চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

মানকরের করবাড়ির রথযাত্রা


মানকরের করবাড়ির রথযাত্রা 

  🔸 শিবানন্দ পাল 

 ➡️ এক সময় পল্লীবাংলার হস্তশিল্প এবং কুটিরশিল্পের মস্ত বাজার ছিল গ্রামের মেলাগুলি। বাংলায় বারো মাসে তেরো  পার্বণের অন্যতম এক পার্বণ ছিল রথের মেলা। মাহেশের রথের মেলা বিখ্যাত হয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনীতে। সাহিত্য সম্রাট রাধারানীকেও অমর রেখে গেছেন রথের মেলার সাথে।

কবিগুরু সেই রথের মেলাকে গেঁথেছেন ছন্দে কবিতায়।
‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রনাম।
পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’,
মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’-হাসে অন্তর্যামী।’

ভাবসম্প্রসারনের অবিস্মরণীয় ভাবের কথায় রথের মেলা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বর্ণ সম্প্রদায়ের কৌলীন্য কে যে বিশেষ আমল দেয়নি, আপামর জনসাধারনের অংশগ্রহনই তা প্রমান করে।

বৃষ্টি ভেজা বর্ষার গোধূলি বেলায় জগতের নাথ রথযাত্রা করবেন। রথের রশি স্পর্শ করে প্রজারা জল কাদায় হরি সংকীর্তনের ধুয়োয় লীন হবে। তবেই না ধন্য হবে বাংলার মানবজীবন! পুণ্য সঞ্চয়ের লোভ যেমন ঠিক তেমনি বৃষ্টি, জল কাদার আবহে কর্দমাক্ত পথে আছাড় খেয়েও অসন্তোষ বা ক্ষোভ প্রকাশ করবে না। এ মার নিঠুর দরদির।
প্রাণ গেলেও আত্মীয়রা মনে করেন স্বর্গবাস নিশ্চিত হল।

দুর্গাপুজোর বারোয়ারি হবার মধ্যে দিয়ে যেমন সাধারণ হবার একটা প্রবনতা লক্ষ্য করা যায় রথযাত্রার মধ্যে তার দরকার হয়নি। রথ প্রথম থেকেই বারোয়ারি।

রাজা ঝাড়ু মেরে পথ পরিষ্কার করবেন, সুতরাং সে ঝাড়ু সোনা বা রুপোর হতেই পারে। কিন্তু রাজা রথযাত্রার দিন সাধারনের মতো দেবতার সেবক। সাধারনের সঙ্গে তিনি ঝাড়ু দেবেন। রানিমা এয়োদের নিয়ে দেবতাকে বরণ করবেন শঙ্খ ঘণ্টা উলু ধ্বনিতে। তিনিও রাজ অন্তঃপুর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন পথে।

সমাজের নিম্নস্তরের অন্ত্যজরা রথের রশিতে হাত না লাগালে রথের চাকা গড়াবে কি করে? না! প্রথাকে কৌলীন্য হতেই হবে। শ্রীক্ষেত্র বহুদূর। তাতে কী হয়েছে? কুলীন গ্রামের কৌলীন্য কম নাকি? স্বয়ং চৈতন্য দেবের পদরেণুতে ধন্য ভিটে। কিন্তু বসু পরিবার রথের কৌলীন্যে এক নম্বরে যাবেন, তা কি করে হয়?
বর্ধমানের রাজা আছেন না?

রাজ পরিবার! শুধু রাজা কেন রানিরও একটা রথ থাকা উচিত। তাই সই।

বসবাসের জন্যে রাজা যে জায়গা পছন্দ করেন তার নামকরণ বৈকুন্ঠপুর অথবা কাঞ্চননগর না হওয়াটাই তো আশ্চর্যের!

রাজ অনুগ্রহে ইতিহাসকারকে তাই লিখতে হয় ভারী ভারী কথা।
“পূর্বে বর্দ্ধমানের সন্নিকটে উহার ন্যায় সুন্দর নগর আর ছিল না। দুই পার্শে সুদৃশ্য হরমাবলী পরিশোভিত সুপ্রসন্ন রাজপথ বিবিধ প্রকার পণ্য দ্রব্য পরিপুরিত বিপনিশ্রেনী, স্বর্ণকার, কাংসকার, কর্মকারগণ বিনির্মিত নয়ন-মন-মুগ্ধকর বিবিধ কারুকার্যপূর্ণ আপন সমুহ এবং স্থানে স্থানে নিত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যপূর্ণ হট্টাদিতে ক্রয় বিক্রয়ার্থে প্রতিনিয়ত বহু লোক সমাগমে, কোলাহলপূর্ণ কাঞ্চননগর যেন নিত্যই উৎসবময় বলিয়া অনুভূত হইত।”
“বর্দ্ধমান রাজবংশানুচরিত” সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত লেখক রাখালদাস মুখোপাধ্যায়।

তা সেই সুবর্ণভুমি কাঞ্চননগর ছেড়ে বর্ধমান ভুমিতে রাজবাড়ি তৈরির প্রয়োজন হল কেন? দামোদরের বন্যা, না ম্যালেরিয়ার জ্বর, বা কালা জ্বর! নাকি রাজরাজাদের রেলগাড়ি চাপবার সখ হয়েছিল? সেসব প্রশ্নের উত্তর দেবেন ইতিহাসের গবেষকরাই। কিন্তু পুঁথিতে বলে যে লাক্কুডি, লাখ টাকার দ্বীপ না লাক্ষা দ্বীপ।  সে নাকি সুবর্ণ --- চাঁদ সদাগরের আমলের? সে তো দামোদরের বানে ভেসে যায়নি?

বনিকশ্রেষ্ঠর নাতির ভুজনো না পুত্রের বিবাহে তৎকালীন বঙ্গের বনিক সম্প্রদায়ের কেষ্টবিষ্টুদের আগমনে ‘আদ্যের গঙ্গা’ দামোদরের এপারওপার নৌকাসজ্জাতেই ভরে গিয়েছিলো!

অবশ্য সব প্রশ্নের উত্তর পুঁথিতে নাই।

সে যাক রথের কথায় আসি।

রথের মেলা মানে তালপাতার বাঁশি, পাঁপড় ভাজা, বেলফুলের মালা, রাধারানীর হারিয়ে যাওয়া- বেশ একটা রোমাঞ্চ আছে। সুতরাং রাজবাড়ির শাখা প্রশাখায় রথ চালু হয় রানীগঞ্জের কাছে উখড়ায় হ্যান্ডে পরিবারে। হাতের কাছে সিয়ারশোল, বাদ যাবে কেন?

বর্ধমান রাজের বিশাল উঁচু কাঠের রথ, মালিয়াদের কোলিয়ারীর কাঁচা পয়সা– তৈরি হল পিতলের রথ। দিগনগরেও সম্প্রসারিত হল  রাজ মহিমা। রাজা কীর্তিচন্দের হাটকীর্তিনগর সেখানেও রথ। রথের সাথে ফাউ চাঁদনী পুকুর!

যত  দেব দেবীর প্রতিষ্ঠা হবে পুজা অর্চনায় রাজ মহিমা ছড়িয়ে পড়বে, হবে সাম্রাজ্যের বিস্তার। সম্পদের উপর একছত্র অধিকার কায়েম থাকবে। প্রত্যেক দেবতার পৃথক পৃথক রথ- কারোর লোহার, কারোর পিতলের, কারোর রুপোর।

কিন্তু সব রথ যদি একসাথে পাঁজি পুথি দেখে তিথি ক্ষণের সময় অনুযায়ী বেরোতে চায় তাহলে তো রাজার মুশকিল। রাজা ক’জায়গায় হাজির থাকবেন? তাই রাজইচ্ছা অনুযায়ী রাজবাড়ি সংলগ্ন লক্ষ্মীনারায়ণ জীউ-র রথ বের হবে সকালে। তাছাড়া এটি সম্পূর্ণ রাজবাড়ির গণ্ডির ভিতরে থাকায় সাধারনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে- বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

কিন্তু কাঞ্চননগরের রথ বের হবে বিকালে। খোলামেলা বিশাল প্রান্তর, বহু মানুষের সমাবেশ, তাই এই রথ বের হবে বিকালে।

রাজাও খুশি, প্রজাও খুশি।বাণিজ্য হবে, দুটো টাকা আসবে টাঁকে। যাকে বলে রথ দেখা, কলা বেচা। ফেল করি মাখ তেল, বাছা তুমি কি আমার পর?

সামাজিক গুণ-মান-প্রতিষ্ঠা অনুযায়ী ধনীদের রথও বের হল পথে। পৃথক পৃথক ধূম। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জমিদার, নব্য জমিদার, নব্য ধনীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা- সমাজে যারা কেষ্ট বিষ্টু হবার প্রত্যাশা রাখেন তাঁরাই বেশী উৎসাহী।

মানকরের কর বাড়িতেও লক্ষ্মী-জনার্দনের রথ বের হল।
পূর্বপুরুষদের গোলমরিচের বিশাল ব্যবসা ছিল। জাহাজ বোঝাই গোলমরিচ এদেশ থেকে ইংল্যান্ডে যায়। তৈরি হল পিতলের রথ।

রথের গায়ে লেখা মানকরের মিস্ত্রী জনৈক কেদার নাথ দে এই রথ তৈরি করেছিলেন কর বংশের মাধবচন্দ্র করের পৃষ্ঠপোষকতায়।

তিনি নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়ে রথযাত্রার প্রচলন করেছিলেন। রথের উচ্চতা ১০ ফুট। পিতলের ঘোড়া, পিতলের সারথি-গরুড় পাখি।
চুরি হয়ে যাবার ভয়ে এখন সবই খুলে রাখা হয়।

বাংলা সন ১৩১৮ সালের ১৩ আষাঢ় এই রথ চলতে শুরু করে। এই হিসেবে রথটির বয়স বর্তমানে ১০৭ বছর পূর্ণ হয়েছে।

করবাড়িতে রথে দড়ি পরাতে বর্তমান উত্তরসূরীদের প্রানান্তকর অবস্থা। লক্ষ্মীজনার্দনের মন্দির টিকিয়ে রাখা, নিত্য সেবা চালু রাখা- খুবই চাপ। এখন তো আর গোলমরিচের ব্যবসা নেই। নামেই তালপুকুর ঘটি ডোবে না।

মানকরের দক্ষিণ রাইপুরের গোস্বামীপাড়ার করবাড়ির এই রথযাত্রা অনুষ্ঠান কার্যত একসময় উৎসবের চেহারা নিত। জাতিধর্মনির্বিশেষে বহু মানুষ এই রথযাত্রায় সামিল হয় এখনো। প্রাচীন নিয়ম-রীতি মেনেই কর পরিবারের উত্তরসুরীরা যথাসাধ্য আয়োজন করে থাকেন।

গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দির ছেড়ে রথে আরোহণ করেন। তার আগে মন্দিরে স্নান পুজা-পাঠ চলে। রথের ওপরে পটের আকারে উপস্থিত থাকেন জগন্নাথ-বলরাম-শুভদ্রা। রথ এখন হাসপাতাল সংলগ্ন হাটতলা পর্যন্ত যায়। হাটতলায় একটি বেদী আছে, সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে।

প্রতীকী মাসির এই বাড়ি থেকে সেইদিনই রথ পুনরায় বাড়ি ফিরে আসে। উলটোরথের দিন একইভাবে রথ হাটতলা ঘুরে আসে।

বর্তমান প্রজন্মের অর্চনা এবং কপিল  কর জানালেন, রথের গায়ের অলঙ্কার চুরি হয়ে যায়। রথ আর আগের মতো ছেড়ে আসতে পারেন না। কোন রকম নিয়ম রক্ষা চলছে। আপ্রান চেষ্টা করে তাঁরা রথটি বাঁচিয়ে রেখেছেন। বাংলা ১৪১৯ সনে এই পরিবারের তিন ভাই শ্যামাপদ, হারাধন এবং তিমিরবরণ তাঁদের পিতা সত্যকিঙ্কর ও মাতা ঊষারানীর স্মৃতি রক্ষার্থে রথটি সংস্কার করিয়েছিলেন।

সেই মানকরের করবাড়িতে রথ উৎসব। রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধূম – না সে ধূম আর নেই। আর লকডাউনে? সে রথের রসিতে কী আজ টান পড়বে?

                      কৃতজ্ঞতা স্বীকার : কপিল কর এবং অর্চনা কর। 

                      চিত্র পরিচয় : করবাড়ির রথ।