Scrooling

হাঁপানি ও অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় ভুগছেন ? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ অয়ন শিকদার আগামী ২৫ আগস্ট বর্ধমানে আসছেন। নাম লেখাতে যোগাযোগ 9734548484 অথবা 9434360442 # টি টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট ২০২৪ : ভারতের বিশ্ব রেকর্ড, প্রথম থেকে শেষ সব ম্যাচে ভারতের জয় # কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন আউসগ্রামের বিউটি বেগম # নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রীসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে শপথ নিলেন ডঃ সুকান্ত মজুমদার ও শান্তনু ঠাকুর # আঠারো তম লোকসভা ভোটের ফলাফল : মোট আসন ৫৪৩টি। NDA - 292, INDIA - 234, Others : 17 # পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ফলাফল : তৃণমূল কংগ্রেস - ২৯, বিজেপি - ১২, কংগ্রেস - ১

আত্মনির্ভর

আত্মনির্ভর

 ✳ শিবানন্দ পাল

 ➡ চালু হয়ে গেছে শ্রমিক এক্সপ্রেস, চালু হয়েছে বিশেষ এসি ট্রেন। ১জুন থেকে চালু হচ্ছে দূরপাল্লার স্লিপার ট্রেন‌ও। প্রধানমন্ত্রী তো আত্মনির্ভরতার কথা বললেন সেদিন। কিন্তু আভাকুমারী (নাম পরিবর্তিত) দু'দিন আগেই বুঝেছিল তাঁকে আত্মনির্ভর হতেই হবে। তাই বুক বেঁধে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে হরিয়ানার গুরগ্রাম থেকে পাড়ি দিয়েছিল নিজেদের গ্রাম বিহারের দ্বারভাঙ্গার পথে। প্রায় ১২০০ কিলোমিটার পথ।

লকডাউনের আগেই রিকশাচালক বাবা সোহম পাসোয়ান (নাম পরিবর্তিত) দুর্ঘটনায় পড়ে কাজ হারিয়েছিল। পায়ে হয়েছিল গভীর ক্ষত। রিকশা টানা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তবু আশায় বুক বেঁধেছিল মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে। ক্ষত ভালো হয়ে গেলেই রিকশা টানবে আবার। বাবার দেখভাল করছিল আভা। সে স্কুলে পড়ছে, পড়াশোনায় তার খুব মন। তার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ... !

কিন্তু লকডাউনের পর আবার লকডাউন। করোনা কাণ্ডে দিল্লির অবস্থা কাগজে দেখেছে, শুনেছে লোকমুখে। রিকশা জমা হয়ে আছে মালিকের কাছে। সে নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু গোল বাধালো বাড়িওয়ালা। বাড়িওয়ালা বলে, হয় ভাড়া দাও, ন‌ইলে বাড়ি ছাড়ো!

বাবার রুজি বন্ধ, তারপর লকডাউনের পর লকডাউন চলছে। কীভাবে চলবে তাদের! সাহায্য করার জন্য পাশে কাউকে পায়নি। তারা আবার দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। উচ্চ বর্ণের মানুষ ওদের মানুষ বলেই গণ্য করে না।যেখানে সেখানে হাত পাততেও যেতে পারে না। না জেনে ঢুকে পরায় কত জায়গায় মার খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছে। বুড়ো মানুষ বলে রেহাই পেয়েছে! কিন্তু দুটো পেট তো কোনো কথা শোনে না। সঞ্চয়ের টাকাও শেষ হয়ে আসছে। ও একা থাকলে হয়তো লঙ্গরখানায় লাইন দিতে পারতো। কিন্তু মেয়েটা আছে সঙ্গে! উঠতি বয়স। মেয়েটা যেন বাড়ছেও কলাগাছের মতো!

এইজন্যই ওর মা মারা যাবার পর নিজের কাজের জায়গা হরিয়ানার এই গুরগ্রামে মেয়েকে নিয়ে এসেছিল সোহম। আভা এখন পড়ছে ক্লাস সেভেনে। তাঁর স্বপ্ন সে 'আইএএস' হবে। আভা লেখাপড়ায় খুব ভালো, লেখাপড়া করার জন্য ও সরকারের জলপানি পায়।
স্কুলের দিদিমণিরা ওর খুব প্রশংসা করে, সবাই আশা করে পরীক্ষায় ও খুব ভালো রেজাল্ট করবে।

বিহারের দ্বারভাঙ্গার বাসিন্দা সোহম পাশোয়ান। নিজের রিকশা কেনার ক্ষমতা নেই, গুরগ্রামে রিকশা চালায়। মালিকের কাছ থেকে রিকশা ভাড়ায় নিয়ে চালায় সে। মালিককে হিসেব চুকিয়ে হাতে যা থাকে তাতেই বাপ-মেয়ের দুটো পেট চালিয়েও কিছুটা সঞ্চয় হয়। আইআইটি-র ছেলেমেয়েদের বাসস্ট্যান্ড থেকে আইআইটি পৌঁছে দেয়, আবার তাদের বাসস্ট্যান্ডে ফেরত নিয়ে আসে। সারাদিনে রোজগার খারাপ নয়। আগে নিজের পেট চালিয়ে যতটা পারতো গ্রামের বাড়িতে পাঠাতো মা মেয়ের সংসারে। কিন্তু ওর মা মারা যেতেই মেয়েটা একা হয়ে গেল। একা সেই মেয়েকে গ্রামে কার কাছে ছেড়ে আসবে!

সেই কবে হরিয়ানার গুরগ্রামে এসেছিল দুটো অন্ন সংস্থানের আশায়। গ্রামে তাদের জমি জমা কিছুই নেই। কাজ করে খেতে হবে। কিন্তু গ্রামে কাজ পাবে কোথায়? এক বন্ধুর পরামর্শে হরিয়ানায় এসেছিল খেতমজুর হয়ে। হয়ে গেল রিকশাচালক। দিল্লি হরিয়ানায় ওদের অতটা খারাপ চোখে দেখে না কেউ। আগে অবস্থা আরো ভালো ছিল। সন্ধেবেলায় কত মানুষ একসাথে গুরগ্রামের পাকুড়তলায় খাটিয়ায় বসে গল্পগুজব করতো। কিন্তু এখন যেন সবকিছু কিরকম পাল্টে গেছে!

বাপ-বেটি পরামর্শ করে লকডাউনে কী করা যায়! আভা বাবাকে বলে 'চলো দেশেই ফিরি! যা হবার সেখানেই হবে'! দেশ বলতে সেই বিহারের দ্বারভাঙ্গা। পাড়ি দিতে হবে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার রাস্তা। এক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে সোহমের কথা হয়। বলে ৬ হাজার টাকা দাও, দ্বারভাঙ্গা পৌঁছে দেব। কিন্তু
অত টাকা সোহম পাবে কোথায়?

আভা বলে, 'বাবা তুমি একটা সাইকেল যোগাড় করো! তোমায় নিয়ে আমি ঠিক পৌঁছে যাব'! যুক্তিটা খারাপ নয়। আবার যদি লকডাউন বাড়ে তাহলে তো আরো মুশকিল। একটু খোঁজখবর করতেই ৫০০ টাকায় একটা পুরনো সাইকেল মিলে গেল। বিহারের সিওয়ান জেলার একটি ছেলে, এখানে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে! কম টাকাতেই সাইকেল দিয়ে বাসে করে বন্ধুদের সাথে সে দেশে ফিরে গেল।
এখন নাকি এদের নিয়ে কাগজে খুব লেখালেখি হচ্ছে। এদের পরিযায়ী শ্রমিক বলে। ওরা প্রায় একশো জনের মতো হবে। তারমধ্যে ওরা জনা তিরিশ সিওয়ান জেলার লোক।

বাবাকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে আভা হরিয়ানা থেকে যাত্রা শুরু করলো মে মাসের ১০ তারিখ, প্রধানমন্ত্রীর "আত্মনির্ভর" বক্তৃতার দু'দিন আগে। পুরো রাস্তাটাই সাইকেল চালিয়েছে সে। সোহম শুধু বসে থেকেছে। তার সাইকেল চালাবার ক্ষমতা নেই। আভা যখন হাঁপিয়ে গেছে দুজনে হেঁটেছে সাইকেল নিয়ে।

রাস্তাঘাটে কত বিপদ ওঁত পেতে থাকে! তবু বুকে সাহস নিয়ে এগিয়েছে দুজনে। যত এগিয়েছে দেখেছে হাজারে হাজারে লাখো লাখো মানুষ হাঁটছে রাস্তায়। তাদের অবস্থা ওদের‌ই মতো। সবাই পরিযায়ী শ্রমিক। এত মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে শুধু দুমুঠো অন্নের জন্য! যত দেখেছে তত অবাক হয়েছে! অনেকে আবার সাইকেলেও যাচ্ছে। কখনো ভিড় পাতলা হয়েছে, কখনো ভিড় বেড়েছে। এরমধ্যেই কতজনা অসুস্থ হয়ে লুটিয়ে পড়েছে পথে। কোথায় পাবে ডাক্তার আর কোথায়ই বা পাবে চিকিৎসা! সঙ্গের সাথীরা ওদের কাছে আটকে পড়েছে। বেশিরভাগের দাঁড়াবার সাহস নেই। দাঁড়ালেই বিপদ আবার ঘাড়ে চেপে বসতে পারে। আভাকে সেজন্য সাইকেল ঠেলতেই হয়েছে। রাত ঘনিয়ে আসার আগেই চাই নিরাপদ একটা আশ্রয়। সে যে মেয়েমানুষ! তার মধ্যেই কত গাড়ি চলছিল রাস্তায়। ভয় ছিল দুর্ঘটনার। খুব সাবধানে আর সতর্ক হয়ে চলছিল আভা।

১০ তারিখে যাত্রা শুরু করেছিল, পৌঁছাল ২০ তারিখে। দিল্লি ছাড়ার সময় বাবা সোহমের কাছে ছিল ৬০০ টাকা। বেশির ভাগ সময়ে তাই কোনও না কোনও খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার যোগাড় করেছে। কোনও কোনও দিন পথের সহমর্মী কোনো বন্ধু ওদের খাবার দিয়েছে। পথেই পরিচয়, পথেই শেষ। কিন্তু এই মানুষগুলোর কথা কোনো দিন ভোলা যাবে না।
দিন রাত সাইকেল চালিয়ে দু'তিন ঘন্টা বিশ্রাম নিয়েছে কোনও পেট্রোল পাম্পের পাশে। যেখানে বুঝেছে জায়গাটা নিরাপদ।

এইভাবে ১২০০ কিলোমিটার সাইকেলে পাড়ি! পনেরো বছরের একটা মেয়ে! তাও অসুস্থ বাবাকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে?
দ্বারভাঙ্গার গ্রামের মানুষ অবাক হয়েছে! এতটা পথ পনেরো বছরের মেয়েটা একা বাবাকে টেনে নিয়ে এসেছে? গ্রামের লাইব্রেরিতে তৈরি হয়েছে পরিযায়ী মানুষদের জন্য কোয়ারান্টিন সেন্টার। এই গ্রামের বহু মানুষ সেখানে হাজির। সবাই বাইরে থেকে এসেছে। দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, আগ্রা, কানপুর ... কত জায়গা! একটা দল এসেছে রাজস্থান থেকে। ওদের মধ্যে দু তিন জন করোনা পজেটিভ। তাই ওদের একটু দূরত্বে আলাদা করে রাখা হয়েছে। কোয়ারান্টিন সেন্টারে আভার বাবা সোহমের ঠাঁই হলো চোদ্দ দিনের জন্য। আভাকে অবশ্য সবাই সুপারিশ করলে বাড়িতে থাকতে। সে থাকবে হোম কোয়ারান্টিনে। মেয়েদের জন্য সেখানে আলাদা কোনও সেন্টার ছিল না! আভা সাইকেল ভালো করে ধুয়ে মুছে রাখে। এই সাইকেল তাকে মুক্তির আনন্দ দিয়েছে। চালাতে চালাতে কতবার ভেবেছে পারবে তো, পারবে তো! বাবা কতবার বলেছে, আমাকে একটু দে! দেখি চালাতে পারি কিনা? ও দেয়নি। বলেছে, 'তুমি চুপ করে বসে থাকো! আমি ঠিক আছি'!

কতদিন পরে গ্রামে ফিরেছে। গ্রামের অনেককিছুই পাল্টে গেছে। ওদের ঘরটাও পাল্টে গেছে। আত্মীয়রা ব্যবহার করতো, এখন আভা থাকবে! স্নান সেরে আভা আজ শাড়ি পড়েছে। এই কয়েক দিনে সে অনেক বড়ো হয়ে গেছে। কত মানুষের আর্শীবাদ মাথায় পড়েছে তার। ভাবে মহামারী না হলে সে কী এই সব বুঝতো! না জানতে পারতো?

মহামারীর ভয় তাই হাজার হাজার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ... সাইকেলে চলতে হয়েছে কত অসহায় গরিব মানুষগুলোকে। এদের সংখ্যা কত? মিডিয়ার প্রশ্নে থতমত খেয়েছে সে! সে কী করে জানবে এই সংখ্যা কত? কিন্তু বলেছে দু তিনটে কথা! ভোটের সময় হলে লাখ লাখ এই  পরিযায়ীদের ঘরে ফেরা নিশ্চিত হতো বাসে কিম্বা ট্রেনে চড়ে! অদৃষ্টের পরিহাস যে তারা জন্মেছে এই দেশে! ওদের জন্য কোনো বাসের ব্যবস্থা হয়না, হয়না ট্রেনের ব্যবস্থা। শুনেছে সে বিদেশেও নাকি এরকম যারা ছিল, তাদের ফেরত আনবার জন্য প্রধানমন্ত্রী উড়োজাহাজ পাঠিয়েছেন।

হরিয়ানার গুরগ্রাম থেকে র‌ওনা হয়ে বিহারের দ্বারভাঙ্গায় সাইকেল চালিয়ে ফিরেছে পনেরো বছরের এক কিশোরী। সঙ্গে অসুস্থ বাবা। না, ফুলের মালা বা মিষ্টি জল নিয়ে কেউ তাদের অভ্যর্থনা জানায়নি। মিডিয়ায় খবরের শিরোনাম হয়েছে আভা। কিন্তু কেউ তার কাছে জানতে চায়নি, সে যে আইএএস হতে চেয়েছিল! প্রধানমন্ত্রীর "আত্মনির্ভর" বকোয়াস তার কী কোনো কাজে আসবে?

                                              ছবি: হিন্দুস্তান টাইমস