তামাকের আবহে মৃত্যু !
✳ ডাঃ এন. সি মন্ডল
➡ আজ ৩১শে মে ২০২০। প্রতি বছর এই দিনটি স্বাড়ম্বরে বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবস বা ধূমপান বিরোধী দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এই একটা দিনকে পালন করলেই তো হবে না। জনগণকে বিশেষ করে উঠতি যুবকদের ধূমপান সচেতন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সিগারেটের প্যাকেটে সরকারী নিয়ম অনুযায়ী বিধিসম্মত সতর্কীকরণ থাকে "ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক (Smoking is injurious to health)" এখন আবার সিগারেটের প্যাকেটে মুখগহ্বর, গলা, ফুসফুস ক্যান্সারের বিভৎস ছবি দেওয়া হচ্ছে এবং এটাও লেখা থাকছে তামাক মৃত্যু যন্ত্রণার কারণ (Tobacco causes painful death)। সরকার রেলস্টেশন, ট্রেন, বাস, অফিস, আদালত, বিদ্যালয়, হাসপাতালে ধূমপান নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু এইসব দেখেও আমরা কতটা সচেতন ? একটু লক্ষ্য করলে এখনো দেখা যায় ট্রেনের কামরায় বা বাসের মধ্যে ধূমপায়ীরা নির্দ্বিধায় ধূমপান করছে এবং ধূমপানের সেই বিষাক্ত ধোঁয়া সামনে বসে থাকা শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ এবং অধূমপায়ীদের মুখের উপর ছুঁড়ে দিচ্ছে এর ফলে ধূমপান না করেও এরা পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হয়ে পড়ছে।
আমার মনে হয় তামাক পৃথিবীতে একমাত্র আইনত স্বীকৃতি পাওয়া বিষ যা অবাধে বিক্রয় করা এবং সেবন করা যায়। বর্তমানে উন্নতশীল দেশে তামাক সেবন এবং ধূমপায়ীর সংখ্যা দ্রুতহারে বেড়ে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে কত মানুষ ধূমপান করে তা সঠিক বলা সম্ভব নয়। ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে ধূমপানের হার খুবই কম পশ্চিমীদেশের তুলনায়। পশ্চিমীদেশে কিছু কিছু অংশে মহিলা ধূমপায়ীদের সংখ্যা পুরুষদের থেকে বেশী।
এইখানে একটা প্রশ্ন থাকছে যে মানুষ ধূমপান করে কেন? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি দেখেছি বেশিরভাগ মানুষই বলেন স্ট্রেশ, টেনশন এবং মানসিক চাপ কাটানোর জন্য। মানুষ প্রথম শুরু করেন দিনে ১টি ২টি দিয়ে, তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে পরে পরিপূর্ণ নেশায় দাঁড়িয়ে যায়। যত টেনশনের মাত্রা বাড়ে তত ধূমপানের মাত্রাও বেড়ে চলে।
এইবার দেখা যাক কি ক্ষতিকর পদার্থ থাকে সিগারেটের মধ্যে?
যদিও সিগারেটের প্রধান উপাদান নিকোটিন যা মানুষকে ধূমপানের নেশায় অভ্যস্ত করে এবং এই সিগারেটের মধ্যে প্রচুর পরিমানে রাসায়নিক যৌগ বর্তমান থাকে যা ধূমপানের ধোঁয়ার সাথে শরীরে প্রবেশ করে এবং ধূমপায়ীদের শরীরের প্রভূত ক্ষতি করে এবং বিভিন্ন জটিল ও মারণ রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এইখানে এই অল্প পরিসরে কিছু যৌগ তাদের ফলাফল সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি।
প্রথমে নিকোটিন সম্বন্ধে একটু বলে নিই। নিকোটিন হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন একটি উদ্ভিদ উৎস যাকে বিজ্ঞানী ভাষায় বলা হয় নিকোটিনিয়া ট্যাবেকাম। আমরা প্রায় সকলেই জানি যে মূলত যে তামাক জাতীয় পদার্থ সিগারেটের মধ্যে থাকে তার নাম নিকোটিন --- যার রাসায়নিক সংকেত (C₁₀H₁₄N₂)। এটি একটি কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেনের মিলিত যৌগ। একটি সিগারেটের মধ্যে ৪ থেকে ২০ মিলিগ্রাম নিকোটিন থাকে (এটি নির্ভর করে বিভিন্ন কোম্পানির ব্র্যান্ডের উপর )। মোটামুটি একটি সিগারেট পান করলে ১ মিলিগ্রামের মতো নিকোটিন শোষিত হয়। ধূমপান করার সঙ্গে সঙ্গেই নিকোটিন ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসের অ্যালভিওলাইয়ের মাধ্যমে রক্তস্রোতে মিশে ১০ সেকেন্ডর মধ্যে ব্রেনে পৌঁছে যায়। ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে নিকোটিন শরীরের কোষে কোষে পৌঁছে যায়। নিকোটিন অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় ফলস্বরূপ রক্তচাপ, হার্টরেট (হৃদস্পন্দন ) বেড়ে যায়।
কার্বন মনো-অক্সাইড :- কার্বন মনো -অক্সাইড হচ্ছে একটি বিষাক্ত গ্যাস যা পাওয়া যায় গাড়ির পোড়া কালো ধোঁয়ার মধ্যে, এই বিষাক্ত কার্বন মনো -অক্সাইড সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে থাকে এবং এই গ্যাস ব্রেনে স্বাভাবিক অক্সিজেন পরিবহন প্রায় ১৫ শতাংশ কমিয়ে দেয়। কার্বন মনো -অক্সাইড হৃদরোগ এবং সেরিব্রোভাসকুলার অ্যাক্সিডেন্ট বা স্ট্রোকের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
বেঞ্জিন :- ধূমপানের ধোঁয়ার মধ্যে থাকে বেঞ্জিন নামক এক রাসায়নিক পদার্থ। বেঞ্জিন ক্যান্সারের একটি কারণ (কার্সিনোজেন )বিশেষ করে ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকোমিয়ার।
অ্যামোনিয়া :- অ্যামোনিয়া হচ্ছে নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেন এর যৌগ মিশ্রিত একটি ঝাঁঝাঁলো ক্ষারধর্মী গ্যাস (NH3)। এই অ্যামোনিয়া সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে এবং শরীরে নিকোটিন প্রবেশ করাকে ত্বরান্বিত করে বা বাড়িয়ে দেয়।
ক্যাডমিয়াম:- ক্যাডমিয়াম হচ্ছে একটি উচ্চপর্যায়ের বিষাক্ত ধাতু যা ব্যাটারী শিল্পে ব্যবহৃত হয়। সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে ক্যাডমিয়াম থাকে। ক্যাডমিয়াম লিভার, কিডনি এবং ব্রেনের প্রভূত ক্ষতি করে।
ফরম্যালডিহাইড :- এটি একটি উচ্চ পর্যায়ের বিষাক্ত বর্ণহীন তরল পদার্থ. এটি মৃতদেহ সংরক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়। ফরম্যালডিহাইড সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে এবং এটি ক্যান্সার, চর্ম, শ্বাসযন্ত্র এবং খাদ্যনালীর বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে।
টার :- টার উৎপন্ন হয় জ্বলন্ত সিগারেটের তামাক থেকে। আমরা জ্বলন্ত সিগারেটের যে ধোঁয়া দেখতে পাই সেটাই টার। ঘন টার চটচটে বাদামি রঙের যা মূলতঃ ধূমপায়ীদের শ্বাসযন্ত্র এবং গলার ক্যান্সারের কারণ এবং এর দাগ দেখা যায় ধূমপায়ীদের আঙ্গুলে, নখে এবং দাঁতে। এই টার সিগারেটের মধ্যে উপস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক এবং কার্সিনোজেনিক পদার্থ (যা ক্যান্সার সৃষ্টিতে সাহায্য করে) শরীরের মধ্যে বহন করে নিয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে এই রকম কয়েকটি রাসায়নিক পদার্থের নাম উল্লেখ করছি যেমন অ্যাসিটোন, ন্যাপথাইলামাইন, পাইরিন, ইথাইল কার্ব্বনেট বা ইউরেথেন, মিথাইল বেঞ্জিন বা টলুইন, ভিনাইল ক্লোরাইড, ডাইক্লোরো ডাই ফিনাইল ট্রাইক্লোরো ইথেন বা ডি.ডি.টি, হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড, আর্সেনিক, পোলোনিয়াম ২১০ নামক তেজস্ক্রিয় উপাদান। এছাড়া আগেই উল্লেখ করেছি কার্বন মনোক্সাইড, অ্যামোনিয়া, ক্যাডমিয়াম এবং ফর্মালডিহাইডের কথা।
এইবার আসছি ধূমপানের দীর্যমেয়াদী কুফল প্রসঙ্গে :
১)ধূমপান হচ্ছে ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ। ধূমপানের ফলে শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয় যেমন ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা, স্মোকার্স কাফ, এবং শিশু ও যুবকদের হাঁপানি। শিশুরা মূলত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার।
২)ধূমপান করোনারি হার্ট ডিজিজ এবং সেরিব্রোভাসকুলার অ্যাক্সিডেন্ট বা স্ট্রোকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধূমপায়ীদের অধূমপায়ীদের থেকে ৭০ শতাংশ বেশী হৃদরোগে আক্রান্ত, পাঁচ গুনের বেশী স্ট্রোক এবং দুগুনের বেশী হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে। ধূমপানের ফলে খারাপ কোলেস্টেরল এল. ডি. এল (লো ডেনসিটি লাইপ্রো প্রোটিন ) রক্তে বেড়ে যায় এবং এর ফলে করোনারি ধমনী এবং সেরিব্রাল ধমনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের সম্ভবনা বেড়ে যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে ধূমপায়ীরা বিশেষ করে ২৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সের মানুষ ধূমপান না করা মানুষের তুলনায় ৪ থেকে ১০ বছর কম বাঁচেন এবং ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের থেকে ৭ থেকে ১০ বছর আগে হার্ট অ্যাট্যাকে আক্রান্ত হন। সুতরাং হার্ট অ্যাটাক আটকাতে হলে অবশ্যই ধূমপান ছাড়তে হবে। ধূমপান করেন এমন মানুষ করোনারী হার্ট ডিজিজে এবং স্ট্রোকে বেশী আক্রান্ত হন।
৩)ধূমপান সমস্ত ক্যান্সারে মৃত্যুর ৩০ শতাংশের বেশী কারণ হিসাবে দেখা যায়। ফুসফুস ক্যান্সারে এই সংখ্যা প্রায় ৯০ শতাংশ। ধূমপান মুখগহ্বর, শ্বাসনালী, শ্বাসযন্ত্র, খাদ্যনালী, পাকস্থলী, অগ্নাশয়, কিডনি, প্রস্রাবথলি (ইউরেনারী ব্লাডার ) এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ু এবং সার্ভিক্স প্রভৃতি অঙ্গে ক্যান্সার কে ত্বরান্বিত হতে সাহায্য করে।
৪)ডায়াবেটিস রোগীদের ধূমপান ভীষণভাবে শারীরিক ক্ষতি করে। সুতরাং ডায়াবেটিস রোগীদের বেশীদিন বাঁচতে হলে ধূমপান অবশ্যই ছাড়তে হবে।
৫)ধূমপানের ফলে কিছু শারীরিক পরিবর্তন ধূমপায়ীদের শরীরে প্রকাশ পায় যেমন - সিগারেটের ধোঁয়ায় উপস্থিত টার দাঁত, মাড়ি, আঙ্গুল এবং নখের মধ্যে জমে হলুদ রঙের দাগ সৃষ্টি হয়। সিগারেটের ধোঁয়ায় উপস্থিত রাসায়নিক ধূমপায়ীদের চুলে এবং চামড়ায় পাওয়া যায়।
অনেকেই প্রশ্ন করেন ধূমপান ছাড়বো কি করে? এর উত্তরে একটা কথাই বলব মনের জোর করুন। একমাত্র মনের জোর ছাড়া ধূমপান ছাড়া বা ধূমপান ছাড়ানো সম্ভব নয়। ভারতবর্ষে বেশীরভাগ মানুষ ধূমপান ছাড়েন যখন তাঁরা ভীষণভাবে শারীরিক অসুস্থ হয়ে পড়েন যেমন হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক অথবা শ্বাসযন্ত্রের রোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization ) এবং প্রত্যেক সরকার ধূমপান কমানোর লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে। এইসব জানার পর আশা করব আপনারা তামাক দ্রব্যাদি যেমন জর্দা, গুটখা, পানমশলা, খৈনী, নস্যি এগুলেকে আমরা বলতে পারি ধোঁয়াহীন তামাক (যা ধূমপানের মতোই সমান ক্ষতিকারক ) ক্রয় এবং ধূমপান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন।
এইসব জানার পর আপনি সিদ্ধান্ত নিন কি করবেন ---- ধূমপান না বিষপান?
✳ ডাঃ এন. সি মন্ডল
➡ আজ ৩১শে মে ২০২০। প্রতি বছর এই দিনটি স্বাড়ম্বরে বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবস বা ধূমপান বিরোধী দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এই একটা দিনকে পালন করলেই তো হবে না। জনগণকে বিশেষ করে উঠতি যুবকদের ধূমপান সচেতন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সিগারেটের প্যাকেটে সরকারী নিয়ম অনুযায়ী বিধিসম্মত সতর্কীকরণ থাকে "ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক (Smoking is injurious to health)" এখন আবার সিগারেটের প্যাকেটে মুখগহ্বর, গলা, ফুসফুস ক্যান্সারের বিভৎস ছবি দেওয়া হচ্ছে এবং এটাও লেখা থাকছে তামাক মৃত্যু যন্ত্রণার কারণ (Tobacco causes painful death)। সরকার রেলস্টেশন, ট্রেন, বাস, অফিস, আদালত, বিদ্যালয়, হাসপাতালে ধূমপান নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু এইসব দেখেও আমরা কতটা সচেতন ? একটু লক্ষ্য করলে এখনো দেখা যায় ট্রেনের কামরায় বা বাসের মধ্যে ধূমপায়ীরা নির্দ্বিধায় ধূমপান করছে এবং ধূমপানের সেই বিষাক্ত ধোঁয়া সামনে বসে থাকা শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ এবং অধূমপায়ীদের মুখের উপর ছুঁড়ে দিচ্ছে এর ফলে ধূমপান না করেও এরা পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হয়ে পড়ছে।
আমার মনে হয় তামাক পৃথিবীতে একমাত্র আইনত স্বীকৃতি পাওয়া বিষ যা অবাধে বিক্রয় করা এবং সেবন করা যায়। বর্তমানে উন্নতশীল দেশে তামাক সেবন এবং ধূমপায়ীর সংখ্যা দ্রুতহারে বেড়ে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে কত মানুষ ধূমপান করে তা সঠিক বলা সম্ভব নয়। ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে ধূমপানের হার খুবই কম পশ্চিমীদেশের তুলনায়। পশ্চিমীদেশে কিছু কিছু অংশে মহিলা ধূমপায়ীদের সংখ্যা পুরুষদের থেকে বেশী।
এইখানে একটা প্রশ্ন থাকছে যে মানুষ ধূমপান করে কেন? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি দেখেছি বেশিরভাগ মানুষই বলেন স্ট্রেশ, টেনশন এবং মানসিক চাপ কাটানোর জন্য। মানুষ প্রথম শুরু করেন দিনে ১টি ২টি দিয়ে, তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে পরে পরিপূর্ণ নেশায় দাঁড়িয়ে যায়। যত টেনশনের মাত্রা বাড়ে তত ধূমপানের মাত্রাও বেড়ে চলে।
এইবার দেখা যাক কি ক্ষতিকর পদার্থ থাকে সিগারেটের মধ্যে?
যদিও সিগারেটের প্রধান উপাদান নিকোটিন যা মানুষকে ধূমপানের নেশায় অভ্যস্ত করে এবং এই সিগারেটের মধ্যে প্রচুর পরিমানে রাসায়নিক যৌগ বর্তমান থাকে যা ধূমপানের ধোঁয়ার সাথে শরীরে প্রবেশ করে এবং ধূমপায়ীদের শরীরের প্রভূত ক্ষতি করে এবং বিভিন্ন জটিল ও মারণ রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এইখানে এই অল্প পরিসরে কিছু যৌগ তাদের ফলাফল সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি।
প্রথমে নিকোটিন সম্বন্ধে একটু বলে নিই। নিকোটিন হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন একটি উদ্ভিদ উৎস যাকে বিজ্ঞানী ভাষায় বলা হয় নিকোটিনিয়া ট্যাবেকাম। আমরা প্রায় সকলেই জানি যে মূলত যে তামাক জাতীয় পদার্থ সিগারেটের মধ্যে থাকে তার নাম নিকোটিন --- যার রাসায়নিক সংকেত (C₁₀H₁₄N₂)। এটি একটি কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেনের মিলিত যৌগ। একটি সিগারেটের মধ্যে ৪ থেকে ২০ মিলিগ্রাম নিকোটিন থাকে (এটি নির্ভর করে বিভিন্ন কোম্পানির ব্র্যান্ডের উপর )। মোটামুটি একটি সিগারেট পান করলে ১ মিলিগ্রামের মতো নিকোটিন শোষিত হয়। ধূমপান করার সঙ্গে সঙ্গেই নিকোটিন ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসের অ্যালভিওলাইয়ের মাধ্যমে রক্তস্রোতে মিশে ১০ সেকেন্ডর মধ্যে ব্রেনে পৌঁছে যায়। ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে নিকোটিন শরীরের কোষে কোষে পৌঁছে যায়। নিকোটিন অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় ফলস্বরূপ রক্তচাপ, হার্টরেট (হৃদস্পন্দন ) বেড়ে যায়।
কার্বন মনো-অক্সাইড :- কার্বন মনো -অক্সাইড হচ্ছে একটি বিষাক্ত গ্যাস যা পাওয়া যায় গাড়ির পোড়া কালো ধোঁয়ার মধ্যে, এই বিষাক্ত কার্বন মনো -অক্সাইড সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে থাকে এবং এই গ্যাস ব্রেনে স্বাভাবিক অক্সিজেন পরিবহন প্রায় ১৫ শতাংশ কমিয়ে দেয়। কার্বন মনো -অক্সাইড হৃদরোগ এবং সেরিব্রোভাসকুলার অ্যাক্সিডেন্ট বা স্ট্রোকের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
বেঞ্জিন :- ধূমপানের ধোঁয়ার মধ্যে থাকে বেঞ্জিন নামক এক রাসায়নিক পদার্থ। বেঞ্জিন ক্যান্সারের একটি কারণ (কার্সিনোজেন )বিশেষ করে ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকোমিয়ার।
অ্যামোনিয়া :- অ্যামোনিয়া হচ্ছে নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেন এর যৌগ মিশ্রিত একটি ঝাঁঝাঁলো ক্ষারধর্মী গ্যাস (NH3)। এই অ্যামোনিয়া সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে এবং শরীরে নিকোটিন প্রবেশ করাকে ত্বরান্বিত করে বা বাড়িয়ে দেয়।
ক্যাডমিয়াম:- ক্যাডমিয়াম হচ্ছে একটি উচ্চপর্যায়ের বিষাক্ত ধাতু যা ব্যাটারী শিল্পে ব্যবহৃত হয়। সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে ক্যাডমিয়াম থাকে। ক্যাডমিয়াম লিভার, কিডনি এবং ব্রেনের প্রভূত ক্ষতি করে।
ফরম্যালডিহাইড :- এটি একটি উচ্চ পর্যায়ের বিষাক্ত বর্ণহীন তরল পদার্থ. এটি মৃতদেহ সংরক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়। ফরম্যালডিহাইড সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে এবং এটি ক্যান্সার, চর্ম, শ্বাসযন্ত্র এবং খাদ্যনালীর বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে।
টার :- টার উৎপন্ন হয় জ্বলন্ত সিগারেটের তামাক থেকে। আমরা জ্বলন্ত সিগারেটের যে ধোঁয়া দেখতে পাই সেটাই টার। ঘন টার চটচটে বাদামি রঙের যা মূলতঃ ধূমপায়ীদের শ্বাসযন্ত্র এবং গলার ক্যান্সারের কারণ এবং এর দাগ দেখা যায় ধূমপায়ীদের আঙ্গুলে, নখে এবং দাঁতে। এই টার সিগারেটের মধ্যে উপস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক এবং কার্সিনোজেনিক পদার্থ (যা ক্যান্সার সৃষ্টিতে সাহায্য করে) শরীরের মধ্যে বহন করে নিয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে এই রকম কয়েকটি রাসায়নিক পদার্থের নাম উল্লেখ করছি যেমন অ্যাসিটোন, ন্যাপথাইলামাইন, পাইরিন, ইথাইল কার্ব্বনেট বা ইউরেথেন, মিথাইল বেঞ্জিন বা টলুইন, ভিনাইল ক্লোরাইড, ডাইক্লোরো ডাই ফিনাইল ট্রাইক্লোরো ইথেন বা ডি.ডি.টি, হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড, আর্সেনিক, পোলোনিয়াম ২১০ নামক তেজস্ক্রিয় উপাদান। এছাড়া আগেই উল্লেখ করেছি কার্বন মনোক্সাইড, অ্যামোনিয়া, ক্যাডমিয়াম এবং ফর্মালডিহাইডের কথা।
এইবার আসছি ধূমপানের দীর্যমেয়াদী কুফল প্রসঙ্গে :
১)ধূমপান হচ্ছে ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ। ধূমপানের ফলে শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয় যেমন ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা, স্মোকার্স কাফ, এবং শিশু ও যুবকদের হাঁপানি। শিশুরা মূলত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার।
২)ধূমপান করোনারি হার্ট ডিজিজ এবং সেরিব্রোভাসকুলার অ্যাক্সিডেন্ট বা স্ট্রোকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধূমপায়ীদের অধূমপায়ীদের থেকে ৭০ শতাংশ বেশী হৃদরোগে আক্রান্ত, পাঁচ গুনের বেশী স্ট্রোক এবং দুগুনের বেশী হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে। ধূমপানের ফলে খারাপ কোলেস্টেরল এল. ডি. এল (লো ডেনসিটি লাইপ্রো প্রোটিন ) রক্তে বেড়ে যায় এবং এর ফলে করোনারি ধমনী এবং সেরিব্রাল ধমনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের সম্ভবনা বেড়ে যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে ধূমপায়ীরা বিশেষ করে ২৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সের মানুষ ধূমপান না করা মানুষের তুলনায় ৪ থেকে ১০ বছর কম বাঁচেন এবং ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের থেকে ৭ থেকে ১০ বছর আগে হার্ট অ্যাট্যাকে আক্রান্ত হন। সুতরাং হার্ট অ্যাটাক আটকাতে হলে অবশ্যই ধূমপান ছাড়তে হবে। ধূমপান করেন এমন মানুষ করোনারী হার্ট ডিজিজে এবং স্ট্রোকে বেশী আক্রান্ত হন।
৩)ধূমপান সমস্ত ক্যান্সারে মৃত্যুর ৩০ শতাংশের বেশী কারণ হিসাবে দেখা যায়। ফুসফুস ক্যান্সারে এই সংখ্যা প্রায় ৯০ শতাংশ। ধূমপান মুখগহ্বর, শ্বাসনালী, শ্বাসযন্ত্র, খাদ্যনালী, পাকস্থলী, অগ্নাশয়, কিডনি, প্রস্রাবথলি (ইউরেনারী ব্লাডার ) এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ু এবং সার্ভিক্স প্রভৃতি অঙ্গে ক্যান্সার কে ত্বরান্বিত হতে সাহায্য করে।
৪)ডায়াবেটিস রোগীদের ধূমপান ভীষণভাবে শারীরিক ক্ষতি করে। সুতরাং ডায়াবেটিস রোগীদের বেশীদিন বাঁচতে হলে ধূমপান অবশ্যই ছাড়তে হবে।
৫)ধূমপানের ফলে কিছু শারীরিক পরিবর্তন ধূমপায়ীদের শরীরে প্রকাশ পায় যেমন - সিগারেটের ধোঁয়ায় উপস্থিত টার দাঁত, মাড়ি, আঙ্গুল এবং নখের মধ্যে জমে হলুদ রঙের দাগ সৃষ্টি হয়। সিগারেটের ধোঁয়ায় উপস্থিত রাসায়নিক ধূমপায়ীদের চুলে এবং চামড়ায় পাওয়া যায়।
এইসব জানার পর আপনি সিদ্ধান্ত নিন কি করবেন ---- ধূমপান না বিষপান?