Scrooling

হাঁপানি ও অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় ভুগছেন ? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ অয়ন শিকদার আগামী ২৫ আগস্ট বর্ধমানে আসছেন। নাম লেখাতে যোগাযোগ 9734548484 অথবা 9434360442 # টি টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট ২০২৪ : ভারতের বিশ্ব রেকর্ড, প্রথম থেকে শেষ সব ম্যাচে ভারতের জয় # কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন আউসগ্রামের বিউটি বেগম # নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রীসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে শপথ নিলেন ডঃ সুকান্ত মজুমদার ও শান্তনু ঠাকুর # আঠারো তম লোকসভা ভোটের ফলাফল : মোট আসন ৫৪৩টি। NDA - 292, INDIA - 234, Others : 17 # পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ফলাফল : তৃণমূল কংগ্রেস - ২৯, বিজেপি - ১২, কংগ্রেস - ১

যখন প্রতিবাদের ভাষার নাম মৃনাল


যখন প্রতিবাদের ভাষার নাম মৃনাল

 ✳ অভিজিৎ মিত্র

 ➡ আজকাল রোজ রাতে শুলেই একটা স্বপ্ন দেখি।

১৯৭০ সালের ‘ইন্টারভিউ’। যুবক রঞ্জিত মল্লিক আর তার শক্ত চোয়াল। একটা বিদেশি ফার্মে চাকরির আশায় কোট-প্যান্ট ইস্ত্রি করতে চেয়েও না পারার হতাশা। গোটা কলকাতায় সব লন্ড্রি স্ট্রাইক ডেকেছে। অগত্যা ধুতি-পাঞ্জাবি পরেই ইন্টারভিউ দিতে যেতে হয়। স্বাবাভিকভাবেই, বিদেশি ফার্মের চাকরি জোটে না। ফিরে আসার পথে এক দোকানে ঝকঝকে কোট-প্যান্ট ঝুলতে দেখে আক্রোশবশত প্রোটাগনিস্ট রঞ্জিত মল্লিকের সপাট ঢিল আর কাচের ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়া।

চমকে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ি। নিজের হার্টের শব্দ শুনতে পাই। মনে হয় যেন লক-ডাউনের মাঝে এই থমকে যাওয়া সমাজের অসংখ্য হাত নিজের পেটের, পরিবারের পেটের ভাত জোটাতে না পেরে আক্রোশবশত আস্তে আস্তে ওপরে উঠছে। আমি শুনতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি। প্রতি হাতে একটা করে ঢিল। উলটো দিকে সেইসব সুবিধেভোগী মানুষেরা যারা এই দুর্দিনেও আর্থিকভাবে সুরক্ষিত। জানিনা সমাজের আড়াআড়ি দাঁড় করানো ঠুনকো আয়নাটা অসংখ্য প্রোটাগনিস্ট ঢিলের আক্রমনে কখন চুরমার ভেঙে পড়বে।

একটা ট্রিলজি ভাবুন। ১৯৭০-এর ‘ইন্টারভিউ’, ৭২-এর ‘কলকাতা ৭১’ আর ৭৩-এর ‘পদাতিক’। প্রথম সিনেমায় বেকারত্বের জ্বালা আর নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সমস্যা। এসট্যাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আক্রোশ। পরেরটায় চারটুকরো গল্প, প্রত্যেকটাই অন্যের সঙ্গে জুড়ে আছে। কখনো বস্তি এলাকার এক পরিবার তাড়া খেয়ে অনেকের মতই রাস্তায় আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে, কখনো পেটের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে দু-বোন পতিতাবৃত্তি বেছে নিচ্ছে, কখনো এক স্কুলপড়ুয়া কিশোর চাল স্মাগলিং-এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে আর ওরা কয়েকজন মিলে এক অত্যাচারী ধনী ব্যবসায়ীকে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে। কোথাও আবার সমাজের উঁচু শ্রেনীর পার্টিতে এইসব ছোটলোকদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যদিও সেটা শুধু মুখেই – এদের জন্য বাস্তবে কেউই কিছু করছে না। তৃতীয় ছবিতে এক রাজনৈতিক পলাতক, যে পুলিশের থেকে লুকিয়ে বাঁচছে, আশ্রয় নিচ্ছে এক ধনী ডিভোর্সি মহিলার বাড়িতে। সেখানে সে ভাবছে, যাদের জন্য তার এই বিপ্লব, এই ত্যাগ, সেই সমাজ কি সত্যিই বদলেছে? নাকি আগের জায়গাতেই থমকে আছে? তার হতাশা থেকে জন্ম নিচ্ছে রাগ, ঘেন্না। এই প্রত্যেক ছবির শট্‌ এখানেই ফ্রিজ করুন। এবার আমাদের চারপাশে তাকান। খবরের কাগজ বা মিডিয়া চ্যানেলে চোখ রাখুন। আমরা এইমুহুর্তে যদি আমাদের রাজ্য বা দেশের সমস্ত মানুষের কথা ভাবি, দেখুন তো, কোন না কোন মুখ হুবহু মিলে যাচ্ছে ওপরের এই চরিত্রগুলোর সঙ্গে। কেউ খেতে পাচ্ছে না, কেউ এই সমাজের প্রতি মনে ঘেন্না জমিয়ে বহুদূর যেতে গিয়ে মারা যাচ্ছে, কেউ নিজেকে বেচে দিচ্ছে, হিউম্যান ট্রাফিকিং শুরু হয়ে গেছে, কেউ হিপোক্রিট, কেউ এতকিছুর মাঝেও নিজের ফায়দা লুটে নিচ্ছে, আবার কেউ সমাজে বদল আনতে না পেরে হতাশায় নিজের ভেতর কুড়ে কুড়ে মরছে।

এবার এই ট্রিলজি ছেড়ে বেরিয়ে একটু অন্য ঘরানায় আসি। ১৯৬০ সালের ‘বাইশে শ্রাবণ’ আর ১৯৮২-র ‘আকালের সন্ধানে’। বাইশে শ্রাবণ তৈরি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায়। খাবার না পেলে মানুষের মনের কালো দিক কিভাবে বেরিয়ে আসে সেই নিয়ে এই ছবি। মনে পড়ে ক্ষিদের জ্বালায় জ্ঞানেশ মুখার্জীর মাথা ঠুকে কান্নার দৃশ্য – ‘মা মাগো, তুমি বেঁচে গেছ মা। মরে গিয়ে তুমি বেঁচে গেছ মা। তুমি সহ্য করতে পারতে না, যদি দেখতে তোমার সংসারের কি হাল হয়েছে’। ভাবুন তো, ভারতের ৭০ কোটি বিপিএল মানুষের অগুন্তি কতজন লক-ডাউনের এই থমকে থাকা সমাজে রোজ রাতে হয়তো শুতে যাবার আগে এভাবেই আমাদের অজান্তে মাথা ঠোকে!


দ্বিতীয় ছবি আকালের সন্ধানে আশির দশকের পটভূমিকায় এক সিনেমা বানানোর গল্প। ৪৩-এর মন্বন্তরের ওপর সিনেমা তৈরি করতে পরিচালক সহ পুরো টিম কোন এক গ্রামে এসে পৌঁছয়। সেখানে ক্ষিদের জ্বালায় দুর্ভিক্ষের সিন ফুটিয়ে তুলতে এক পতিতার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য যখন একটি মেয়ের দরকার, তখন সেলুলয়েড আর বাস্তবের টানাপোড়েন আমাদের এসে ধাক্কা মারে। শ্রীলা মজুমদারের অনবদ্য অভিনয় আমাদের পর্দার বাইরে নির্বাক করে দেয়। আমরা বুঝতে পারি আমাদের সমাজ তখনো ৪৩-এর অনাহার আর দুর্ভিক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

এই দুই আবহ ছেড়ে আরেকটু এগোই। আরেক জ্বলন্ত বিষয়ে। ১৯৭৪-এর ‘কোরাস’। কোন এক কোম্পানির ১০০টা শূণ্যপদের জন্য আবেদন আসে প্রায় ৩০ হাজার। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসা আধপেটা খাওয়া হতদরিদ্র শ্রমিকের দল যখন বুঝতে তারা চাকরি পাবে না, তারা বিদ্রোহ শুরু করে। কোন একজন নিজের পরিচয় দেয় ‘জনমজুর’ হিসেবে। যেন তার কোন নাম নেই, তার একটাই পরিচয় – সে জনমজুর। ভাবুন তো, কাতারে কাতারে ঠিকে শ্রমিকের দল, এই লক-ডাউনের মধ্যে, পেটে দানা নেই জল নেই, বাড়ি ফেরার জন্য রাস্তায় হাঁটতে শুরু করছে। ৫০০-১০০০-১৫০০ কিলোমিটার। কি অমানুষিক দীর্ঘ পথ। ওদের মধ্যে কেউ পারছে, কেউ পারছে না। কারো নিথর দেহ মাঝরাস্তায় থেমে যাচ্ছে। কাউকে ট্রেন-ট্রাকের চাকা পিষে দিচ্ছে। দেখুন, সিনেমা আর বাস্তবের সীমারেখা কিভাবে মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে।


দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব, ক্ষিদের জ্বালা, নিজেকে বেচে দেওয়া, উঁচুতলার মানুষের অবহেলা, সমাজের প্রতি ঘেন্নায় তৈরি হওয়া আক্রোশ আর সেই রাগের আগুনে উঠে আসা একেক প্রতিবাদের ভাষা, ভিন্ন প্রোটাগনিস্ট। এই হলেন মৃনাল সেন। সেলুলয়েডের ক্যানভাসে সুক্ষ্ম শৈল্পিক আঁচড় নয়, জ্বলজ্বলে মোটা ব্রাশের ইমপ্রেসনিস্ট স্ট্রোক। ঠিক যেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। ক্যানভাস থেকে চোখ ফেরান যাবে না। ওনার অনেক সমালোচক বলে থাকেন ওনার সিনেমা অ্যাবরাপ্ট, প্রথাগত সমাপ্তি থাকে না। কিন্তু অতি বড় সমালোচকও মেনে নিতে বাধ্য হন এইসব সিনেমা সামাজিক অস্থিরতায় আমাদের সামনে একটা আয়না বসিয়ে সমাজের নগ্ন কালো চেহারা দেখতে বাধ্য করে। মৃনাল সেনের যে ছ’টা ছায়াছবির কথা ওপরে বললাম, যদি না দেখে থাকেন, তাহলে নিজের ফাঁকা সময়ে একবার সেগুলো দেখে নেবেন। দেখবেন, আজকের আবহেও এইসব সিনেমা কত প্রাসঙ্গিক, কত অপ্রিয় ও জবাবহীন প্রশ্নের কোরাস।

গত ১৪ই মে মৃনাল সেনের জন্মদিন গেল। বেঁচে থাকলে এদ্দিনে ৯৭ বছর বয়স হত। আমার মনে হয়, বেঁচে থাকলে এই বয়সেও হয়ত সমাজের এই থমকে যাওয়া লক-ডাউন আর ট্রেনে কাটা পড়া শ্রমিকদের নিয়ে আবার একটা সিনেমা বানাতেন। আবার চোয়ালচাপা প্রতিবাদের নতুন ভাষা উঠে আসত। ‘ইন্টারভিউ’ বা ‘কলকাতা ৭১’-এর মত। বেশ কয়েক দশক হল হলিউডের এক বিশেষ শ্রেণীর সিনেমায় দেখছি উঠে আসছে অবহেলা থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিবাদের ভাষা। এরকম অনেক সিনেমা অস্কার পেয়েছে, যেমন, আনফর্গিভন (১৯৯২), গ্ল্যাডিয়েটর (২০০০), থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং মিসৌরি (২০১৭), জোকার (২০১৯) ইত্যাদি। কোন কোন সমালোচক বলেন, এটাই নাকি সুররিয়েলিজম এবং অতিনাটকীয়তা ছেড়ে বেরিয়ে আসা সামাজিক লড়াইকে দেওয়া হলিউডের স্বীকৃতি। আমি মুচকি হাসি। মনে মনে বলি, দাদা, এতবড় গাছটা দেখলেন, অথচ কোন বীজ থেকে গাছ জন্মাল, সেটা খেয়াল করলেন না! একবার মৃনাল সেনের ১৯৭০ সালে বানানো ‘ইন্টারভিউ’ দেখুন!

আসলে মৃনাল সেন মানে প্রতিবাদের এক বলিষ্ঠ ভাষা। স্বগতোক্তি নয়, উঁচুতলার মানুষের চোখে চোখ রেখে বুঝিয়ে দেওয়া যে তুমি যদি আমার সঙ্গে সুবিচার না কর, আমিও ছেড়ে কথা বলব না। অবিকল নজরুলের ভাষা। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, ঐ জিজ্ঞাসে কোন্‌ জন? / কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’। রোজ দেখি না খেতে পাওয়া ঘরে ফিরতে চাওয়া একে একে শ্রমিক মরছে, পায়ে হাঁটা পথে ট্রেনে বাসে ট্রাকে নৌকোয় জঙ্গলে – আর রোজ বসে থাকি আবার এক নতুন প্রতিবাদের ভাষার অপেক্ষায়। এক নতুন মৃনালের অপেক্ষায়।