চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

বিশ্ব উষ্ণায়ন ও ভবিষ্যতের উৎকণ্ঠা


বিশ্ব উষ্ণায়ন ও ভবিষ্যতের উৎকণ্ঠা 

 ✳ ডাঃ এন.সি. মন্ডল

  ➡ গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন একবিংশ শতাব্দীর সব থেকে ভয়ঙ্করতম সমস্যা। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, গ্রীন হাউস গ্যাস, আবহাওয়ার পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ এইসব কথা গুলি বর্তমানে আমাদের কাছে খুবই পরিচিত। উষ্ণ পৃথিবী গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের একটি মারাত্মক ফল যা বর্তমান বিশ্বের জ্বলন্ত সমস্যা।  বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউস গ্যাস মূলত কার্বনডাই-অক্সাইড (CO2) এর  ঘনত্ব বৃদ্ধি, বিশেষকরে মানুষের সৃষ্টির কারণে বাতাসে কার্বনডাই -অক্সাইড এর ঘনত্ব বৃদ্ধির ফলেই গ্রীন হাউস প্রভাবে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা পরিবেশ উষ্ণায়নের অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC) নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ১৯৯০ সালে একটি রিপোর্টে বলেছেন বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বেড়ে চলার জন্যই আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং অদূর ভব্যিষতে এই পরিবর্তন মারাত্মক আকার ধারন করবে এবং সেখানে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি করার জন্য কার্বনডাই অক্সাইডকে দায়ী করা হয় আর এও উল্লেখ করা হয় শিল্পোন্নত দেশগুলি বেশী করে কার্বনডাই অক্সাইড ছড়াচ্ছে। ২০০৫ সালে তারা বলেছেন গত শতকে যেখানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বা উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ছিল ০.৭ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড সেইখানে চলতি শতকের শেষে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়বে কমপক্ষে ১.৮ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ৬.৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এবং এই ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা বৃদ্ধির ফল হবে ভয়াবহ। আবহাওয়াবিদদের এক সমীক্ষায় জানা গেছে ১৯৮০ সালের পর থেকে প্রতিটি বছরেই গ্রীষ্মের দাবদাহ বেড়েছে ভয়ঙ্করভাবে। ১৯৯৮ সালটি ছিল গতশতকের উষ্ণতম বছর এবং এই শতকের ২০০৫ সালের গ্রীষ্মের দাপট ছিল প্রচন্ড যা ১৯৯৮ সালের থেকেও বেশী। ৬টি ঋতুর মধ্যে হেমন্ত এবং বসন্ত ঋতুর অস্তিত্ব আজ আমরা উপলব্ধি করতে পারি না এই গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্যই। গ্রীনহাউস গ্যাস সম্পর্কে কিছু বলার আগে আমরা জেনে নিই গ্রীনহাউস বা সবুজঘর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা। সবুজ ঘর মানে সবুজ উদ্ভিদকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নির্মিত এক বিশেষ ধরনের ঘর। শীত প্রধান দেশে অল্প উষ্ণতায় তীব্র শীতের হাত থেকে উদ্ভিদ বা গাছপালাকে বাঁচিয়ে রাখতে বা প্রতিপালনের জন্য এক বিশেষ ধরনের কাঁচের ঘর তৈরী করা হয়। গ্রীষ্ম প্রধান দেশের উদ্ভিদ বেশী তাপে থাকতে অভ্যস্ত এবং এদের শীত প্রধান দেশে নিয়ে গেলে ঠান্ডায় বাঁচতে পারে না। এই অসুবিধার সমাধান করার জন্য বিজ্ঞানীরা বহুবছর আগেই আবিষ্কার করেন এক বিশেষ ধরনের কাঁচের ঘর। কাঁচের ভিতর দিয়ে সূর্যের তাপ তরঙ্গ রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সহজেই ভিতরে প্রবেশ করে এবং ঘরের ভিতরে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় প্রায় ৩৫ ডিগ্রী থেকে ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপ তৈরী হয়। সাধারণত এই প্রতিফলিত তাপতরঙ্গ বেশীরভাগই হচ্ছে ইনফ্রারেড রশ্মি। ভিতরে উদ্ভিদের শ্বসন থেকে পাওয়া কার্বনডাই অক্সাইড উদ্ভূত তাপ কাঁচ ভেদ করে বাইরে আসতে পারেনা ফলে ঐ কাঁচের ঘরের ভিতর জমা হয় উত্তাপ যা উদ্ভিদকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। উদ্ভিদ প্রতিপালনে তৈরী এই বিশেষ ধরনের কাঁচের ঘরকেই বলা হয় গ্রীন হাউস। পৃথিবী নিজেও একটি গ্রীন হাউস। সূর্য থেকে মোট যে পরিমান তাপ তৈরী হয় তার দুশো কোটি ভাগের একভাগ মাত্র পৃথিবীতে আসে। সূর্য থেকে প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আসতে সূর্য রশ্মির তাপ তরঙ্গের সময় লাগে প্রায় সাড়ে আট মিনিটের মতো। গ্রীন হাউস গ্যাস বলা হয় সেই সমস্ত গ্যাসকে যারা তাপরশ্মিকে শোষণ করতে পারে। বায়ুমণ্ডলে কার্বনডাই অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), নাইট্রাস অক্সাইড (N₂O), ওজোন (O3), জলীয় বাষ্প (H2O) প্রভৃতি গ্যাস প্রাকৃতিকভাবে উপস্থিত থাকে এবং এদের তাপশোষণ ক্ষমতা আছে তাই এরা গ্রীনহাউস গ্যাসের ধর্মবিশিষ্ট। গ্রীনহাউস গ্যাসগুলি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকলে ঠিক আছে  কিন্তু আমাদের প্রধান সমস্যা মানুষের সৃষ্টির কারণে গ্রীনহাউস গ্যাস যেমন কার্বনডাই অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), নাইট্রাস অক্সাইড (N₂O), হাইড্রোফ্লুরোকার্বন (HFC), ক্লোরোফ্লুরো কার্বন (CFC), পারফ্লুরোকার্বন (PFC), সালফার হেক্সা ক্লোরাইড (SF6), সালফার ডাই অক্সাইড (SO₂) ইত্যাদি যে ভাবে বেড়ে চলেছে এবং এর সাথে পাল্লা দিয়ে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে তাতে পৃথিবী এক ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে এগিয়ে চলেছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে নির্গত সূর্যের ইনফ্রারেড রশ্মি এইসব গ্রীন হাউস গ্যাসের সংস্পর্শে এসে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তোলে। ভূপৃষ্ঠের ১২কিলোমিটার উপর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশী। বায়ুমণ্ডলের উচ্চতায় থাকা এই ওজোন গ্যাসের মোটা আবরণকে ওজোনস্তর বলা হয়। সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি (আলট্রা ভায়োলেট রে ) এই স্তরে শোষিত হয় বলে পৃথিবীর জীবজগৎ আজ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। ওজোনকে গ্রীন হাউস গ্যাস বলা হয় কারণ এটি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে শোষণ করে নিজে গরম হয়ে যায় এবং বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে। ওজোনস্তর ক্ষয়ে গেলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। ক্লোরোফ্লুরোকার্বন, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাবে ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব কমে যাচ্ছে এবং এর ফলে ওজোন হোল বা গহ্বর সৃষ্টি হচ্ছে। ওজোন গহ্বর সৃষ্টির জন্য মূলত দায়ী বাতাসে অতিরিক্ত ক্লোরোফ্লুরোকার্বন এর উপস্থিতি। গ্রীন হাউস গ্যাস গুলির মাত্রাতিরিক্ত ঘনত্ব বৃদ্ধির ফলে পৃথিবী থেকে বিকিরিত তাপের সবটাই মহাশুন্যে ফিরে যেতে পারে না এবং পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং এর ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বা উষ্ণতার বৃদ্ধি ঘটে। গ্রীনহাউস গ্যাসের প্রভাবে এই উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে গ্রীনহাউস এফেক্ট বা গ্রীনহাউস প্রভাব বলা হয়।
      পৃথিবীজুড়ে যেভাবে ব্যাপকহারে শিল্পায়ন ও নগরায়ন হচ্ছে বা বনভূমি  কেটে চাষ হচ্ছে ফলে অক্সিজেন এবং কার্বনডাই অক্সাইড এর ভারসাম্য হানি হচ্ছে এবং বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড বৃদ্ধি পাচ্ছে তাও উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। উষ্ণ পৃথিবী গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর একটি মারাত্মক ফল।
       গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে হিমবাহের গলন শুরু হয়েছে। 'মেরিন অ্যান্ড ওয়াটার রিসোর্স গ্রুপ অব্ স্পেস  অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার ' নামক সংস্থা তাদের এক গবেষণায় জানিয়েছে যে, হিমবাহের বরফ যে হারে গলতে শুরু করেছে এই হার চলতে থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে হিমালয়ের বেশীরভাগ বরফই শেষ হয়ে যাবে। মেরু অঞ্চল এবং উচ্চপার্বত্য অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্র জলস্তর বেড়ে গেলে সারা পৃথিবীর উপকূল অঞ্চলগুলি সমুদ্রের তলায় চলে যাবে। বাংলাদেশ এবং সুন্দরবনের মতো নিচু জমির দেশগুলি জলমগ্ন হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী ২০৪০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে সমগ্র পৃথিবীর সমুদ্র জলতল কমপক্ষে এক থেকে দেড় মিটার বেড়ে যাবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে কাশ্মীরের অমরনাথের বরফের শিবলিঙ্গ গলে যাচ্ছে।
       পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে ক্রমশই বেড়ে চলেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ভূমিকম্প, দাবানল, টর্নেডো, হ্যারিকেন, সাইক্লোন, টাইফুন, আয়লা, সুনামি, বুলবুল, ফনী প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফল। ২০০৪ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর ঘটে যাওয়া সুনামির ভয়াবহ চিত্র এখনো আমাদের মনের স্মৃতিকোঠা থেকে মুছে যায়নি। মনে পড়ে  যায় ২০০৯ সালের মে মাসের (২৫ থেকে ২৭ মে ) আয়লার ভয়াবহতাকে। অতি সম্প্রতি এই বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ২০শে মে ভয়ঙ্কর সুপার সাইক্লোন উম্ফান বা আমফানের বিধ্বংসী ধ্বংসলীলার ভয়াবহ রূপ আমরা প্রত্যক্ষদর্শী। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে আবহাওয়ার এবং ঋতুচক্রের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। কোথাও অতিবৃষ্টির ফলে ভয়ঙ্কর বন্যা আবার কোথাও অনাবৃষ্টির ফলে ভয়াবহ খরা। বেড়ে চলেছে গ্রীষ্মের দাবদাহ।
       আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে বহু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়ারা আরও সক্রিয় হয়ে উঠবে কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা দেখেছেন - যে কোন কঠিন পরিস্থিতিকে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এদের রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো জীবানুরা নিজেদের জীবনচক্রে পরিবর্তন ঘটিয়ে আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে, ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ওষুধ আর কাজ করছে না। তাপমাত্রা আরও বাড়লে এই রোগের আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেকগুন বেড়ে যাবে। বাড়বে ডেঙ্গু এবং আরও অন্য রোগের প্রকোপ।


বর্তমানে আমরা বিশ্বে ত্রাস সৃষ্টিকারী মারণ রোগ করোনা ভাইরাসের (COVID 19) সম্মুখীন হয়েছি। এই রোগ আক্রমণের ফলে আজ বিশ্বে মৃত্যু মিছিল অব্যাহত। বায়ুদূষণের ফলে বাতাসে বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস (যে গুলি আগেই উল্লেখ করেছি ) ফুসফুসের কার্য ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে বিভিন্ন শ্বাসযন্ত্রের রোগ সৃষ্টি করে। করোনা ভাইরাস রোগে মৃত্যু সরাসরি বায়ু দূষণের সাথে যুক্ত না হলেও পরোক্ষ ভাবে জড়িত। বায়ু দূষণ আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কে দুর্বল করে দেয়। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ যেহেতু শ্বাসযন্ত্র বা ফুসফুসে,  তাই দুর্বল শ্বাসযন্ত্র এই রোগ প্রতিরোধ করতে পারে না। ফলস্বরূপ ফুসফুসে অক্সিজেন কমে যায় এবং কার্বনডাই অক্সাইড বেড়ে যায়। এর ফলে শুরু হয় প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট যা এই রোগে মৃত্যুর একটি কারণ হিসাবে ধরা যেতে পারে। এই শতাব্দীতে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে যত মানুষের মৃত্যু হবে তা দুটি বিশ্বযুদ্ধে যত মানুষ মারা গিয়েছিল তার থেকে অনেক বেশী। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মৃত্যু এখন প্রায় রোজকার খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
         বর্তমানে ক্যান্সারের মতো মারণ রোগ এবং এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। মোটরগাড়ি, কলকারখানার ধোঁয়া থেকে নির্গত জৈব এবং অজৈব গ্যাসের ফলে যে বায়ুদূষণ হয় তা থেকে ফুসফুস ক্যান্সার হতে পারে। বাতাসে গ্রীন হাউস গ্যাসের অতিরিক্ত বৃদ্ধি বিশেষ করে ক্লোরোফ্লুরো কার্বন গ্যাসের প্রভাবে ওজোনস্তর ফুটো হয়ে যাওয়ার ফলে সূর্যের ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছাচ্ছে ফলে স্কিন বা ত্বক ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
        জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক বা রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে শাক, সবজি, ফলমূল হয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত। এই বিষযুক্ত খাদ্য গ্রহনের ফলে জিনের মিউটেশন ঘটিয়ে ক্যান্সারের মতো মারণরোগ শরীরে সৃষ্টি হচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন গোটা পৃথিবীর কাছে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের সকলেরই ভূমিকা রয়েছে। আমাদের সকলকেই সচেতন হতে হবে। আসুন দেখি আমরা কি করতে পারি।
      জমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক এর ব্যবহার কমাতে হবে। রাসায়নিক সার থেকে উদ্ভূত নাইট্রোজেন অক্সাইড গুলি পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি করে। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে হবে।
        পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে অত্যধিক পরিমানে ব্যবহৃত পলিব্যাগ পরিবেশের কাছে এক বিরাট বোঝা ও পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা পলিথিন ড্রেন এবং বিভিন্ন নদীনালা খালে জমে গিয়ে নিকাশী ব্যবস্থার সর্বনাশ করে জমে থাকা জৈব পদার্থের পচন ঘটায় এবং এই পচনের ফলে প্রচুর মিথেন গ্যাস তৈরী হয়, বিশ্ব উষ্ণায়নে যার ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্ব উষ্ণায়ন থেকে পরিবেশ দূষণ পরিবেশবিদদের কাছে পৃথিবীর ভবিষ্যত সম্পর্কে বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
      প্রচুর গাছপালা লাগাতে হবে এবং গাছকাটা বন্ধ করতে হবে কারণ গাছ অতিরিক্ত কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। আমরা ইচ্ছা করলেই নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে প্রচুর গাছ লাগিয়ে বা বৃক্ষরোপন করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ পৃথিবী গড়ে যেতে পারি।
         ক্লোরোফ্লুরোকার্বন এর উৎপাদন ও ব্যবহার কমাতে হবে। এয়ার কন্ডিশন মেশিন, রেফ্রিজারেটার বা ফ্রিজ, বিভিন্ন  কসমেটিক দ্রব্য থেকে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন গ্যাস নির্গত হয় যা ওজোনস্তরের ঘনত্ব কমিয়ে ওজোন হোল বা গহ্বর সৃষ্টি করে প্রত্যক্ষভাবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
        ঘন জনবসতি এলাকা থেকে দূরে শিল্পাঞ্চল গড়ার পরিকল্পনা নিতে হবে। কোনো কলকারখানা মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ছড়াচ্ছে কিনা সেই ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং কলকারখানায় দূষণরোধী যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা সেইদিকে নজর দিতে হবে।
       জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে সেই অনুপাতে গাড়ির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিজেল বা পেট্রলচালিত মোটরগাড়ির কালো ধোঁয়ায় থাকে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বনডাই অক্সাইড যা শুধু বায়ু দূষণই করছে না, সৃষ্টি করছে প্রচুর পরিমানে গ্রীনহাউস গ্যাস যা বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য দায়ী। পেট্রল, ডিজেলের পরিবর্তে 'কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস ' বা সি.এন. জি যে কোনো গাড়িতেই ব্যবহার করা যায়। দিল্লি, মুম্বাই সহ উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি শহরে সি. এন. জি  গ্যাস দিয়ে বাস, অটো, ট্যাক্সি চালানো হচ্ছে। সমগ্র ভারতবর্ষে সি. এন. জি ব্যবহার করে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে সরকারকে কড়া পদক্ষেপ  নিতে হবে। সি. এন. জি কে আমরা পরিবেশ বন্ধু (ECO-FRIENDLY) জ্বালানি বলে আখ্যা দিতে পারি। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে লকডাউন সময়ে কলকারখানা এবং রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকার জন্য বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ অত্যন্ত কমে গেছে। এই সময়ে বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এর পরিমান ও  অনেক কম।
       ভারতের এক শ্রেণীর মানুষের পশ্চিমী দেশগুলির মতো জীবন যাপন, অপরিমেয় ভোগবিলাস এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাই শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে ৫ই জুন কে গোটা পৃথিবীজুড়ে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসাবে পালন করলেই হবে না। পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতো পরিবেশের পরিবর্তন জনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে গত ৩০ বছরে প্রতিবছরে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এদের বেশীরভাগই তৃতীয় বিশ্বের গরীব মানুষ।
'গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর বিপদ ' আমরা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না। আমাদের আরও সজাগ হতে হবে এবং এই বিপর্যয় প্রতিরোধে আমাদের সকলকেই সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বারবার মনে পড়ে  যাচ্ছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন -----
'দাও ফিরে সে  অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ, লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা। হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সে তপোবন, পুন্যছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি....................। '