জরুরী অবস্থা
🔸 শিবানন্দ পাল
➡️ ২৫ জুন, ১৯৭৫ মধ্যরাত্রে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। আমি তখন বম্বেতে থাকতাম। সবে বম্বাইতে গিয়ে একটা কাজের সন্ধান করছি। হঠাৎ এরকম অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। গুজব ছড়িয়েছিল নানা রকম। বাঙালিদের নাকি ধরে ধরে পেটানো হচ্ছে। আমি যাদের সঙ্গে থাকতাম সবাই বাঙালি। একটি সোনার দোকানের কারিগর হিসেবে কাজ করছিলাম তখন। ডিজাইনের কাজ শিখছিলাম। দোকানের মালিক ছিলেন বাঙালি। দীর্ঘদিন সেখানে ব্যবসা করছিলেন। আমরা তাঁর আশ্রয়ে ছিলাম। হুগলির বেগমপুরে তাঁর বাড়ি ছিল।
২৬ জুন সকাল সাতটায় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত জানিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। 'ভারতের সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ' থেকে তাকে বাধা দেওয়ার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে 'গভীর ও ব্যাপক ষড়যন্ত্র' করা হচ্ছিল বলে তিনি দাবি করেছিলেন। 'বিদেশী হাত'-এর প্ররোচনায় তৈরি সমস্যা থেকে দেশকে রক্ষা করতে জরুরি অবস্থার মতো একটা 'তেতো বড়ি' দেশবাসীকে গেলাতে বাধ্য হয়েছেন― এরকমই কিছু বলেছিলেন। সকাল থেকেই আমাদের কাজকর্ম মাথায় উঠেছিল।
জরুরি অবস্থা কী জিনিস ধারণা ছিল না। যুদ্ধের সময় এরকম একটা ব্যাপার হয় শুনলাম তাও ধোঁয়া ধোঁয়া। খবরের কাগজের খোঁজ নিয়ে জানা গেল বের হয়নি। রাতেই অনেক নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার সঙ্গে অনেক কালোবাজারিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তখনকার দিনে বোম্বাইয়ের ডন ছিল হাজী মস্তান, শুনলাম সেও নাকি এরেস্ট হয়েছে। বেলা বাড়লে তখনও বাঙালীদের খেদানো শুরু হয়েছে জেনে খুবই অসহায় মনে হচ্ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে সি. পি. আই বাদে অন্য বিরোধী দলগুলির নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কথাবার্তায় জেনেছিলাম ইন্দিরা বিরোধী সকলকে রাতেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা রাজনীতিতে থাকি না, কিন্তু বাঙালি!
সকলেরই বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে। কেউ কেউ অবশ্য পাঁচ সাত বছর ধরে বোম্বাইতে কাজ করেছে। যারা পাঁচ সাত বছর ধরে বোম্বাইতে ছিল, তারা কলকাতায় ফেরার ব্যবস্থা করবার চেষ্টা করছিল। ওদের সাথে চার্চগেট নরিম্যান পয়েন্ট দৌড়াদৌড়ি করলাম কিন্তু সারাদিন চেষ্টা করেও রেল বা বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করা গেল না। তখন হাওড়া বোম্বাই সরাসরি চারটে মাত্র ট্রেন ছিল। দুটো নাগপুর দিয়ে, দুটো ভায়া এলাহাবাদ। বিমান যাত্রা ছিল একটাই। ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনস। এখনকার মতো অত ফ্লাইটও তখন ছিল না। সারাদিনে দু'চারটি উড়ান মাত্র। যদিও বিমানে সফর করার মতো অবস্থা ছিল না। কিন্তু প্রাণের ভয়টাই সবচেয়ে বড় হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিল।
১৯৭৫-এর ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরিয়েছিল। এই রায়ে জনতা (তৎকালীন) দলের রাজনারায়ণের আনা মামলায় ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। সেই রায়ে ৬ বছরের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে সংসদ রাজনীতি থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। শুধু তাই নয় বিচারপতি জগমোহনলাল সিংহ রায়বেরিলি লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হিসাবে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার পর্যন্ত খারিজ করে দিয়েছিলেন। আবার এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরোনোর দিন গুজরাট বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল বেরিয়েছিল, তাতে কংগ্রেস পরাজিত হয়েছিল। পরে দেখেছিলাম এলাহাবাদ হাইকোর্টের সেই বিচারপতির বাড়িটা। পানাগড় গ্রামে।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরোনোর পর সেসময়ের বিরোধী দলগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ২৫ জুন তাঁরা সারা দেশে এক সপ্তাহব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাবে এবং তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে যাবে।
কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ওই দিনটিকেই বেছে নিয়েছিলেন মানুষের অধিকারহরণের জন্য। নেতৃত্ব এবং ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তিনি এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে সব কাজের মধ্যে আতঙ্ক দেখছিলেন। এমনকি তাঁর খুব কাছের লোকদের বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। দলের মধ্যে একাধিপত্য তৈরি করতে মরীয়া হয়ে স্বৈরতান্ত্রিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করছিলেন। সেজন্য দেশের কল্যাণকামী কোনো নীতিগ্রহণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। যা কিছু করছিলেন তখন তিনি সবই তাঁর ব্যক্তি স্বার্থে এবং শ্রেণিস্বার্থে।
ক্রমশ ব্যাপারটা স্পষ্ট হল জরুরি অবস্থা মানে বিনা বিচারে যেকোনো ব্যক্তিকে যখন তখন জেলে পুরে দেওয়া। নতুন একটা আইন তৈরি হয়েছে মিসা অর্ডিন্যান্স। এ আইনে কোনো প্রশ্ন তোলা যেত না। বিনা বিচারে জেলের ঘানি টানতে হতো।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বিষয়টি খুব ভালো বোঝা গিয়েছিল। খবরের কাগজের পাতাগুলো এখানে ওখানে ফাঁকা থাকতো, বোঝা যেত ফাঁকা জায়গার সংবাদ সরকারের পছন্দ হয়নি, তাই বাদ গেছে। যাঁরা সংগঠন, জমায়েত, ধর্মঘট, বিক্ষোভ প্রতিবাদ আন্দোলন ইত্যাদি করতেন তাঁদের সেসব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ছাত্র, শ্রমিক, কর্মচারী, খেতমজুর, কৃষক, সাধারণ মানুষ, মহিলাদের কেউ কিছুই বলতে পারতেন না। মিশা, ডি. আই. আর এসব নানা রকম আর গ্রেপ্তার, তারসাথে জেলে পুলিশি অত্যাচারের ভয়। পশ্চিমবঙ্গে তার আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল পুলিশ-রাজ সেজন্য বোম্বাইতে সেটা নতুন কিছু মনে হয়নি। শুধু মার দাঙ্গার বিষয়টি ভয় সঞ্চার করেছিল। আচার্য বিনোবা ভাবে দেশের এই অবস্থানকে অনুমোদন করেছিলেন অনুশাসন পর্ব বলে।
পরের দিন সংবাদপত্রে কিছু নেতার ছবি ছাপা হয়েছিল যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৭-এ জুন ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ কবিতাটির ইংরাজি অনুবাদ (‘Where the mind is Without fear’) সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় ছাপানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। ‘দি টাইমস-লন্ডন, ২৭ জুন, ১৯৭৫ পত্রিকার খবরে জানা যায় জয়প্রকাশ নারায়ণ গ্রেফতার হয়েছেন। ঘোষণা করেছেন, ইন্দিরা গান্ধী ভারতে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন এবং জনসাধারণকে এজন্য তিনি সতর্ক হতে বলেন।
সন্ধ্যায় আমরা যেখানে থাকতাম সেই মহম্মদ আলী রোডে একটা টিভির দোকানে টিভিতে সংবাদ দেখছিলাম গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের ছবি দেখানো হচ্ছিল। তার মাঝে হঠাৎ দেখা যায় হাজী মস্তানের ছবি। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। উপস্থিত মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছিল, ওই গ্রেপ্তার ইন্দিরা গান্ধীর লৌহমানবী ভাবমূর্তি তৈরি করেছে।
সবমিলিয়ে দিনটা ছিল ভারতের ইতিহাসে একটা কালো দিন। পরে জানা যায় জরুরি অবস্থা জারি করার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে প্ররোচিত করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। তারপর দীর্ঘ একুশ মাস ধরে চলেছিল সেই কালো অধ্যায়। জরুরি অবস্থা এখন জারি নেই, তবে মনে হয় কী আমরা খুব ভালো আছি?