চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

খাবারে বিষ ! রোজ ঢুকছে শরীরে, কি ভাবে নিজেকে সুস্থ রাখবেন ?


বিষ ! রোজ ঢুকছে শরীরে, কি ভাবে 
নিজেকে সুস্থ রাখবেন ?

 ✳ ডাঃ এন.সি. মন্ডল

 ➡ বেঁচে থাকার জন্যই আমাদের খাবারের প্রয়োজন এবং খাবারই আমাদের শক্তি ও পুষ্টি যোগায়। সুতরাং পুষ্টির জন্যই আমরা খাবারের উপর নির্ভরশীল। সাধারণ মানুষ পেট ভরাবার এবং মুখের স্বাদের জন্য খাবার খান। তাঁরা খাদ্যের গুনাগুন বা পুষ্টির কথা খুব একটা চিন্তা করেন না। সেই খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে খাবারে বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম রং মেশানো হয় --- যার বেশীর ভাগই হচ্ছে নিষিদ্ধ বিষাক্ত রং।
   অর্গানোক্লোরাইড, অর্গানোফসফরাস, কার্বোফুরানের মতো কীটনাশক, সস্তার বিষ রং, সংরক্ষণে ব্যবহৃত রাসায়নিক বা প্রিজারভেটিভ দ্রব্য, যার মধ্যে মজুত থাকে পারা, সীসা এবং ফসফরাসের মতো বিষাক্ত মৌল যা ক্যান্সারের কারণ বা কার্সিনোজেনিক। কিছু হরমোন প্রচুর পরিমানে ব্যবহৃত হচ্ছে সবজি বা ফলজাতীয় খাদ্যকে তাজা দেখাতে এবং ফলন বাড়াতে। ফলকে পাকাতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড যা আমাদের কাছে কার্বাইড নামে পরিচিত। অথচ খাদ্য ভেজাল নিরোধক আইনে কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানো নিষিদ্ধ। এই ক্যালসিয়াম কার্বাইড বাতাসের সংস্পর্শে এলে এর থেকে এক ধরনের গ্যাস উৎপন্ন হয় যার নাম  অ্যাসিটিলিন এবং এই অ্যাসিটিলিন গ্যাসের উত্তাপে কাঁচা ফল তাড়াতাড়ি পেকে যায়। আম, কলা,  পেঁপে পাকাতে কার্বাইড বেশি ব্যবহৃত হয়। নিয়ম অনুযায়ী ফল পাকানোর কথা রাইপনিং চেম্বারে কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা অল্প খরচে এবং অল্প সময়ে ফল পাকানোর জন্য এই কার্বাইডকেই  হাতিয়ার করে। কার্বাইডে পাকানো ফল বেশী  দিন খেলে নার্ভ বা স্নায়ু তন্ত্রের অসুখ এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। কার্বাইড এর এই ক্ষতিকর প্রভাবের কারণেই বেশ কিছু দেশ কার্বাইডের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। সাধারণত খাবারের প্রতি জেল্লা আনতে,  খাবারকে টাটকা দেখাতে এবং সর্বোপরি খাবারকে মনোগ্রাহী করে তুলতে খাবারে নানা ধরনের রঙ মেশানো হয়, কারণ মানুষের মধ্যে রঙিন খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেড়েই চলেছে। রঙিন খাবার না হলে যেন মন ভরে না। খাবারে ব্যবহারের জন্য ভারত সরকার আটটি রংকে স্বীকৃতি বা ছাড়পত্র দিয়েছে। এই ব্যাপারে ১৯৫৪ সালের "দি প্রিভেনশন অব ফুড  অ্যাডালটারেশন অ্যাক্ট" নামক আইন তৈরি হয়েছে এবং ১৯৫৫ সালের ১লা জুন থেকে এই আইনটি কার্যকরী হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী যে আটটি রং কে ব্যবহার করার জন্য অনুমোদন করা হয়েছে তা হল----
১) লাল রংয়ের জন্য কারমোসিন(Carmosine) পনসিউ ফোর  আর(Ponceau 4 R), এরিথ্রোসিন(Erythrosine)।
২) নীল রংয়ের জন্য ইন্ডিগো কারমাইন(Indigo Carmine) এবং ব্রিলিয়ান্ট ব্লু এফ. সি. এফ (Brilliant blue FCF)।
৩) হলুদ রংয়ের  জন্য সানসেট ইয়োলো(Sunset Yellow), টারট্রাজিন (Tartarazine)।
৪) সবুজ রংয়ের জন্য ফাস্ট গ্রীন এফ সি এফ(Fast Green FCF)।
পরে আইন সংশোধন করে আরও তিনটি রং কে এই তালিকায় যুক্ত করা হয় যেমন-- লাল রঙের জন্য আমারান্থ(Amaranth),  ফার্স্ট রেড ই (Fast Red E)  এবং সবুজ রঙের জন্য উলগ্রীন বি এস (Wool Green Bs)। অনুমোদিত রং বলেই সেগুলি কিন্তু পুরো নিরাপদ নয় এবং যেমন খুশী  ব্যবহার করা যাবে না। কোন খাবারে কোন রং  সর্বোচ্চ কতটা পরিমাণ ব্যবহার করা যাবে তারও পরিষ্কার গাইডলাইন দেওয়া আছে এই আইনে। খাবারে ঠিকমতো রং মেশানো হচ্ছে কিনা বা কোন খাবারে কতটা রং মেশানো হয়েছে তা নির্ণয় করার জন্য দুটি প্রধান ল্যাবরেটরি বা  পরীক্ষাগারও  আছে। সে দুটি হলো কলকাতার সেন্ট্রাল ফুড ল্যাবরেটরি এবং মাইশোরের সেন্ট্রাল ফুড টেকনোলজিক্যাল  রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
     

উপরোক্ত অনুমোদিত রংগুলি ঠান্ডা পানীয়,  বিস্কুট,  আইসক্রিম,প্রেস্টি, কেক, লজেন্স ইত্যাদি খাবারে প্রতি কেজিতে মাত্র ১০০ মিলিগ্রাম এবং  স্কোয়াস, জ্যাম,  জেলি,সিন্থেটিক সিরাপের মতো খাবারে সবথেকে বেশী  প্রতি কেজিতে ২০০ মিলিগ্রাম নির্দিষ্ট করা আছে। এই পরিমাণ ছাড়ালে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের দেশে এই এগারোটি রং আইনগতভাবে  স্বীকৃত হলেও এর ক্ষতিকর প্রভাবের জন্যই পৃথিবীর অনেক দেশে এর অনেকগুলোই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। যেমন কারমোসিন -- আমেরিকা এবং কানাডায়, টারট্রাজিন -- নরওয়ে, আমেরিকা এবং ফিনল্যান্ডে, সানসেট ইয়েলো-- সুইডেন, নরওয়ে এবং ব্রিটেনে, পনসিউ ফোর আর -- আমেরিকা এবং কানাডায়।
    সরকারি স্বীকৃত অনুমোদিত কৃত্রিম রং  ছাড়াও বেশকিছু বিষাক্ত কৃত্রিম রং বিভিন্ন খাবারে এবং শাক-সবজিতে বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। রোজ নিজের অজান্তে কতটা রঙিন বিষ রং খাবারের সঙ্গে আমাদের শরীরে ঢুকছে  তার খোঁজ আমরা রাখিনা। অবশ্য একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে এত কিছু জানা সম্ভব নাও হতে পারে। এর প্রধান কারণ সচেতনতার অভাব।  এই ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।  এইবার কোন কোন কৃত্রিম ক্ষতিকারক বিষ রং খাবারে মেশানো হচ্ছে এবং তার বিষক্রিয়ায়  মানুষের কি ক্ষতি হতে পারে সেই প্রসঙ্গে একটু আলোচনায় আসছি।
    অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যদ্রব্যে হলুদ রং আনার জন্য আলকাতরা থেকে তৈরি মেটানিল ইয়েলো অর্থাৎ কিশোরী রং মেশান। কিশোরী রংয়ের কোন প্যাকেট যদি বাজার থেকে কেনা যায় দেখা যাবে তাতে পরিষ্কার করে লেখা আছে "শুধু শিল্পে ব্যবহারের জন্য"--- "মানুষের খাবার জন্য নয়"। অথচ এই রং ব্যবহার করা হচ্ছে মিহিদানা,  ছানার পোলাও, জিলিপি, লাড্ডু, সন্দেশ, বোঁদে, অমৃতি, ঘুগনি, আলুর দম, চপ, মোগলাই,  বিরিয়ানি,  পোলাও, তাজা দেখতে গোটা হলুদ,  ছোলার ডাল,  মুগ ডাল এবং অন্য অনেক কটকটে হলুদ রংয়ের খাবারে। এই কিশোরী রং বা মেটানিল ইয়েলোর  প্রভাবে পুরুষের শুক্রাশয় থেকে শুক্রাণু তৈরিতে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে এবং এই মেটানিল ইয়েলো পুরুষের সন্তান উৎপাদনে অক্ষমতার একটা বড় কারণ হতে পারে। আবার এই কিশোরী রং দেওয়া খাবার দীর্ঘদিন খেলে শ্বাসকষ্ট,  কিডনির অসুখ,  ক্যান্সার,  ক্রোমোজোমের পরিবর্তন এমনকি মেয়েদের ব্রেস্ট টিউমারও  হতে পারে। খাবারে লাল রং আনার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা নিষিদ্ধ কঙ্গো রেড এবং রোডামিন বি নামক  বিষাক্ত রং মেশান। এই রং মেশানো হয় সাধারণত জ্যাম,  জেলি,  টম্যাটো  সস,  শরবত (স্কোয়াস ),  আইসক্রিম, চকোলেট, বোঁদে, পানমশলা, করমচা (যা  দেখতে টকটকে লাল এবং বাজারে চেরি নামে বিক্রি হয় এবং মিষ্টিকে আকর্ষণীয় করার জন্য মিষ্টির উপরে এই নকল চেরির টুকরো দেওয়া হয়) এবং তাজা  দেখতে শুকনো লঙ্কা, রাঙা আলু, মাছের কানকোয়। রোডামিন বি বা  কঙ্গো রেড এর কারনে লিভার,  মূত্রাশয়,  মস্তিষ্ক,  প্লীহা,  শুক্রাশয়,  কিডনির  টিউমার এমনকি ক্যান্সার হওয়ারও  সম্ভাবনা থাকে। কমলা রং করতে অরেঞ্জ ওয়ান, টু নামে এক  ধরনের নিষিদ্ধ রং মেশানো হয় স্কোয়াস,  শীতল পানীয়,  লজেন্স, জিলিপি, ক্রিম দেওয়া বিস্কুট, মিষ্টি  ইত্যাদি খাবারে। এর কারণে কিডনির অসুখ নার্ভ বা স্নায়ুর রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে। লেড ক্রোমেট নামক বিষাক্ত ক্ষতিকর রং মেশানো হয় গোটা হলুদ এবং প্যাকেটের গুঁড়ো মশলাতে। একটানা দীর্ঘদিন ব্যবহারে অ্যানিমিয়া,  মহিলাদের গর্ভপাত,  ব্রেন টিউমার এবং হাত পায়ের জোর কমে গিয়ে পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস এর সম্ভাবনা থাকে। বর্তমানে দ্রুতগতির জীবনে মানুষের হাতে সময় কম। এর সাথে তাল মেলাতে ফাস্টফুড বা চটজলদি খাবারের চাহিদা দিনদিন বেড়েই চলেছে এবং এর চাহিদা মেটাতে নোংরা পরিবেশে,  ড্রেনের ধারে,  ফুটপাতে দেদার চলছে এই ফাস্টফুডের স্টল। একটু চোখ কান খোলা রাখলেই দেখা যাবে বড় বড় দোকানের তুলনায় এইসব স্টলগুলিতে ভিড় খুব বেশী। এইসব স্টলে খাবারের সাথে যে সস  বিশেষ করে টম্যাটো সস ব্যবহার করা হয় তাতে আদৌ টম্যাটো  থাকে না। এই সস তৈরি হয় কুমড়ো সিদ্ধ দিয়ে এবং তাতে মেশানো হয় সাইট্রিক অ্যাসিড, লাল রংয়ের জন্য নিষিদ্ধ বিষ রং রোডামিন বি বা কঙ্গো রেড এবং স্বাদ গন্ধ আনতে আজিনামোটোর মতো  ক্ষতিকারক রাসায়নিক।
      বাইরের দোকানের রেডিমেড খাবার কেনার সময় দেখবেন প্যাকেটের গায়ে ফুড প্রিজারভেটিভ, ফুড অ্যাডিটিভ ইত্যাদি লেখা আছে। খাবার যাতে নষ্ট না হয় এবং দীর্ঘদিন রাখা যায় তার জন্য যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ সুরক্ষার জন্য খাবারে যা মেশানো হয় তাকে বলে ফুড প্রিজারভেটিভ। যেমন সোডিয়াম বেনজয়েট, সোডিয়াম নাইট্রাইট, সালফার-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। খাদ্য সুরক্ষার জন্য সোডিয়াম বেনজয়েট সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয় অথচ সোডিয়াম বেনজয়েট একটি নিষিদ্ধ প্রিজারভেটিভ। এইটি সস, আচার,  ঠান্ডা পানীয়, প্যাটিসজাতীয় খাবারে বেশী  ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারে এটির কারণে ত্বকে অ্যালার্জি হতে পারে ফলে ত্বক প্রচণ্ড চুলকায় এবং ফুলে যায়। সর্দি, হাঁচি,  শ্বাসকষ্ট অর্থাৎ  অ্যালার্জিক-রাইনাইটিস এবং অ্যালার্জিক ব্রংকাইটিসও দেখা দেবার সম্ভাবনা থাকে। ঠান্ডা পানীয় বোতলজাত করার সময় সংরক্ষক  হিসাবে  মেশানো হয় সোডিয়াম বেনজয়েট এবং সালফার ডাই অক্সাইড এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে  ক্রোমোজোমের বিকৃতি ঘটতে পারে।
       খাবারে ফুড অ্যাডিটিভ ব্যবহার করা হয় খাবারের সুগন্ধ বাড়াতে এবং খাবারের রং উজ্জ্বল করে তুলতে। বাইরের খাবার কিনে খেলে এমন কোন খাবার পাবেন না যাতে অ্যাডিটিভ নেই। আর এমন কোন অ্যাডিটিভ নেই যা একশো ভাগ নিরাপদ। খাবারে যেসব স্বীকৃত রং অ্যাডিটিভ হিসাবে ব্যবহার করা হয় সেগুলি কিন্তু পুরো নিরাপদ নয়। যেমন স্বীকৃত রং কারমায়োসিন দীর্ঘদিন ধরে শরীরে ঢুকলে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে। পনসিউ ফোর আর থেকে হাঁপানি, অ্যালার্জি, ক্যান্সার এবং রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে গিয়ে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে পারে । সানসেট ইয়েলো থেকে শিশুদের হাঁপানি,  পেট ব্যথা এবং ক্রোমোজোমের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। ইন্ডিগো  কারমাইন, ব্রিলিয়ান্ট ব্লু, ফাস্ট গ্রীন থেকে ব্রেন টিউমার, শ্বাসকষ্ট,  ইউরিনারি ব্লাডারের  টিউমার এবং ক্রোমোজোমের বিচ্যুতি ঘটতে পারে। খাবারে যেসব অনুমোদিত রং যে পরিমাণে মেশান উচিত তা না করে অসাধু ব্যবসায়ীরা অনেক সময় মেটানিল ইয়েলো, কঙ্গোরেড, রোডামিন বি, ম্যালাকাইট গ্রিন জাতীয় নিষিদ্ধ বিষ রং মিশিয়ে খাবার কে আকর্ষণীয় করে তোলে এবং খাবারের সুগন্ধ বা ফ্লেভার আনার জন্য ব্যবহার হয় অ্যাজিনামোটো বা মোনো সোডিয়াম গ্লুটামেট নামক কেমিক্যাল বা রাসায়নিক পদার্থ। শিশুদের অ্যাজিনামোটো যুক্ত খাবার দেওয়া ঠিক নয় কারণ অ্যাজিনামোটো মস্তিষ্ক বা ব্রেনের বৃদ্ধিতে বাধার  সৃষ্টি করে এবং এর ফলে বৃদ্ধির বিকাশ আটকে যায়। গর্ভবতী মহিলারা অ্যাজিনামোটো যুক্ত খাবার খেলে ভ্রূণের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
        বাজারে যেসব সস, কেচাপ এবং ইন্সট্যান্ট নুডুলস পাওয়া যায় তাতে বিভিন্ন মাত্রায় অ্যাজিনামোটো থাকে। তাই প্যাকেট খাবার কেনার আগে আমাদের দেখে নেওয়া উচিত যে, ঐ  প্যাকেটের খাবারে কি ধরনের ফুড  অ্যাডিটিভ বা  প্রিজারভেটিভ দেওয়া আছে। খুব ঘন গাঢ় রঙের রঙিন খাবার খুব কম খাওয়াই ভালো। " দি প্রিভেনশন অব  ফুড অ্যাডালটারেশেন অ্যাক্ট"-এ সরকার অনুমোদিত অ্যাডিটিভ এর তালিকা আছে। সেই স্বীকৃত তালিকার বাইরে খাবারে কোন কিছু যোগ করা আইনত দণ্ডনীয়। ১৯৭৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) দৈনিক ৬ গ্রামের বেশি অ্যাজিনামোটো মানুষের শরীরের পক্ষে চরম ক্ষতিকর বলে ঘোষণা করে। পরে দেখা যায় যে এর থেকে অনেক কম অ্যাজিনামোটো শরীরে গেলে বিশেষ করে শিশুদের শরীরে নানা ধরনের উপসর্গ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি যেমন লাড্ডু,  সন্দেশ, কাজু বরফি এবং জর্দাপানে এক ধরনের রুপালি তবক দেওয়ার রেওয়াজ আছে। খাদ্য আইন অনুসারে খাদ্য উপযোগী সিলভার তবক ব্যবহার করা উচিত কিন্তু বেশীর ভাগই থাকে নিষিদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম তবক বা পাতলা রাংতা। এই অ্যালুমিনিয়াম শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং এর ফলে হাড়ের সমস্যা, মানসিক অবসাদ এবং পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই তবক দেওয়া মিষ্টি থেকে দূরে থাকাই ভালো। বাজারে এক ধরনের বিদেশি স্টিকার মারা লাল চকচকে আপেল সহজেই  আমাদের নজর কাড়ে। দেখলে মনে হয়, এই বুঝি সিমলা বা কাশ্মীর থেকে সদ্য তুলে আনা হয়েছে। আসলে এসব ঝাঁ চকচকে মসৃণ আপেলে মোম পালিশ করা থাকে। আমরা জানি মোম একটি পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ। দীর্ঘদিন এই মোম আমাদের শরীরে ঢুকলে প্রভূত ক্ষতি করতে পারে।
     

বাঙালী রসনা প্রিয়।  মাছ ছাড়া ভাত প্রায় ভাবাই যায় না। মাছ খাবেন তবে দেশী বা স্থানীয় পুকুরের মাছ হলেই ভালো। সামুদ্রিক মাছ এবং বাইরে থেকে আসা চালানি মাছ খাবেন বুঝেসুঝে। সামুদ্রিক মাছ বা চালানি মাছ কে পচন রোধ করতে ফর্মালিন জলে চুবিয়ে বা ফর্মালিন স্প্রে করা হয়। এখন বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ফর্মালিন ইনজেকশন মারফত মাছের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফর্মালিন একটি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। ফর্মালিনের প্রভাবে লিভার, কিডনি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্যান্সারের মতো রোগের আশঙ্কাও বাড়িয়ে দেয়। এইবার আসছি ইলিশ মাছ প্রসঙ্গে। ইলিশের প্রতি আমাদের দুর্বলতা আছে। এখন ইলিশ মাছকে  টাটকা দেখাতে বা পচন রোধ করতে ফর্মালিনের ব্যবহার তো হচ্ছেই। তা বলে কি বর্ষাকালে ইলিশ মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকবো? আমি বলবো না, খাবেন। তবে ইলিশ মাছ কেনার সময় একটু নজর রাখবেন যেমন মাছের উপর মাছি বসছে কিনা, মাছ টা  শক্ত না নরম, মাছের চোখের রং কালচে লাল বা ঘোলাটে কিনা। ফর্মালিন দেওয়া মাছে মাছি বসবে না বা কম বসবে, মাছ শক্ত হবে এবং চোখ কালো হবে। এইসব পড়ে  অনেকেই ভাববেন এতো শত দেখে কি মাছ কেনা যায়?  তাই বলছি বর্ষায় ইলিশ নিশ্চয় খাবেন তবে মাঝে মধ্যে। ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে বলছিনা। তবে সচেতনতার প্রয়োজন।
       বাঙালীদের কাছে জলখাবারে মুড়ি একটি প্রিয় খাবার। বর্তমানে বাজারে দু'রকমের মুড়ি আমাদের চোখে পড়ে। একটি লালচে কমফুলো মুড়ি  এবং অপরটি আকর্ষণীয় ধবধবে সাদা বড় আকারের ফুলো মুড়ি। এই সাদা বড় মুড়িতে মেশানো হয় ইউরিয়া যার ফলে মুড়ি হয় সাদা, বড় এবং দেখতে সুন্দর। এই ধরনের সাদা ফোলা মুড়ি বেশী  দেখা যায় শহরাঞ্চলে বিশেষ করে রেল স্টেশন, পার্ক এবং বিভিন্ন মেলায় ভেলপুরি এবং মুড়ি মশলার স্টলে। আমাদের শরীরে নানা ধরনের বিপাকীয় কাজকর্মের ফলে এমনিতেই ইউরিয়া তৈরি হয়। এই ইউরিয়া কে কিডনি ছেঁকে শরীর থেকে বের করে দেয়  প্রস্রাবের সাথে। এর ফলে অতিরিক্ত ইউরিয়া শরীরে কখনই জমা হতে পারেনা এবং রক্তে ইউরিয়া থাকে সবসময় একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। কিন্তু মুড়িতে মেশানো এই মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া শরীরে প্রবেশ করে নানা রকম অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে যেমন-- ব্রেন,  লিভার,  কিডনির মারাত্মক সমস্যা। শরীরে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়ার প্রভাবে সন্তান উৎপাদনে বাধা এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও  থাকতে পারে। পরীক্ষায় দেখা গেছে ইউরিয়ার এক শতাংশ দ্রবণ দিয়ে মুড়ি ভাজলে  মুড়িতে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ইউরিয়া থেকে যায় যা মুড়ির সাথে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এইরকম ইউরিয়াযুক্ত মুড়ি কেউ ১০০ গ্রাম খেলে তার শরীরে ইউরিয়া ঢুকবে ৭০০ থেকে ৭৫০ মিলিগ্রাম। সুতরাং শরীর সুস্থ রাখতে মুড়ি কেনার সময় বা মশলামুড়ি,  ভেলপুরি খাবার সময় এই সাদা ধবধবে ফুলকো ইউরিয়া মেশানো মুড়ির রূপে ভুলে না গিয়ে  লালচে কম ফুলো মুড়ি কেনা  বা খাওয়াই হবে শ্রেয়। "দি  প্রিভেনশন অব ফুড অ্যাডালটারেশন অ্যাক্ট" অনুযায়ী খাদ্যে ইউরিয়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। বর্তমানে এই আইনকে উপেক্ষা করে মুড়ি তৈরিতে ইউরিয়ার ব্যবহার ক্রমশই বেড়ে  যাচ্ছে। এই ব্যাপারে আমাদের নিজেদেরই  সচেতন হতে হবে।
     

সবজি বাজারে গেলে দেখা যায় সবুজের মেলা। এইসব সবুজ শাকসবজির  দিকে তাকালে মনে হবে যেন সদ্য জমি থেকে তুলে আনা হয়েছে। এইরকম টাটকা সবুজ তাজা শাকসবজি কিনতে কার না মন চাইবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বাজারে আনার আগেই শাকসবজিকে  তাজা এবং লোভনীয় করার জন্য রঙিন জলে  ডুবিয়ে বাজারজাত করে। শাকসবজিকে  সবুজ করতে মূলত নিষিদ্ধ বিষাক্ত ম্যালাকাইট গ্রিন এবং তুঁতে বা কপার সালফেট ব্যবহার করা হয়। এই রং মেশানো হয় সাধারণত সবুজ সবজি যেমন-- ব্রকোলি, মটরশুঁটি, করলা,  উচ্ছে,  পটল, ঝিঙে,  বরবটি, ক্যাপসিকাম, বীনস, কাঁচালঙ্কা ইত্যাদি সবজিতে। এইসব নিষিদ্ধ রাসায়নিক যদি ধারাবাহিকভাবে শরীরের ঢুকতে থাকে তাহলে লিভার,  কিডনির  সর্বনাশ হবে এবং পেটের রোগ, নার্ভের অসুখ, অ্যানিমিয়া বা রক্তশুন্যতা এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। এই বিষাক্ত রং এর ব্যবহার ছাড়াও শস্য বা শাকসবজি কে রক্ষার জন্য আজকাল কীটনাশক ব্যবহার দিনের পর দিন যথেচ্ছভাবে বেড়েই চলেছে। শাকসবজি এবং শস্য কে বাঁচাতে গিয়ে যে কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে, খাদ্য হিসাবে সেই শাকসবজি গ্রহণ করার সময় সেই কীটনাশক শরীরে গিয়ে কতটা ক্ষতি আমাদের করছে তা একবার ভালো করে ভেবে দেখা দরকার। শস্য বা শাক সবজির উপর কীটনাশক প্রয়োগ করার কথা শুনে আমাদের অনেকেরই মনে ভয় বা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। মনে হয় শাকসবজি খেলে বিষ খাওয়া বেড়ে যাবে না তো? শাকসবজি বা শস্যে  যে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় তার প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। কীটনাশক  হিসাবে শাকসবজিতে কোন ওষুধ প্রয়োগের পর তা ব্যবহারের আগে নির্দিষ্ট কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে যৌগটির  রাসায়নিক রূপান্তর ঘটে যার ফলে বিষক্রিয়তা  হ্রাস পায়। এই প্রসঙ্গে কিছু কীটনাশকের নাম এবং তা প্রয়োগের কতদিন পর ফসল তোলা হবে এই সম্বন্ধে একটু জানিয়ে রাখি। ফোরেট  বা কার্বোফুরান প্রয়োগের ৬ সপ্তাহ পর, মিথাইল প্যারাথিয়ন, ডাইমিথোয়েট প্রয়োগের দু সপ্তাহ পর, এন্ডোসালফান প্রয়োগের চার সপ্তাহ পর, ফসফামিডন, ক্লোরপাইরিফস, মিথাইল ডিমেটন, কুইনালফস, মনোক্রোটেফস প্রয়োগের তিন সপ্তাহ পর, কার্বারিল, ম্যালাথিয়ন, ডাইক্লোরোভস প্রয়োগের এক সপ্তাহ পর ফসল তুললে কীটনাশকের রাসায়নিক যৌগের পরিবর্তন ঘটে বিষাক্ততা হ্রাস পায়। সুতরাং কীটনাশকের বিষক্রিয়া নষ্ট হলে তবেই ফসল বাজারে আনা উচিত। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা সেই সময় অপেক্ষা না করে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক দিয়ে (এই ক্ষেত্রে সঠিক মাত্রার সঠিক ওষুধ সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ না করে) পরের দিনই সবজি বাজারজাত করছে। ফসলের মাঠে ইঁদুর মারার বিষ হিসাবে ব্রোমোডায়ালোন, ক্লোরডেন এবং জিঙ্ক ফসফাইড জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করা হয় এবং যার অবশেষ শরীরে ঢুকলে স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেমের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। সবজিতে কীটনাশক প্রয়োগের তারতম্য আছে। কোনটায় বেশী  আবার কোনটায় কম কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। কম কীটনাশক প্রয়োগ করা সবজিকে খাদ্যতালিকায় বেশী  রাখতে হবে। বেশী  কীটনাশক প্রয়োগ করা সেই সব সবজি যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো। কোন সবজিতে বেশী  কীটনাশক বা কোন সবজিতে কম  কীটনাশক দেওয়া হয় সেই প্রসঙ্গে একটু বলে নিই।
১) বেশী কীটনাশকযুক্ত সবজি--- বেগুন, ঢেঁড়স, উচ্ছে,  করলা,  সিম,  বীনস, কাঁচালঙ্কা,  পটল,  ক্যাপসিকাম, কাঁকরোল, বরবটি,  ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলী, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, শশা, হাইব্রিড টম্যাটো( হাইব্রিড সবজিতে বেশি কীটনাশক থাকে) প্রভৃতি।
২)কম কীটনাশকযুক্ত সবজি --- লাউ,  কুমড়ো,  পেঁপে, কাঁচাকলা,  ওল,  কচু,  মুলো,  মোচা, থোড়, কুঁদরি, মটরশুঁটি,  গাজর, আলু, পেঁয়াজ,  রসুন,  আদা,  হলুদ, কলমি শাক, পালং শাক, পুঁইশাক,  ধনেপাতা, চালকুমড়ো,  শাঁকালু, এঁচোড়,  মানকচু, সজনেশাক, সজনেডাঁটা  প্রভৃতি।
     এত শত জানার পর স্বাভাবিকভাবে আমাদের মনে প্রশ্ন আসবে তাহলে কি আমরা শাকসবজি বা বাইরের খাবার খাব না? এর উত্তরে আমি বলবো অবশ্যই খাবো তবে কীটনাশক এবং বিষাক্ত রং এর প্রভাব কমিয়ে।
      কিভাবে বিষাক্ত রং এবং কীটনাশকের প্রভাব কমানো যাবে এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে কিছু টিপস:-
১) বাজার থেকে সবজি কেনার পর আধঘন্টা জলে ভিজিয়ে রাখলে সবজির গায়ে লেগে থাকা কীটনাশকের প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ বেরিয়ে যায়। ভিনিগার এবং তেঁতুলগোলা জল দিয়ে সবজি ধোয়া হলে সবজির গায়ে লেগে থাকা কীটনাশক ৯০-৯৫ শতাংশ দূর করা যায়। এই ক্ষেত্রে দু কাপের মতো ভিনিগার জলে মিশিয়ে তাতে সবজি ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পরে ঠাণ্ডা জলে ভালো করে ধুয়ে নিয়েও সবজির কীটনাশক নষ্ট করা যায়। ভিনিগার হচ্ছে অ্যাসিটিক অ্যাসিডের জলীয় দ্রবণ। তেঁতুল গোলা জলের ক্ষেত্রে ১ লিটার জলে ২০ গ্রাম তেঁতুল মিশিয়ে তেঁতুল গোলা জল তৈরি করতে হবে এবং ভিনিগারের মতো সবজি ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পরে ঠান্ডা জলে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।  তেঁতুলের মধ্যে আছে টারটারিক অ্যাসিড।  এছাড়াও জলের মধ্যে খাবার সোডা বা সোডিয়াম বাই কার্বনেট মিশিয়ে সেই দ্রবণে সবজি মিনিট দশেক ভিজিয়ে রেখে পরে সাধারণ জল দিয়ে ধুয়ে নিলে কীটনাশকের বিষাক্ততা নষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে সবজি যেন জলে ডুবে থাকে। জলে ধোয়ার সময় কীটনাশকের সাথে কিছুটা রং ও সবজি থেকে ধুয়ে বেরিয়ে যায়। যেসব সবজির খোসা ছাড়ানো যায় সেখানে খোসার সাথে লেগে থাকা রং বাদ  চলে গিয়ে বিষাক্ত রঙের প্রভাব অনেকটাই কমে যায়। আবার যেসব সবজির খোসা ছাড়ানো যায় না যেমন উচ্ছে, বীনস, ঢেঁড়শ  ইত্যাদি গায়ে লেগে থাকা রঙ অতি সহজেই চলে আসে খাবারের সঙ্গে। সুতরাং যেসব সবজির খোসা ছাড়ানো হয় না সেইসব সবজি কম খাওয়াই ভালো।
২) বেশী কীটনাশকযুক্ত সবজি এড়িয়ে চলাই ভালো বা যত কম খাওয়া যায় ততই স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গল।
৩) বাজারে গিয়ে গাঢ় সবুজ রঙের উজ্জ্বল চকচকে সবজির প্রতি আকৃষ্ট হবেন না কারণ ওইগুলো বিষে  ভর্তি থাকার সম্ভাবনা বেশী।
৪) বর্ষাকালে বেশী  শাকপাতা না খাওয়াই ভালো কারণ ঐগুলি তখন পোকামাকড় এবং রোগ-জীবাণুর আশ্রয়স্থল।
৫) সরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রশংসিত আগ মার্ক, আই.এস.আই, বি. এস. আই, এফ. পি.ও চিহ্ন দেখে খাবার কিনুন।