চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

সাঁওতাল বিদ্রোহ : সেই ভগনাডিহির প্রান্তর আজ থাকছে নিস্তব্ধ


সাঁওতাল বিদ্রোহ : সেই ভগনাডিহির প্রান্তর 
আজ থাকছে নিস্তব্ধ

 🔸 শিবানন্দ পাল

 ➡️ হুল দিবসে ভগনাডিহিতে আজ কোনো অনুষ্ঠান হবে না। যেখান থেকে ১৮৫৫-র ৩০শে জুন, বিদ্রোহ (হুল) শুরু হয়েছিল, সেই ভগনাডিহির প্রান্তর আজ থাকছে নিস্তব্ধ। কোনো অনুষ্ঠান হবে না, থাকবে না কোনো আড়ম্বর। 

বন্ধুরা সবাই জানেন সাঁওতালদের বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিল দুই ভাই সিধু-কানু। অপর দুই ভাই চাঁদ এবং ভৈরব তাঁরাও সঙ্গে ছিল। বিদ্রোহ করার জন্য কোম্পানি সরকার তাঁদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। চার ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র সিধু ছিল বিবাহিত। তার বংশধররা আজও দামিনকো-র ভগনাডিহিতেই বাস করে।

পাঁচ বছর আগে গিয়েছিলাম সিধু-কানুর গ্রামে। সিধু-কানুর ভগনাডিহির বাড়িতে প্রবেশ করি। পরিচিত হ‌ই সিধু-র উত্তরসূরি পঞ্চম প্রজন্মের পুরুষ ভাদো-র সাথে। সিধু-কানুর মর্মর মূর্তির সামনে বসে ভাদো, তাঁর স্ত্রী এবং দুই পুত্রের সঙ্গে ছবি তুলি। ভাদোর সঙ্গে ঘুরে দেখি শক্তি স্থল। যেখানে মহেশ দারোগাকে বধ করেছিল বিদ্রোহীরা, যেখানে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় সিধুকে। দেখেছি ভগনাডিহির প্রান্তরকে, সেখানে সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে শুরু হয়েছে উদ্যোগ।


রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ... দামিন-ই-কো বলে কোনো জায়গা কেউ এখন খুঁজে পাবে না, জানতে পারবে না কেউ সাঁওতাল পরগণা কোথায় ছিল! ভগনাডিহির সেই প্রান্তর এখন ভাগ হচ্ছে। কোথাও রাজপথ তাকে টুকরো করছে, কোথাও অন্য সম্প্রদায়ের শেষকৃত্যের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট হচ্ছে।



যে বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে দুই ভাই স্থানীয় জমিদার, মহাজনী শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিল, সেই বটগাছ আজ আর নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ সেই ডাক পরবর্তীতে কোম্পানি শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধে গিয়েছিল, সেই ডাক বিদ্রোহীদের কলকাতা অভিমুখে যাত্রা মরীয়া করে তুলেছিল। আর তাই তাকে রুখে দেওয়ার নির্মম চেষ্টা হয়েছিল মাঝপথেই। মানবতাকে স্তব্ধ করে দেবার মতো সেই কাহিনি শুরু করবো আজ। কিন্তু একটা খারাপ খবর দিয়ে।



সিধুর বংশধররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবার (২০২০) হুল দিবসে তাঁরা আনন্দ করবেন না। তাঁদের ঘরে আজ শোকের আবহ। না লকডাউনের জন্য নয়।



গত ১২ জুন তাঁদের এক জ্ঞাতি ভাই রামেশ্বর মুর্মূ-র অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। রামেশ্বর সিধুর বংশের উত্তরসূরি ষষ্ঠ পুরুষ। এখনো তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদন সমাপ্ত হয়নি। সংস্কার মতে পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদন সমাপ্ত না হলে কোনও আনন্দ অনুষ্ঠান করা যায় না। সেজন্য পরিবারের পক্ষে মণ্ডল মুর্মূ সরকারি বেসরকারি সমস্ত উদ্যোগকে অনুষ্ঠান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন।

------------------------------------------



টম কাকার কুটির কালো মানুষদের কথা সারা বিশ্বে তুলে ধরেছিল। সেই কাহিনি তুলে ধরেছিলেন লেখিকা হ্যারিয়েট বেচার স্টো। আমাদের দেশের সাঁওতালদের কাহিনি তুলে ধরার জন্য কেউ ছিল না।



দেশে ছাপাখানা এসে গিয়েছিল। সংবাদ পত্র ছাপা শুরু হয়েছিল, ছাপা হয়েছিল অসংখ্য ব‌ইপত্র। কিন্তু সাঁওতালদের কাহিনি লিখবেন কে? ওরা তো ছোটলোক, ডাকাত! আজন্ম শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করিয়ে হত্যা করার পরিকল্পিত সেই কাহিনি। কোথাও কোনো প্রশ্ন থাকলে বন্ধুরা অবলীলায় করতে পারেন। নো প্রবলেম!

-------------------------------------------



উনিশ শতকে বাংলাদেশ বহু ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়ে চলেছিল। বাংলাদেশের এক শ্রেনির শিক্ষিত শহুরে রাজ অনুগ্রহলোভী বাবুসমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল, অন্যদিকে সমাজের নিচু তলার বিশাল একটা অংশের মানুষের মধ্যে চলেছিল অস্তিত্ব রক্ষার সংকট। অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। পরিবর্তে তারা পেয়েছিল লাঠি, গুলি, ফাঁসির সাজা। যেমন সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানুকে গুলি করে হত্যা করা হয়নি, তাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। (গুলিতে মৃত্যু যাঁরা বলেন, সঠিক বলেন না)।



সাঁওতাল বিদ্রোহে ইংরেজ রাজত্ব অবসানের কথা বলা হয়েছিল, ভদ্র বাঙালি সমাজ তা মানতে পারেনি। সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার কারণে সংঘটিত হয়নি, হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। সেজন্য দেখা গেছে ওই সময়ে বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়াজাত অন্যান্য বিক্ষোভ-অসন্তোষগুলো রাষ্ট্রশক্তি যেভাবে মোকাবিলা করেছে, সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রে তারা আরও নৃশংস নারকীয় ভূমিকা নিয়েছে। অথচ দেখা গেছে স্থানীয় জমিদার শোষকশ্রেণী অর্থ ও বাহুবল নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগিতা করেছে। ব্যতিক্রম ছিল নীল বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে কয়েকজন জমিদার ইংরেজ রাজশক্তিকে সহযোগিতা তো করেই নি, উপরন্তু বিদ্রোহীদের পরোক্ষে মদত দিয়েছিল। তাঁর কারণ, নীল বিদ্রোহ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিল না। জমিদাররাও চেয়েছিল নীলকর সাহেবদের উপযুক্তভাবে জব্দ করতে।



সাঁওতাল বিদ্রোহের ক্ষেত্রে জমিদার ও তাঁদের আমলাদের অত্যাচার, মহাজনদের অত্যাচার, রাষ্ট্রশক্তির অত্যাচারে ইন্ধন যুগিয়েছিল।

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইংরেজ শাসনের সূচনায় মোগল ভুমি রাজস্ব ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। চতুর ইংরেজ আর রেজা খাঁ মিলে বাংলাকে শোষণে জর্জরিত করে। তারপর আসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। দেশে এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়, অথচ সরকার নির্বিকার। ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার পাকা সিদ্ধান্ত হয় ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। ইংরেজের দাক্ষিণ্যপুষ্ট হঠাৎ-বাবুদের দলের সামনে লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরির সুযোগ আসে। তারা সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে। প্রাচীন জমিদার বংশগুলো একে একে ধ্বংস হয়। তৈরি হয় ইংরেজের তাঁবেদার একদল অসংখ্য নতুন ভুস্বামীশ্রেনি যারা আগের জমিদারদের জায়গা দখল করতে চাইল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এরা ষোলোআনা আগ্রহশীল, অথচ প্রজা স্বার্থে কিছুই করেনি! একেবারে উদাসীন। এদের সমস্ত শোষণের কেন্দ্রবিন্দু হয় বাংলার কৃষক সমাজ।



২৭.৫.১৮৪০ ‘দি ক্যালকাটা কুরিয়র’ নব্য জমিদারশ্রেনি সম্পর্কে মন্তব্য করে, 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্থের ফলে (বাংলার) কৃষকরা একটুও উপকৃত হয় নি, উপরন্তু এমন একদল লোকের হাতে তাদের তুলে দেওয়া হয়েছে-যাদের অত্যাচার ও নিপীড়নের কথা সারা ভারতে প্রবাদতুল্য।' ফলে চিরাচরিত জমিদার প্রজা সম্পর্কের ক্রম অবনতি ঘটতে থাকে। প্রজারা জমিদার এবং তাদের নায়েব-গোমস্তাদের ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করে।



জমিদারদের হরেকরকম খাঁই মেটানো কৃষকের পক্ষে অসম্ভব হওয়ায় সাহায্যের জন্য তারা হাত পাততে বাধ্য হয়। এই অবস্থায় তৈরি হয় একদল মহাজন। তারা সাগ্রহে এগিয়ে এসে ঋণ দেয় কৃষককে। কিন্তু পরের বছর ফসল উঠলে ঋণ ও সুদের দায়ে কৃষককে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য করে। ফলে জমিদারের প্রাপ্য আর মহাজনের ঋণ এবং সুদের খাঁই মিটিয়ে কৃষকের হাতে কিছুই থাকে না, সারা বছরের খোরাকিতে তার টান পড়ে। ঘুরেফিরে সেই মহাজনের দ্বারস্থ হতে হয় আবার কৃষককে। এইভাবে কয়েক বছর পর দেখা যায় মহাজন হয়েছে কৃষকের জমির মালিক, আর কৃষক হয়েছে সেই জমির ভাগচাষী। ব্রিটিশ আইনে সম্পত্তি ক্রোক ও জমি হস্তান্তরের সুযোগ নিয়ে কৃষকের সর্বনাশ এভাবেই গ্রাম বাংলাকে ধ্বংস করতে শুরু করে।



বীরভূমের মহাজনদের সুদের হার ছিল ৫০ শতাংশ। সাঁওতাল বিদ্রোহের শুরুটা ছিল মহাজনদের বিরুদ্ধে। দেখা গেছে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়লে বহু গ্রাম আক্রমণ করে সাঁওতালরা মহাজনদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু সাধারণ প্রজার কোন ক্ষতি করেনি।



দামিনকো-র মধ্যে কিছুদিন নআগেও সাঁওতাল পরগণা নামে আমরা যে জায়গাটা চিনতাম। আজ সেই সাঁওতাল পরগণা নেই। ভেঙ্গে ছ'টা জেলা করা হয়েছে। ১৮২৩-এ দামিনকো সরকারের সম্পত্তি ঘোষিত হয়। ১৮৩৬-এ সাঁওতালদের সেখানে বসবাসে উৎসাহ দেওয়ার জন্য একজন স্পেশাল অফিসার নিয়োগ করা হয়।



১৮৩৭-এ মিঃ পনেটকে এই পদে নিয়োগ করা হয়। সাঁওতালদের বলা হয় অপরিষ্কৃত জমির জন্য প্রথম তিন বছর তাদের কোনও খাজনা দিতে হবে না। পরের তিন বছর নামমাত্র খাজনা দিতে হবে। এরপর পাঁচ বছরের জন্য জমি লিজ দেওয়া হবে, মাঝিদের পঞ্চায়েত গ্রামের বার্ষিক খাজনা কতো হবে তা স্থির করে দেবে।



কিন্তু তারপর খাজনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলে। ১৮৩৭ থেকে ১৮৫৫, ১৮ বছরের মধ্যে ১০ গুণ খাজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি সাঁওতালদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। মিঃ পনেট খাজনা আদায়ের ভার দিয়েছিল স্থানীয় জমিদারদের নায়েব – সুজোয়ালদের। এরা খাজনা আদায়ের নামে জমিদারদের মতো সাঁওতালদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার করতো। নানা রকমের সেস আদায় করতো। সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক সিধুর অভিযোগ ছিল, নায়েব-সুজোয়ালরা প্রতি গ্রাম থেকে ৫ থেকে ১০ টাকা অতিরিক্ত সেলামী আদায় করে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কোনও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। দামিনকো-র ১২১৮ টি গ্রাম থেকে তারা অন্তত ৭৩০৮ টাকা বেআইনি সেস আদায় করেছিল।



সাঁওতালরা যখন জঙ্গল উচ্ছেদ করে পতিত জমি উদ্ধার করে তাকে শস্য শ্যামল করেছিল তখনই আশেপাশের জমিদারদের লুব্ধ দৃষ্টি পড়েছিল সেই জমির ওপর। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী মহাজনশ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছিল দামিনকোতে। আশেপাশের অঞ্চল থেকে তারা এসেছিল। দামিনকো-তে তারপর থানা, আদালত বসলো। এলো আমলা আর পুলিশের দল। এরা সবাই নিরীহ সাঁওতালদের শোষণ করবার সুযোগ খুঁজতে থাকল। মহাজনদের অত্যাচার সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল।



সাঁওতালদের সবথেকে সংকটের সময় ছিল বর্ষাকাল। এই সময় তারা কোনো কাজ করবার সুযোগ পেত না। তাদের কোনো উপার্জন ছিল না, তাদের কোনো সঞ্চয় ছিল না। এই সুযোগে মহাজনরা সাঁওতালদের কিছু টাকা বা শস্যকণা ঋণ দিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করতে লাগল। শুধু সুদ নয়, ওজনে ঠকানো (একবার বিশ বল বাবু!), নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে জাল খত তৈরি করা, প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া, এসব ছিল মহাজনদের নিত্যকর্মপদ্ধতি। 
                                                            (চলবে)