজি ৪০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ৬০০ গ্রাম এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ওজন ১ কেজি ২০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ৪০০ গ্রাম এর মত। লিভারের ডান দিকের অংশটা বেশ বড়।  লিভারে কোন অসুখ হলে লিভার বড় হয়ে পাঁজরের তলা ছাড়িয়ে নিচে নেমে আসে এবং এই অবস্থায় পেট টিপে পরীক্ষা করলে লিভারকে হাতে অনুভব করা যায়।  খাদ্যকে পরিপাক করা, খাদ্যবস্তু সঞ্চয় করা এবং তাকে প্রয়োজন অনুযায়ী রূপান্তরিত করা, রক্ত প্রস্তুত প্রক্রিয়া কে সক্রিয় রাখা, রক্ত তঞ্চন এর জন্য প্রয়োজনীয় তঞ্জক পদার্থ উৎপন্ন করা এবং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তু গ্রহণ করে অপ্রয়োজনীয় বিষাক্ত বস্তুসমূহ কে বিনষ্ট করে দেওয়া প্রভৃতি বিভিন্ন কাজই   লিভারের মাধ্যমে হয়। তাই লিভারকে সুস্থ রাখাটা খুবই জরুরি।  বর্তমান অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতি যুগেও কিন্তু পৃথিবীতে প্রতিবছর ১৫-২০ লক্ষ মানুষ কেবল লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে যা আজও আমাদের কাছে খুবই পীড়াদায়ক। অনেক রোগের কারণ জানা যায় না বা তার সঠিক প্রতিকারের উপায়ও জানা নেই।  কিন্তু সবথেকে বিস্ময় এবং দুঃখের বিষয় হল লিভার ক্যান্সার কেন হয় তার সম্ভাব্য কারণ জানা যায় এবং এর পরেও ক্রমবর্ধিত লিভার ক্যান্সার আমাদের কাছে ভীষণ বেদনাদায়ক। লিভার একদম স্বাভাবিক এবং কোনো গোলযোগ নেই এমন ব্যক্তির লিভার ক্যান্সার খুব একটা শোনা যায় না। তবে কোন ব্যক্তি যদি লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে তাহলে এটা নিশ্চিত তার কোন না কোন লিভারের রোগ ছিলই।  বর্তমানে কিন্তু লিভার ক্যান্সার বৃদ্ধির অগ্রগতিকে বিজ্ঞানীরা আধুনিক জীবনযাত্রার মান এবং খাদ্যাভাসের পরিবর্তনকেই দায়ী  বলে মত দিয়েছেন।  ফ্রিজে রাখা খাদ্য, ফাস্টফুড বা চটজলদি খাবার এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সংরক্ষিত করা খাবার গ্রহণের সাথে লিভার ক্যান্সারের যোগসূত্র আছে এমন প্রমাণ বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন।  ডায়াবেটিস এবং  স্তূলতা লিভারের সমস্যা তৈরি করতে পারে বিশেষ করে ফ্যাটি লিভার (সেটা নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজও  (NAFLD) হতে পারে)।  এই নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার বাড়তে বাড়তে ভবিষ্যতে লিভার সিরোসিস হয়ে লিভার ক্যান্সারের একটি বিপদ সম্ভাবনাময় কারণ হতে পারে।  কিছু ক্ষেত্রে লিভার ক্যান্সারের রিস্ক বাড়তে পারে যাদের হিউম্যান ইমিউনো ভাইরাস(HIV) সংক্রমণের ফলে প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে।  দূষিত বা পরজীবী সংক্রামিত হওয়া কাঁচা বা আধসিদ্ধ মাছ পিত্তনালী (Bile Duct) ক্যান্সারের  সহিত সম্পর্ক যুক্ত।   কিছু ক্ষেত্রে লিভার ক্যান্সার নির্দিষ্ট কিছু কার্সিনোজেনিক কেমিক্যালস বা  রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শের জন্য দায়ী - যেমন ইথাইল কার্বনেট বা ইউরেথেন যেটি ব্যবহৃত হয় কীটনাশক হিসাবে।  পলিভিনাইল ক্লোরাইড(PVC) যেটি ব্যবহার হয় প্লাস্টিক এবং পলিথিন শিল্পে। আবার ধূমপানের ধোঁয়ায় পলিভিনাইল ক্লোরাইড এবং ইউরেথেন থাকে (যা আমি ৩১ শে মে ২০২০ "তামাকের আবহে মৃত্যু" লেখায় উল্লেখ করেছি) যেটি ফুসফুস ক্যান্সার ছাড়াও লিভারে  টিউমার সৃষ্টি করে যা লিভার ক্যান্সারের একটি কারণ হিসেবে ধরা হয়।  আর্সেনিকের সংস্পর্শে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকলেও (আর্সেনিক এক্সপোজার) লিভার ক্যান্সার হতে পারে।  এই ধরনের লিভার ক্যান্সার কে বলা হয় হেপাটিক অ্যানজিওসারকোমা (Hepatic angiosarcoma)।  দীর্ঘদিন ধরে উচ্চশক্তিতে অ্যানাবলিক স্টেরয়েড গ্রহণ,  দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনকেও হেপাটিক অ্যানজিওসারকোমার একটি বাহ্যিক কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
লিভারের ভাল নাম হেপার।  লিভারে  যে কোষগুলি থাকে তাদের প্রধানত হেপাটোসাইটস বলা হয়।  লিভারের ক্যান্সার কে হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা বলা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়। প্রায় ৯০ শতাংশ লিভার ক্যান্সারই  হচ্ছে এই হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা।  বেশিরভাগ লিভার ক্যান্সারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে হেপাটিক বা লিভার টিউমার।  হেপাটোসাইটস বা লিভার কোষ থেকে উৎপন্ন ম্যালিগন্যান্ট বা মারণ টিউমারই  হচ্ছে লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ।  হেপাটাইটিস ভাইরাস বিশেষ করে "হেপাটাইটিস বি (HBV)" এবং "হেপাটাইটিস সি (HCV)" ভাইরাসের সংক্রমণ হলে এবং এই সংক্রমণ ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী হলে লিভার ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে।  পৃথিবীর অনেক অংশে বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এশিয়ায় লিভার ক্যান্সারের একটি প্রধান কারণ "হেপাটাইটিস বি" ভাইরাসের ক্রনিক সংক্রমণ।
   মানুষের আদি অকৃত্রিম শত্রু ধূমপান ও মদ্যপান।  আপনারা অনেকেই জানেন ধূমপান করলে ফুসফুসের  ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে এবং অতিরিক্ত মদ্যপান বা অ্যালকোহল তো লিভারের পক্ষে ক্ষতিকারক এবং সিরোসিস অব  লিভারের  একটি সম্ভাব্য কারণ ও ধরা যেতে পারে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে ১০ জন  সিরোসিস লিভারে আক্রান্তের মধ্যে ৩ থেকে ৪ জনেরই লিভার ক্যান্সার হয়।  পশ্চিমী দেশগুলিতে দীর্ঘদিন অ্যালকোহলের অতিরিক্ত ব্যবহারকে সিরোসিস অব লিভার এবং হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমার প্রধান কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।  পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতিদিন ৮০ গ্রামের বেশি ইথানল এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে৫০ গ্রামের বেশি ইথানল দীর্ঘদিন ধরে পান করলে লিভারের কোষের ক্ষতি করে সিরোসিস অব লিভার হয় যা লিভার ক্যান্সার বা হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমার  একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।  অবশ্য এটা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে।
 

                    Image courtesy : news-medical.net



লিভার সিরোসিসের বৃদ্ধি বিশেষত পুরুষানুক্রমে পাওয়া জেনেটিক ডিজিজ এর সহিত যুক্ত হয়ে যেমন আলফা ওয়ান অ্যান্টিট্রিপসিন এনজাইমের ঘাটতি অথবা

হিমোক্রোমাটোসিস (লিভারে আয়রনের অতিরিক্ত সঞ্চয়) এর ফলেও লিভার ক্যান্সার বা হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা হতে পারে। আগে লিভার ক্যান্সার একবারেই হতো না একথা ভাববেন না। হয়তো হতো কিন্তু তখন তো এত আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল না তাই হয়তো ধরা পড়তো না। জন্ডিস (ন্যাবা) হয়ে অথবা পেটে জল জমে (উদরী) মৃত্যু হয়েছে এমন তো আমরা আগেও শুনতে পেতাম কিন্তু এই রোগের কারণ যে লিভার ক্যান্সার তা হয়তো জানা যেত না। সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রেও লিভার ক্যান্সার হতে পারে এমন ধারণা পূর্বে করা যেত না কিন্তু বর্তমানে সমীক্ষায় জানা গেছে যে মাত্র তিন বছরের শিশুরও লিভার ক্যান্সার হয়েছে। এই ধরনের ক্যান্সার এর নাম হেপাটোব্লাসটোমা। যদিও এটি একটি অত্যন্ত বিরলতম ক্যান্সার। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৪ শতাংশ হেপাটোব্লাসটোমা দেখা যায় জন্মের সময়, ৬৮ শতাংশ দেখা যায় জন্মের ২ বছরের মধ্যে, ৯০ শতাংশ দেখা যায় ৫ বছর বয়সের মধ্যে এবং মাত্র ৩ শতাংশ দেখা যায় ১৫ বছর বয়সের বেশি রোগীর ক্ষেত্রে। ভিজে,অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় খাবার দীর্ঘদিন সঞ্চিত রাখলে বিশেষ করে দীর্ঘদিনের গুদামজাত খাদ্যশস্যে অ্যাফলাটক্সিন বি ওয়ান (Aflatoxin B 1) নামে এক প্রকার ছত্রাক বা ফাংগাস তৈরি হয়। তা দীর্ঘদিন ধরে অস্বাস্থ্য পরিবেশে সঞ্চিত করে রাখা এমন সব খাবার খেলে ওই ফাংগাসের মাধ্যমে লিভার ক্যান্সারের সূত্রপাত হতে পারে। এই ভাবে লিভার সরাসরি নিজেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে যাকে বলা হয় প্রাইমারি লিভার ক্যান্সার। বেশিরভাগ বাকি ক্যান্সারের মধ্যে কোলাঙ্গিওকার্সিনোমা (Cholangiocarcinoma) বা পিত্তনালী ক্যান্সার অন্যতম। যেটি উৎপন্ন হয় পিত্তনালী বা বাইল ডাক্টের মধ্যে। বাইল ডাক্ট হচ্ছে একটি নালী বা টিউব যেটি যোগাযোগ রয়েছে লিভার,গলব্লাডার বা পিত্তথলির সঙ্গে ক্ষুদ্রান্ত বা স্মল ইনটেশটাইনের। বাইল বা পিও তৈরি হয় লিভারে। লিভার প্রতিদিন ৬০০-১০০০ মিলি পিত্ত উৎপাদন করে। বাম হেপাটিক ডাক্ট এবং ডান হেপাটিক ডাক্ট নামক দুটি নালীর মাধ্যমে লিভারের দুটি লোব হইতে তৈরি হওয়া পিও কমন হেপাটিক ডাক্ট এর মাধ্যমে পিত্তথলিতে জমা হয়। লিভারের ভেতরে থাকে বলে এই নালী কে Intra Hepatic Duct বলা হয়। বাইল বা পিত্ত চর্বি জাতীয় খাদ্য হজম করতে সাহায্য করে। যখন কোন মানুষ চর্বিজাতীয় খাবার খায় তখন পিত্তথলিতে জমে থাকা পিও পিত্তনালী বা বাইল ডাক্টের মাধ্যমে ক্ষুদ্রান্তে এসে পড়ে। এই পিত্তনালী বা কমন বাইল ডাক্ট যেহেতু লিভারের বাইরে থাকে তাই একে বলা হয় Extra Hepatic Bile Duct। যখন লিভারের ভেতর ডাক্ট এর মধ্যে ক্যান্সার দেখা যায় তখন তাকে বলা হয় Intra Hepatic Cholangiocarcinoma. অনুরূপভাবে যখন এটি লিভারের বাইরে পিত্তনালী বা বাইল ডাক্টের মধ্যে হয় তখন তাকে বলা হয় Extra Hepatic Cholangiocarcinoma. যেহেতু লিভার এর মাধ্যমে খুব বেশি রক্ত চলাচল হয় এবং সেই কারণে এটা খুবই স্বাভাবিক শরীরের অন্যান্য অঙ্গের যেমন কিডনি, পাকস্থলী, পিত্তথলি (দীর্ঘদিন ধরে পিত্তথলির বা পিত্তনালী তে স্টোন বা পাথর থাকলে তার থেকেও পিত্তথলির ক্যান্সার হতে পারে), অগ্নাশয় বা প্যাংক্রিয়াস, খাদ্যনালী, ফুসফুস, স্তন, কোলন ইত্যাদিতে ক্যান্সার হলেও পরবর্তীকালে সংক্রামিত আকারে লিভারে ছড়িয়ে পড়ে লিভার ক্যান্সার হতে পারে, যাকে বলা হয় সেকেন্ডারি বা মেটাস্টেটিক লিভার ক্যান্সার।



              Image courtesy : researchgate.net


লিভার ক্যান্সার সম্বন্ধে সাধারণভাবে রোগীর পক্ষে প্রথমেই কিছু বোঝা সম্ভব নয় কারণ বদহজম, অম্বল, পেটফাঁপা, পেটব্যাথা, খিদেকমে যাওয়া - অনেক সময় ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে দেখা দেয় এবং এইসব লক্ষণ ক্যান্সার ছাড়া অন্যান্য অনেক কারণেই হতে পারে। তাছাড়া পেটের গন্ডগোল, গ্যাস-অম্বল তো আমাদের মাঝে মধ্যেই হয়ে থাকে। এইসব লক্ষণ দীর্ঘদিন ধরে চলতে চলতে পরবর্তী সময়ে পেটের যন্ত্রণা, পেটে জল জমা, পেট ফুলে শক্ত হয়ে যাওয়া, পেট বড় হয়ে যাওয়া, অনিয়মিত জ্বর, অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্য হয়ে পড়া এবং উপসর্গ হিসেবে পায়খানার দ্বার দিয়ে রক্ত পড়া, রক্তবমি ইত্যাদি হতে থাকে।

      তবে সাধারণভাবে এইগুলি ক্যান্সারের লক্ষণ কিনা তা রোগীর পক্ষে বোঝা খুব অসম্ভব। কিন্তু বর্তমানে উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগে আজকাল ডাক্তারবাবুদের কাছে এই রোগ নির্ণয় করা খুবই সহজ। লিভার ক্যান্সারের মূল লক্ষণ হলো উপরের পেটের ডান দিকে খুব ব্যথা। এই ব্যথার ফলে পেট আস্তে আস্তে ফুলে উঠে। ওই জায়গায় হাত ছোঁয়ানো যায় না এবং ওই জায়গায় স্টেথোস্কোপ বসালে সোঁ সোঁ শব্দও শোনা যায়। অনেক সময় সুগারের মাত্রাও কমতে থাকে। খিদেও কমতে থাকে, সঙ্গে রোগীর ওজনও কমতে থাকে। জন্ডিসের লক্ষণ যেমন চর্ম ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, গাঢ় হলুদ প্রস্রাব দেখা দিতে পারে। অবসন্ন ভাব দেখা দেয়। তাই দীর্ঘদিন পেটের রোগে ভুগছে এমন রোগী আমাদের কাছে এলে প্রথমেই তার কাছ থেকে লিভার সম্পর্কিত বিস্তারিত কিছু ইতিহাস জানতে চাওয়া হয়। হাত দিয়ে পরীক্ষা করলে লিভারের সাম্প্রতিক অবস্থা কিছুটা বোঝা যায়। পরীক্ষার সময় যদি বড় নডিউল অনুভব করা যায় সে ক্ষেত্রে ক্যান্সার বলে সন্দেহ করা হয়। তখন রোগ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগীকে রক্ত পরীক্ষা যেমন লিভার ফাংশন টেস্ট যথা সিরাম বিলিরুবিন, সিরাম প্রোটিনস, বিভিন্ন লিভার এনজাইম যেমন অ্যাসপারটেট অ্যামাইনো ট্রান্সফারেজ বা এ.এস. টি, অ্যালানাইন অ্যামাইনো ট্রান্সফারেজ বা এ. এল. টি,অ্যালক্যালাইন ফসফাটেজ, গামা গ্লুটামিল ট্রান্স পেপটাইডেস বা জি. জি. টি ইত্যাদি করতে বলা হয়। যদিও এই ল্যাবরেটরী প্যারামিটারস কে হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমার স্পেসিফিক বলা যায় না। এই ক্ষেত্রে আলফা ফিটোপ্রোটিন (AFP) নামক একটি রক্ত পরীক্ষা লিভার ক্যান্সার নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে। এটি একটি ভ্রূণীয় প্রোটিন (Embryonic Protein)। তাই এক্ষেত্রে আলফা ফিটো প্রোটিনের মাত্রা নির্ণয় করার পরামর্শ দেওয়া হয়। আলফা ফিটোপ্রোটিন সাধারণত তৈরি হয় মাতৃগর্ভে থাকাকালীন শিশুর লিভার এবং কুসুম কোষে (Yolk Sac)। জন্মের পর AFP তৈরি স্বাভাবিক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আলফা ফিটোপ্রোটিনের মাত্রা ৫০০ ন্যানোগ্রাম প্রতি মিলিলিটারে এর বেশি থাকলে হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা হয়েছে ধরে নেওয়া হয়। রক্ত পরীক্ষা ছাড়াও পেটের এবং লিভারের আলট্রাসোনোগ্রাফি, কালার ডপলার, সিটিস্ক্যান, লিপিওডল সিটি, এম.আর.আই, পেট স্ক্যান (PET Scan) এবং সম্ভব হলে অ্যানজিওগ্রাফি করতে বলা হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে সন্দেহজনক অস্বাভাবিক লিভারের স্থানে আলট্রাসোনোগ্রাফি গাইডেড বা সিটি গাইডেড এফ.এন.এ.সি (এই ক্ষেত্রে ২২ গেজের সরু সূচ বা নিডল ঢুকিয়ে লিভার বায়োপসি) করার পরামর্শ দেয়া হয় বিশেষ করে আলফা ফিটোপ্রোটিন নেগেটিভ রোগীর ক্ষেত্রে। তবে যেখানে আলফা ফিটোপ্রোটিনের মাত্রা খুব বেশি থাকে এবং রোগীর লিভারে সার্জারি বা লিভার প্রতিস্থাপন করার চিন্তাভাবনা করা হয় সেই ক্ষেত্রে এই লিভার বায়োপসির পরামর্শ দেওয়া হয় না কারণ এতে অপারেশনের আগে টিউমার সেল ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। এতসব জটিল পরীক্ষা ছাড়াও পেটে জমা জল সরু সূচ দিয়ে (এফ.এন.এ.সি) বের করে নিয়ে পরীক্ষা করেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই রোগ সম্বন্ধে একটা নিশ্চিত ধারণা পাওয়া যায়।

      লিভারকে সুস্থ রাখতে হলে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। সুষম, পুষ্টিকর খাদ্য খেতে হবে। খাদ্য তালিকায় প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যুক্ত খাবার প্রয়োজন অনুযায়ী রাখতে হবে। অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার, ফাস্টফুড এবং দীর্ঘদিন ধরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সঞ্চিত করে রাখা খাদ্যকে বর্জন করতে হবে। তামাকজাত দ্রব্য যেমন বিড়ি, সিগারেট, জর্দ্দা দিয়ে পান, পান মশলা এবং অ্যালকোহল বা মদ্যপান কে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে খেতে হবে। ওজন বেশি থাকলে নিয়মিত শরীর চর্চা করে (প্রতিদিন ৪৫ মিনিট হাঁটা) তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ ছাড়া অযথা ওষুধ খাওয়া এবং অপ্রয়োজনীয় লিভার টনিক কিনে খাওয়ার কু অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। এমন কিছু ওষুধ আছে যা অন্য রোগের জন্য খেলেও লিভারের প্রভূত ক্ষতি করে, যাদের হেপাটোটক্সিক ড্রাগ বলা হয়। এইসব ওষুধ বাদ দিয়ে এমন ওষুধ নির্বাচন করতে হবে যাতে লিভারের ক্ষতি কম হয় এবং এই দায়িত্বটা নিজে না নিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসকের উপর ছেড়ে দেওয়াই সঠিক কাজ হবে। তাই কিছুটা বিধি-নিষেধ মেনে চললে ক্যানসারের সম্ভাবনা অনেকটাই এড়ানো যায়। "হেপাটাইটিস বি" ভাইরাসটি যেহেতু সিরোসিস লিভার এবং লিভার ক্যান্সারের অন্যতম কারণ সেইহেতু এই প্রতিষেধক টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা বা লিভার ক্যান্সার কমিয়ে আনার একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হিসেবে ধরা যেতে পারে।

    চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি যুগের লিভার ক্যান্সারের বেশ কিছু চিকিৎসা আছে। যেমন কোন অংশে টিউমার হলে ওই অংশটি সার্জারি করে কেটে বাদ দেওয়া এবং লিভার প্রতিস্থাপন বা ক্যান্সারে আক্রান্ত লিভার কেটে বাদ দিয়ে সুস্থ লিভার প্রতিস্থাপিত করা। বর্তমানে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতিটি আমাদের দেশে সাফল্যের সাথেই চালু রয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতিটি হল ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা বা কেমোথেরাপি। এর সাহায্যে রোগীকে ২-৪ বছর বাঁচিয়ে রাখা যায়। প্রাইমারি লিভার ক্যান্সারে রেডিও থেরাপি দেওয়া যায় না। তবে একথা বলা যায় যে, প্রাথমিক স্তরে ধরা না পরলে এইসব চিকিৎসা বিশেষ ফলদায়ক হয় না।

    পরিশেষে একটা কথা সবসময় মনে রাখা দরকার যে "প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর"। তাই আগেভাগে নিজের জন্য কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলুন। তাতে আপনার শরীরের রাসায়নিক কারখানা লিভার ভালো থাকবে আর দিব্যি হেসেখেলে আপনিও আর পাঁচজনের মতো সুস্থ জীবন যাপন করতে পারবেন।